সেই তুমি? পর্ব -১৭

0
2710

সেই তুমি?
পর্ব -১৭
Samira Afrin Samia(Nipa)

ইয়াশ বাইরে থেকে ইশিতার কান্নার শব্দ পেল। ইয়াশ বুঝতে পারছে ইশিতা ওয়াশরুমে গিয়ে কাঁদছে। ইশিতা কাঁদছে এটা বুঝার সাথে সাথে ইয়াশ ওয়াশরুমের সামনে গিয়ে দরজা ধাক্কাতে লাগলো।
— ইশিতা,, ইশিতা বের হও।
ইশিতা তাড়াতাড়ি দু মিনিটে ভেতরে বের হও বলছি।
ইশিতা বাইরে থেকে ইয়াশের ডাক শুনতে পেয়ে খুব কষ্টে কান্না থামিয়ে আবার চোখে মুখে পানি দিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে।
— কি হলো ওয়াশরুমে গিয়ে দরজা লক করে কাঁদছিলে কেন?
— কই কাঁদছিলাম না তো।
— কাঁদছিলে না?
তাহলে কি আমি এমনি এমনি কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম?
ইশিতা কান্না আর চেপে রাখতে না পেরে ইয়াশের সামনে ই কাঁদতে লাগলো।
ইয়াশ ইশিতা কে কাঁদতে দেখে ইশিতার কাছে এসে আলতো করে ওর হাত ধরে
— এই মেয়ে এভাবে কাঁদছো কেন? আমি আছি না তোমার সাথে। তুমি কারো কথা কানে নিবে না। যে যাই বলুক না কেন আমি সব সময় তোমার পাশে থাকবো।
ইশিতা মাথা নিচু করে কেঁদেই যাচ্ছে
— আমার দিকে তাকাও। আর কান্না থামাও। শুধু শুধু লোকের কথা শুনে তুমি কেন তোমার চোখের পানি ফেলবে?
কি হলো বললাম না আমার দিকে তাকাতে।
ইশিতা ইয়াশের দিকে তাকিয়ে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলো
— আপনি কেন আমাকে বিয়ে করলেন?
আপনার ভাইয়ের পাপ আপনি কেন নিজের কাঁধে নিলেন? এখন তো সবাই আমার সাথে সাথে আপনাকেও কথা শুনাবে। আমি দোষ করেছি তাই আমাকে বাজে কথা শুনালে আমি তা মেনে নিতে পারবো। কিন্তু বিনা দোষে কেউ আপনাকে আমার জন্য কথা শুনালে আমি তা মেনে নিতে পারবো না।
আপনি আমাকে আমার মত একা ছেড়ে দিতেন। যেমনটা ইফান দিয়েছে।
ইয়াশ ইশিতার মুখে আঙ্গুল দিয়ে ইশিতা কে চুপ করিয়ে দিলো
— চুপ আর একটা কথাও বলবা না। কে আমাকে কি বললো তাতে আমার কিছু যায় আসে না। যে কারনেই হোক আর যেভাবেই হোক আমি তোমার বিয়ে করেছি। তুমি এখন এই ইয়াশ চৌধুরীর ওয়াইফ। সো কারো রাইট নেই আমার ওয়াইফ কে নিয়ে কথা বলার। বা আমার ওয়াইফ কে বাজে কথা শুনানোর। যে আমার ওয়াইফের দিকে আঙ্গুল তুলে কথা বলবে আমি তার আঙ্গুল ভেঙ্গে দিব। যারা আমার ওয়াইফের দিকে বাজে ভাবে তাকাবে আমি তাদের চোখ তুলে নিবো।
ইশিতা ইয়াশের কথা গুলো শুনে আগের থেকে বেশি করে কাঁদতে লাগলো। ইয়াশ একটু আদুরে সুরে
— কি হলো আবার কাঁদছো কেন? আমি কি ভুল কিছু বলেছি?
ইশিতা বুঝতে পারছে না এই জন্মে সে কি এমন ভালো কাজ করেছিল যার জন্য আল্লাহ ইয়াশের মত একজন কে তার ভাগ্যে লিখেছেন।
— আচ্ছা ইশিতা তুমি কি পারবে না সব কিছু আবার নতুন করে শুরু করতে?
পারবে না আমার আর তোমার সন্তানের জন্য আগের সব কিছু ভুলে যেতে?
মানুষ মাত্রই তো ভুল তাই না?
তুমিও নাহয় একটা ভুল করে ফেলেছো। তাই বলে এখন কি এই ভুল টা কে সারা জীবন আকড়ে রেখে বাঁচতে পারবে?

রাত এগারো টা কি বারোটা, রোডের এক পাশে ইফানের কার সাইড করা। ইফান কারের উপর পা দুলিয়ে বসে আছে। রিহা কারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইফানের হাতে মদের বোতল। রিহা,ইফান কারে করে সেই সন্ধ্যা থেকে এখানে সেখানে ঘুরছে আর সাথে তো ড্রিঙ্ক করছে ই। ইফান আজ একটু বেশিই ড্রিঙ্ক করে ফেলেছে যার কারনে আজ ও নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। ঠিক মত দাঁড়াতে পারছে না। দাঁড়াতে গেলে পড়ে যাচ্ছে। ঠিক করে কথা ও বলতে পারছে না।
— রিহা তুমি জানো আজ আমি অনেক খুশি?
রিহা এতো ড্রিঙ্ক করেনি। তাই রিহা এখনও নিজের সেন্সে আছে।
— হুম জানি তো। তোমাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে আজ তুমি অনেক খুশি।
— হুম আজ সত্যি ই আমি নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে বেশি সুখী মনে করছি। ইশিতা কে দেখে কেউ আর কখনও এই ইফান চৌধুরীর সাথে ভালোবাসা নিয়ে ফান করতে আসবে না।
রিহা ইফানের কথা গুলো শুনে মনে মনে ভিষণ ভয় পাচ্ছে। ইফান ভুলেও যদি সব কিছু জানতে পারে তাহলে রিহার কি অবস্থা করবে তা ই ভাবছে রিহা।
— ইফান একটা কথা বলি?
ইফান লাফ দিয়ে কার থেকে নেমে গেলে নিজেকে সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নিলে রিহা ধরে ফেলে।
— রিহা তুমি একটা কথা বলার জন্য পারমিশন নিচ্ছো কেন?
তুমি একটা না হাজার টা কথা বলতে পারো। তুমি ই আমার রিয়েল ফ্রেন্ড। তুমি সব সময় আমার পাশে থাকো। দেখো না রাফি টা চলে গেল। ওটা আমার ফ্রেন্ড ই না।
রিহা খুব কষ্ট করে ইফান কে দাঁড় করিয়ে রাখছে। ইফান শরীরের সমস্ত ভার রিহার উপর ছেড়ে দিলে রিহার ইফান কে সামলাতে কষ্ট হচ্ছে।
— ইফান তুমি ইশিতা কে ভুলে যাও। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমাকে ভালোবাসতে পারবে না?
ইফান চলো না আমরা বিয়ে করে নেই।
ইফান রিহার কথা শুনে নিজেকে রিহার থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে ধপ করে নিচে পড়ে যায়। রিহা ইফান কে আবার দাঁড় করানোর চেষ্টা করে।
— আমি কখনও ইশিতা কে ভুলতে পারবো না রিহা। ও আমার প্রথম ভালোবাসা ছিল।ইশিতা আমাকে মন থেকে না ভালোবাসলে কি হবে। আমি তো ওকে মন থেকেই ভালোবেসে ছিলাম। ইশিতা কে নিয়ে আমার জীবন সাজাতে চেয়েছিলাম। আমার মনে শুধু মাত্র ইশিতা কে জায়গা দিয়েছিলাম। এখন ইশিতা ওই জায়গায় না থাকলেও আর কেউ সেই জায়গা টা নিতে পারবে না। আমি নিজেই অন্য কাউকে সেই জায়গা টা দিতে পারবো না।
ইফানের এসব কথা শুনে রিহার ইশিতার উপর ভিষণ রাগ হচ্ছে। আর নিজের উপর ঘৃণা তৈরি হচ্ছে, কষ্ট ও হচ্ছে।
ইফান কেন ইশিতা কে এতো ভালোবাসে? কেন রিহা কে ভালোবাসতে পারে না?
আর রিহা ই কেমন যে তাকে ভালোবাসে না তার জন্য সে কত কিছু করছে। রিহা মনে মনে বলছে
— দেখো ইফান তুমি আমাকে ভালোবাসো না এটা জেনেও আমি তোমার জন্য পাগল। আমি কোনো দিনও তোমার ভালোবাসা পাবো না এটা জানার পরও যে কোনো মূল্যে তোমাকে পেতে চাই। তোমাকে পাওয়ার জন্য সব করতে। তোমাকে নিজের করে রাখার জন্য হাজার অপরাধ ও আমার কাছে কিছু না। তোমার জন্য এতো কিছু করার পরও তুমি কেন আমাকে ভালোবাসতে পারবে না? কেন ইশিতা কে ভালোবাসবে?
কেন ইফান কেন?
— আচ্ছা রিহা ইশিতা আমার সাথে এমন কেন করলো?
ইফানের কথা শুনে রিহা ইফানের কথার কোন জবাব দিলো না।
— আমি কি খুব বাজে ছেলে?
আমাকে কি ভালোবাসা যায় না?
আমি ই ইশিতার ভালোবাসা পাবার যোগ্য ছিলাম না?
রিহা এবার চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে ইফান কে ধরে বলতে লাগলো
— আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি কেন আমাকে ভালোবাসলে না? তুমি কেন ওই ইশিতা কে ভালোবাসলে?
ওই মেয়েকে তোমার লাইফ থেকে বের করার জন্য, ওকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরানোর জন্য কতো কিছু করলাম। আর তুমি এখনও ওর কথাই বলে যাচ্ছো। মনে মনে ওকেই ভালোবেসে যাচ্ছো।
কেন ইফান?
কি আছে ওই মেয়ের মাঝে যা আমার মাঝে নেই। আমি তোমাকে পাঁচ বছর ধরে ভালোবাসি।এখন কি করে নিজের পাঁচ বছরের জমানো ভালোবাসা গুলো কে মাটি চাপা দিয়ে দেই? কি করে নিজের চোখের সামনে তোমাকে অন্য কারো হতে দেই?
রিহা চিৎকার করে কথা গুলো বললে ও কোন কথা ই ইফানের কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। ইফান সেন্সলেস হয়ে গেছে।রিহা ইফানের মাথা ওর কোলে তুলে নিয়ে। ইফানের কপালে একটা চুমু দিয়ে
— আমি যেকোনো মূল্যে তোমাকে আমার করে নিবো। আমাকে তোমার ভালোবাসতে ই হবে। আমি তোমাকে ইশিতার থেকে হাজার গুণ বেশি ভালোবাসা দিবো।

ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট। নাজমা চৌধুরী নিজের রুমে ঘুমিয়ে আছে। ইশিতা ও ঘুমিয়ে গেছে। ইয়াশ রুমের লাইট অফ করে ব্যালকনিতে ইজি চেয়ারে কপালে হাত দিয়ে আধ শুয়া ভাবে বসে আছে।
হঠাৎ করে কলিংবেল বাজার শব্দ হলো। ইয়াশ বুঝতে পারলো ইফান এসেছে। সাথে সাথে ইয়াশ রুম থেকে বের হয়ে নিচে চলে এলো। ইয়াশ দরজার কাছে আসতে আসতে আরো কয়েক বার কলিংবেলের শব্দ হলো।
ইয়াশ মেইন ডোর খুলে কিছু বলতে যাবে। তখনই সামনে রিহা কে দেখতে পেলো। ইয়াশ আগে থেকে রিহা কে চিনে। রিহা কয়েক বার ইফানের সাথে ওদের বাসায় এসেছে।
— রিহা এতো রাতে তুমি এখানে?
— ভাইয়া ইফান
— কোথায় ইফান? কি হয়েছে ইফানের? ও ঠিক আছে তো?
— ভাইয়া ইফান ঠিক আছে। কিন্তু
— কিন্তু কি?
— আসলে ভাইয়া আজ ইফান একটু বেশি ড্রিঙ্ক করে ফেলেছে। তাই সেন্সলেস হয়ে গেছে। ও গাড়িতে আছে ভাইয়া। আপনি একটু ওকে
রিহার কথা শেষ করার আগেই ইয়াশ গিয়ে ইফান কে কার থেকে কাঁধে ভর করে নামিয়ে নিয়ে আসে। ইফান নিজের মধ্যে নেই। হেলছে দুলছে। আর অস্পষ্ট ভাবে বিরবির করে কি যেন বলছে।
— আ,,, আমি তো,,,তো–মাকে কখ—নো হ্মমা,,,,
ইয়াশ ইফানের উপর হাজার রাগ করে থাকলেও ইফান কে এ অবস্থায় দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে ইফান কে কাঁধে ভর করে খুব সাবধানে রুমে নিয়ে যায়।
রিহা ও ওদের পিছনে ইফানের রুমে যায়।ইয়াশ ইফান কে বেডে শুইয়ে দিয়ে।
— রিহা অনেক রাত হয়েছে তুমি কি আজ আমাদের বাসায় থেকে যাবে নাকি তোমার বাসায় চলে যাবে?
তুমি থাকলে আমি গেস্ট রুম খুলে দিচ্ছি।
— না ভাইয়া। আমি থাকবো না। কার নিয়ে আসছি চলে যেতে পারবো।
— আচ্ছা। একা যেতে পারবে তো? নাহলে আমি তোমাকে ছেড়ে দিয়ে আসি।
— না ভাইয়া আপনার কষ্ট করতে হবে না আমি একাই চলে যেতে পারবো।
রিহা চলে গেলে ইয়াশ ইফান কে ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে চাঁদর টেনে দিয়ে রুমের আলো নিভিয়ে চলে গেল।

সকালে ইয়াশ হাতে করে এক গ্লাস পানি নিয়ে ইফানের রুমে আসে। এসে দেখে ইফান এখনও মরার মত পড়ে ঘুমাচ্ছে। ইয়াশ প্রথমে কয়েক বার খুব স্বাভাবিক ভাবে ইফান কে ডাকে। কিন্তু ইয়াশের ডাকে ইফানের কোনো সাড়া শব্দ নেই। ইয়াশ অযথা আর ইফান কে না ডেকে হাতে থাকা পানির গ্লাসের সবটুকু পানি ইফানের উঠে ঢেলে দেয়। ইফান চিৎকার দিয়ে এক লাফে ঘুম থেকে উঠে বসে।
— কে,,,,কে? কার এতো বড় সাহস আমার উপর পানি ফেলে।
ইফান সামনে তাকিয়ে ইয়াশ কে দেখে। মাথা চুলকিয়ে
— ভাই তুই?
— কাল সারা দিন, সারা রাত কোথায় ছিলি?
— ভাই! আসলে
— ফ্রেশ হয়ে নিচে আয়।
ইয়াশ এক মিনিট ও ইফানের রুমে না দাঁড়িয়ে বের হয়ে আসলো। কালকের কথা মনে করে ইয়াশের মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছিল। ইচ্ছে করছিল ইফান কে মেরে ফেলতে।
ইয়াশ নিচে হলরুমে সোফায় বসে পায়ের উপর পা রেখে নিউজ পেপার পড়ছে। ইফান সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে
— মা আমার চা কই?
উফ মাথা টা ছিড়ে যাচ্ছে। কাল রাতে মনে হয় একটু বেশিই হয়ে গেছিল। কি হয়েছে কিছুই মনে আসছে না। কখনও তো আমার এমন হয়না।
নাজমা চৌধুরী কিচেনে রান্না করছিল। ইশিতা ও সাথে হাতে হাতে সাহায্য করছে। নাজমা চৌধুরী ইফানের ডাক শুনে ইশিতা কে ইফানের জন্য চা নিয়ে যেতে বললো।
— ইশিতা মা তুই একটু ইফান কে চা দিয়ে আসতে পারবি?
ইশিতা এখন কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। ইফানের সামনে গেছে ইফান যদি উল্টা পাল্টা রিয়েক্ট করে তখন?
আর যদি এখন চা নিয়ে না যায় তাহলে নাজমা চৌধুরী কি মনে করবে।
নাজমা চৌধুরী চায়ের কাপ ইশিতার হাতে দিয়ে
— নে মা যা ইফান কে দিয়ে আয়।
ইশিতার হাত পা কাঁপতে শুরু করে দিলো। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এখুনি মাথা ঘুরে পড়ে গেলে ভালো হতো।
ইশিতা কাঁপা কাঁপা পায়ে কিচেন থেকে বের হয়ে হল রুমের দিকে এগুতে লাগলো।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here