সেই তুমি?
পর্ব -২
Samira Afrin Samia(nipa)
সেই সকালে না খেতে খালি পেটে বাড়ি থেকে বের হয়েছে ইশিতা।পুরো টা দিন পাড় হয়ে এখন রাত নেমে আসলো। এখনও কিছু খায়নি ইশিতা। সকাল থেকে পেটে খাবারের একটা দানা পড়বে তো দূর এক ফোঁটা পানি ও পেটে পড়েনি।
ইফান চলে গেলে ইশিতা উঠে দাঁড়িয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে হাটতে লাগলো। এই রাতের বেলায় কোথায় যাবে কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না ইশিতা। রাস্তার পাশের ল্যামপোস্টের আলোয় সব কিছু ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। রাতের অন্ধকারে স্পষ্ট করে কিছু দেখা না গেলেও ল্যামপোস্টের আলোয় হালকা হালকা সব কিছুই দেখা যাচ্ছে।
আজ রাতের আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। কালো মেঘ গুলো চাঁদ কে আড়াল করে রেখেছে। ইশিতা ল্যামপোস্টের ঝাপসা আলোতে গন্তব্যহীন পথে হেঁটে চলছে। ইশিতার দুচোখ বেয়ে অঝোর গতিতে পানি পড়ছে। এতো দিন সে একটা ভুল মানুষ কে বিশ্বাস করছে। একটা প্রতারক কে ভালোবেসেছে। যে তাকে মাঝ রাস্তায় এভাবে একা রেখে চলে গেছে তাকে নিয়ে সে কত ই না স্বপ্ন দেখেছে।
ইশিতা হাঁটতে হাঁটতে একটা ব্রিজের উপরে এসে গেল। ইশিতা একটু এগিয়ে গিয়ে ব্রিজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে।একটু উঁকি দিয়ে ব্রিজের নিচের নদী টার দিকে তাকালো। নদীতে অনেক পানি এখান থেকে ঝাঁপ দিলে পানির স্রোত কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে তার কোন ঠিক নেই। ছোট থেকে হাজার কষ্ট করার পর ও ইশিতা কখনও নিজের জীবন নেওয়ার কথা মাথায় আনেনি। কিন্তু আজ কেনই যেন এসব উল্টা পাল্টা খেয়াল আসছে মাথায়। ইফানের এতো বড় ধোঁকার কথা মনে করেই ইশিতার নিজের উপর রাগ হচ্ছে। একটা ভুল মানুষ কে এতদিন অন্ধের মত বিশ্বাস করে গেছে।
ইশিতা মাঝে মাঝে নিচের দিকে উঁকি দিয়ে পানির গভীরতা বুঝার চেষ্টা করছে। মুখ বাড়িয়ে দিয়ে নিচের দিকে দেখতেই মাথা ঘুরে উঠছে। ভয় হচ্ছে প্রচুর। ইশিতা সব সময় ভাবতো আত্মহত্যা সব কিছুর সমাধান না। কিন্তু আজ ইশিতার কাছে আত্মহত্যা ই এসব সমস্যার একমাত্র সমাধান বলে মনে হচ্ছে। আজ খুব ইচ্ছে হচ্ছে এ জীবন থেকে মুক্তি পাবার। সবাইকে ফাঁকি দিয়ে এই সব সার্থপর মানুষ গুলোর ভিড় থেকে দূরে কোথায় চলে যেতে। মুখোশধারি মানুষ গুলোর ভিড়ে নিজেকে খুব একা মনে হচ্ছে ইশিতার। ব্রিজের রেলিং ধরে এক পা বাড়িয়ে দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে চোখ বুঁজে নিলো ইশিতা। দু’তিন মিনিট চোখ বুঁজে থেকে কিছু একটা ভেবে নিচে নেমে এসে দু’পা পিছিয়ে এসে নিচে মাটিতে বসে পড়লো ইশিতা।
কি করতে যাচ্ছিল এটা? এখন তো সে একা না। তার ভেতর যে আর একটা জীবন আছে তা কিছুক্ষণের জন্য ভুলেই গেছিল ইশিতা।
ইশিতা পেটে হাত রেখে জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো।
— আমাকে হ্মমা করে দিস।আমি তোর কথা না ভেবেই এতো বড় একটা ভুল করার জন্য পা বাড়িয়ে দিছিলাম। আমি যে তোর জন্য তোর বাবার বিরুদ্ধে গেছি এটা ভুলে গিয়েই কত সহজে তোর আর আমার নিজের জীবন শেষ করে দিতে নিছিলাম। তোকে পৃথিবীতে আনার জন্য তোর বাবার সাথে ও সব সম্পর্ক শেষ করতে পারি। সমাজের সব মানুষের বিরুদ্ধে যেতে পারি। পরেও আমি তোর কিছু হতে দিব না।
আজিম সাহেব একবার ঘরে যাচ্ছে তো একবার বাইরে বের হয়ে আসছে। বাইরে বের হয়ে বার বার গেটের দিকে তাকিয়ে দেখছে ইশিতা বাড়ি ফিরলো কি না? আজিম সাহেব কে এমন টেনশন করতে দেখে সালেহা বেগম নানান ধরনের কথা শুনিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আজিম সাহেব সালেহা বেগমের কোনো কথা কানে নিচ্ছেন না।
— কলঙ্কিনী টা কে নিয়ে এতো চিন্তা করে নিজে প্রেসার বাড়াচ্ছো কেন? এখন তোমার কিছু একটা হলে তোমাকে কে দেখবে?
ভালোই হয়েছে কোথাও চলে গেছে না হলে তো আমাদের মান সন্মান সব ডুবাতো। ছোট থেকে মানুষ করে আজ এমন কিছু দেখতে হবে ভাবতেই পারিনি। ও যে এভাবে আমাদের মুখে চুনকালি মাখাবে এটা বুঝতে পারলে কখনোই ওকে কোলে পিঠে করে মানুষ করতাম না। আমাদের ভালোবাসার এই মূল্য দিলো? শেষে কিনা সমাজের মানুষের সামনে আমাদের মুখ দেখানো মত কিছুই রাখলো না।
সালেহা বেগমের এসব কথা শুনে আজিম সাহেব ধমক দিয়ে বললেন
–আহ! তুমি একটু থামবে।দেখতেই তো পারছো এতো রাত হয়ে গেল মেয়েটা এখনো বাড়ি ফিরলো না। কোথায় গেছে কি করছে। নিজের সাথে কিছু একটা করে বসলো না তো?
এখন দিনকাল ভালো না এতো রাতে একা একটা মেয়ে বাইরে আছে যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে।
— আর কি বাকি আছে হওয়ার মত। আগে থেকেই তো মুখ পুড়িয়ে এসেছে। এখন আর নতুন করে কি হবে।
আজিম সাহেব সালেহা বেগমের কথা উত্তরে কিছু না বলে। একটা র্টচ লাইট হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে লাগলো। সালেহা বেগম পেছন থেকে চিল্লিয়ে
— এখন আবার কোথায় বের হচ্ছো তুমি? এমনিতেই তোমার প্রেসার আর র্হাটের সমস্যা। সেদিন ডাক্তার দেখিয়ে আসছি। এখন যদি আবার কিছু হয় তখন কে দেখবে তোমাকে?
আমি আর পারি না সব জ্বালা আমার সহ্য করতে হবে। একজন কুকাজ করে মুখে চুনকালি মেখে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। আর উনি যাচ্ছেন ওকে খুঁজে বাড়িতে নিয়ে আসতে। সব কষ্ট আমার কপালে। ঘরে আরো দুইটা মেয়ে আছে, এসব কথা বাইরে ছড়ালে এই মেয়ে দুইটার কি হবে?
ওদেরকে কে বিয়ে করবে যদি লোকে শুনে বড় বোন এসব করেছে। নিজের মেয়েদের কথা তো কোনো দিন ও ভাবোনি। সব সময় বোনের মেয়েকে নিয়েই ভেবেছো। বোনের মেয়েকে নিজের মেয়েদের থেকে বেশি ভালোবাসা দিছো।এখন দেখলে তো তোমার ভালোবাসার মূল্য কিভাবে দিল?
আজিম সাহেব র্টচ লাইট ধরে রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছে। ভালো করে চারিদিকে দেখছে ইশিতা কোথাও আছে কি না।
ইশিতা রাস্তায় বসে কাঁদছে। এখন কোথায় যাবে ও। সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মামী স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে আর যাতে ও বাড়ির চৌকাঠে পা না রাখে। একটা কলঙ্কিনীর জায়গা ও বাড়ীতে আর হবে না। এতো কিছু ঘটে যাওয়ার পর এখন কোন মুখে মামা মামীর সামনে দাঁড়াবে?
ইশিতা জ্ঞান হবার পর থেকেই মামা মামীর কাছে মানুষ হয়েছে। ছোট বেলা বাবা মা মারা গেলে।মামা মামী ই ওকে আপন করে নেয়। বাবা মা হারা মেয়ে বলে মামা সব সময় ই ইশিতা কে একটু বেশি ভালোবেসেছে। দুইটা মামাতো বোন থেকে ওকে একটু বেশি যত্ন করেছে। আর আজ ইশিতা সেই মামার সন্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিল। ওর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। কিন্তু আত্নহত্যা করার ও তো পথ খোলা নেই। নিজের একা জীবন থাকলে এতক্ষণে হয়ত রাস্তায় বড় কোন গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে যেত। কিন্তু এখন তো ওর ভিতরে আর একটা প্রান বেড়ে উঠছে। ও তো কোনো দোষ করেনি। তাহলে শুধু শুধু কেন ওই নিষ্পাপ জীবন টা কে মেরে ফেলবে।
সকাল থেকে কিছু না খাওয়ায় হঠাৎ করে মাথা টা ঘুরে গেল ইশিতার। শরীর টা প্রচন্ড দূর্বল লাগছে। চোখের সামনে সব কিছু অন্ধকার মনে হচ্ছে। অনেক কষ্ট করেও চোখ মেলে তাকাতে পারছে না।
চলবে…….