সূর্যোদয় #পর্ব_৩৮ #কারিমা_দিলশাদ

0
628

#সূর্যোদয়
#পর্ব_৩৮
#কারিমা_দিলশাদ

সময় তার নিজ গতিতে চলে। সময় যখন চলে যায় আমরা তখন বুঝতেই পারি না। একসময় খেয়াল হয় আর তখন ভাবি এতো তাড়াতাড়ি সময় চলে গেল!

দেখতে দেখতে দু’মাস কেটে গেছে। এরমধ্যে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। ইলোরা ইয়াসমিন আর স্মৃতির সাথে ঐশীর বন্ডিং আরও জোরালো হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই কথা হয় তাদের সাথে। স্মৃতি তো দিনের মধ্যে হাজারবার ফোন করবে, বাসায় কি হয় না হয়, সারাদিন সে কি করে না করে সবকিছু ঐশীকে না বললে তার পেটের ভাত হজমই হয় না। ইলোরা ইয়াসমিনের সাথেও মাখেমধ্যে ঐশীর কথা হয়। কিন্তু তবুও একটা দেয়াল তাদের দুজনের মধ্যে আছে। তবে এটা খারাপ না। কিছু কিছু সম্পর্কে একটা নির্দিষ্ট গন্ডি থাকা প্রয়োজন। সিয়াম, ফয়সাল, নিতু, রুপা এদের সাথেও ঐশীর সম্পর্ক অনেক ভালো। সেদিনের পরেও তাদের সাথে ঐশীর অনেকবার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে কথা হয়েছে।

ওরা কোনো প্রোগ্রাম করলে সেখানে ঐশীর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। মোট কথা জয়ের সাথে জড়িত সব মানুষের সাথে ঐশীর বন্ডিং খুব ভালো। জয়ের জীবনের সাথে জড়িত সবকিছুর সাথে ঐশী পরিচিত। কিন্তু ঐশীর পরিবারের মানুষের সাথে জয়ের বন্ডিং তেমন না।

এই দুইমাসে অনেকবার ঐশীদের বাসায় তার যাওয়া আসা হয়েছে। ঐশীদের বাসায় কোনো প্রোগ্রাম হলে বা কোনো আয়োজন হলেই জয়কে এবং তার পরিবারকে ডাকা হয়। যেমনটা সাধারণত হয়ে থাকে। কিন্তু জয় চেয়েও ঐশীর পরিবারের সাথে সেভাবে ভালো বন্ডিং তৈরি করতে পারে নি। মানুষগুলোর মানসিকতা আর জয় এবং তার পরিবারের মানসিকতা একদমই মিলে না। যতবার জয় ওদের বাসায় গেছে সে বিব্রত আর অকওয়ার্ড পরিস্থিতিতে পড়েছে।

বিশেষ করে ঐশীর বড় খালার দ্বারা। মহিলাটি এমন এমন সব কথা বলে প্রথম প্রথম তার মূর্খামি আর চাপাবাজী দেখে হাসি পেলেও এখন খুব বিরক্ত লাগে। তার মেয়ে কলি স্মৃতির সমবয়সী। এসএসসির পর এখানকার কোনো কলেজে চান্স পায় নি। পরবর্তীতে ঐশীদের গ্রামের বাড়ির একটা কলেজে চান্স হয়। তাই মেয়েকে নিয়ে আবার গ্রামে চলে যায় তিনি। এখন গ্রামেই থাকে। আর তার ছোট ছেলেটা এবার চবিতে চান্স পেয়েছে। পালি ও সংস্কৃত ভাষায়। বাংলাদেশে যদিও সাবজেক্ট ভিত্তিক জব নেই কিন্তু মহিলার যেই গালগল্প বাপরে বাপ!

তার ছেলেকে নাকি এখনই বড় বড় কোম্পানি থেকে চাকরির জন্য ডাকে, বিদেশে যাওয়ার অফার করে হেনতেন কত কি। অথচ সবে পড়ে ফার্স্ট ইয়ারে। আর পালি নিয়ে পড়া স্টুডেন্টকে বড় বড় কোম্পানিতে চাকরি কে দিবে? কিন্তু জয় সবসময় চুপই থাকে। সে মনে করে মূর্খদের সাথে তর্ক করে নিজেকে মূর্খ পরিচয় দেওয়ার কোনো মানে হয় না। তারউপর আবার সে হবু জামাই। তার কিছু বলাটা মোটেই সাজে না।

বলতে নেই তবুও এমন ছোটলোকি কায়কারবার তার পছন্দ নয়। জয় ভেবে পায় না এরকম একটা টক্সিক ফ্যামিলিতে বড় হয়েও ঐশী এতো ভিন্ন হয়েছে কিভাবে। আর বারবার ঐশীর জন্য তার কষ্ট অনুভব করে। এমন একটা পরিবেশে ঐশী থাকে কিভাবে! যদিও জয় সবার সাথে খুবই ভালো, আন্তরিক ও ভদ্র ব্যবহার করে। তার মনে যে তাদের নিয়ে এমন বিরুপ মনোভাব তা কেউ জানে না। সে খুবই স্বাভাবিক ব্যবহার করলেও মনে মনে সে তাদের খুবই অপছন্দ করে।

———————————-

কালকে জয়ের জন্মদিন। জয় খুবই এক্সাইটেড ঐশীর সাথে দেখা হওয়ার পর এটা তার দ্বিতীয় জন্মদিন। প্রথমবার ঐশী এই বিষয়ে অবগত ছিল না এবং তাদের বন্ডিংও খুব একটা ভালো ছিল না। টুকটাক কথা হতো এই আরকি। তার দিক থেকে ভালোবাসা থাকলেও ঐশীর দিক থেকে কিছুই ছিল না। তাই জয় ঐশীর কাছ থেকে কিছু এক্সপেক্ট করে নি। কিন্তু এবার তার আর ঐশীর মাঝে একটা সম্পর্ক আছে। এই দুমাসে তাদের বন্ডিংটাও ভালো হয়েছে। যদিও ঐশীর মনের খোঁজ সে জানে না, বাট ঐশী এখন তারসাথে খুবই ফ্রী ভাবে কথা বলে, ফ্রী ভাবে মেলামেশা করে। তাই সে ঐশীর কাছ থেকে কিছু এক্সপেক্ট করে। বেশি কিছু না সে আশা নিয়ে আছে ঐশী আজকে রাত বারোটায় তাকে উইশ করবে। এর বেশি কিছু না।

কিন্তু রাত বারোটা পার হয়ে গেছে। ওর মা-বোন, ফ্রেন্ড-কলিগ, শুভাকাঙ্ক্ষী সবাই তাকে উইশ করেছে। কিন্তু ঐশী তাকে উইশ তো দূরের কথা একটা মেসেজ বা ফোনও করে নি। উল্টো সে যখন রাতে ফোন করেছিল তখন তার মাথাব্যাথা বলে কেটে দিয়েছিল।

জয়ের মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। বার্থডে নিয়ে কখনো কারো কাছ থেকে তার কোনো এক্সপেক্টেশন কোনদিনই ছিল না। বরং যখন কেউ তাকে বার্থডে উইশ করে সে মনে মনে কিছুটা লজ্জাবোধ করে। এখন বয়স হয়েছে তারজন্য না। অনেক আগে থেকেই সে এসব বার্থডে সেলিব্রেশন পছন্দ করে না। তবে যতদিন বাবা বেঁচে ছিল ততদিন সে বাবার গিফটের জন্য খুব এক্সাইটেড থাকতো। আর প্রতিবছর মায়ের হাতের স্পেশাল রান্না। ব্যস এটুকুই।

কিন্তু এই প্রথমবার সে আরেকজনের কাছ থেকে একটা উইশ আশা করেছিল। পরক্ষণেই জয় ভাবে ঐশীর তো মাথাব্যাথা তাই হয়তো উইশ করতে পারে নি। এটা ভেবে তার মন খারাপ কমে গেলেও সে তখন ঐশীর জন্য চিন্তিত হয়ে উঠে। না জানি মাথাব্যথায় মেয়েটা কতটা কষ্ট পাচ্ছে। ও থাকলে তো ব্যাথা কমানোর জন্য কিছু একটা করতে পারতো। সারারাত জয় ঐশীর চিন্তায় নির্ঘুম রাত পার করে।

———————————-

সকালে জয় ঐশীকে কল দেয়। ওপাশ থেকে ঐশী হ্যালো বলতেই জয় অস্থির কন্ঠে বলে উঠে,

“ তুমি ঠিক আছো? মাথাব্যথা কমেছে?”

“ হ্যা কমে গেছে। কি করছেন আপনি?”

“ কিছু না রেডি হবো এখন। তারপর হসপিটালে যাব।”

“ ওহহ আচ্ছা ঠিক আছে। যান তাহলে। আমিও বের হবো এখন।”

“ ঐশী?”

“ জ্বি।”

“ আজ কয় তারিখ?”

“ আজ? আজ….. ১২ তারিখ। কেন?”

“ না এমনেই জিজ্ঞেস করলাম। আজ কি কোনো স্পেশাল দিন?”

“ কই না তো। কি হয়েছে বলুন তো?” – ঐশীর এমন নির্লিপ্ত জবাবে জয়ের মন খারাপ হয়ে যায়। সে ভেবেছিল ঐশী এখন তাকে উইশ করবে। কিন্তু ঐশীর কথায় মনে হচ্ছে সে জানেই না কিছু। জয়ের অভিমান হয়। সে গম্ভীর কন্ঠে কথা শেষ করে কল কে’টে দেয়।

রুম থেকে বের হতেই তার মা তার কাছে এসে কপালে চুমু খায়। জয় মায়ের আদরটা লুফে নেয়। প্রতিবছর এইদিনে মা তার পছন্দের সব রান্না করে। যদিও জয় এখন না করে, মায়ের বয়স হয়েছে এখন এত ঝক্কি ঝামেলা না করতে বলে। তবে তার মা তা আমলে নেয় না। কিছুক্ষণ মায়ের সাথে আহ্লাদ করে বোনের সাথে খুনসুটি করে। রেডি হয়ে হাসপাতালে চলে যায়। কিন্তু তার মন খারাপ ভাব কাটে না। মন খারাপ নিয়েই সারাটাদিন হাসপাতালে কাটায় জয়।

বিকাল হয়ে গেছে। এখনও রোগী দেখছে জয়। এমন সময় কল আসে জয়ের ফোনে। স্ক্রিনে ‘প্রেয়সী’ নামটা ভাসছে। তারমানে ঐশী কল দিয়েছে। জয় বেশ অবাক হয়। ঐশী সাধারণত এসময় কল দেয় না। রোগীকে সামনে রেখে জয় কখনো কল রিসিভ করে না। তাই কলটা কেটে দেয়। একটুপর আবার কল আসলে জয় সাইলেন্ট করে রাখে। রোগী বেরিয়ে যেতেই জয় কল ব্যাক করে ঐশীকে। কল রিসিভ করে জয়ের কলিজায় ফেটে যাওয়ার উপক্রম।

তার ঐশী কাঁদছে। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। কেন কাঁদছে তা জানে না জয়। ফোনে ঐশীর কান্না শুনেই জয়ের ভিতরটা শুকিয়ে যায়। ঐশী কাঁদতে কাঁদতে কোনোরকমে জয়কে নৃত্যশৈলিতে আসতে বলে, সে খুব কষ্ট পাচ্ছে।

———————————-

এতটা রাস্তা জয় কিভাবে এসেছে সে জানে না। সারাটা রাস্তা জয়ের ভিতর এক অজানা ভয় কাজ করেছে। ঐশী খুবই শক্ত ধরনের মেয়ে। সেই মেয়ে যাকে সে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। সে হয়তো কখনো ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না ঐশী জয়ের কাছে কি। সেই মেয়েটা এভাবে কান্না করছে। তার ভিতরে কি ঝড় বইছে তা সে কিভাবে বুঝাবে। এমনেতেই জয় সারাটাক্ষন ঐশীকে নিয়ে চিন্তায় থাকে। ঐশী তার ফ্যামিলি নিয়ে খুবই ডিপ্রেসড। ঐশীর যে ফ্যামিলি পরিস্থিতি তাতে যখন তখন যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। সে যতই শক্ত হোক সে আফটার অল ঐশী তার পরিবারকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। সারাটা রাস্তা জয় মর্মে ম*রেছে।

নৃত্যশৈলির সামনে এসে জয় কোনোরকমে বাইক দাঁড় করিয়ে ভিতরে চলে যায়। গিয়ে চিৎকার করে ঐশীর নাম ধরে ডাকতে থাকে। কিন্তু ঐশীর কোনো সারা শব্দ নেই। প্রতিটা রুম, বাথরুম, কিচেন পুরো বাসা খুঁজেও ঐশীকে পায় না। জয় মাথার চুলগুলো পেছন দিকে টেনে ধরে। গেট খোলা দরজা খোলা কিন্তু তার ঐশী নেই। কোথাও নেই। কোথায় গেল তার ঐশী? কোথায় খুজঁবে সে তাকে?

#চলবে

( কপি করা নিষেধ।)

[ গল্পটা আপনাদের কেমন লাগছে? গল্প সম্পর্কে আপনাদের মতামত প্রকাশ করুন। ভালো খারাপ যেটাই আপনাদের মনে আছে তা প্রকাশ করুন। আমি নতুন নতুন লিখছি। আপনারা যদি আপনাদের মনের ভাব প্রকাশ না করেন, ভুলত্রুটিগুলো ধরিয়ে না দেন তাহলে তো আমি লেখায় উন্নতি করতে পারব না।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here