সেই তুমি? পর্ব -২৬

0
2556

সেই তুমি?
পর্ব -২৬
Samira Afrin Samia(nipa)

— আমি ইফান কে সব সত্যি বলে দিব রিহা।
— ওহ আচ্ছা!
— হুম। আমি আর পারছি না। এখন তো ইফানের এমন অবস্থা দেখে নিজের কাছেই নিজেকে অপরাধী মনে হয়। মনে হয় ইফানের এমন অবস্থার জন্য আমি দায়ী।
— রিয়েলি?
আচ্ছা ঠিক আছে তুই ইফান কে সব কিছু সত্যি সত্যি বলে দে।
— সিরিয়াসলি এই কথা তুই বলছিস রিহা?
— ইয়াহ 100% আমিই বলছি।

রাফি রিহার মতিগতি বুঝতে না পেরে এখান থেকে চলে যাওয়া টাই ভালো মনে করে, চলে আসতে নিলে রিহা পেছন থেকে কি যেন ভারী একটা কিছু দিয়ে জোরে রাফির মাথায় আগাত করে। যার কারনে রাফি উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে যায়।
রিহা পেছনে থেকে একটা হকি স্টিক হাতে নিয়ে ওটা এদিক সেদিন নাড়াতে নাড়াতে। রাফির সামনে এসে এক হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে।
— তুই এতো বোকা কেন রাফি?
আমার এতো দিনে এতো কষ্ট, এতো সাধনা এভাবে মুহূর্তের মধ্যে তুই শেষ করে দিতে চাইবি আর আমি তা চেয়ে চেয়ে দেখবো।
তুই ভাবলি কি করে তুই এখান থেকে ভালোয় ভালোয় যেতে চাইবি আর আমি তোকে যেতে দিব।
ফোনে তোর কথা শুনেই আমার মনে হয়েছিল আজ তোর একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। নাহলে তুই ইফান কে আমার থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিবি।
রিহা রাফি মাথায় হাত দিয়ে
— ইশ দেখ তো কতো টুকু ফেটে গেছে আর কতো রক্ত বের হচ্ছে। কেন এমন বোকামী করিস দোস্ত বল তো?
তুই আমাকে বাধ্য করলি তোর সাথে এমন কিছু করতে। বিশ্বাস কর রাফি তোর সাথে এমন কিছু করার আমার মোটেও ইচ্ছে ছিল না। কি করার যে যেমন তাকে তেমন ভাবেই বুঝাতে হয়।
তোকে ভালো কথায় বুঝাতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুই ভালো কথায় বুঝলি না।
রিহা জোরে জোরে হাসতে লাগলো। রিহা কে দেখে মনে হচ্ছে না ও কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ। কারণ কোনো মানুষ পুরোপুরি সুস্থ মস্তিষ্ক নিয়ে এমন কিছু করতে পারবে না। তাও আবার নিজের বন্ধুর সাথে।
রিহা উঠে দাঁড়িয়ে ফোন বের করে কাকে যেন কল করে।
— মরে গেছে নাকি বলতে পারবো না। হয়ত এখনও মরে নি বেঁচে আছে। বডি টা এখানে পড়ে আছে তোরা এসে তুলে নিয়ে যা। যেমন যেমন বলেছি ঠিক তেমন টাই করবি। একটু উল্টা পাল্টা হলে কিন্তু তোদের খবর আছে। আমি কি কি করতে পারি এটা তো তোরা খুব ভালো করেই জানিস।
আর হ্যাঁ দেখিস ওর যেন কোনো কষ্ট না হয়। হাজার হোক আমার বন্ধু। ওর খুব ভালো করে যত্ন নিবি।

রিহা আবার খুব স্বাভাবিক হয়ে বাসায় ফিরে আসলো।
দিন কয়েক কেটে গেলে মনির চৌধুরী ইফানের সাথে কথা বলতে আসে। ইফান বেডে বসে আছে আর মনির চৌধুরী সোফায়।
— দেখো বাবা তোমার আর রিহার বিয়ের সপ্তাহ কয়েক হয়ে গেছে। শুনতে পারছি সোসাইটির মানুষ গুলো নাকি তোমাকে নিয়ে নানান কথা বলছে।
তুমি যদি কিছু মনে না করো বাবা তাহলে একটা কথা বলি।
তুমি রিহা কে নিয়ে তোমার বাসায় যাও। আমার যা আছে এখন সব কিছুই তোমার পরেও বিয়ের পর মেয়ের বাবার বাড়ি থাকলে লোকে তো কথা বলবে ই।
— আঙ্কেল
— তুমি না যেতে চাইলে জোর করবো না। আমি তো শুধু তোমাকে বলছি।
ওটা তোমার ও বাড়ি তুমি কেন মা ভাইয়ের সাথে রাগ করে বাড়ি ছেড়ে থাকবে। ওই বাড়িতে তোমার ও ইয়াশের মত সমান অধিকার আছে।
আর বাবা তোমার মা ই কেমন? সৎ ছেলের পহ্ম নিয়ে নিজের আসল ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন।
মনির চৌধুরীর এই কথা শুনে ইফান সাত আসমান থেকে নিচে পড়লো।
— কি বললেন আঙ্কেল। সৎ ছেলে?
ভাই কি আমার নিজের আপন ভাই না?
— এসব কথা কি বলবো বাবা।
— আমার থেকে কিছু লুকাবেন না আঙ্কেল। আপনি যা যা জানেন সব সত্যি করে আমাকে বলেন।
সত্যি টা জানা আমার খুব দরকার। ভাই আমার নিজের ভাই না।
— তাহলে শুনো বাবা। তোমার বাবা আমি আর আমাদের আরেক বন্ধু। আমরা তিনজন তিনজনের জীবন ছিলাম। তিন জন এক সাথে থাকতাম এক সাথেই ব্যবসা করতাম। তোমার বাবা ইকবাল চৌধুরী আর আমাদের আরেক বন্ধু খলিল আহমেদ বউ বাচ্চা নিয়ে সবাই একসাথে সুখে শান্তিতে দিন যাপন করছিলাম।
ইয়াশের যখন আট বছর বয়স তখন ইয়াশের মা আমেনা চৌধুরীর ব্রেন টিউমার হয়। অনেক ডক্টর দেখিয়ে ও কোনো লাভ হয়নি। টিউমার টা ব্রেনে হওয়ার কারনে কোনো ভাবেই অপারেশন করা সম্ভব না। অপারেশন করলে উনাকে বাঁচানো যাবে তার গ্যারান্টি ছিল ২০% তাই ভাবী ই জোর করে অপারেশন করায় নি। আমার বন্ধু অবশ্য অনেক জোর করেছিল কিন্তু ভাবী কোনো ভাবেই রাজি হয়নি।
এভাবেই তিন মাসের মাথায় ভাবী আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন। ইকবাল একেবারে একা হয়ে গেল। ইয়াশ ছোট বয়সেই মা হারালো।
ইকবাল বিজনেস দেখার পাশাপাশি ইয়াশের ঠিক মত খেয়াল রাখতে পারছিল না। বাড়ি অফিস দুই দিক সামলে উঠতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল।
আমরা অনেক বুঝিয়েছি আবার বিয়ে করে নিতে। নিজের জন্য না হলেও ইয়াশের কথা ভেবে আবার বিয়ে করা উচিত। কোনো কথাতেই কোনো কাজ হলো না। ইকবাল বিয়ে করার জন্য কোনো ভাবেই রাজি হলো না।একদিন ইয়াশ নিজে ওর বাবা কে বলে
— বাবা সবার মা আছে আমার মা নেই। আমাকেও তুমি মা এনে দেও বাবা। এভাবে একা একা আমার ভালো লাগে না। মায়ের কথা খুব মনে হয়।
ওই দিন ইকবাল চৌধুরী ইয়াশ কে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কান্না করে। অবশেষে ইকবাল চৌধুরী দ্বিতীয় বার বিয়ে করার জন্য রাজি হয়। তবে এমন একজন কে বিয়ে করবে যে ইয়াশ কে নিজের ছেলের মত করে মানুষ করবে। কখনও সৎ বলে মনে করবে না।

এই টুকু শুনে ইফান মাথায় হাত দিয়ে নিচে ফ্লোরে বসে পড়লো। মনির চৌধুরী ইফানের মাথায় হাত রেখে
— নিজেকে সামলাও বাবা।
ইফান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে
— তার পর কি হলো আঙ্কেল?
— তার পর একদিন আমাদের কোম্পানিতে তোমার মা একটা কাজের জন্য আসে।
আমার ওই বন্ধ খলিল আহমেদ তোমার বাবাকে আগে থেকেই চিনতো যার কারনে তোমার মা’কে ও চিনতো।
তোমার মা হঠাৎ করে কাজের জন্য আসলে খলিল সব কিছু জানতে চাইলো, কেন হঠাৎ করে তোমার মায়ের চাকরি দরকার।
তোমার মা আমাদের সব খুলে বললো।
যিনি তোমার নিজের বাবা, উনি নাকি তার অফিসের ই একজন কর্মচারি কে ভালোবাসে তাকে বিয়ে করবে বলে তোমার মাকে ডিভোর্স দেয় তোমাকে আর তোমার মা’কে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। তখন তোমার বয়স ছয় বছর। তুমি ইয়াশের থেকে দুই বছরের ছোট ছিলে।
তোমার মা’কে আমরা ইকবালের সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিলে প্রথমে রাজি হয়নি। কিন্ত পরে তোমার কথা ভেবে, তোমাকে বড় করতে হলে, ভালো ভাবে মানুষ করতে হলে, তোমার পড়াশুনা, ভরনপোষণ করবে হলে নতুন করে আবার কারো সাথে জীবন শুরু করতে হবে। একা নিজের পহ্ম্যে তোমার ভরনপোষণ করা সম্ভব না।

অবশেষে ইকবালের আর তোমার মা’র দুজনেই আবার নতুন করে জীবন শুরু হয়। দুজন দুজনের বাকি টা পথ চলার সাথী হয়। তোমার মা ইয়াশ কে কখনও সৎ ছেলে মনে করেনি সব সময় তোমার থেকে একটু বেশি ভালোবাসা দিয়েছে ইয়াশ কে। ইয়াশ ও তোমার মা’কে নিজের মায়ের জায়গা দিয়ে আপন করে নিয়েছে।
তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় হয়ে যাতে ঝগড়া বিবাদ সৃষ্টি না হয় তাই ছোট বেলা ই ইকবালের সমস্ত সম্পত্তি তোমাদের দুই ভাইয়ের নামে সমান ভাবে ভাগ করে লিখে দেয়।
তাই বলছি বাবা নিজের অংশের ভাগ ছেড়ে বাড়ি থেকে চলে আসা তোমার ঠিক হয়নি।
ইফান মনির চৌধুরীর কথা গুলো শুনে কিছু না বলে চুপচাপ রুম থেকে বের হয়ে যায়।

রাতে ইয়াশ ইশিতা আর নাজমা চৌধুরী এক সাথে ডাইনিং টেবিলে বসে ডিনার করছে। খাওয়া শেষে ইশিতা সব কিছু গুছিয়ে রাখতে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই বিকট শব্দে কলিং বেল বাজতে লাগলো। এতো রাতে কে এসেছে। আর এমন ভাবে কলিং বেল চাপছে?
নাজমা চৌধুরী দরজা খোলার জন্য উঠতে নিলে।
— তুমি বসো মা। আমি দেখছি কে এসেছে।
— আচ্ছা তাড়াতাড়ি দেখ। মনে হচ্ছে কলিং বেল চাপতে চাপতে ভেঙে ফেলবে।
ইশিতা গিয়ে দরজা খুলে দেয়। সামনে ইফান রিহা কে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইশিতা ওদের দুজন কে এক সাথে দেখে মোটেও অবাক হয়নি।
ইফান ইশিতা কে ধাক্কা দিয়ে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে ভেতর চলে আসে। নাজমা চৌধুরী ইফান কে দেখে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়।
— ইফান তুই এসেছিস?
এতো দিন পর ইফান কে দেখে নাজমা চৌধুরীর চোখ জলে ভরে উঠলো।
— আয় বাবা আয়। রাগ করে কি কেউ এতো দিন বাড়ি ছেড়ে থাকে?
ইয়াশ ইফান আর রিহা কে দেখতে পেয়ে ওদের কাছে আসে।
— ইফান তোর সাথে রিহা কেন এসেছে?
ইফান শার্টের কলারের ভাঁজ ভেঙে কলার টা একটু উপরে তুলে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসে।
— রিহা আমার ওয়াইফ। এই বাড়ির ছোট বউ।
নাজমা চৌধুরী কান্না ভেজা কন্ঠে
— তুই রিহা কে বিয়ে করেছিস। তা আমাদেরকে একবার ও জানানোর প্রয়োজন মনে করিস নি। আমরা কি তোর কেউ না।
ইফান বিরক্তি নিয়ে
— মা বন্ধ করো তো তোমার কান্না। এতো দিন আমি বাড়ি না থাকায় তো বড় ছেলেকে নিয়ে ভালোই ছিলে। আমি না থাকায় তো তোমাদের কোনো কষ্ট হয়নি।
— ইফান তুই মায়ের সাথে এভাবে কথা বলতে পারিস না।
— ওহ জাস্ট সেটআপ। তুই আমার সাথে উচু গলায় কথা বলতে আসবি না। এটা তোর একার বাড়ি না। তুই যেমন এ বাড়ির ছেলে তেমন আমিও এ বাড়ির ছেলে। এই বাড়ি তোর যতটুকু অধিকার আছে ঠিক ততটা আমার ও আছে।
— তুই কি অধিকার ফলানোর জন্য এতো দিন পর বাড়ি ফিরেছিস?
— অবশ্যই। তুমি তোমার বড় ছেলে
না আমার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে, ওটা বড় ছেলে না ওটা সং ছেলে হবে।
তুমি তোমার সৎ ছেলের জন্য আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে এটা তো হতে পারে না।
ইফানের মুখে এই কথা শুনে নাজমা চৌধুরী ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো।
— ইফান কি বলছিস তুই এসব?
— ঠিক ই তো বলছি। তুমি তো তোমার সৎ ছেলেকে ই নিজের ছেলে মনে করো। আর নিজের ছেলেকে সৎ।
ইয়াশ রেগে ত্যারে এসে
— তোকে এসব কে বলেছে?
তোর সাহস হয় কি করে মা’কে এসব কথা বলার। স্কাউন্ডেল আমি তোকে জানে মেরে ফেলবো।
ইয়াশ ইফানের শার্টের কলার ধরে টান দিয়ে সোফা থেকে তুলে নিয়ে আসে।
ইফান ইয়াশ কে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে।
— আমার গায়ে হাত তুলার সাহস দেখাতে আসিস না ভাই।
নাজমা চৌধুরী ইয়াশের কাছে এসে ইয়াশ কে দুই হাতে আটকে ধরে
— ও একটা অমানুষ হয়ে গেছে বাবা। তুই তোর সাথে লাগতে যাস না।
— হুম এখন তো সৎ ছেলেকে পেয়ে গেছো। তাই নিজের ছেলেকে অমানুষ মনে হয়।
ভাগ্য ভালো আমার সৎ বাবা ভালো মানুষ ছিলেন। আর আমার নামে ও উনার সম্পত্তি লিখে দিয়ে গেছিলেন। নয়তো তোমরা তো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে আমাকে এ বাড়ি থেকে বের করে দিতে।
ইশিতা এক পাশে দাঁড়িয়ে নির্বোধ দর্শকের মত সব কিছু দেখে যাচ্ছে। কোনো কিছুই ইশিতার মাথায় ঢুকছে না। ইফান এতো টা নিচে কি করে নামতে পারলো।
— আমার সাথে এক বাড়িতে থাকতে তোমাদের অসুবিধা হলে, তোমরা আমার প্রাপ্য অংশ আমাকে দিয়ে দেও আমি এ বাড়ি থেকে চলে যাবো।
ইফানের এমন রূপ দেখে নাজমা চৌধুরী কিছু বলতে পারছে না। নিজের পেটের সন্তান যাকে দশ মাস গর্ভে ধরেছে সে আজ নাজমা চৌধুরী কে এমন ভাবে কথা শুনাচ্ছে। যে ভাই তাকে কোনো দিনও সৎ ভাই মনে করেনি। সব সময় নিজের আপন ভাই ভেবে কলিজায় জায়গা দিয়েছে ইফান আজ তার সাথে ও বাজে ব্যবহার করেছে।
— আমি বিয়ে করে বউ নিয়ে বাসায় এসেছি। তার পর ও তোমরা এসব ড্রামা করলে। কোথায় নতুন বউকে বরণ করে ঘরে তুলবে তা না করে ড্রামা স্টার্ট করে দিলে।
আমি ভিষণ টায়ার্ড। রিহা এখানে তোমাকে কেউ বরণ করে রুমে নিয়ে যাবে না। তুমি তো আমার রুম চিনো ই। তাই নিজে থেকেই আমার সাথে চলো।
ইফান নিজের রুমে যেতে লাগলো। পিছন ফিরে তাকিয়ে আবার বলতে লাগলো
— আজকের জন্য ড্রামা শেষ। আর যদি বাকি থাকে তাহলে আবার কাল সকাল থেকে স্টার্ট করবো। এখন ঘুমাতে যাও গুড নাইট অল।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here