সেই তুমি? পর্ব -৩১

0
2408

সেই তুমি?
পর্ব -৩১
Samira Afrin Samia(nipa)

ইয়াশ অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। ইশিতা রুমেই যেন কি কাজ করছে। ইয়াশ ড্রেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তৈরি হওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকিয়ে ইশিতা কে দেখছে। ইশিতা ইয়াশের দিকে তাকালে দুজন চোখাচোখি হয়ে গেলে ইয়াশ আবার চোখ নামিয়ে নেয়। এমনটা ইশিতা অনেকক্ষণ ধরেই খেয়াল করছে। কিন্তু কিছু বলছে না। ইয়াশ শার্টের হাতা ভাঁজ করে এদিক সেদিক তাকিয়ে কি যেন খুঁজতে লাগলো। ইয়াশ কি খুঁজছে তা ইশিতা বুঝতে পেরে একটা টাই এনে ইয়াশের সামনে তুলে ধরে।
— এটাই খুঁজছিলে?
— হ্যা।
ইয়াশ ইশিতার হাত থেকে টাই নিতে চাইলে ইশিতা টাই না দিয়ে নিজে ইয়াশ কে পড়িয়ে দিতে লাগলো। ইয়াশ ইশিতার চোখের দিকে এখনও তাকাচ্ছে না। মাথা সোজা করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।
ইশিতা টাই বাঁধতে বাঁধতে
— কি হলো আমার দিকে তাকাচ্ছো না কেন?
ইয়াশ ইশিতার কথার জবাবে কিছু বললো না।
— আমাকে ওভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলে কেন?
এবার ইয়াশ ইশিতার দিকে চোখ তুলে তাকালো ঠিকই কিন্তু সাথে সাথে আবার চোখ নামিয়ে নিয়ে ইশিতার হাত থেকে টাই নিয়ে ওপাশ ফিরে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেই বাঁধতে লাগলো।
হঠাৎ করে ইয়াশের কি হয়েছে তা ইশিতা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। ইয়াশের এমন বিহেইভ দেখে ইশিতা প্রথমে কষ্ট পেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে আবার ইয়াশের সামনে এসে দাঁড়ায়।
— নিজের বউ কে এমন ভাবে লুকিয়ে দেখতে হয় নাকি?
আমি তোমার বউ। আমার দিকে তুমি তাকিয়ে থাকলে আমি কিছু মনে করবো না।
— লুকিয়ে দেখবো কেন?
তোমাকে লুকিয়ে দেখার কি আছে?
— লুকিয়ে দেখার কিছু না থাকলে আমার চোখে চোখ পড়ার সাথে সাথে তুমি আমার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলে কেন?
— এমনি।
ইয়াশের টাই বাঁধা হয়ে গেলে ইয়াশ ইশিতার সামনে থেকে চলে এসে ওয়ালেট নিয়ে রুম থেকে বের হতে নিচ্ছিল।
এতক্ষণ ইশিতা খুব কষ্টে কান্না চেপে রাখলেও এখন আর পারলো না। ইশিতার দু’চোখ ভরে পানি পড়তে লাগলো।
— কি করেছি আমি। আমার সাথে এমন করছো কেন। আমার দোষ টা কি তা একবার বলো?
কথা গুলো বলেই ইশিতা ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগলো।ইয়াশ ইশিতা কে কান্না করতে দেখে রুম থেকে বের হতে নিয়েও হলো না। ইয়াশের চোখ ও পানিতে টলমল করছে।
— আমি যাকেই নিজের করে নিতে চাই, যাকেই আপন ভাবতে শুরু করি সেই আমার থেকে দূরে সরে যায়। আমার ভাগ্য টাই এমন। ইফান কে ভালোবেসে জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল করছি। প্রথমে ও আমাকে ধোঁকা দিলো। এখন যখন ওকে ভুলে তোমাকে ভালোবাসতে চেষ্টা করছি এখন তুমি আমার থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছো।
ইশিতা কেঁদে কেঁদে ফ্লোরে বসে পড়লো। ইয়াশ ইশিতার কাছে এসে
— চুপ কি বলছো এসব?
কে তোমাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আমি তোমাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ভালোবাসি নি। কথায় কথায় শুধু বাচ্চাদের মত কান্না করা।
— তুমি আমাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছো না। তাহলে আমার সাথে এমন করছো কেন কথা বলছো না।
ইয়াশ ইশিতা কে তুলে বেডে বসিয়ে হাত দিয়ে ইশিতার গাল বেয়ে পড়া পানি গুলো মুছে দিয়ে। মাথা নিচু করে
— তুমি এক সময় ইফান কে ভালোবাসতে। এখন হয়ত ভালোবাসো না। তবে ইফান তোমার জীবনে প্রথম ভালোবাসা।
ইশিতা টলমল চোখ নিয়ে ইয়াশের দিকে তাকিয়ে ইয়াশের কথা শুনছে
— ইফান ওর ভুল বুঝতে পেরেছে। এখন ও তোমাকে ফিরে পেতে চাই। তুমি ওকে একটা সুযোগ
ইয়াশ কথা শেষ করার আগেই ইশিতা দাঁড়িয়ে গেল।
— তুমি আমাকে এতো টা ও নিচু মনের মনে করো না। ইফান আমি অতীত তুমি আমার বর্তমান আর তুমি ই আমার ভবিষ্যত। ইফান ওর ভুল বুঝতে পেরেছে ভালো কথা, এখন তুমি ভাবলে কি করে আমি আবার ওর কাছে ফিরে যাবো।
ইফান আমার প্রথম ভালোবাসা তাই তুমি আমাকে ওর কাছে ফিরে যেতে বলছো। ওকে হ্মমা করে দ্বিতীয় একটা সুযোগ দিতে বলছো। আচ্ছা একটা কথা বলবে?
ইফান আমার প্রথম ভালোবাসা হলে, আমি কি তোমার প্রথম ভালোবাসা না?
তুমি পারবে আমাকে অন্যের হাতে তুলে দিতে?
ইয়াশের চোখের কোণা বেয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। ইয়াশ ইশিতা কে ওর চোখের পানি দেখতে দিলো না। আড়ালে ই চোখের পানি মুছে নিলো।
— ইফান ওর ভুল বুঝতে পেরে কষ্ট পাচ্ছে। আর তুমি তো ওকে ভালোবাসতে।
— ইফান ওর ভুল বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেছে।
আর হ্যা আমি ওকে ভালোবাসতাম কিন্তু এখন তো বাসি না।
আমি সবার সামনে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি। এখন আমার একটাই পরিচয় আমি তোমার স্ত্রী। আমি তোমাকে ভালোবাসি।
তোমার ভালোবাসা আমাকে বাধ্য করেছে তোমাকে ভালোবাসতে।
ইয়াশ কিছু বলছে না। চুপ করে ইশিতার কথা শুনে যাচ্ছে।
— আর ইফান ওর ভুল বুঝতে পেরেছে এটা খুব ভালো কথা এখন সব কিছু ভুলে গিয়ে নিজের ওয়াইফ কে নিয়ে সুখে সংসার করুক। রিহা ইফান কে পাগলের মত ভালোবাসা ইফান ও রিহা কে ভালোবাসার চেষ্টা করুক।
— তুমি কি ইফানের কাছে ফিরে যেতে চাও না।
— এই যে মি.জামাই আর একটা কথা মুখ দিয়ে বের করলে খুন করে ফেলবো।
ইশিতার মুখে এমন কথা শুনে ইয়াশ ব্যাবাচেকা খেয়ে গেল।
— কত বার বলতে হবে আমি তোমাকে ভালোবাসি। এক কথা একবার বললে কানে যায় না?
— আসলে।
— কি আসলে অনেক হয়েছে। সেই কখন থেকে আমাকে কাঁদাচ্ছো আর লুকিয়ে লুকিয়ে নিজে ও কেঁদে যাচ্ছো।
খুব ভালো লাগে আমাকে কষ্ট দিলে।
— আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আর তাই তোমার ইচ্ছে মত তোমাকে সিধান্ত নিতে বলছিলাম। যদি তুমি ইফানে কাছে ফিরে যেতে চাও। তাহলে আমি তোমাকে জোর করে আটকে রাখবো না। এমনকি তোমাকে বাঁধা ও দিব না।
ইশিতা ইয়াশ কে নিজের দিকে ফিরিয়ে ইয়াশের পায়ের উপর নিজের দু’পা রেখে ভর দিয়ে ইয়াশের গলায় হাত পেঁচিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
ইয়াশ বেশ অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে মুখ একটু হা করে তাকিয়ে আছে।
ইশিতা হাত দিয়ে ইয়াশের মুখ মিশিয়ে দিয়ে
— কি মি. এতো অবাক হচ্ছেন কেন?
আমি আপনারই বউ। তবে এটা আমার নতুন রূপ। এই রূপে আপনি আমাকে আগে কখনও দেখেন নি।
ইয়াশ ইশিতার কোমর পেচিয়ে ধরে নিয়ে
— তাই নাকি?
তাহলে তো ভালোই হলো। প্রতি দিন একটা করে নতুন নতুন রূপ দেখা যাবে। আর এতে অবাক হবো না বরং সারপ্রাইজড হবো।
— আচ্ছা?
এবার ইয়াশ ইশিতা কে পাঁচকোলে তুলে নিয়ে। ইশিতার নাকের সাথে নিজের নাকের ডগা একটু ঘসে দিয়ে দুষ্টুমি করে বললো
— হুম ম্যাডাম হুম।
ইশিতা চোখ বন্ধ করে নিলো হতে পারে ভয় পেয়ে নয়তো হতে পারে ইয়াশ এভাবে কোলে তুলে নেওয়ার লজ্জা পেয়েছে।
— কি করছেন পড়ে গেলে কেমন হবে? নামান বলছি।
— এই টুকু বিশ্বাস রাখতে পারেন আমি আপনাকে ফেলবো না।
— হুম বিশ্বাস আছে। অনেক বিশ্বাস আছে।
এই বলে ইশিতা ইয়াশের গলা থেকে হাত ছেড়ে দিলো। ইয়াশ ইশিতার কান্ড দেখে একটু মৃদু হাসলো। কিছু বললো না।
প্রায় কিছুক্ষণ পর ইশিতা নিজের থেকে বলে উঠলো।
— আজ কি অফিসে যাবে না?
নাকি সারা দিন এভাবেই বউ কে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে?
— ইচ্ছে তো তাই করছে তবে অফিসে ও তো যেতে হবে। আমার যে অনেক কাজ। আমি না গেলে সেই কাজ গুলো কে করবে?
— হুম এখন অফিসে গিয়ে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে আবার তাড়াতাড়ি করে বাসায় চলে আসো।
— হুম।
— হুম না মশাই নামান আমাকে।
ইয়াশ ইশিতা কে নামিয়ে দিয়ে শার্ট টা একটু ঠিক করে ফোন আর ওয়ালেট নিয়ে রুম থেকে বের হতে যাবে ঠিক তখনই ইশিতা পেছন থেকে “” আহ””” করে শব্দ করে পেটে হাত দিয়ে নিচু হয়ে গেল।
ইয়াশ ইশিতার শব্দ পেয়ে পেছন ফিরে দৌঁড়ে এসে
— কি হয়েছে ইশিতা?
শরীর খারাপ লাগছে নাকি? আমি ডক্টর রে ফোন দিবো?
ইয়াশ নাজমা চৌধুরী কে ডাকতে নিলে ইশিতা মুখে হাত দিয়ে
— এভাবে চেচাঁমেচি করছো কেন?
ঠিক আছি আমি। আমার কিছু হয়নি।
— কিছু হয়নি তাহলে এমন করে উঠলে কেন? ইশিতা ইয়াশের হাত নিয়ে পেটে ধরে
— দুষ্টু টা যে বড্ড বেশি জ্বালাচ্ছে। মনে হচ্ছে বাইরে আসার জন্য ওর তড় সইছে না।
ইয়াশের মুখে প্রাপ্তির হাসির রেখে স্পষ্ট ফোঁটে উঠেছে।
— ও কিছু করেছে?
— কিছু করেছে? ফুটবল খেলছে। একবার আসুক বাইরে তারপর আচ্চা করে বকে দিব।
— হুম। তোমাকে বকতে দিলে তো। কিছু বলতে পারবে না আমার ছেলেকে।
ইশিতা অবাক হয়ে
— ছেলে?
তুমি কি করে জানলে ছেলে না মেয়ে হবে?
— সিউর জানি না। তবে আমার মন বলে আমাদের ছেলে হবে।
— আচ্ছা তা হবে একটা।
এখন অফিসে যাও। লেট হচ্ছে তো।
ইয়াশ আলতো করে দুই হাতে ইশিতার হাত চেপে ধরে বের হয়ে গেল।

ইয়াশ অফিসে যাওয়ার জন্য রুম থেকে বের হয়ে চলে গেল। সাথে সাথেই ইফান রুমে ঢুকলো। ইশিতা কি যেন করছিল ইফানের শব্দ পেয়ে ফিরে দাঁড়ালো। ইফান রাগে কটমট করছে।
— তুমি আমাকে ভালোবাসো। ভাই কে না। আমি আমার বাচ্চা কে চাই।
ইশিতা ইফানের কথায় কান না দিয়ে রুম থেকে বের হতে চাইলে ইফান ইশিতার হাত ধরে নেয়।
— কোথায় যাচ্ছো?
তোমার সাথে আমার কথা আছে। তুমি এভাবে আমার কথা না শুনে চলে যেতে পারো না।
— হাত ছাড়ো ইফান।
— না তোমাকে আমার কথা শুনতেই হবে।
— হাত ছাড়ো বলছি।
ইশিতা ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিলো।
— দ্বিতীয় বার আমার হাত ধরার সাহস করবে না।
ইফান ইশিতার দুই হাত চেপে ধরে দেওয়ালের সাথে আটকে ধরে
— কেন? আমি তোমার হাত ধরার সাহস করবো না কেন?
— আমার হাত ধরার অধিকার তুমি অনেক আগে হারিয়েছো।
— ভাইয়ের সাথে তো দেখছিলাম খুব ভালই রোমান্স করছিলে। ভাই তোমার হাত ধরার সময়, তোমাকে কোলে তুলে নেওয়ার সময় তো তোমার কোন অসুবিধা হয়নি।
— আমার স্বামী আমার হাত ধরেছে অন্য কেউ তো ধরেনি সমস্যা কেন হবে। আর স্বামীর সাথে স্ত্রী রোমান্স করবে এটা তো অস্বীকার কিছু না।
তুমি তাহলে লুকিয়ে আমরা কি করছি তা দেখছিলে। বড় ভাইয়ের ঘরে আড়ি পাতার আগে লজ্জা করলো না। এতো টা নিচে নামতে পারলে তুমি। অবশ্য তোমার কাছে এসব নতুন কিছু না।
ইশিতা ধাক্কা দিয়ে ইফানের থেকে সরে এসে দাঁড়াল।
— স্বামী? তুমি কি তাহলে ভাই কে মেনে নিয়েছো?
— অবশ্যই মেনে না নেওয়ার কি আছে। এখন উনি আমার স্বামী। আর আমি আমার স্বামী কে অনেক ভালোবাসি।
ইফান রেগে গিয়ে ইশিতার গালে শক্ত করে চেপে ধরে
— তুই আমাকে ভালোবাসতিস। আমার পিছনে পাগলের মত ঘুরতি। এখন তুই আমার ভাই কে পেয়ে সব কিছু ভুলে গেলি। সত্যি ই তুই একটা ক্যারেক্টারলেস। তোর মত মেয়ে যখন যাকে পায় তাকেই ফাঁসিয়ে নেয়।
— হ্যা আমি ক্যারেক্টারলেস। আমি আমার স্বামী কে ভালোবাসি। তোর মত অমানুষ কে না। আরে তুই তো একটা পশু। মনে আছে কি ভাবে দিনের পর দিন তুই আমাকে অপমান করেছিস। আমার ভালোবাসা কে অবহেলা করে ফিরিয়ে দিয়েছিস আমাকে। আমি যখন আমার সন্তানের দাবি দিয়ে তোর কাছে যেতাম তখন তুই লাথি দিয়ে আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতি। মনে আছে এসব কথা। এখন তোর ভুল বুঝতে পেরেছিস তাই আমাকে ফিরিয়ে নিতে চাইছিস। যদি কোন দিন তোর ভুল না ভাঙ্গত। ইয়াশ আমাকে বিয়ে না করতো তখন আমার কি অবস্থা হতো এটা ভেবে দেখেছিস কখনও। আমি ক্যারেক্টারলেস হলে তুই নিজে কি?
ইফান ইশিতার কথা শুনে কিছুই বলতে পারলো না। ইশিতা ইফান কে আর এক মিনিট ও সময় না দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে চলে গেল।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here