#সূর্যোদয়
#পর্ব_০৫
#কারিমা_দিলশাদ
৮.
ইলোরা ইয়াসমিন এর অতীত মন্থনের মাঝেই জয় কল করে। সে জয়কে তার অবস্থান বলে দেয়।
একটু পর জয় নদের ধারে চলেও আসে। এসে দেখে তার মা সিমেন্টের তৈরি বেঞ্চে উদাস ভঙ্গীতে বসে একদৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। জয় গিয়ে তার মার পাশে বসে এবং জিজ্ঞেস করে,
“ কি ভাবছো মা? তোমার কি শরীর খারাপ?”
জয়ের কথায় ইলোরা ইয়াসমিন ছেলের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মুচকি হেসে বলে,
“ না কিছু না। আমার শরীর ঠিক আছে। ”
“ তাহলে এভাবে উদাস হয়ে এখানে বসে আছো কেন? ফ্যাকাল্টিতে গিয়েও তোমাকে পায় নি। কি হয়েছে মা?”
ইলোরা ইয়াসমিন হালকা হেসে বললেন কিছু হয় নি। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“ আজ একটু অতীতের স্মৃতিচারণ করছিলাম আরকি। তোর বাবার কথা মনে পড়ছে। অবশ্য তোর বাবাকে আমি ভুলিই বা কখন। তবে আজকে ভিতরে ভিতরে কেমন জানি লাগছে বুঝলি। খুব অস্থির অস্থির লাগছে। সবকিছু এমন এলোমেলো কেন হয়ে গেল বলতো? প্রথমে তোর বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আমাদের একা করে দিয়ে। তারপরও যখন তার বেদনা বুকে সামলে নিয়ে বাঁচতে শুরু করলাম তখন তোর……”
এটুকু বলেই চুপ করে গেলেন। তার কেন জানি আজকে বুক চিড়ে কান্না পাচ্ছে। তার বারবার মনে হচ্ছে সুখ কেন চিরস্থায়ী হয় না। সুখের সময় খুশির সময়গুলো এতো অল্প সময়ের জন্য কেন আসে।
জয় তার মা’র না বলা কথা বুঝেছে। সারাটাজীবন মা কম তো কষ্ট করে নি। ভিতরে ব্যাথা নিয়ে সবসময় হাসিমুখে শক্ত হয়ে থেকেছে। মা বাবার সম্পর্কটা কতটা মধুর ও মজবুত ছিল তা তো জানা আছে জয়ের। বাবাকে হারিয়ে যখন ওকে নিয়ে বাঁচতে শুরু করলো তখন সেই ছেলেই তাকে আঘাত দিয়ে দিল।
সে কি বলে মাকে সান্ত্বনা দিবে বুঝতে পারছে না।
ইলোরা ইয়াসমিন ঘন ঘন কয়েকটা নিশ্বাস ছেড়ে জয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“ বাবা তুই আমার একমাত্র সম্বল। নিজের মাঝে কষ্ট চেপে রাখিস না কখনো। আমি তোর মা, তোর সাথে আছি। আমাদের খুশি রাখতে গিয়ে নিজের মাঝে কষ্টকে দাবিয়ে রাখিস না।”
তার মা একথা দ্বারা কি বুঝাতে চাচ্ছে তা সে জানে। জয় তার মাকে আশ্বস্ত করার জন্য তার মা’র হাত ধরে বলে,
“ মা যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। আমি এখন সত্যি মন থেকে চাইছি ভালো থাকতে। সাথে তোমাদেরও ভালো রাখতে। ট্রাস্ট মি। কষ্ট লাগছে এটা ঠিক তবে আমি সেই কষ্টটাকে কাটিয়ে উঠতে চাইছি। এটা করতে আমার কিছু সময় লাগবে তবে আমি জানি এই সময়টা আমি পার করে ফেলবো। আমি নিজেও আর কষ্ট পাব না তোমাদেরকেও পেতে দেব না।” – বলে সে তার মা’র হাতে একটা চুমু খায়।
ছেলের কথা শুনে ইলোরা ইয়াসমিনের আজ সত্যি খুব ভালো লাগছে। যাক ছেলেটা তাহলে সত্যি সত্যি খারাপ সময়টা থেকে বের হতে চাচ্ছে। এতদিন তো খারাপ সময়টাকে জাঁকিয়ে রেখে বেঁচে ছিল। তিনি খুশি হয়ে ছেলের মাথায়, মুখে হাত বুলিয়ে দেন। জয়ও মা’র দিকে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দেয়। এরপর বলে,
“ মা ফুচকা খাবে?”
ইলোরা ইয়াসমিন হেসে মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় ছেলের কথায়। জয় মাকে ওয়েট করতে বলে ফুচকা আনতে চলে যায়৷ কিছুক্ষণ পর দুইপ্লেট ফুচকা নিয়ে এসে একপ্লেট মা’র হাতে দিতে গিয়েও সরিয়ে নেয়। আর বলে,
“ শোনো কেবল আজকের জন্য, আজকের পরে কিন্তু এসব ভুলেও মুখে নেওয়ার কথা চিন্তাও করবে না। এসব খেলে শরীর খারাপ করে। আজকে কেবল তোমার মন ভালো করার জন্য দিচ্ছি। তবে এরপর আর না। দরকার বুঝলে আমি নিজেই খাওয়াবো।”
ছেলের কথায় ইলোরা ইয়াসমিন তার দিকে অসহায় চোখে তাকায়। তবে জানে মেনে না নিয়ে কোনো উপায় নেই। তাই মেনে নিলেন। এতে জয় তাকে তার প্লেটটা দিয়ে নিজেও তার পাশে বসে পড়লো। একটা মুখে দিয়ে বলে উঠলো,
“দাঁড়াও একটা ছবি তুলে নেই। তোমার আদরের মেয়েকে গিয়ে দেখাবো তাকে ছাড়াই আজকে আমরা মা-ছেলে ফুচকা পার্টি করেছি।” -বলেই একটা দুষ্টু হাসি দিল।
ইলোরা ইয়াসমিনও ছেলের সাথে হেসে ছেলের কাঁধে আলতো একটা চড় দিয়ে বলল,
“ বাসায় গিয়ে আবার দুটোতে মিলে শুরু করবি তাই না? আজকে এমন কিছু হলে তোর পিঠে আমি ডাল ঘুটনি ভাঙবো দেখিস।”
এভাবেই হালকা দুষ্টু মিষ্টি কথাবার্তা বলে জয় তার মাকে নিয়ে বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্য বাইকে করে রওনা হয়।
৯.
রাত প্রায় ১০টার বেশি হয়েছে। জয় তার নিজের রুমে এমাথা থেকে ওমাথা পায়চারি করছে। সে ডিসিশন নিতে পারছে না। সে ঐশীর সাথে কথা বলতে চায়। ঐশীর সেদিনের কথাগুলো তার মাঝে সত্যিই পরিবর্তন এনেছে। সত্যিই সে এতদিন পুতুলকে ভুলার কোনো চেষ্টায় করে নি। সে পুতুলকে কখনো ভুলতেই চায় নি। তবে তার নিজেকে ভালো রাখার জন্য তার মা’কে ভালো রাখার জন্য পুতুলকে ভুলতে হবে। কারণ যেটা কখনো হওয়ার নয় তা নিয়ে সবাইকে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে নেই। পুরোপুরি নাহলেও তার জীবনে এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। আর সেদিন মায়ের সাথে ওইকথাগুলো বলার পর যেন আরও সহজ হয়ে গেছে।তার মা এখন বেশ চিন্তামুক্ত।
তার জীবনে এখন আরেকটা নাম কিভাবে জানি জুড়ে গেছে। ‘ ঐশী ’। বড়জোর এক দেড় ঘন্টা তারা একসাথে কিছুক্ষণ কথা বলেছিল এটুকু সময়েই মেয়েটা তার মাঝে বেশ বড় একটা ছাপ ফেলে গেছে।
সে ঐশীর সাথে কথা বলতে চায়। ওইদিনের পর থেকেই এই চাওয়াটা। সে জানে এই চাওয়ার কোনো মানে নেই। তবে আজকে হসপিটাল থেকে আসার সময় রাস্তায় ঐশীকে দেখেছে। সে তার ফ্রেন্ড’দের সাথে হাসাহাসি করছে। ওকে দেখে জয়ের কথাবলার আকাঙ্খাটা আরও তীব্র হয়। কিন্তু সে তার সাথে কথা বলবেই বা কিভাবে। তাদের দেখাদেখির পর তার মা আর ঐশীর পরিবারের কাছে ফোন দেওয়ার সাহস পায় নি। এর এক সপ্তাহ পর নাকি ঐশীদের পরিবার থেকেই ফোন দেয় এবং ঐশীর বাবা ইনিয়েবিনিয়ে ভদ্রভাবে বিয়ে না দেওয়ার কথা বলে।
তবে এমুহূর্তে সে পাগল হয়ে যাচ্ছে ঐশীর সাথে কথা বলার জন্য। কি করবে সে এখন? ঐশীর নাম্বারে বেশ কয়েকবার ফোন দিতে গিয়েও দেয় নি। এতরাতে ফোন দিলে কি না কি ভাববে মেয়েটা। তাকে যদি খারাপ ছেলে ভাবে? খারাপ কেন ভাববে, সে তো কেবল একটু কথা বলবে। কিন্তু কি কারণে? আর ঐশীই বা তার সাথে কথা বলবে কেন? সব তো শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু কথা না বলেও তো জয় থাকতে পারছে না। এসব নানা হাবিজাবি চিন্তা করতে করতে জয় ক্লান্ত। নিজেকেই নিজের গালে চ*ড় মা*রতে ইচ্ছে করছে।
তারমাঝে একটা অদ্ভুত অযাচিত আকাঙ্খা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। যেটা প্রশ্রয় দেওয়া তার মোটেই সাজে না। কিন্তু সে সেটাকে কোনোভাবে দমিয়েও রাখতে পারছে না। এসব চিন্তা করতে করতে সে দুহাতে নিজের মাথার চুলগুলোকে মুঠো ধরে টেনে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
কি করবে সে এখন? ঐশীর সাথে কথা বলবে? কোন অধিকারে কিংবা তার এই কথা বলার আকাঙ্খাটাই বা কেন?
১০.
সকালবেলা,
জয় এবং তার কলিগ কাম বেস্টফ্রেন্ড সিয়াম এবং ফয়সালের সাথে হসপিটালের ক্যান্টিনে বসে চা পান করছে। সিয়াম বারবার জয়ের দিকে তাকাচ্ছে আর চা’য়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। জয় সেটা দেখেও না দেখার ভান করে চা পান করছে আর ফোন স্ক্রল করছে। সিয়াম কিছুক্ষণ পর বলে,
“ তা তুই ওই মেয়েটার সাথে দেখা করতে চাস। ওকে।”-বলে আরও কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর আবার বলে,
“ তা কেন দেখা করতে চাস? আইমিন কি বলবি? কি কারণে এত উতলা হচ্ছিস তুই?”
“ উতলা মানে? আমি জাস্ট থ্যাংকস বলতে চাই ওনাকে। সে সত্যিই আমাকে সঠিক পথটা বেছে নিতে সাহায্য করেছে। তার জন্য আমার মাঝে বেশ পরিবর্তন এসেছে। তুই কি সেটা অস্বীকার করতে পারবি? তাই আমি তাকে একটা থ্যাংকস দিতে চায়, যেটা সে ডিজার্ভ করে দ্যাটস ইট। এটার জন্য এতটা জেরা করার কি আছে রে ভাই।”
“ দ্যাটস ইট না? ব্যাটা তুই কালকে রাতে ৭বার কল দিছস। দিয়া সেই একই প্যাচাল পারছস। তোর হাবভাবে স্পষ্ট তুই মেয়েটার সাথে কথা বলার জন্য মরে যাইতেছিস। আর বলিস দ্যাটস ইট?”
“ আর ওই মেয়ে তোর সাথে কথা বলবেই বা কেন হ্যা? এমনও তো হতে পারে তোর কথা তার মনেই নেই। সে কি এইগুলা নিয়া বসে আছে নাকি… তার আর কোনো কাজকাম নাই। আর থ্যাংকস বলতে চাস বলে দে। মেসেজে একটা থ্যাংকস বলতে এতো সেন্টি খাওয়ার কি আছে? বলে দে থ্যাংকস শেষ, খাতাম৷ এতো দেখাদেখি করার কি আছে? ”-ফয়সাল বলল।
“ হুমম। এতো উতলা হওয়ার কি আছে মেসেজ পাঠায় দিলেই তো শেষ হতো।”- সিয়াম বলল।
“ ভাই তোরা বিষয়টা বুঝতেছিস না। বিষয়টা বিষয়টা বিষয়টা একটু….. ”- জয় কথা বলতে বলতেই আটকে গেছে। সে কাউকে বোঝাতে পারছে না, তার মাঝে কি চলছে।
“ হইছে থাক আর বলা লাগবে না। তুই ওই মেয়েটার সাথে দেখা করতে চাইছিস এইটাই হচ্ছে মেইন কথা। বাট তুই যে বাহানা দেখাচ্ছিস আসল কারণ ওটা না। তা আমরা বুঝতেছি। কিন্তু তুই সেটা মানতে চাইছিস না৷ নাহলে ওই মেয়ে যা বলছে, তোকে তা আমরা গত দুই আড়াই বছর ধরে বলে আসছি। বাট তুই বিষয়টা বুঝিস নাই। পোলা মানুষ তো আমরা, তাই আমাদের কথা তোমার মনে ধরে নাই।”- বলেই একটা মুখ মুচড়া দেয় ফয়সাল। শেষের কথা শুনে জয় রাগী দৃষ্টিতে তাকায় ফয়সালের দিকে। ফয়সাল তাতে গুরুত্ব না দিয়ে আপন মনে তার চা শেষ করতে থাকে। সিয়াম ফয়সালের কথা শুনে তার হাসি চাপিয়ে জয়কে বলে,
“ জয় লিসেন। তুই কি মেয়েটাকে পছন্দ করিস? তুই কি বিয়ের বিষয়টাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছিস? দেখ তুই পুতুলের বিষয় নিয়ে কতোটা সিরিয়াস কতটা পাগল তা আমাদের জানা আছে। এখন একটা মেয়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে আজ দুইমাস পর এসে তুই তার সাথে দেখা করার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছিস, এর কোনো মানে হয়? বিষয়টা জাস্ট তোর আবেগ ছাড়া কিছুই না। তুই যদি একান্তই ধন্যবাদ দিতে চাস, তাহলে মেসেজ করে বলে দে। ব্যাস হয়ে গেল। আর মেয়েটা সত্যি সেটা ডিজার্ভও করে। আই মাস্ট স্যা মেয়েটা অত্যন্ত বুদ্ধিমতি, বাস্তবমুখী, এবং বেশ দারুণ একটা মেয়ে। টেক ইউর টাইম। সময়ই বলে দেবে সবকিছু। ”
সিয়ামের কথা শুনে জয় এবার চুপ হয়ে গেল। সিয়ামের কথাগুলোও ফেলে দেওয়ার মতো না৷ হুট করে একটা মেয়ের সাথে দেখা করার জন্য এতটা পাগল হওয়ার কোনো মানে নেই। না না ওর এসব বিষয় থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। তবে সবই কি তার আবেগ? বয়স তো কম হলো না। এইতো বছর দুয়েক পরে ত্রিশের ঘরে পড়বে। এই বয়সেও এতো আবেগ!! সে আজকাল এতো সিদ্ধান্তহীনতায় কেন ভোগে?
ফয়সাল যেন তার মনের কথাগুলো শুনে নেয়। ফয়সাল জয়ের কাঁধে হাত রেখে বলে,
“ দেখ জয়। আমরা জানি তুই কেমন, তোর পরিস্থিতি কেমন। তুই অনেক ম্যাচিউর, আর রেসপন্সিবল একজন পারসন। কিন্তু কিছু ঘটনা তোকে নাড়িয়ে দিয়েছে। বাট সবকিছুই তোর হাতে। এটা থেকে তুই নিজেই নিজেকে রিকোভার করতে পারিস। নিজেকে সবসময় ছোট ভাবিস না। ইউ আর সাচ এ জিনিয়াস ইয়ার। তোর কেবল এখন একটায় ওষুধ ‘ সময়’। সময় দে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।”
‘সময়’- হ্যা সময় সবচেয়ে বড় মহৌষধ। সবক্ষেত্রে কিছু সময় দেওয়া প্রয়োজন। হোক নিজেকে কিংবা অন্যকে। Time is the best healer.
দেখা যাক সময় এবং উপরওয়ালা কার ভাগ্য কি লিখে রেখেছেন।
ক্রমশ……….
( কার্টেসী ব্যতিত কপি করা নিষেধ।)
[ গল্পটা সম্পর্কে আপনাদের মতামত জানাবেন এবং ভুলত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিবেন।]