#সূর্যোদয়
#পর্ব_০৯
#কারিমা_দিলশাদ
বিশাল জ্যাম লেগেছে। জয় তার কাজ শেষ করে আবার কলেজে যাচ্ছিল স্মৃতিকে নিতে। অথচ তার যাওয়ার কথা ছিল না। আসলেই স্মৃতিকে নিতে যাচ্ছে নাকি স্মৃতির বাহানা দিয়ে অন্য কারো সাথে দেখা করার আকাঙ্খা নিয়ে যাচ্ছে তা জয়ের জানা নেই। সে জানতেও চায় না।
হুট করে একটা মেয়ের সান্নিধ্যে পাওয়ার জন্য কেন তার এতো ব্যাকুলতা তা তার জানা নেই, সেটা নিয়ে তার মাথাব্যাথাও নেই। এতদিন সবকিছু চিন্তাভাবনা করেই কাজ করতো। হুটহাট করে কোনো কাজ করা তার মধ্যে নেই। ভেবেচিন্তে সবদিক বিচার বিবেচনা করে কাজ করতো এবং সেটাই পছন্দ করতো সে। তাই তো ভেবেছিল নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তারপর পুতুলকে এবং তার পরিবারকে তার মনের কথা জানাবে। কিন্তু সে কেবল নিজের পরিকল্পনার কথা চিন্তা করেছিল। অপরপাশের কথা ভেবেই দেখেনি। তবে ওসব বিষয় নিয়ে সে আর মন খারাপ করে না। সে মেনে নিয়েছে বিষয়টা।
তবে কেন জানি এখন আর এতো বিচার বিবেচনা করে কাজ করতে ইচ্ছে করে না। লাইফে সবকিছু তো পরিকল্পনা মাফিক হয় না। তার পোক্ত উদাহরণ সে নিজেই। কেউ কখনো লাইফ সম্পর্কে প্রেডিক্ট করতে পারে না। কি হবে তাহলে এতো ক্যালকুলেশন করে? এসব ভেবেই জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আর মনে মনে বলে,
“ ঐশী আমি জানি না আপনার সান্নিধ্যে থাকার জন্য আমার এতো আকুলতা-ব্যাকুলতা কিসের। আমি জানি না এই অনুভূতির নাম কি। আমার জানা নেই এই অনুভূতির আদোও কোনো মানে আছে নাকি নেই। আমি জানি না এর ভবিষ্যৎ কি। জানি না কি হবে ভবিষ্যতে। কেবল এটা জানি আমি আপনার সান্নিধ্যে থাকতে চাই। আমার বয়সের সাথে আমার এই ব্যবহারের, আমার এই চাওয়ার হয়তো কোনো মানে হয় না। তবে আমি সেসব নিয়ে ভাবতে চাই না। কেবল একটু সান্নিধ্যেতা চাই আপনার। একটু…….”
জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে। জয় আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইক নিয়ে ছুটলো তার গন্তব্যের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছেও গেল। আনমনে এদিক ওদিক তাকাতেই নজর পড়ে মুক্তমঞ্ছের দিকে। কড়ই গাছের নিচে পাতা এক বেঞ্চে হাতে চা নিয়ে ফ্রেন্ডদের সাথে বসে আলাপচারিতায় মত্ত ঐশী। এতোক্ষণ যেই ব্যাকুলতা নিয়ে দৌড়ে এসেছিল জয়, তা যেন এখন ঠান্ডা হয়ে গেছে। এখন ভাবছে যদি ঐশী তাকে দেখে ফেলে তাহলে কি ভাববে? আসাটা উচিত হয় নি তার। অবস্থাটা এমন যেন এখন এখান থেকে পালাতে পারলেই বাঁচে জয়। তবে নড়ার মতোও ইচ্ছাশক্তি পাচ্ছে না সে। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আর এদিক সেদিক তাকানোর ভান করে ঐশীর দিকে নজর দিচ্ছে।
এরইমধ্যে স্মৃতি বেরিয়ে আসে কলেজ থেকে। এসে গেটের সামনের রাস্তাটায় তার ভাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। যে এখন বারবার এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। তার ভাইয়ের তো তাকে নিতে আসার কথা ছিল না… তবুও ভাইকে হঠাৎ দেখায় এক্সাইটমেন্টে জোরে ‘ভাইয়া…’ বলে ডাক দেয় এবং দৌড়ে ভাই এর কাছে যায়। তার ডাকে আশেপাশের কয়েকজনের সাথে ঐশীদের মধ্যে থাকাও কয়েকজন সেদিকে তাকায়। তারমধ্যে ঐশীও একজন। ঐশী ডাক দেওয়া মেয়েটিকে ফলো করে জয়কে দেখে এবার ততোটা অবাক হয় না। বরং জয় তার দিকে তাকালে সে হাত উঠিয়ে ‘হাই’- প্রদর্শন করে। জয়ও তার দিকে তাকিয়ে হাত উচিয়ে হাই প্রদর্শন করে।
ঐশী হাই প্রদর্শন করতেই জয়ের মাঝের সকল দ্বিধা যেন কে’টে যায়। স্মৃতিকে সাথে নিয়ে সে ঐশীর দিকে আগায়। যেতে যেতেই স্মৃতি জয়কে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ ভাইয়া এটা ওই মেয়েটা না। যার সাথে তোর বিয়ের কথা চলছিল? আর তুই কলেজে এলি যে। তুই তো আসবি না বলেছিলি। কি ব্যাপার! হুমমমম! ”
“ কাজ শেষ তাই ভাবলাম তোকে নিয়ে যাই। বেশি ভাবিস না। আর আপাতত চুপ থাক। এখন একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবি না।”
জয় আর স্মৃতি ঐশীদের কাছে যেতেই অনিক বেঞ্চ থেকে উঠে জয়কে জায়গা করে দেয়। আর বলে,
“ ভাই বসেন।”
“ না না না ইটস ওকে আপনি বসুন সমস্যা নেই। আমি এখনই চলে যাব।”
“ আরে সে নাহয় যাবেন এখন বসুন। চা খান। আপনার সাথে কি আপনার বোন?”- ঐশী বলে।
“ ও হ্যা। ও আমার বোন স্মৃতি। আর স্মৃতি ইনি হচ্ছে ঐশী।”
জয়ের কথায় স্মৃতি এবার মুখে হাসি নিয়ে ঐশীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“ হাই আপু। কেমন আছেন?”
ঐশীও হাসিমুখেই বলে,
“ আমি ভালো আছি। আর তুমি?”- ঐশীর প্রশ্নে স্মৃতি কেবল হ্যা’সূচক মাথা নাড়ায়।
ঐশী সামনের বেঞ্চ থেকে সৌরভকে উঠিয়ে স্মৃতিকে বসতে দেয়। আর দুজনের জন্য ওদের চয়েসমতো চায়ের অর্ডার দেয়। ঐশীর ফ্রেন্ডরা জয়ের ছবি দেখায় তাদের চিন্তে আর অসুবিধা হয় না। আর অনিক তো বলেই দিয়েছিল সবাইকে জয়ের কথা। আর প্রথম দর্শনে জয়কে ঐশীর ডাক্তার বলায় ইতোমধ্যে ঐশীর হাতে বেশ কয়েকটা চ*ড় খাওয়াও হয়ে গেছে।
এবার ঐশী জয়কে তার বাকি ফ্রেন্ডদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। হাসি মজার আলাপচারিতার মাঝেই স্মৃতি ঐশীকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ আপু আপনারা তো অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের। আর যারা নাচ করলো তাদের সাথে আপনাকে দেখলাম। ওরা তো ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের। মানে…..”
স্মৃতির কথা শেষ না করতে দিয়েই বিজয় ঐশীকে দেখিয়ে বলে,
“ আরে তিনি হচ্ছে এখন আমাদের সম্মানিত ম্যাডাম। তিনি এখন তা তা ধিন ধিন, তা তা থৈ থৈ ধিনাক ধিনাক শিখায়।”
বিজয়ের কথায় সবাই হেসে ফেললেও ঐশী বিজয়ের দিকে রা’গি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
“ সম্মান দিয়ে কথা বলো মূ’র্খ। আমার এখন একটা সম্মান আছে। আমি এখন সম্মানিত ডান্স টিচার। সম্মানের সহিত কথা বলবা।”
ঐশীর কথায় আরও একদফা হেসে নেয় সবাই। এরপর স্মৃতির জবাবে ঐশী তার ডান্স ক্লাসের কথা জানায়। যা শুনে স্মৃতি বেশ আগ্রহের সাথে জানায় তারও নাচ শিখার খুব শখ ছিল। এভাবে আরও বেশ কিছুক্ষণ হাসি আনন্দে সবার কথা চলে।
জয়ও বেশ এনজয় করে ঐশী এবং তার ফ্রেন্ড’দের কথা। বেশ প্রাণবন্ত ছেলেমেয়েগুলো। আর প্রথম দেখায় ঐশীকে গম্ভীর, ম্যাচিউর আর কেবল বাস্তববাদী মনে হলেও আজ সে ঐশীর মাঝের উচ্ছলতা ও চঞ্চলতাটাও উপলব্ধি করতে পারে। তার মনটা আজ অনেকাংশে ভালো হয়ে গেল। না জানি কতদিন পর এমন প্রাণখোলে হাসাহাসি করছে। ইদানীং যদিও তার মাঝে আগের সেই হাসি-খুশি ভাবটা ফিরে এসছে। তবে আজকে যেন সবকিছু একদম নতুন নতুন লাগছে। ঐশীদের সাথে তার বয়সের যে এতো ডিফারেন্স তা তার মনেই হচ্ছে না। প্রথম প্রথম অস্বস্তি লাগলেও এখন একদম অস্বস্তি লাগছে না।
এরমধ্যে স্মৃতির ফোনে ইলোরা ইয়াসমিনের কল আসে। তিনি তো জানতেন স্মৃতি একা একা আসবে কলেজ থেকে। তাই স্মৃতি বাসায় পৌঁছেছে কিনা জানতে ফোন দেয়। ইলোরা ইয়াসমিনের কল আসায় যেন সবার এতোক্ষণে হুশ ফিরে। তারা তো এতোক্ষণ দিন দুনিয়া সব ভুলে আড্ডায় মত্তো ছিল। তাদেরও তো বাসায় যেতে হবে।
জয় এবার ভদ্রতার খাতিরে চলে আসার জন্য উঠে পড়ে। কারণ বেশিক্ষণ থাকলে বিষয়টা ভালো দেখায় না। এমনিতেও অনেক বেশি হয়ে গেছে। আর থাকাটা ভালো দেখাবে না। তাই সে স্মৃতিকে নিয়ে উঠে পড়ে।
জয় স্মৃতি চলে যাচ্ছে দেখে ঐশীরাও ভদ্রতার খাতিরে উঠে দাঁড়ায়। জয় স্মৃতি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় ঐশীকে জড়িয়ে ধরে। যখন জয়ের বিয়ের উদ্দেশ্য ঐশীর কথা হয়। তখন সে কেবল ঐশীর ছবি দেখে। সত্যি বলতে ঐশীর ছবি দেখে এবং কোয়ালিশন দেখে ঐশীকে তার খুব একটা পছন্দ হয় নি। যদিও স্মৃতি জয়ের সম্পর্কে সব জানে। তবুও কেন জানি তার সুন্দর, স্মার্ট, হ্যান্ডসাম ডাক্তার ভাইয়ের পাশে ঐশীকে ভাবি হিসেবে মানতে মন টানছিল না। তবে আজকে ঐশীর সাথে মিশে তার মনে হলো। তার ভাইয়ের জন্য ঐশীই বেস্ট। কিন্তু তাতে এখন কিছুই হবে না। তবুও ঐশীকে তার এখন খুব মনে ধরেছে।
ঐশীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্মৃতি একটু আগে এগিয়ে গিয়ে বাইকের কাছে দাঁড়ায়। তার উদ্দেশ্য জয় এবং ঐশীকে একটু স্পেস দেওয়া। ঐশীর ফ্রেন্ডরাও এমনিতেই তখন জয় আর ঐশী থেকে একটু দূরে দাড়িয়ে আছে।
জয় এবার ঐশীর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে,
“ তাহলে এবার আসি? ইনশাআল্লাহ আবার দেখা হবে।”
“ জ্বি। আমাদের বাসায় যাবেন একদিন সময় করে।”
“ ওমমম। বাসায় যাব কি না জানি না। তবে আপনার ডান্স ক্লাসে যাওয়ার ইচ্ছা রাখলাম। যদি দাওয়াত দেন তাহলে যেতেই পারি।” – জয়ের কথায় ঐশী এবার হেসে ফেলে। আর বলে,
“ জ্বি অবশ্যই। দাওয়াত রইলো একদিন এসে দেখে যাবেন।”
“ জ্বি। এবার চলি। আল্লাহ হাফেজ।”
জয় সেখান থেকে চলে আসে তার বাইকের কাছে। বাইকে উঠে বাইকের সামনের আয়নায় আরও একবার ঐশীকে দেখে নিয়ে চলে যায়।
ঐশীও তাদের বিদায় দিয়ে তার ফ্রেন্ড’দের কাছে যায়। আর তার মহান ফ্রেন্ডরা জয় আর ঐশীকে নিয়ে শুরু করে দেয় আলাপ। যার অর্ধেকই ঐশীকে প’চানিমূলক। যেন ঐশী লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করছে। ঐশী জানে এদেরকে বলেও কোনো লাভ নেই। এরা জেনেশুনেও ওকে নিয়ে প’চাচ্ছে। তাই সে চুপচাপ কেবল শুনে যাচ্ছে।
#চলবে……..
(কার্টেসী ব্যতিত কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ। কেউ কপি করবেন না৷ তবে শেয়ার করতে পারেন। আশা করি গঠনমূলক মন্তব্য করবেন।)