#সূর্যোদয়
#পর্ব_৩৩
#কারিমা_দিলশাদ
রাতে জয় বাসায় আসলে ইলোরা ইয়াসমিন জয়কে তার রুমে ডেকে পাঠায়। জয় ফ্রেশ হয়ে এসে তার পাশে বসলে ইলোরা ইয়াসমিন জয়ের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,
“ বাবা সব মেয়েদের চাহিদা কিন্তু বেশি না। কিছু কিছু মেয়ে আছে যাদের আকাশের চাঁদ তারা এনে দিলেও তাদের মন তুমি পাওয়া যাবে না। আবার কিছু মেয়ে আছে যাদের একটা বেলীফুলের মালা দিয়েও খুশি করা যায়। ত্রিশটাকা দিয়ে একমুঠো চুড়ি কিনে দিলেই তারা খুশি। আবার কিছু মেয়ে আছে যাদের মাথায় একটু ভালোবেসে হাত বুলিয়ে দিলেই তারা অপর মানুষের জন্য জীবন দিয়ে দিবে। ঐশী সেই ধরনের মেয়ে। ওকে খুশি করতে তোর বেশি কিছু লাগবে না। ওকে তুই কেবল তোর ভালোবাসা দিয়েই খুশি রাখতে পারবি, তোর করে রাখতে পারবি। মেয়েটা ভালোবাসার কাছে খুবই খুবই খুবই দূর্বল। তুই বলেছিলি না ওর মা হয়ে উঠতে আমি তা চেষ্টা করব। এবার তুই আমাকে কথা দে, যেই ভয় আর দ্বিধা নিয়ে মেয়েটা তোর কাছে আসবে সেই ভয়টা যেন কোনোদিন সত্যিতে পরিণত না হয়। ছেলেদের সম্পর্কে তার ধারণা যেন ভুল প্রমাণিত হয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওর হাত কখনো ছেড়ে দিস না। ওর চোখের পানির কারণ হস না, ওর সুখের কারণ হস। স্ত্রীর কাছে উত্তম পুরুষ হস। আমার আর তোর বাবার আদর্শ আর শিক্ষাকে কখনো প্রশ্নবিদ্ধ হতে দিস না বাবা।”
জয় তার মাকে জড়িয়ে ধরে। তার চোখের কোণে হালকা পানি জমেছে। সে তার মাকে জড়িয়ে ধরে কথা দেয়। সে বুঝে গেছে ঐশী বিয়েতে রাজি। তার ভিতরে যে কি হচ্ছে তা সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না।
———————————-
আয়নার সামনে বসে নিজেকে তৈরি করছে ঐশী। আজকে জয় আর তার পরিবার আসবে বিয়ের ডেট ফিক্সড করতে। সেদিনই ইলোরা ইয়াসমিন বলে দিয়েছিল ঐশীকে, যে তারা আজকে আসবে। ঐশীও আর মানা করে নি, আসলে করতে পারে নি। কেমন যেন একটা লোভ হচ্ছে তার, ভালোবাসা পাওয়ার লোভ। যদিও ভিতরের অন্য একটা স্বত্তা বারবার তাকে বিভিন্ন নেগেটিভ বিষয় নিয়ে ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিন্তু কেন জানি সেগুলো নিয়ে আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না ঐশীর।
এসেই পড়বে ওরা তাই তৈরি হচ্ছে ঐশী। তৈরি হওয়া বলতে একটা মিষ্টি রঙের জামদানী শাড়ি পড়েছে। এবার নিজের ইচ্ছেতেই পড়েছে। আর ঠোঁটে হালকা মিষ্টি রঙের লিপস্টিক, কানে একটা ছোট্ট ইমিটেশনের টপ, গলায় একদম পাতলা ফিনফিনে চেইন ব্যস এতেই সে তৈরি। তবে এটুকু সাজেই তাকে অপার্থিব লাগছে। বেচারা জয় আজকে শেষ।
ওরা এলে ঐশীর বাবা মা ইলোরা ইয়াসমিন আর স্মৃতির খাতির যত্নে লেগে যায়। স্মৃতি অবশ্য এসেই ঐশীর কাছে চলে এসেছে। একটুপর ইলোরা ইয়াসমিনও আসে তাকে দেখতে। মিষ্টি মুখের মানুষটা এসেই ঐশীকে নিজের বুকে জড়িয়ে নেয়। কপালে মমতার স্পর্শ একেঁ দেয়। এরপর আবার তিনি নিজেই ঐশীকে সঙ্গে করে নিয়ে ড্রয়িং রুমে আসে।
ঐশীকে আসতে দেখেই জয় মাথা নিচু করে নেয়। বাসা ভর্তি মানুষজন। এই মেয়েকে দেখলে এমনেই তার মাথা ঠিক থাকে না। তার দ্বারা যদি উল্টাপাল্টা কিছু হয়ে যায়? লজ্জায় পড়তে হবে। দেখা যাবে সেই বিষয়টাকে কেন্দ্র করে আবার এই পাষাণী বিয়ে করবে না বলে বেঁকে বসলো তখন কি হবে জয়ের! এর থেকে ভালো ওই মেয়ের দিকে তাকাবেই না সে।
কিছুক্ষণ পর বিষয়টা ঐশী খেয়াল করলো। আসার পর থেকে জয় একবারও তারদিকে তাকায় নি। সবার সাথে হাসিখুশিভাবে কথা বলছে ঠিক আছে কিন্তু ঐশীর দিকে তাকাচ্ছে না। ঐশী এবার জয়কে পরখ করা শুরু করে। সাদা শার্ট ঘিয়ে প্যান্টে পরিপাটি লোকটাকে বরাবরই ফরমাল লুকে চরম লেভেলের হ্যান্ডসাম লাগে। আজও লাগছে। তবে লোকটা তার দিকে কেন তাকাচ্ছে না? অন্য কোনো কারণ নাকি লজ্জায়? ঘরভর্তি করে তার মায়ের ফ্যামিলির মানুষজন। এরমধ্যেও ঐশী জয়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পারলো জয় লজ্জা পাচ্ছে। কথার ছলে ছলে অল্প একটু ঐশীর দিকে তাকিয়েও বারবার কৌশলে চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। বিষয়টা ঐশীর কাছে খুব মজার লাগলো। মেয়ে হয়েও সে লজ্জা পাচ্ছে না আর জয় কি না লজ্জায় তাকাতেই পারছে না। মনে মনে বেশ হাসছে সে। এরমধ্যেই ঐশী জয়কে আলাদা কথা বলতে চায় লিখে একটা মেসেজ পাঠায়।
———————————-
জয় আর ঐশী ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে। প্রচুর বাতাস বইছে। ঐশীর শাড়ির আঁচল উড়ছে। জয় নির্নিমেষ ঐশীর দিকে তাকিয়ে আছে। মিষ্টি রঙের শাড়িতে মেয়েটাকে ভীষন মিষ্টি লাগছে। চুলগুলো বেণী করা, বেণীটা আবার একপাশে নিয়ে রাখা।মুখের সামনের কিছু খুচরো চুল বারবার ঐশীকে ডিস্টার্ব করছে, আর ঐশী বারবার তাদের সরাচ্ছে। এইটা দেখতেও তার ভালো লাগছে। ঐশী জয়ের দিকে তাকায়। চোখাচোখি হয় দুজনের। কিন্তু কেউই চোখ সরিয়ে নেয় না। ঐশী জয়ের চোখে চোখ রেখেই বলে,
“ এখন এভাবে তাকিয়ে আছেন যে। রুমে তো লজ্জায় আমার দিকে তাকাতেই পারছিলেন না। এখন লজ্জা লাগছে না?”
জয় চোখে চোখ রেখেই বলে,
“ না। তখন লজ্জাও লাগছিল প্লাস নিজের উপর ভরসা ছিল না। তাই তাকায় নি। তখন আপনাকে দেখে কন্ট্রোললেস হয়ে যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলি সেইজন্য তাকায় নি। কিন্তু আপনি তো সারাক্ষণ আমাকেই দেখছিলেন। ইশশ এখনই আমাকে এতো চোখে হারাচ্ছেন। পরে তো আপনি আমার সাথে দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা একদম স্যাটে থাকবেন দেখছি।”
ঐশী কিছুটা থতমত খেয়ে যায়। ভেবেছিল জয়কে কথা দ্বারা লজ্জায় আরও কোণঠাসা করবে কিন্তু এতো উল্টো ওকেই কোণঠাসা করে ফেলছে। অস্বস্তিতে ঐশীর নজর চঞ্চল হয়ে উঠে।
জয় ঐশীর অস্বস্তি ধরতে পেরে হালকা হাসে। তাকে আরেকটু অস্বস্তিতে ফেলতে ঐশীর কাছে গিয়ে ঝুঁকে চোখে চোখ রেখে বলে,
“ এখানে কিন্তু কেউ নেই। আর তাই আমার নিজেকে কন্ট্রোল করারও দরকার নেই মিস ঐশী……ই”
নামটা টেনে উচ্চারণ করতেই ঐশী জোরে শ্বাস নিয়ে পিছিয়ে যায়। আর বড় বড় চোখ করে তাকায় জয়ের দিকে।
“ দেখুন আমি আপনার সাথে কিছু ইম্পরট্যান্ট কথা বলার জন্য এখানে এসেছি। একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না বলে দিলাম। আমার কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখবেন বলে দিলাম।”
“ যথা আজ্ঞা রাণীসাহেবা।” — কুর্নিশ করে জয় ঐশীকে। ঐশী একটা জোরে শ্বাস ফেলে। তারপর গলার স্বর নরম করে মিনমিন করে বলে,
“ ডাক্তারসাহেব আমার কিছু শর্ত আছে, কিছু কথা আছে। ”
জয় একলাফে ঐশীর কাছে আসতে আসতে বলে,
“ হ্যা হ্যা বলুন না৷”
ঐশী ঘাবড়ে পিছনে ঝুঁকে যায়। জয়ের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে জয়কে পিছন দিকে ঠেলে শক্ত গলায় বলে,
“ দূরে যান। দূর থেকেও কথা বলা যাবে।”
“ ওকে জা……..ন।”
ঐশী গলা পরিষ্কার করে নেয় আর গলার স্বর কঠিন রেখে বলে,
“ শর্তগুলো মনযোগ দিয়ে শুনবেন ওকে? তারপর ভেবে চিন্তে উত্তর দিবেন। ওকে?”
জয় সুবোধ বালকের মতো মাথা নাড়ে।
“আমার প্রথম শর্ত হচ্ছে আমি বিয়ের পরও আমার পড়ালেখা, ডান্স ক্লাস চালিয়ে যাবো। আর চাকরিও করব। আমাকে কখনো বাঁধা দিতে পারবেন না।
আমি এখন যেমন আছি বিয়ের পরও তেমনই থাকবো। ছেলেবন্ধু মেয়েবন্ধুদের সাথে মিশবো আমাকে বাঁধা দিতে পারবেন না। আর আমার ছেলে ফ্রেন্ডদের তো চিনেনই। ওরা কেবল আমার খুব ভালো বন্ধু এটা মাথায় ঢুকিয়ে রাখুন। এখন যেমন বিয়ের পরও তেমন থাকবো তার মানে এই না যে সংসারের সব দায় দায়িত্ব থেকে আমি পিছিয়ে যাব। সংসারের সব দায় দায়িত্ব, স্ত্রী হিসেবে আমার সব কর্তব্য আমি ঠিকভাবে পালন করবো।
আমি মাঝে মাঝে আমার বাসায় গিয়ে থাকবো। মানে নৃত্যশৈলিতে আরকি বাঁধা দিতে পারবেন না।
আমি আমার কামাই করা টাকা যেভাবে খুশি সেভাবে খরচ করব। কিন্তু আপনি সেগুলোর অতো হিসাব রাখতে পারবেন না। মানে রাখবেন তবে অতো না।
আর এগুলো আরও ভালো করে মনে রাখবেন। বাইরে থেকে এসে কোনো কিছু ধরতে পারবেন না। আগে গোসল করবেন। বাইরের কাপড়চোপড় জিনিসপাতি বিছানায় রাখতে পারবেন না। যেটা যেখানের জিনিস সবসময় সেখানে রাখবেন। পরিষ্কার থাকবেন। আরও আছে ওগুলো টাইম টু টাইম বলে দিব। আর আপনাকে তা মানতে হবে ওকে?
আর আমার রাগ হলে আমার মাথা ঠিক থাকে না। মুখে যা আসে তা বলতে থাকি। ভেবেচিন্তে কিছু বলি না। রাগের মাথায় বলি। ওগুলো অতো মনে রাখবেন না কষ্ট পাবেন না। আমি রাগ করে কথা বললে তখন আপনি চুপ থাকবেন। তর্ক করলে আমার রাগ আরও বেড়ে যায়।”
“ ঐশী….. তুমি যেই কথাগুলো বললে তা তুমি না বললেও কোনো সমস্যা ছিল না। তুমি বিয়ের পর যদি পড়ালেখা করতে না চাও আমার মা তোমাকে পি’টিয়ে পি’টিয়ে পড়াবে। আর মা’র বক্তব্য মেয়ে মানুষের যদি চাকরি করার উদ্দেশ্য নাই থেকে থাকে তাহলে এতো পড়াশোনার পিছে টাকা খরচ করে ডিগ্রি কিনে ঘরে ফেলে রাখার কোনো দরকার নেই। এইচএসসি পর্যন্ত পড়লেই মোর দ্যান এনাফ। সো পড়াশোনা, ডান্স ক্লাস, চাকরি বাকরি এসবে কেউ তোমাকে কক্ষনো কোনদিন বাঁধা দিবে না। বরং সাপোর্ট করবে। আর তোমার টাকা তুমি যেভাবে ইচ্ছা খরচ করতে পারো। আমি কিংবা আমার মা এসব কখনো দেখতে যাব না। আমার বাবাকেও কোনদিন আমার আম্মুর উপার্জন করা টাকার হিসেব নিতে দেখি নি।
আর রইলো তোমার ছেলে বন্ধুদের সাথে মেলামেশা করা, তোমার বাসায় গিয়ে থাকা এসব নিয়ে চিন্তা করো না। এগুলো নিয়ে আমরা কখনো ভাবিও না। আমরা এতোটাও খারাপ না ঐশী। এতো চিন্তা করো না। সবঠিক ঠাক হবে। তারপরও তুমি যখন বলেছ তাই তোমার মনের শান্তির জন্য বলছি ওকে। আপনার সব শর্ত আমার শিরোধার্য রাণীসাহেবা।”
ঐশী চুপ করে আছে। এরপর হুট করেই জয় একটা কাজ করে ফেলে। জয় হুট করেই ঐশীর কোমড় তার শক্তপোক্ত পুরুষালি বাহু দ্বারা আবদ্ধ করে নেয়। ঐশী আর জয় এখন এতটা কাছাকাছি যে তারা একে অপরের শ্বাস প্রশ্বাসগুলো অনুভব করতে পারছে। জয় লম্বা হওয়ায় জয়ের শ্বাসগুলো একদম ঐশীর মুখের উপর পড়ছে। আচমকা এমন কাজে ঐশী হতভম্ব। যখন সে বিষয়টা বুঝতে পারলো তখন সে আতঙ্কিত নজরে জয়ের দিকে তাকায়। জয়ের মুখে দুষ্টু হাসির রেশ। জয় একদৃষ্টিতে ঐশীর আতঙ্কে শুকিয়ে যাওয়া মুখটা দেখছে।
মেয়েটার ভয় পাওয়া চেহারাটাও কি মোহনীয়। ইশশশশশশ। এই যে ভ্রুদুটো কুঁচকে রেখেছে। ফেসটা কি কিউট লাগছে। ইচ্ছে করছে কষে টপাটপ কয়েকটা চু*মু খেয়ে নিতে। ঐশী মোচড়ামুচড়ি শুরু করে দিয়েছে। কোনোরকমে আমতা আমতা করে বলে,
“ কি করছেন ছাড়ুন। বলেছি না আমার কাছে আসবেন না। দূরে থাকুন। আপ আ আপনি তো খুব অসভ্য। ছি: ছাড়ুন অসভ্য লোক।”
“ মিস ঐশী আমারও না একটা রোগ আছে।”
এবার ঐশী শান্ত হয়ে যায়। সে সিরিয়াস ফেসে জয়ের দিকে তাকায়। জয় অসহায় ফেস নিয়ে তাকিয়ে আছে ঐশীর দিকে। ঐশী জয়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলে জয় অসহায় বাচ্চার মতো ফেস করে বলে,
“ আপনার সামনে আসলে আমার মেরুদণ্ড খালি আপনার দিকে ঝুঁকে যায়। আমার হাত, মাথা, মন কিচ্ছু কন্ট্রোলে থাকে না। আমার ন্যায় নীতি কাপড়চোপড়ের মতো লুজ হয়ে যায়। আমার তখন অসভ্য, লু*চু প্রকৃতির মানুষ হতে ইচ্ছে করে।“
ঐশী হা করে জয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। জয়ের কথা শুনে ঐশী সিরিয়াস কিছু ভেবেছিল। কিন্তু এই লোক আস্ত একটা খবিশ। রুমে এই লোকটাকেই তার লাজুক মনে হয়েছিল। যার জন্য ঐশীর নিজেকেই নিজের চ*ড়াতে ইচ্ছে করছে। এই লোকটা কোনদিন লাজুক হতে পারে না। ঐশীর হাত পা কাপছে। ঐশীর পাতলা ঠোঁটটা কাপছে। দম বন্ধ বন্ধ হয়ে আসছে। জীবনে প্রথম কোনো পুরুষ তাকে এভাবে জড়িয়ে ধরেছে, কোনো পুরুষের এতোটা কাছাকাছি এসেছে। জয়ের গায়ের পুরুষালী ঘ্রাণ তার নাকে আসছে। ঘ্রাণটা সোজা তার মাথায় আর মনে হেনেছে। ঐশীর গলা দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। কাঁপা কাঁপা গলায় কোনোরকমে বলে,
“ আ আ আমাকে…… আমাকে ছাড়ুন জয়। আহমার আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”
জয়ের মাথাতেও যেন কিছু একটা খুব জেঁকে বসেছে। সে ঐশীকে একটু ভড়কে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন সে নিজেই নিজের মাঝে নেই। সে ঐশীর শরীরের কাঁপুনি টের পাচ্ছে। ঐশীর ঊর্ধ্ব শ্বাস, কাঁপা কাঁপা ঠোঁট, কাঁপা কাঁপা গলা তার সংযমকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিচ্ছে। সে এখন কোনো একটা ঘোরে ডুবে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে আরও জোরে নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরে মেয়েটার কাঁপা কাঁপা অধরে নিজের শুষ্ক অধর দুটো চেপে ধরতে। সে কোনোরকমে তার বাম হাত দিয়ে ঐশীর ডান হাতের ভাঁজে নিজের আঙুল ডুবিয়ে দেয়। এরপর তাতে নিজের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে নিজের অধর ছোঁয়ায়। তার পরক্ষণেই আবার কুটুস করে একটা কামড় বসিয়ে দেয়।
———————————-
বসার ঘরে মাথা নিচু করে বসে আছে জয়। সবাই বিয়ের বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করলেও তার এখন সেদিকে মন নেই। ছাদে তার করা কান্ডটা নিয়ে সে ভিতরে ভিতরে আফসোস করছে। যদিও ঐশী তাকে কিছু বলে নি। সুযোগই পায় নি। জয়ের ঘোর কাটতেই জয় কোনোরকমে সরি বলে ছাঁদ থেকে চলে এসেছে। এসে থেকেই এখানে বসে আছে। ঐশী এখন ছাঁদ থেকে বাসায় আসে নি। এদিকে জয় মরমে ম’রে যাচ্ছে। যদি ঐশী বিষয়টা নিয়ে বিয়েটা ভেঙে দেয় তাহলে? কিন্তু তার যে এমন কিছু করার মোটেই কোনো ইন্টেনশন ছিল না। কেবল ঐশীর সামনে গেলেই কি থেকে যে কি হয়ে যায় তার। তার হাত পা কাপছে। হার্টবিট বেশ বেড়ে গেছে। ওর মনে হচ্ছে সবাই ওর কর্মকান্ড জেনে গেছে। এবার সবাই বিয়েটা ভেঙে দিবে।
এসব ভাবনা চিন্তার মাঝেই ঐশী বাসায় ঢুকে। জয় চোরা নজরে ঐশীর দিকে তাকায় তার হাবভাব বোঝার জন্য। কিন্তু জয় ঐশীর মুখ দেখে কিছুই বুঝতে পারে না। স্বাভাবিকই লাগছে। জয় আবার মাথা নিচু করে নেয়। এরমধ্যেই ঐশীর বাবা ইলোরা ইয়াসমিনের উদ্দেশ্য বলে,
“ বেয়ান সাহেবা এবার ডেটটা ঠিক করলে ভালো হয় না?”
“ জ্বি ভাই। আসলে সামনে আমার মেয়েটারও পরীক্ষা। ওর একমাত্র ভাই। আর তাছাড়া আমাদেরও একটা ব্যবস্থার বিষয় আছে। তাই আমার ইচ্ছা বিয়েটা চার পাঁচ মাস পড়ে হলে ভালো হয়। এখন নাহয় এ্যাঙ্গেজমেন্টটা করে রাখলাম। এরমধ্যে ওরা দুজনও দুজনকে একটু জেনে নিল। কি বলেন ভাই?”
জয়ের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। সে আসার সময়ও তার মা’কে বলেছিল যত তারাতাড়ি সম্ভব তত তারাতাড়ি যেন বিয়ের ডেট ফিক্সড করে। তখন তার মা কেবল হেসেছে। এই ছিল তার মায়ের মনে!? সে ঐশীর রুমের দিকে তাকালো। ঐশী তার রুমের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। জয় তার দিকে তাকাতেই ঐশী মুখে দুষ্টু হাসি নিয়ে জয়ের দিকে তাকিয়ে দুই ভ্রু উঁচু করে ইশারা করে। জয়ের ফেস দেখে মনে হচ্ছে সে কেঁদে দিবে। ঐশীর বেশ মজা লাগছে জয়ের ফেস দেখে।
“ জ্বি আপা তাই ভালো হয়। একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা। একটু আয়োজন তো করতেই হয় বলেন। না হলে লোকে কি বলবে। আর হাতে তেমন টাকা পয়সাও নেই এখন। মাস দুয়েক সময় লাগবে আমার।”
কিন্তু বাদ সাধে ঐশীর মা। তিনি বিয়ে না দিয়ে এ্যাঙ্গেজমেন্ট ট্যাঙ্গেজমেন্টের পক্ষে না। তার সাথে সায় দেন তার বড় বোনও। এই প্রথম জয়ের ঐশীর মায়ের কথা ভালো লাগলো। সে চুপচাপ থাকলেও মনে মনে সেও ঐশীর মায়ের সাথে একমত। একেকজনের একেক কথার মাঝে ইলোরা ইয়াসমিন ঐশীর মায়ের উদ্দেশ্য বলেন,
“ দেখুন আপা। এখনের সময় আর আমাদের সময়ের মাঝে বহু পার্থক্য। যুগ যুগের পার্থক্য। দুটোকে একসাথে করলে তো চলবে না। একটু সময়ের দরকার আছে আপা। আপনাদেরও গোছগাছের একটা বিষয় আছে আর ওদেরও দুজনকে জানা শোনার একটা বিষয় আছে। আমার ছেলের প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। ও নিজের গন্ডি সম্পর্কে জানে। ও কখনো নিজের গন্ডি থেকে বেরোবে না। আর ঐশীকে আমি যতদূর চিনি ও খুবই বুদ্ধিমতী মেয়ে। ও নিজের গন্ডি সম্পর্কে জানে। আমার মনে হয় না আপনি যেটার শংকা করছেন ওমন কিছু হবে।”
মায়ের মুখে গন্ডির কথা শুনে জয় আবারও অনুতপ্ত হয়। সেই তো নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। কিন্তু এখন নিজের মুখে তো আর নিজের বিয়ে আগানোর কথা বলতেও পারে না। দুপক্ষের সবার কথাবার্তা শেষে চারমাস পড়ে বিয়ের তারিখ ঠিক হলো। মোটামুটি সবাই খুশি হলেও বর নিজেই খুশি না। সে মায়ের উপর বেশ অভিমান করেছে। আর অভিমান করেছে দরজায় দাঁড়িয়ে সারাটা সময় দুষ্টু হাসা মেয়েটার উপরও।
#চলবে