সেই তুমি?
পর্ব -২৮
Samira Afrin Samia(nipa)
পার্টির সব গেস্ট রা মাঝে মাঝে ইফান কে খুঁজলেও পায়নি। ইফান কোথায় গেছে কাউকে জানিয়ে যায়নি। পার্টিতে ইফান কে না পেয়েও কারো তেমন মাথা ব্যথা নেই। যে যার মত পার্টি এনজয় করছে। কিন্তু রিহা ইফান কে না পেয়ে প্রায় পাগলের মত হয়ে গেছে। যাকে পাচ্ছে তাকেই ইফানের কথা জিঙ্গেস করতে লাগলো।
ইয়াশ নিজের রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে। নাজমা চৌধুরীর রুমে আসে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে
— মা আসবো?
— কে ইয়াশ। ভেতরে আয়। আমার ঘরে আসতেও তোর বলে আসা লাগবে।
ইয়াশ নাজমা চৌধুরীর কাছে এসে। নাজমা চৌধুরীর পাশে বসে
— নিচে এসব কি হচ্ছে মা?
— জানি না বাবা। ইফান পার্টি রেখেছে। ও বিয়ে করেছে এটা নাকি শহরের সবাইকে জানাতে হবে। আর তাই ও পার্টি রেখেছে আমি বাঁধা দিতে চাইলে ও ঝামেলা করতো তাই বাঁধা দেই নি। শুধু শুধু ঝামেলা করে কি লাভ। বাড়ির মাঝে এসব ভালো লাগে?
— ইফান কাউকে না জানিয়ে হঠাৎ করে বাড়িতে এভাবে পার্টি রাখতে পারে না। আজ ওর সাথে শেষ বুঝাপড়া হবে। দরকার হলে আজই সব কিছু ভাগাভাগি হয়ে যাবে।
— কি বলছিস তুই এসব? তুই নিজে বলছিস ইফানের থেকে আলাদা হয়ে যেতে?
— এছাড়া আর কোনো উপায় কি ইফান রেখেছে মা?
— ইফান টা যে কেমন করে হঠাৎ এমন হয়ে গেল।
— আমি জানি মা ইফান কেন এমন হয়েছে। এসবের পিছনে রিহার বাবা মনির চৌধুরী রয়েছে। উনি ই ইফানের মাথায় এসব আজেবাজে চিন্তা ঢুকিয়েছে।
— মনির ভাইয়ের আমাদের সাথে এসব করে কি লাভ হচ্ছে?
— কেন মা তোমার মনে নেই?
আমাদের কোম্পানি থেকে চুরির দায়ে উনাকে কিভাবে বের করে দেওয়া হয়েছিল। সেই থেকেই তো উনি আমাদের থেকে প্রতিশোধ নিতে চায়।
— তোর বাবা মারা যাবার পর কতো বিশ্বাস করে উনাকে আমাদের বিজনেস সামলাতে দিয়েছিলাম। কিন্তু উনি কি করলেন, দিনের পর দিন কোম্পানির নাম করে টাকা নিয়ে নিজের ব্যবসা বড় করে তুলেছেন।
এসব করেও উনি থেমে থাকেন নি। কোম্পানি থেকে বড় অংকের টাকা চুরি করে নিলেন। আর উনার চুরি ধরা পড়ায় দোষ দিলো ম্যানেজারের উপর।
— এসবের বদলা ই এখন নিতে চাইছে মা। উনার দাবার গুটি হিসেবে এতো দিন নিজের মেয়েকেই ব্যবহার করেছে। আর এখন ইফান কে করছে।
ইফান এতো টা বোকা কি করে হতে পারে?
— ইফানের বাইরের দুনিয়ার সাথে এতোটা পরিচয় নেই কে কেমন তা ইফান বুঝতে পারে না।
— তার জন্যই তো ওকে ছোট থেকে এতোটা আগলে রেখে বড় করে তুলেছি। তার পরও তো আমি যেমন চাইছি ইফান তেমন হলো না।
— দুঃখ করিস না বাবা। ইফান খুব শীগ্রই নিজের ভুল বুঝতে পারবে। আমার মন বলছে ইফান খুব তাড়াতাড়ি আবার আগের ইফান হয়ে যাবে।
— তা হলেই ভালো মা। নয়তো আমার অন্য কোন রাস্তা বের করতে হবে।
আচ্ছা মা আসি রাত অনেক হলো তুমি ঘুমিয়ে যাও।
— কি করে ঘুমাবো? শুনতেই তো পারছিস নিচে কতো হাই ভলিউমে গান বাজছে। গানের শব্দ সোজা এসে কানে লাগছে। মাথা টা ও ধরেছিল। ইশিতা এসে ঔষধ দিয়ে গেছে।
— এখন ঠিক আছো তো?
— হুম।
— আচ্ছা তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো। আমি নিচে গিয়ে গান অফ করছি। অনেক হয়েছে পার্টি।
ইয়াশ নাজমা চৌধুরীর রুমের লাইট অফ করে দিয়ে দরজা লাগিয়ে চলে যেতে নিলে নাজমা চৌধুরী ইয়াশ কে ডেকে উঠে
— ইয়াশ চলে গেলি বাবা?
ইয়াশ আবার রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে
— না মা যাই নি। কিছু লাগবে তোমার?
— না কিছু লাগবে না। তুই একটু আমার পাশে এসে বসবি?
ইয়াশ নাজমা চৌধুরীর পাশে বসে
— কি হয়েছে বলো?
— তোকে তো একটা কথা বলতে ভুলেই গেছিলাম। তোর খলিল আহমেদ আঙ্কেলের কথা মনে আছে?
ইয়াশ হেসে
— মনে থাকবে না কেন?
— তাহলে নিশ্চয় ইশুর কথা ও মনে আছে?
ইয়াশ মাথা নেড়ে
— হুম।
— তুই জানিস ইশু এখন কোথায় আছে?
ইয়াশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে
— হুম।
নাজমা চৌধুরী রীতিমত অবাক হয়ে
— তুই জানিস ইশু কোথায়?
— হ্যা।
— তাহলে আমাকে আগে জানালি না কেন?
— ঠিক সময় আসলে জানাতাম।
— তুই ছোট বেলা থেকে যাকে ভালোবেসে এসেছিস সে আজ তোর ঘরের বউ।
আমি তো ভাবতেই পারিনি যে ইশিতা আমাদের সামনে আছে সেই আমাদের সেই ছোট ইশু।
নাজমা চৌধুরীর কথা ইয়াশ শুনে যাচ্ছে কিছু বলছে না।
— তোর সাথে ইশিতা কত খেলা করতো। সারাক্ষণ তোর সাথে থাকতো। কেউ কিছু বললেই বলতো ‘”” আমি ইয়াশের কাছে তোমাদের সবার নামে বিচার দিবো'”” ওর এই কথা শুনে সবাই যে কি ভাবে হেসে গড়িয়ে পড়তো।
ইশিতা চলে যাবার পর তুই কত রাত ওর কথা মনে করে আমার কোলে মুখ লুকিয়ে কেঁদেছিস তোর মনে আছে?
ইয়াশ একটু হেসে নড়ে বসলো
— শুধু তোর কথা ভেবে ইশিতা কে কতো খুঁজেছি। শেষে তো নিউজ পেপারে ও বিজ্ঞাপন দিতে চেয়েছিলাম।
ইয়াশ সেই আগের মতই চুপ করে নাজমা চৌধুরীর কথা শুনছে
— কি রে তুই কিছু বলছিস না কেন?
— কি বলবো?
তুমি বলো আমি শুনছি।
নাজমা চৌধুরী চোখ থেকে চশমা খুলে বেড সাইড টেবিলে রাখলো
— তুই ইশিতা কে কিছু বলেছিস?
ইশিতা কি জানে তুই ওর ছোট বেলার সেই খেলার সাথী ইয়াশ।
— না।
— জানাস নি? আমি তো আজ ইশিতা কে সব বলে দিয়েছি। এটা অবশ্য জানতাম না তুই আমার আগেই ইশিতা কে চিনিস।
ইশিতা ও মনে হয় জানে না তুই ওর আসল পরিচয় সম্পর্কে জানিস।
— ইশিতার তো আমার কথা মনেই নেই। আর ছোট বেলা থেকে আমি ওকে ভালোবাসলে কি হবে ইশিতা তো আমাকে ভালোবাসে নি। আর আমি নিজে ও তো তখন জানতাম না আমি ইশিতা কে ভালোবাসি।
— তুই ছোট বেলা বুঝতে পারিস নি তুই ইশিতা কে ভালোবাসিস তবে যখন বড় হয়েছিস তখন তো বুঝতে পেরেছিস তুই ওকে ভালোবাসিস।
— কিন্তু ইশিতা তো বড় হওয়ার পর ইফান কে ভালোবেসেছে।
— এখন তো ইশিতা ইফান কে ভালোবাসে না। আর এখন সবথেকে বড় সত্যি হলো ইশিতা তোর বউ।
ইশিতা এতক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে নাজমা চৌধুরী ও ইয়াশের সব কথা শুনছিল। ইশিতা রুমে একা ছিল। অনেকক্ষণ হলো ইয়াশ নিজের রুমে যায় না তাই ইশিতা দেখতে এসেছিল ইয়াশ নিচে কোন ঝামেলা করছে না তো?
কিন্তু নিচেও যখন ইয়াশ কে পেল তা তখন নাজমা চৌধুরীর রুমে আসলো। ইশিতা রুমে ঢুকতে যাবে তখনই ইয়াশের কথা শুনতে পেল। নাজমা চৌধুরী আর ইয়াশের মধ্যে এসব কথা শুনে ইশিতা আর রুমে আসলো না।
ইশিতা দরজায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে বলে যাচ্ছে
— ইয়াশ আমাকে ছোট বেলা থেকেই ভালোবাসে?
আমি ওদের থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে ইয়াশ কে ভুলে গেলেও ইয়াশ আজও আমাকে ভুলেনি।
ইয়াশ এতো বছর ধরে নিঃস্বার্থ ভাবে আমাকে ভালোবেসে এসেছে।
এতো বছর পর ইয়াশ যখন জানতে পারলো আমি ই তার ইশু আর এটাও জানতে পারলো আমি ওর ছোট ভাই ইফান কে ভালোবাসি,আমার গর্ভে ওর ছোট ভাইয়ের সন্তান তখন ওর কেমন লেগেছে?
নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিজের ছোট ভাইয়ের সাথে দেখে নিশ্চয় ওর মাথা আকাশ ভেঙে পড়েছিল।
আমি না জেনে ইয়াশ কে কতো কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। নিজের অজান্তেই ইয়াশের ভালোবাসা কে ছোট করেছি।
কথা গুলো ভেবে ইশিতার চোখ ভিজে উঠলো। চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে নেওয়ার আগেই ইশিতা হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে নিলো। নাজমা চৌধুরী দরজার সামনে ইশিতা কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে
— ইশু, কি রে তুই দরজায় দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
ভেতর আয়।
ইশিতা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে ভেতর এলো। এমন ভাব করলো যেন ও কিছুই শুনেনি।
ইশিতা রুমে আসলে নাজমা চৌধুরী ইশিতা কে ইয়াশের পাশে বসতে বলে। ইশিতা কিছু একটা ভেবে পরহ্মনেই ইয়াশের পাশে বসে পড়ে।
— বাহ! তোদের দুজন কে এক সাথে বেশ সুন্দর লাগছে। বেশ মানিয়েছে তোদের দুজন কে।
ইশিতা কিছু বললো না। ইয়াশ উঠে দাঁড়িয়ে গেল।
— নিচে মনে হয় পার্টি শেষ। আমরা যাই তুমি ঘুমাও।
— কোথায় যাচ্ছিস এখনও তো আসল কথা টাই বলা হয়নি। ইশিতা এসে ভালোই করেছে। দুজনের সামনেই কথা টা বলা যাবে।
— কি কথা মা?
— আমি ভাবছি তোদের দু’জনের আবার নতুন করে বিয়ে দিব। তবে ইশিতার ডেলিভারির পর এখন না।
— আবার বিয়ে দিবে কেন মা?
— তোদের দুজনের বিয়ে কোন পরিস্থিতিতে কেমন ভাবে হয়েছে তা আমি জানি। আর তোদের বিয়েটা তো এখন বৈধ হয়নি।
ইশিতা প্রেগন্যান্ট। আর গর্ভবতী অবস্থায় বিয়ে হলে বিয়ে বৈধ হয়না। মানছি তুই তখন ইশিতার সন্মান বাঁচানোর জন্য, একটা নিঃপাপ বাচ্চার কে দুনিয়াতে আনার জন্য ইশিতা কে বিয়ে করেছিস।
পরেও তোদের সম্পর্ক টা পুরোপুরি ভাবে বৈধ হয়নি। তাই আমি চাই তোদের আবার সম্পূর্ণ নিয়ম রীতি মেনে বৈধ ভাবে বিয়ে হোক।
ইয়াশ তরল কন্ঠে
— ডেলিভারির এখনও অনেক সময় বাকি আছে। এসব নিয়ে পরেও ভাবা যাবে।
— হুম তা যাবে। পরেও আমার মনের কথা টা তোদের দু’জনকে ই জানিয়ে রাখলাম।
রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই পার্টি প্রায় শেষ সব লোকেরা চলে গেছে। যাওয়ার সময় সবাই ইফান কে খুঁজেছে তবে কোথাও পায়নি। ইফান নিজে পার্টি রেখে পার্টির মাঝ থেকে কোথায় উধাও হয়ে গেছে তা চিন্তা করতে করতে রিহা প্রায় অস্থির হয়ে উঠেছে। বার বার বাড়ির কাজের লোক গুলোর কাছে ইফানের কথা জিঙ্গেস করছে। মেইন ডোরের সামনে সমানে পায়চারি করে যাচ্ছে।
— ইফান কোথায় গেল? ভাল্লাগে না আর ইফান টা সব সময় এমন করে। কোথাও যাওয়ার আগে অন্তত বলে যাবে তো। ও কি জানে না ওর জন্য আমার কত টেনশন হয়।
রিহা নিজে নিজে কথা বলছে আর ইফান কে ফোনে ট্রায় করছে। বার বার ইফানের ফোন সুইচ অফ বললে রিহা রেগে নিজের ফোন টা কে জোরে আছাড় মারে। নিচে পড়ে ফোন টা কয়েক খন্ডে ভাগ হয়ে যায়। রিহা আর নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। রুমে চলে গেল।
ইফান কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না। ও এতো দিন রিহার কথা শুনে ইশিতা কে অনেক কষ্ট দিয়েছে। দিনের পর দিন নানা ভাবে ইশিতা কে অপমান করেছে। ইশিতা কে ছোট করার কোনো সুযোগ হাত ছাড়া করেনি ইফান। আজ সত্যি টা জানার পর নিজেকেই অপরাধী দাবী করছে ইফান।
ইফান তো সত্যি ই অপরাধী তা আর দাবী করার কি আছে।ইফানের ইচ্ছে হচ্ছে রিহা কে খুন করতে। ইফান রিহার পাপের জন্য রিহা কে সঠিক শাস্তি দিবে। কিন্তু এখন কি ভাবে ইশিতা কে ফিরিয়ে আনবে নিজের কাছে। এখন ইশিতার সামনে গিয়ে হ্মমা চাইলে ইশিতা কি ইফান কে হ্মমা করে দিবে। ইফান নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে এটা ভেবে কি ইশিতা ইফান কে দ্বিতীয় সুযোগ দিবে। নিজের ভালোবাসা, নিজের সন্তান কে কি করে ফিরে পারে ইফান?
ইফান কার ড্রাইভ করছে আর এই কথা গুলো ভেবে যাচ্ছে।
— আমার সত্যি টা জানতে বড্ড বেশিই দেরি হয়ে গেল। ইশিতা আমাকে হ্মমা করবে তো?
আমি আমার সন্তান কে ফিরে পাবো তো?
ওই রিহার জন্য আমি নিজের অংশ নিজের সন্তান কে অস্বীকার করেছি। রিহা কে তো আমি আস্ত রাখবো না। এই পৃথিবীতেই আমি ওকে জাহান্নামের শাস্তি দিব। রিহা প্রতি দিন মৃত্যু কামনা করবে তার পরেও ও মৃত্যু পাবে না। ওকে আমি তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে মারবো। এতো সহজে আমি রিহার মৃত্যু দিব না।
ইফান ঝড়ের গতিতে কার ড্রাইভ করেছে। ইফানের দু’চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। ইফান এমন জায়গায় এসে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে এখন সে না পারবে সামনে এগুতে, না পারবে পেছনে ফিরে গিয়ে সব কিছু আগের মত ঠিক করে নিতে।
চলবে……