#সূর্যোদয়
#পর্ব_৮
#কারিমা_দিলশাদ
ইলোরা ইয়াসমিন বেশ তাড়াহুড়ো করে নাস্তাগুলো ডাইনিং টেবিলে নিয়ে রাখছেন। তার লেইট হয়ে যাচ্ছে। আজকে একটা স্পেশাল ক্লাস আছে তার। ওদিকে স্মৃতির কলেজেও আজ ফাংশন আছে। ছেলেমেয়েকে খায়িয়ে রেখে তিনি যাবেন।
“জয়, স্মৃতি হলো তোদের? নাস্তা রেডি। তাড়াতাড়ি আয় বাবা, আমার লেইট হয়ে যাচ্ছে। তোদের খাওয়া হলে আমি বের হবো। বাস এসে পড়বে এক্ষুনি।”
মায়ের ডাকে হাসপাতালের জন্য একবারে রেডি হয়ে আসে জয়। ডাইনিং টেবিলে বসতে বসতে মায়ের উদ্দেশ্য বলে,
“ আমারও আজ জলদি জলদি হাসপাতালে যেতে হবে। এরমধ্যে আবার তোমার রাজকুমারিকে তার কলেজে দিয়ে আসতে হবে। যত্তসব।”- বলেই খাওয়া শুরু করে জয়। খেতে খেতেই আবার বলে,
“ তা তোমার রাজকুমারি কই? কত আর আটা ময়দা সুজি মাখবে। আমারও তো বের হতে হবে বলো।”
জয়ের কথার মাঝেই স্মৃতি তৈরি হয়ে আসে। ভাইয়ের কথা শুনেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায় তার। ভাইয়ের হাতে চিমটি কে’টে বলে,
“ একদম আমার মেকআপ নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলবি না বলে দিলাম।”
চি’মটি খেয়ে উহহ্ করে চি’মটি দেওয়া জায়গায় ডলতে শুরু করে জয়। স্মৃতির দিকে তাকিয়ে দেখে বোন তার মেকআপ দিয়ে সেজেগুজে তৈরি। জয় কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ আম্মু কালকে থেকে রুটি বানাবে কি দিয়ে? তোমার মেয়ে তো সব আটা তার মুখেই লাগিয়ে ফেলেছে!!”-একথা শুনতেই স্মৃতি মা বলে চিৎকার দেয়।
ইলোরা ইয়াসমিন এতোক্ষণ ছেলে মেয়ের কথায় চুপচাপ ছিলেন। তবে এবার তিনি জয়ের দিকে রে*গে তাকিয়ে খেতে বলেন। আর স্মৃতিকে খাবার দিয়ে নিজেও খেতে বসেন।
খেতেই খেতেই জয় তার মা’র উদ্দেশ্য বলে,
“ মা তোমার মেয়ে অনুষ্ঠানে যাচ্ছে না বিয়ে করতে যাচ্ছে? যে সাজা সেজেছে।”
“ ভাইয়া……” জয়ের কথায় স্মৃতি তার বিরক্তি প্রকাশ করে।
এবার ইলোরা ইয়াসমিন বলেন,
“ জয় এবার কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে। আমার বাস এসে পড়েছে এবার আমাকে যেতে হবে। দুজনে খেয়ে ভালো করে দরজা লক করে সাবধানে বোনকে নামিয়ে দিয়ে নিজেও যাবে। সাবধানে। আমি আসছি। আল্লাহ হাফেজ।”
জয় এবার নিজের খাওয়া শেষ করে। স্মৃতির মাথায় চাটি মে*রে বলে,
“ তাড়াতাড়ি খা। আমার লেইট হয়ে যাচ্ছে।”
“ ধ্যাত! ভাইয়া…..”
একটুপরে দুই ভাইবোন বের হয়ে যায় কলেজের উদ্দেশ্য।
——————
জয় স্মৃতিকে নিয়ে কলেজে পৌঁছে ওকে নিয়ে অডিটোরিয়াম হলে ঢুকে। স্মৃতিকে তার ফ্রেন্ডদের কাছে দিয়ে ভালো করে এবং সাবধানে থাকতে বলে যেই বের হবে তখনই তার একটা মেয়ের দিকে নজর যায়।
সাদা শাড়িতে কালো পাড়ের হালকা কাজ করা, পিঠ জুড়ে হালকা কোঁকড়ানো খোলা চুল, কানে ঝুমকো আর মুখে মিষ্টি হাসি। মেয়েটা ঐশী। সে এক মেয়ের চুল ঠিক করতে ব্যস্ত। মুখে একটা কালো ক্লিপ নিয়ে সেটা খুলে মেয়েটার চুলে লাগিয়ে দিচ্ছে গভীর মনযোগ দিয়ে।
জয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। অনেকদিন পর দেখলো মেয়েটাকে। চার মাস। সে এখন ঐশীর সাথে কথা বলবে কিনা এই দ্বিধাদ্বন্দে আছে। একসময় গুটি গুটি পায়ে ঐশীর পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। এবং গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
“ হাই ঐশী।”
ঐশী তারকাজে ব্যস্ত ছিল। অনুষ্ঠান এখনি শুরু হয়ে যাবে। এদিকে আসতেও তার অনেক লেইট হয়ে গেছে। তাও ভালো তার ফ্রেন্ডরা এদিকে সব সামাল দিচ্ছিল। তার ফ্রেন্ডরা না থাকলে তার খুবই ঝামেলায় পড়তে হতো। এমতাবস্থায় কারো ডাকে তার দিকে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে যায়। ডা. জয়।
ঐশীর চোখেমুখে অবাকের ছাপ স্পষ্ট। সে অবাক হয়ে বলে,
“ ও মাই গড! ডাক্তার সাহেব যে! আপনি এখানে?”
জয় একটু মুচকি হেসে মাথা চুলকে বলে,
“ যাক মনে আছে তাহলে।”
“ অফকোর্স। মনে থাকবে না কেন?”
“ আসলে আমার বোনকে নিয়ে এসেছিলাম। ও এখানেই পড়ে। ওদেরই নবীনবরণ হচ্ছে। তা আপনি অনুষ্ঠান দেখতে এসছেন বুঝি?”
“ ওমম…. দেখতেও এসেছি আবার কাজেও এসেছি। আসলে আমার স্টুডেন্টদের একটা পারফরম্যান্স আছে আজকে এখানে।”-ঐশী হাসিমুখে বললো।
স্টুডেন্ট শুনে কিছুটা কনফিউশান ও জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে বলে,
“ স্টুডেন্ট?! ”
জয়ের লুক দেখে ঐশী এবারও হাসিমুখে বলে,
“ আমম, আসলে আমি একটা ছোট ডান্স ক্লাস শুরু করেছি। ওরা সেখানকারই স্টুডেন্ট।”-বলতে না বলতেই ঐশীকে তার এক স্টুডেন্ট ডাক দেওয়ায় সে জয়কে বলে,
“ প্লিজ এক্সকিউজ মি। জাস্ট এ মিনিট?”
“ ইয়াহ সিওর সিওর। ”
ঐশী এবার দৌড়ে চলে যায়। আর জয় তাকিয়ে থাকে ঐশীর দিকে। হালকা পাতলা গড়নের, শ্যামবর্ণের সাধারণ উচ্ছল একটা মেয়ে। বাট কথাবার্তায় চাল চলনে কিছু একটা তো আছে যা এই সাধারণ মেয়েটাকে অসাধারণ করে তুলে। এই যে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছে আবার মেয়েদের কিছু ডান্স স্টেপ শিখিয়ে দিচ্ছে এগুলো দেখতে তার ভালো লাগছে। ওদিকে যে তার জরুরি মিটিং ছিল সেটা সে বেমালুম ভুলে গেছে।
এরমধ্যেই আবার ঐশী তার সামনে এসে পড়েছে। আর এসে দুঃখীত ভঙ্গিতে বলে,
“ সরি সরি। আসলে একটু ব্যস্ততায় আছি তো। সরি।”
“ ইটস ওকে। আমি বুঝতে পারছি। তা বেশ আছেন তাহলে? নিউ স্টার্টিং!”
জয়ের কথায় ঐশীর ভেতর থেকে না চাইতেও ছোট্ট একটা শ্বাস বেরিয়ে এলেও মুখের হাসিটা বজায় রেখে বললো,
“ হ্যা। ভালো থাকতে হলে কিছু না কিছু তো করতে হবেই তাই শুরু করে দিলাম। এখন মোটামুটি কাটছাঁট করে বেশ দারুণ আছি আমি। আপনার কি খবর?”
“ আমিও আছি আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর রহমতে আর আপনার দোয়ায় বেশ ভালো আছি।” -বলতেই দুজনে হেসে ফেলে।
“ ঐশী….”- জয়ের কথার মাঝখানেই এক ছেলে এসে ঐশীকে তাড়া দেয়।
“ ওই ছেরি তাড়াতাড়ি আয়, উদ্বোধনী নৃত্য এহনই শুরু হবো।”
“ ওওহ আচ্ছা দাঁড়া। ডাক্তার সাহেব ও হচ্ছে আমার ফ্রেন্ড অনিক। আর অনিক ইনি হচ্ছে জয়। ডা. জয়।”
অনিক ঐশীর কথায় বোঝার চেষ্টা করছে কে এই সামনের দাঁড়ানো ব্যক্তি ঐশী ভ্রু উঁচিয়ে কিছু ইশারা করতেই অনিক বলে উঠে,
“ ওওওও ডাক্তার!! আরে ওই যে তোর ডাক্তার?? আগে কইবি না।”
ঐশী কিছু বলবে তার আগেই অনিক তার বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে জয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,
“ হ্যালো ঐশীর ডাক্তার…. আমি অনিক। ঐশীর ফ্রেন্ড। ”
জয়ও হেসে তার হাত বাড়িয়ে দেয়।
“ হ্যালো অনিক। নাইস টু মিট ইউ।”
অনিক এবার ঐশীর উদ্দেশ্য বলে,
“ দাঁড়া আমি সবাইরে নিয়া আইতাছি।”
অনিক আরও কিছু বলার আগেই ঐশী অনিক শার্টটা পিছন থেকে ধরে ফেলে। অনিক পিছনে ঘুরতেই ঐশী অনিকের দিকে চোখ বড় বড় করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“ পরে দেখা করবে হ্যা। এখন নাচ শুরু হয়ে যাবে তো। পরে দেখা করবে বাকিরা।”
এরপর জয়ের দিকে তাকানোর আগেই মুখ স্বাভাবিক করে বলে,
“ আসলে এখন নাচ শুরু হয়ে যাবে তো। আপনি আসুন না, ভিতরে গিয়ে বসুন প্লিজ।” বলেই অনিকের দিকে এমন ভাবে তাকায় যাতে অনিক বুঝে যায় আজকে তার কপালে বহুত দুঃখ আছে। ভেবেই অনিক জোরপূর্বক একটা হাসি দেয়।
এরপর তিনজনেই অডিটোরিয়ামের দিকে যায়। অনিক জয়কে কর্ণারের একটা সীটে বসার জায়গা করে দেয়। যা দরজার পাশে। আর ঐশী তার স্টুডেন্টের কাছে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলতে থাকে। তাদের ডাকা হলে তারা মঞ্চে উঠে যায়। নাচ শুরু হতেই ঐশী ভালো করে দেখার জন্য দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তার সাথে তার ফ্রেন্ডরাও গিয়ে দাঁড়ায়।
নাচ সুষ্ঠুভাবে শেষ হতেই ঐশীর মুখে হাসি যেন ধরে না। কারণ টিমটার মধ্যে অনেকেই কস্টিউমস পড়ে নাচতে একদমই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। স্টেজে উঠার আগ পর্যন্তও শাড়ি খুলে যাবে খুলে যাবে বলে নিজেরাও ভয় পেয়েছে সাথে ঐশীকেও ভয় পাইয়েছে। আর এই অনুষ্ঠানে কোনো গড়বড় হলে তার মানসম্মান একদম থাকতো না। কারণ এই পারফরম্যান্স ভালো হলে কলেজের স্যার ম্যাডামদের কাছে তার একটা সুনাম থাকবে। যা তাকে আরও কিছু করার সুযোগ করে দিবে। আর পারফরম্যান্স ভালো হওয়ায় তার এখন শান্তি লাগছে। এতক্ষণ বেশ টেনশনে ছিল।
আর এদিকে জয় নাচ কম ঐশীকেই দেখেছে বেশি। মেয়েটার যে এই গুণও আছে তা তার একদম জানা ছিল না। আর মেয়েটার হাসিটা তো মারাত্মক। তার ভাবনার মাঝেই মেয়েরা নিচে নেমে আসে আর ঐশী তাদের নিয়ে বাইরে চলে যায়। ঐশী চলে যেতেই জয়ও সেখান থেকে উঠে পড়ে আর ঐশীর পিছু নেই। ঐশীর কাছে যাওয়ার আগেই তার সামনে স্মৃতি এসে পড়ে।
স্মৃতি তো তার ভাইকে এখনো এখানে দেখেই অবাক। সে বলে,
” ভাইয়া তুই এখনো এখানে কি করছিস? তোর না কি ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে? ”
এতোক্ষণে জয়ের হুশ আসে। সে তো ভুলেই গেছিল তার আজকে একটা মিটিং আছে। সে তাড়াতাড়ি পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখে হাসপাতাল থেকে অনেকগুলো ফোনকল আর মেসেজেস এসছে। তার মাথায় হাত।
“ শী’ট! শী’ট, শী’ট, শী’ট। গল্পের ধান্দায় পড়ে একদম ভুলে গেছি। শী’ট। তুই যা আমি আসছি।”-বলে ঐশীর দিকে একবার দেখে নেয় যে এখন বন্ধু এবং স্টুডেন্টদের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। কথা বলতে চেয়েও ঐশীকে আর ডিস্টার্ব না করে পরে কথা বলবে ভেবে চলে যায় দ্রুত।
স্মৃতি কিছুক্ষণ ভাইয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেও ফ্রেন্ডসদের কাছে চলে যায়। যা হলো তা তার মাথার উপর দিয়ে গেল। আর যাইহোক ভাইয়া তার প্রফেশনে খুব আন্তরিক। সে তাকে নামিয়ে দেওয়ার পরও এতক্ষণ এখানে কি করলো তা তার বুঝার বাইরে। তবে স্মৃডি সেদিকে অতো মাথা ঘামালো না সে তার ফ্রেন্ডদের কাছে চলে যায়।
#চলবে……….
( কার্টেসী ব্যতিত কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ। কেউ কপি করবেন না৷ তবে শেয়ার করতে পারেন।)