#সূর্যোদয়
#পর্ব_২২
#কারিমা_দিলশাদ
জয় ফয়সালের বাসার ছাঁদে দাঁড়িয়ে সি’গারেট ফুঁকছে। জয় আজকে ফয়সাল আর তার অন্য কয়েকজন কলিগের সাথে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল। সেখানে সে ঐশীকে ওই লোকটার সাথে দেখে। বেশ হাসিখুশি ছিল তারা। লোকটা ঐশীর খুব কেয়ারও করছিল। বিষম খেয়েছিল ঐশী, আর লোকটা কি সুন্দর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।
এসব ভেবেই তার মুখে ব্যর্থতার এক হাসি ফুটে উঠে। পিছন থেকে ফয়সাল এসে জয়কে ডাক দেয়। জয় পিছু ঘুরে ফয়সালের দিকে তাকায়। ফয়সাল বলে,
“ দোস্ত দেখ তুই আগেই উল্টাপাল্টা কিছু ভাবিস না। হতে পারে….. ”
জয় তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। ফয়সালকে তার কথা শেষ না করতে দিয়ে বলে,
“ শা**লা আর স্বান্তনা বাণী দিস না। আই এম ওকে।”
এরপর বেশ বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে জয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ আই লাভ হার দোস্ত। আই রিয়েলি লাভ হার। জানিস মেয়েটা খুবই অসাধারণ। তুই তো ওর সাথে কখনো কথা বলিস নি। ওর সাথে কথা বললেই না, মনটা খুব ভালো হয়ে যায়৷ কি সুন্দর করে কথা বলে দোস্ত। ওর কথাগুলো মনে শান্তি দেয়।
জানিস ওর সাথে কথা বললে মনে হবে খুব গম্ভীর ধরনের মানুষ ও। কিন্তু ও খুব চঞ্চল জানিস। মাঝে মাঝে এমন এমন সব কথা বলে এমন এমন সব ভাবভঙ্গি করে যে হাসতে হাসতে পেটে ব্যাথা ধরে যায়।” — বলেই হা হা করে হাসতে থাকে জয়৷
আর ফয়সাল দেখতে থাকে আবারও ভালবাসায় ব্যর্থ হওয়া এক পাগলাটে প্রেমিককে। চোখে পানি আর মুখে হাসি নিয়ে প্রেয়সীর জন্য নিজের আবেগে ব্যক্তরত এক পুরুষকে। ফয়সাল গিয়ে জড়িয়ে ধরে জয়কে। জয়ও এবার ফয়সালকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। আর বলতে থাকে,
“ আমি আবার হেরে গেলাম দোস্ত। আবারও হেরে গেলাম। ও কেন আমার হলো না দোস্ত, কেন আমার হলো না? ও আমারই যদি না হবে, আল্লাহ ওকে আমারই যখন না করবে তখন কেন তাকে আমার জীবনে নিয়ে এলো? বল…… আমি ওকে খুব ভালবাসি দোস্ত, খুব ভালোবাসি।”
জয়ের কথায় ফয়সালের চোখ দিয়েও নিরবে পানি গড়াচ্ছে। বন্ধুর কষ্টে তার বুকটাও যে ভার হয়ে আসছে। সত্যিই তো। আল্লাহ যেই মানুষের সাথে আমাদের ভাগ্য লিখে রাখে নি সেই মানুষকে তাহলে কেন আমাদের জীবনে নিয়ে আসে? হাউমাউ করে কাঁদছে জয়। ফয়সাল তার কান্নায় বাঁধা দিল না। ওকে ওভাবেই জড়িয়ে রাখলো এক ভরসা হিসেবে। বেশ কিছুক্ষণ পর জয় একটু স্বাভাবিক হয়। ফয়সালকে ছেড়ে নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে বলে,
“ থাক ও সুখে থাক, তাতেই হবে। ওই অসাধারণ মেয়েটা অসাধারণ এক জীবনসঙ্গী ডিজার্ভ করে। সুখী, হাসি খুশি একটা জীবন ডিজার্ভ করে। আমার কাছে থাকলে হয়তোবা তা পেত না। আল্লাহ হয়তো ওকে ওই মানুষটার ভাগ্যেই লিখে রেখেছে। থাক, ও খুশি থাক।
আর হাবিব ভাই বললো উনি এখানকার এসপি। মাশাল্লাহ বেশ ভালো।”
বলে থেমে যায় জয়। একটুপর আবার ফয়সালকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ উনি ঐশীকে ভালো রাখবে তো দোস্ত? ঐশী ভালো থাকবে তো উনার কাছে?”
ফয়সাল ভেজা চোখে জয়ের দিকে তাকিয়ে তাকে কিছুক্ষণ। এরপর মাথা নেড়ে হ্যা সূচক বলে,
“ ইনশাআল্লাহ।”
জয় আকাশের দিকে তাকিয়ে মন থেকে দোয়া করে ঐশীর জন্য। ঐশী কি তা জানে যে কেউ একজন ভাঙা মন নিয়ে তার জন্য আল্লাহর কাছে মন থেকে দোয়া করছে?
—————————–
ঐশী বাসায় তার নিজের রুমে হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। রেস্টুরেন্ট থেকে আসার পর থেকেই সে এভাবে বসে আছে। মারুফ এক সপ্তাহের সময় দিয়ে গেছে। ঐশী যেন এই এক সপ্তাহের মধ্যে তার মতামত জানায়। যদি ঐশীর উত্তর হ্যা হয় তাহলে এক সপ্তাহ পর সে তার পরিবারকে নিয়ে ঐশীর বাসায় প্রস্তাব আনবে। আর যদি উত্তর না হয় তাহলে তার ভ্যালিড কারণটা যেন তাকে বলে দেয়।
কিন্তু ঐশী তো বিয়েই করতে চায় না। কেবল মারুফকেই যে বিয়ে করতে চায় না এমন না। সে কাউকেই বিয়ে করতে চায় না।
সেদিন যদি জয় রাজি থাকতো বিয়েতে তাহলে ঐশী নিশ্চিত বিয়েটা ভেঙে দিতো। সে গিয়েছিলই এই উদ্দেশ্য, কিন্তু সেখানে গিয়ে জয়কে দেখে আর তার ভাবভঙ্গি দেখেই ঐশী বুঝতে পেরেছিল জয় বিয়েতে রাজি না। তাই সে আর তার অমতের কথা বলে নি।
রেস্টুরেন্ট থেকে ঐশী সরাসরি বাসায় এসে পড়েছে। তার কোনোকিছু ভালো লাগছে না। এমন একটা পরিস্থিতিতে সে পড়েছে যে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সে জানে মারুফ যদি তার বাসায় প্রস্তাব পাঠায় তাহলে তার বাবা মা কখনো এই প্রস্তাবে অমত করবে না। আর মারুফকে না করার মতো কোনো কারণও নেই তার।
————————-
গত দুদিন ধরে ঘরেই বসেছিল ঐশী। ওইদিন রেস্টুরেন্ট থেকে বাসায় গিয়ে আর বের হয় নি। তাই আজকে আশা, প্রীতি মিলে ধরে বেঁধে বের করে নিয়ে এসছে তাকে।
ওর বাকি ফ্রেন্ডরাও এই প্রপোজালে খুব খুশি থাকলেও কিছুটা দোলাচলে তারাও রয়েছে। ওরা কেউই নিজেদের ক্লোজ ফ্রেন্ডের জামাই হিসেবে মারুফকে ততটা পছন্দ করতে পারছে না।
বিশেষ করে আশা। সে তার বেস্টফ্রেন্ডের হাজব্যান্ড হিসেবে ওই টাকলাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তবে আবার এটাও ঠিক একমাত্র টাকলা ছাড়া বাকি সবদিক দিয়ে লোকটা একশো’তে একশো। মারুফের ব্যবহার, কথাবার্তা, চাকরি-বাকরি সবকিছু পার্ফেক্ট। কিন্তু ঐশীর থেকে বেশ বড়। তবে আশা এটাও জানে এর থেকে ভালো পাত্র হয়তো ঐশীর জন্য আর পাবে না।
—————————
ওরা এখন কবিতাদের বাসার ছাঁদে বসে আছে।
একসময় কবিতা ঐশীকে বলে,
“ দোস্ত তুই কি উনার বয়স আর লুকের জন্য বিয়ে করতে চাইতেছিস না?”
“ মানে!?”
“ মানে এই যে উনি টাকলা, উনার বয়স তোর থেকে বেশি। এগুলোই কি কারণ? ”
“ উহুম। মোটেই না। আমার কাছে লুক খুব একটা ম্যাটার করে না। আর ভালো ওয়েল স্যাটেল কর্মজীবী ছেলে চাইলে বয়স তো একটু বেশি হবেই। এটা কোনো ম্যাটার না। ম্যাটার হচ্ছে আমি বিয়ে করতে চাই না। কেবল উনাকে না, কাউকেই বিয়ে করতে চাই না।”
প্রীতি বলল,
“ তাইলে কি করবি? সারাজীবন এমনে একলা থাকবি?”
“ জানি না। হয়তো হ্যা হয়তো না। আমি স্বাবলম্বী হতে চাই দোস্ত। নিজের একটা ঠিকানা থাকবে। নিজের বলতে কিছু থাকবে। যেখানে আমি আমার পছন্দমতো রান্না করতে পারবো, পছন্দমতো ঘর সাজাতে পারবো। এককথায় যেখানে সবটা আমার নিজের থাকবে এতটুকুই আমার চাওয়া।”
প্রীতি বলল,
“ তো এইটার জন্য হইলেও তো বিয়া করা লাগবো। তাইলেই না নিজের সংসার পাবি। আর উনিও তো বলছে বিয়ার পর তোরে পড়াইবো। তাইলে সমস্যা কি?”
কবিতা বলল,
“ আর ঝামেলাহীন ছিমছাম সংসার। তুই সব নিজের মতো করে সাজাতে পারবি, চালাতে পারবি। ”
“ তাই!! তোদের সত্যি মনে হচ্ছে ওটা ঝামেলাহীন ছিমছাম সংসার? হ্যা তাদের সাথে যেহেতু আমার দেখা হয় নি কথা হয় নি, তাই আগে থেকেই আমি কিছু বলতে চাইছি না।
কিন্তু দেখ পরিবারের বড় সন্তান। এতদিন নিজেরসহ অন্য ভাইবোনের পড়াশোনা, সংসার চালানো, বোনদের বিয়ে দেওয়া সংসারের সবকিছুতে সে নিঃস্বার্থভাবে দিয়ে গেছে। যেই মানুষটা নিঃস্বার্থভাবে তাদের জন্য এতদিন করে গেছে সেই মানুষটার যদি নিজের সংসার হয়, অন্য একটা পিছুটান হয় তাহলে সে সেই জায়গায় এতোটা নিঃস্বার্থভাবে তাদের টানতে পারবে না। তোদের কি মনে হয় এটা আদোও ছিমছাম? সত্যিই কি এর কোনো প্রভাব পড়বে না?
আর প্রীতি তুই বলছিস বিয়ের পর নিজের একটা সংসার পাওয়া যায়! সিরিয়াসলি! তুইই তো বলিস বিয়ের এত বছরেও তোর মায়ের নিজের সংসার বলতে কিচ্ছু নেই। বিয়ের এত বছর পরেও তোর দাদী তোর মা রে দেখতে পারে না, তোর ফুফু দেখতে পারে না। আমি সিওর তোর মা রে তুই মা’র খাইতেও দেখছস তোর বাপের হাতে। হয়তো এখনও খায়, রাইট? তাহলে নিজের সংসারটা হয় কোথায়?
শুধু তোর মা না, আমাদের চারজনের কারো মায়েরাই তাদের সংসার জীবনে সুখি না। এটা নিজেরাই জানি। ইভেন তোরা আমাকে তোদের আশেপাশের কিংবা চেনা পরিচিত কাউকে দেখাতে পারবি যে সেই নারী সুখী? আমি আমার জীবনে তো কোনো নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান, মূল্যায়ন পেতে দেখি নি। আমি সত্যি দেখি নি।
আমি কিন্তু এটা বলছি না কারো বিয়ে করা উচিত না, বিয়ে করলেই মানুষ অসুখী হবে। আমি আমার কথা বলছি। আমি আমার প্রায়োরিটির কথা বলছি। সবার প্রায়োরিটি তো এক না।
কি দরকার বল? যেখানে আমি নিজের বাপ মা’র ঘরেই নিজের ছোট ছোট খুশি, শখ, ইচ্ছা পূরণ করতে পারলাম না। যেখানে বাবা মা সন্তানের জন্য একরকম আলাদীনের চেরাগ হয়, সেখানে অন্য একটা ফ্যামিলিতে গিয়ে আমার অপূর্ণ ইচ্ছে, শখ, খুশি পূরণ হবে এটা ভাবাটাও বিলাসিতা।
নিজের বাবা মাকেই যখন খুশি করতে পারলাম না সেখানে পরেরবাড়ি গিয়ে তাদের খুশি করতে তো আরও পারব না। আর আমি এখন কাউকে আর খুশি করতে চাইও না। মেয়েদের জীবন খালি অন্যদের খুশি করতে আর অন্যদের মন রক্ষা করতে করতেই যায়। অন্যের সেবা করতে করতেই যায়।
এখন আমার কথার আবার ভুল মানে বের করিস না, ভুলভাবে নিস না প্লিজ। স্বামী শ্বশুরবাড়ির লোকেদের সেবা করা তাদের খুশি করাটাকে আমি খারাপ বলছি না। আমি মানি এটা মেয়েদের দায়িত্ব, একটা মমতা, একটা আস্ত ভালোবাসা। তবে এগুলো তো এক তরফা হলে চলে না। এক তরফা হলে এগুলো আর ভালবাসা, দায়িত্ব কর্তব্যের মাঝে পড়ে না। সেগুলোকে তখন গো’লামী, দা’সী, বা’ন্দিগিরি করা বলে। আর আমি চাই না এগুলো করতে।”
সবাই চুপ। সবাই ঐশীর কথাগুলোর গভীরতা ভাবছে। এই কথাগুলো শুনলে অনেকেই বিশেষ করে ছেলেরা হয়তো ভাববে এসব ফ্যা’মিনিস্ট টাইপের কথাবার্তা। নিজেদের হক, অধিকার, প্রাপ্য সম্মানের কথা বলতে গেলেই আজকাল তা ফ্যা’মিনিস্টের কাতারে পড়ে।
আশা, প্রীতি, কবিতা এরাও হয়তো নিজেদের মায়ের কথায় ভাবছে, নিজেদের কথা ভাবছে কিংবা অন্যকিছু। ঐশী অন্যকিছু ভাবছে। সে এখন এই বিষয়গুলো নিয়ে অন্যকারো সাথে কথা বলতে চায় না। বলেও লাভ নেই।
কেউ তার মনের কথা, চিন্তাভাবনা, দ্বিধা বুঝবে না। পৃথিবীতে কেউ কখনো অন্যকারো সমস্যার সমাধান করতে পারে না। যার যার সমস্যা তা নিজেদেরই সমাধান করতে হবে। ঐশীকেও সবদিক বিচার বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
#চলবে
( কপি করা নিষেধ। কেউ কপি করবেন না।)
[ ঐশী কি করবে বলে আপনার মনে হয়? আপনাদের মতামত দিন।]