সেই তুমি? পর্ব -১০

0
3167

সেই তুমি?
পর্ব -১০
Samira Afrin Samia(nipa)

সালেহা বেগমের অনেক চিন্তা হচ্ছে। এতো না করার পর ও ইশিতা তার মামীর কথা না শুনে সেই সকালে ভার্সিটি গেছে। এখন তো সন্ধ্যা হয়ে যাবে প্রায় এখনও ইশিতা বাড়ি ফিরেনি। কোথায় গেলো মেয়েটা আবার। ভার্সিটি থেকে আসতে এতো দেরি হচ্ছে কেন? কখনও তো এতো দেরি করে না ইশিতা তাহলে আর কেন এতো সময় পার হওয়ার পর ও বাড়ি ফিরছে না।
এসব ঘটনা হওয়ার পর ইশিতা ভার্সিটিতে থেকে বের হয়ে আসে। ইশিতা কাঁদতে কাঁদতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কয়টা বাাজে কখন বাড়ি থেকে বের হয়েছে এসব কিছুর খেয়াল নেই ইশিতার। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। এতক্ষণ বাইরে থাকায় বাড়ি না যাওয়ায় মামা মামী চিন্তা করছে এটা ইশিতার মাথায় আসছে না।
ওই দিন রিহার কথা বিশ্বাস করে যদি ইফানের গায়ে হাত না তুলতো ইফান কে অবিশ্বাস না করতো তাহলে আজ এসব কিছুই হতো না। ইশিতা নিজে নিজেকে দোষ দিচ্ছে।
— সব কিছু আমার জন্য হয়েছে। আমি নিজের ভালোবাসার মানুষ কে বিশ্বাস না করে রিহা কে বিশ্বাস করেছি। রিহার কথা শুনে না জেনে ইফান কে কষ্ট দিয়েছি। ইফান কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সবার সামনে অপমান করেছি। ভালোবাসার উপর বিশ্বাস না রাখার শাস্তি তো আমাকে পেতেই হবে।

হঠাৎ করে কেউ গাড়ির সামনে চলে আসায় খুব দ্রুত গাড়ি ব্রেক করতে গিয়ে নিজের তাল সামলাতে না পেরে সামনের দিকে ঝুঁকে যায় ইয়াশ যার কারনে মাথায় হালকা লেগে যায়। আর একটু রক্ত ও বের হয়। এভাবে আচমকা কে গাড়ির সামনে আসলো তা দেখার জন্য গাড়ি থেকে নেমে যায় ইয়াশ। ইয়াশ সামনে গিয়ে দেখে একটা মেয়ে শক্ত করে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে।ইয়াশ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। এতো মায়াবী চেহারা থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না ইয়াশ। হালকা বেগুনী রঙের লং জামা পড়া। একদম কোনো সাজ গোজ ছাড়া যে একটা মেয়েকে এতো টা সুন্দর এতো টা মায়াবী লাগতে পারে তা ইয়াশের জানা ছিল না। আজকের আগে ইয়াশ অনেক মেয়েকেই দেখেছে তবে ইশিতার মত আর কাউকে এতো ভালো লাগে নি। ইয়াশ কিছুক্ষণ ইশিতার দিকে তাকিয়ে থেকে তার পর বলতে লাগলো
— এই যে, কে আপনি?
ইশিতা এতক্ষণ চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ করে এভাবে গাড়ির সামনে এসে ও সে বেঁচে যাবে এটা ইশিতা ভাবতে পারছে না। ইশিতা তো জেনে বুঝেই গাড়ির সামনে এসে ছিল। পরেও ওর কিছু হলো না উল্টো গাড়ির লোকটার ই হ্মতি হলো। ওই লোকটা ই ব্যথা পেল। ইশিতা ভাবছে এখন হয়ত ইয়াশ এসে ওকে অনেক কথা শুনাবে এভাবে হঠাৎ গাড়ির সামনে আসার জন্য।
— এভাবে হঠাৎ করে কোথা থেকে গাড়ির সামনে এসে গেলেন আর একটু হলেই তো আপনার লেগে যেত।
ইশিতা কিছু বলছে না। ইশিতা কে কিছু বলছে না দেখে ইয়াশ আবার বললো
— ভয় পেয়েছেন কি?
ইশিতা মাথা নাড়িয়ে না বললো
— এই সন্ধ্যা বেলায় আপনি একা একা কোথায় যাচ্ছেন? আর রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় চার পাশ টা একটু ভালো করে দেখে নিবেন তো। এক্সিডেন্ট হয়ে গেল কেমন হতো।
ইয়াশ ইশিতা কে দেখে বুঝতে পারছে ইশিতার কিছু একটা হয়েছে। চোখ ফোলা ও লাল হয়ে আছে। নাকের ডগা আর গাল দুটো লাল হয়ে আছে। কথা গুলো ও একটু বেঁজে আসছে।
ইয়াশ আর ইশিতা কে কিছু জিঙ্গেস করলো না।
— আপনি কোথায় যাবেন আমাকে বলেন আমি আপনাকে ড্রব করে দিব।
ইশিতা একদৃষ্টিতে ইয়াশের দিকে তাকিয়ে দেখছে। ইশিতা এভাবে ইয়াশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে। ইয়াশ একটু মুচকি হেসে বললো।
— এভাবে কি দেখছেন?
ইশিতা ইয়াশের এ কথায় একটু লজ্জা পেয়ে গেল। ইশিতা ইয়াশের দিক থেকে চোখ নামিয়ে মাথা নিচু করে নিলো।
— আচ্ছা এবার গাড়িতে উঠে বসেন। অন্ধকার নেমে এসেছে। আপনি একা যেতে পারবেন না।
ইশিতা কিছুক্ষন কি যেন ভেবে। কিছু না বলে ইয়াশের গাড়িতে গিয়ে বসে। ইয়াশ কার ড্রাইভ করছে আর মাঝে মাঝে আড় চোখে তাকিয়ে ইশিতা কে দেখছে। একটা অচেনা অজানা মেয়ের জন্য হঠাৎ করে ইয়াশ এতো টা মায়া অনুভব করছে কেন? ইয়াশ তো আজকের আগে কখনও ইশিতা কে দেখেনি। তাহলে কেন এতো টান ইশিতার প্রতি?
ইয়াশ ইশিতা কে ওর বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলে ইশিতা বাড়ির ভেতর আসে। ইশিতার মামী ইশিতা কে দেখে দৌঁড়ে ইশিতার কাছে আসে।
— সারাটা দিন কোথায় ছিলি তুই? এ কি অবস্থা করেছিস নিজের। কতো চিন্তা করেছি তোর জন্য। তুই কি আমাদের কে একটু ও শান্তি দিবি না। তোর জন্য কি আমরা শান্তিতে বাঁচতে পারবো না?
ইশিতা তার মামী কে ধরে কাঁদতে লাগলো
— মামী আমি বাবা মা’র সাথে কেন মারা গেলাম না। বাবা মা আমাকে একা রেখে কেন চলে গেল। আমাকে কেন নিজেদের সাথে নিয়ে গেল না?
ইশিতার মুখে এমন কথা শুনে মামীর মন ঘলে শক্ত বরফ থেকে পানি হয়ে গেল। সারা দিনের জমানো সব রাগ গুলো মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে গেল।
— কেন রে মা এমন কথা বলছিস কেন?
আমরা কি তোকে ভালোবাসি না?
— তোমাদের ভালোবাসার জোরেই তো আমি আজও বেঁচে আছি। নাহলে তো আমি কবে ই বাবা মা’র কাছে চলে যেতাম। তোমরা আমাকে এতো ভালোবাসা দিয়ে বড় করে তুলেছো। তার বদলে কি পেয়েছো তোমরা?
আমি তো আমাদের কে কিছুই দিতে পারলাম না।
— এভাবে বলিস না মা। আমরা তোর থেকে কি ই বা চাইবো। আমরা তোর থেকে কিছু চাই না। তুই শুধু সুখে থাক এটাই আমাদের চাওয়া।সালেহা বেগম ও আজিম সাহেব ইশিতার মুখ থেকে সব টা শুনার পর এই সিদ্ধান্ত নিলো যে আজিম সাহেব ইফানের সাথে কথা বলতে যাবে। যেভাবেই হোক ইফানের ভুল টা ভাঙ্গিয়ে দিবে। একটা ভুল বুঝাবুঝির জন্য এভাবে দুইটা জীবন নষ্ট হতে পারে না। ইফান সামান্য একটা ভুল ধারণা নিজের মনে পোষে, রেখে ইশিতার সাথে এতো বড় অন্যায় করতে পারে না। কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে একটা মেয়ে কখনও ই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারে না। নারীদের কাছে যে ওদের সন্মান টা ই সবচেয়ে বড়। নিজের সন্মান হারিয়ে সমাজে কিভাবে মাথা তুলে বাঁচবে ইশিতা?

পরের দিন কথা মত ইশিতার মামা আজিম সাহেব ইফানের সাথে দেখা করার জন্য ইফানদের বাড়িতে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত সেখানে গিয়ে ইফান কে বাড়িতে পায়নি। ইফানের মা নাজমা চৌধুরী আজিম সাহেবের সাথে খুব ভালো ব্যবহার করেন ও আজিম সাহেবের কাছে জানতে চান কেন উনি ইফান কে খুঁজছেন। কিন্ত আজিম সাহেব উনাকে কিছুই জানালেন না।

কয়েক দিন যাওয়ার ওর ইশিতার বাড়ি থেকে বের হওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। এলাকার সবাই এখন ইশিতা কে নিয়ে নানা কথা বলে বেড়াচ্ছেন। এমনকি ইশিতার মামা মামী কে ও কোনো ভাবে কথা শুনানো থেকে বিরত থাকছেন না। ইশিতা ও ওর মামা মামী কে অপমান করার কোনো সুযোগ ই কেউ হাত ছাড়া করছে না। এখন তো ইশিতার শ্বাস নেওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে।

এর মাঝেই একদিন আজিম সাহেব ইফানের সাথে দেখা করে সব কিছু বুঝাতে চায়। কিন্তু ইফান তার প্রতিশোধের খেয়ালে নিজেকে এতোটাই মগ্ন রেখেছে যার কারনে সে সত্যি টা বুঝতে পারলো না। আর বুঝার চেষ্টা ও করলো না। ইফান আজিম সাহেবের কোনো কথা মাথায় না নিয়ে উল্টো আজিম সাহেব কে অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।
কোন পথ দেখতে না পেয়ে আজিম সাহেব ও সালেহা বেগম ইশিতা কে বাচ্চা টা না করে দেওয়ার জন্য জোর দিতে শুরু করে। ইশিতা ও নিজেদের কথা চিন্তা করে উনারা বাচ্চা টা নষ্ট করে দেওয়ার জন্য নানা ভাবে ইশিতার উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। এখন উনাদের কাছে এছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।
— ইশিতা মা তুই তোর মামার মুখের দিকে তাকিয়ে এ পাপ কাজ টা কর মা। আমাদের কাছে এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
— মামী তুমি নিজে একজন মেয়ে, একজন মা হয়ে আমার কাছে এমন একটা অন্যায় আবদার করছো?
— আমি একজন মেয়ে বলেই তোকে বলছি। আমরা যে সমাজে বাস করি এখানে একটা অবিবাহিত মেয়ের মা হওয়াকে কেউ মেনে নিবে না। আর তোর এই সন্তান দুনিয়ায় আসলে কোন পরিচয়ে বড় হবে? বাবার পরিচয় ছায়া ও কি করে এ পৃথিবীতে আসবে?
তুই কি একা ওকে মানুষ করতে পারবি?
— আমি আমার সন্তানের জন্য সব করতে পারবো। আমি সবার সাথে লড়ে ওকে একা ই মানুষ করে তুলবো। আর ইফান তো একদিন ওর ভুল বুঝতে পারবে। তখন তো ও আমাকে আর আমাদের বাচ্চা কে মেনে নিবে। এখন ও সত্যি টা জানে না রিহার প্লেন বুঝতে পারছে না কিন্তু যেদিন ও সব সত্যি জানতে পারবে তখন তো আমার কাছেই ফিরে আসবে। তখন যদি ওর বাচ্চার জন্য আমাকে দোষী করে।
— এমন কিছুই হবে না। ইফান ওর ভুল বুঝতে বুঝতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তোর মামা ইফানের সাথে কথা বলতে গেছিল।
— মামা ইফানরে সাথে কথা বলতে গেছিল?
কবে, তোমরা তো আমাকে কিছুই জানাও নি। ইফান কি বলেছে?
— ইফান তোর মামার কোনো কথা না শুনে তোর মামা কে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে।
তুই একটা বার আমাদের কথা চিন্তা কর মা। একবার তোর ছোট দুইটা বোনের কথা চিন্তা কর। ওদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তুই এই বাচ্চা টা নষ্ট করে ফেল। তোর কাছে এটা আমার শেষ অনুরোধ।

সপ্তাহ খানেক পরে
ইশিতা হসপিটালের বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে। একটু পরে ভেতর থেকে ওকে ডাকা হবে। আজ ই ডক্টরের সাথে কথা বলে বাচ্চা টা নষ্ট করে ফেলবে। মামী ইশিতার পাশে বসে আছে। মামা ভিতরে ডক্টরের সাথে কথা বলছে। এতো কিছুর পরেও ইশিতা বাচ্চা টা কে পৃথিবীতে আনতে পারবে না। ইশিতা একা একা এ সমাজের মানুষ গুলোর সাথে লড়াই করে পেড়ে উঠলো না। ইফানের প্রতি ইশিতার প্রচুর রাগ হচ্ছে। ইফান প্রতিশোধ নেওয়ায় এতো টা ই ব্যস্ত সে কিছু দেখতে,বুঝতে পারছে না। এজন্য ইশিতা ইফান কে কখনও ই হ্মমা করবে না।

ডক্টর ইশিতা কে দেখে কিছু টেস্ট ও চেকআপ করে। রিপোর্ট দেখে রিপোর্টের উপর নির্ভর করে দুই দিন পর অপারেশনের ডেট দিলো। ইশিতার প্রেগন্যান্সির এখনও দুই মাস পূর্ণ হয়নি যার কারনে এখন এ্যাবরেশন করলেও ইশিতার ততটা সমস্যা হবে না।

ইশিতা কে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো। আর কিছুক্ষণ পর ই অপারেশন করা হবে। ইশিতা আলতো করে তার পেটের উপর হাত বুলাচ্ছে আর নিরবে চোখের পানি ফেলছে। এখন আর কিছু করার নেই ইশিতার। সে কোনো ভাবেই তার বাচ্চা কে বাঁচাতে পারবে না।
একটু পর একজন নার্স এসে ইশিতা কে তার ক্যাবিনে যেতে বললো।
— মিস ইশিতা আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে।
— আমার সাথে?
— হুম। উনি আপনার ক্যাবিনে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।
ইশিতা নার্সের সাথে গিয়ে দেখে সত্যি ই একটা লোক তার সাথে দেখা করতে এসেছে। লোকটা উল্টো দিকে মুখ করে তাড়িয়ে থাকায় ইশিতা উনাকে দেখতে পারছে না। কে এই লোকটা? আমার সাথে কেন দেখা করতে আসছে। আমাকে আগে থেকে চিনে নাকি ইফান ওকে পাঠিয়েছে এমন অনেক প্রশ্ন ইশিতার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। ইশিতার মনে হচ্ছে ইফান উনাকে পাঠিয়েছে ইফান হয়ত ওর বাচ্চার জন্য ওকে মেনে নিবে এটা ভেবেই ইশিতার খুশীর সীমা মানছে না।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here