সেই তুমি?
পর্ব -৪০
Samira Afrin Samia (nipa)
ইয়াশ আর ইশিতা নাজমা চৌধুরীর রুমের সামনে দাঁড়িয়ে
— মা আসবো?
— কত বার বলবো আমার রুমে আসার জন্য তোদের অনুমতি নিতে হবে না।
ইয়াশ ইশিতা ভেতরে এসে। ইয়াশ বললো
— কেন ডাকছিলে মা।
নাজমা চৌধুরী চশমা টা পড়ে টেবিলের উপর থেকে একটা কার্ড নিয়ে ইয়াশের হাতে দিলো।
— দেখ তো এটা কেমন হয়েছে?
— কি এটা? কিসের কার্ড?
— খুলেই দেখ না।
ইয়াশ কার্ড খুলে দেখে এটা ইয়াশ আর ইশিতার বিয়ের কার্ড।
— এসব কি মা?
— আমি ভাবছিলাম তোদের আবার নতুন করে বিয়ে দিব। এই ইচ্ছা টা অনেক আগে থেকেই ছিল। কিন্তু মাঝের সময় টা তে যা হয়ে গেল।
নাজমা চৌধুরী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে
— আমি তোদের বিয়ে আবার দিতে চাই। সব আয়োজন শেষ করে ফেলেছি। অনেক দিন ধরেই প্লেন করছিলাম। তোদের কিছু জানানো হয়নি।
ইয়াশ কি বলবে কিছু ভেবে না পেয়ে চুপ করে আছে। ইশিতা ও মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। নাজমা চৌধুরী ওদের দু’জন কে চুপ করে থাকতে দেখে
— কি হলো তোরা এভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
কিছু তো বলবি।
ইয়াশ মাথা নেড়ে
— তুমি যা ভালো মনে করো তাই করো মা।
নাজমা চৌধুরী ইয়াশের কথা শুনে একটু হাসলো।
— আচ্ছা ঠিক আছে। এখন বল কার্ড টা কেমন হয়েছে?
ইয়াশ কিছু বলতে যাওয়ার আগেই নাজমা চৌধুরী ইয়াশ কে থামিয়ে দিয়ে
— থাক তোর বলতে হবে না। ইশিতা তুই বল তোর কাছে কেমন লেগেছে। পছন্দ হয়েছে তো?
— তুমি কার্ড টা পছন্দ করেছো, আমার পছন্দ না হয়ে পারে নাকি।
— আচ্ছা তাহলে তোরা এখন যা। বিয়ের অনেক কাজ বাকি আছে। কাল থেকে সব কাজ শুরু হয়ে যাবে।
আর ইশিতা
না থাক তোর কিছু করতে হবে না। আমি নিজে গিয়ে তোর মামা মামী কে কার্ড দিয়ে আসবো।
ইয়াশ আর ইশিতা নিজের রুমে চলে গেল।
রুমে ঢুকার সাথে সাথে ইয়াশ হেঁচকা টান দিয়ে ইশিতা কে নিজের কাছে নিয়ে যায়। ইশিতা ইয়াশের বুকের উপর গিয়ে পড়ে।
— কি হচ্ছে মিস্টার?
— কই কি হচ্ছে কিছু না তো।
— তাহলে এভাবে আচমকা টান দিয়ে কেন? যদি পড়ে যেতাম।
— আমি তোমাকে পড়ে যেতে দিলে তো পড়তে।
ইশিতার যেন কেনই আজ ইয়াশের চোখে চোখ রাখতে লজ্জা লাগছে।
— কি ম্যাডাম এভাবে চোখ লুকাচ্ছ কেন?
আমার দিকে তাকাও।
ইশিতা ইয়াশের বুকে আরও শক্ত করে জাপটে ধরলো। ইয়াশ বুঝতে পারছে ইশিতা লজ্জা পাচ্ছে।
— আচ্ছা আমার মায়াবতীর জন্য কোন কালারের বেনারসি নিলে ভালো হবে?
কোন রঙে আমার মায়াবতী কে আরও সুন্দর লাগবে?
— জানি না।
— তুমি না জানলে কিভাবে হবে?
আমি চাই বিয়ের দিন সবাই যেন আমার মায়াবতী কে ই চেয়ে দেখে। আমাকে না দেখলে ও হবে।
আমি নিজের হাতে তোমাকে বউ সাজাবো।
ইয়াশ আর কিছু বলার আগেই ইশিতা বলে উঠলো।
— এতো সুখ আমার কপালে লিখা ছিল বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা আমার কপালে এতো সুখ সইবে তো?
ইয়াশ নিজের দুই হাতে ইশিতার গাল ধরে কপালে গভীর ভাবে একটা চুমু দিয়ে
— কেন সইবে না?
এখনও তো অনেক সুখ তোমার পাওয়ার বাকি আছে। আমি পৃথিবীর সব সুখ এনে তোমার হাতে তুলে দিব।
— তুমি শুধু সারা জীবন আমার পাশে থেকো এর থেকে বেশি আমি আর কিছু চাই না।
পরের দিন বিকেলে ইশিতা রিহার রুমে যায়। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রিহা কে ডাকতে যাবে। তখনই ভেতরে তাকিয়ে দেখে বুঝতে পারলো রিহা বেডে উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছে। কান্নার তেমন শব্দ হচ্ছে না। তবে মাঝে মাঝে হেঁচকির শব্দ শুনা যাচ্ছে।
ইশিতা আর ভেতরে গেল না। বাহিরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে আসলো। রিহা ওর পাপের জন্য যথেষ্ট শাস্তি পেয়েছে। তার পর ও ইফান রিহা কে মেনে নিচ্ছে না। উল্টে রিহা কে আরও কষ্ট দিচ্ছে। মেয়েটা সত্যি ই ওর ভুল বুঝতে পেরে ভালো হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।ইফান এখন বিজন্যেস সামলাতে শুরু করেছে। কাজ গুলোর সাথে নিজেকে খুব সহজেই মানিয়ে নিয়েছে ইফান। দিনের বেশির ভাগ সময় অফিসে থাকে। অনেক রাত করে বাসায় ফিরে যাতে রিহার সামনে না পড়তে হয়।
আজও অনেক রাত করেছে অফিসে। ইচ্ছে করেই ইফান এতো রাত পর্যন্ত অফিসে থেকে কাজ করে।
অফিস থেকে বের হলো রাত এগারোটার দিকে। বাসায় ফিরতে ফিরতে সাড়ে এগারোটার বেঁজে গেছে।
ইফান রুমে এসে কোর্ড টা খুলে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে ওয়াশরুমে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখে রিহা দাঁড়িয়ে আছে। ইফান রিহা কে দেখেও না দেখার ভান করে রিহার সামনে দিয়ে চলে আসলো।
— এতো রাত করে বাসায় ফিরলে কেন?
ইফান কিছু বললো না।
— তুমি প্রায় ই রাত করে বাসায় ফিরো।একদিন ও রাতের খাবার খাও না। আচ্ছা ইফান তুমি কেন এমন করো?
— আমি এখন তোর সাথে কথা বলার মোডে নেই। একা একটু একা ছাড়বি প্লিজ।
— কেন একা ছাড়বো তোমাকে?
তুমি কেন সব সময় আমাকে ইগনোর করে চলো। আমি তোমার স্ত্রী। তোমার উপর আমার যথেষ্ট অধিকার আছে।
— তুই আমার উপর অধিকার দেখাতে আসছিস?
— তুমি আমাকে বলো আমার কি ভুল হয়েছে যার জন্য তুমি আমার সাথে এমন করছো?
— তোর কয়টা ভুল ধরিয়ে দিব?
মনে নেই তুই কি কি ভুল করেছিস?
— আমি আমার ভুল গুলো শোধরে নিতে চাইছি তুমি আমাকে একটু সাহায্য করো তাহলে আমি আমার সব ভুল শোধরে নিব।
— সারা দিন অফিসে অনেক কাজ করেছি। ভিষণ ক্লান্ত লাগছে। আমাকে একটু শান্তিতে ঘুমাতে দে।
— আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে আগে খেয়ে আসো তার পর ঘুমাও।
— আমি খাবো না।
— খাবো না বললে হবে না। একদিন ও রাতে খাও না।
রিহা ইফানের হাত ধরে নিয়ে যেতে চাইলে ইফান এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে।
— তোকে বারণ করেছি আমার উপর অধিকার দেখাতে।
আমি বলেছি খাবো না,তো খাবো না। এতো জোর করার কি আছে।
— কেন খাবে না তুমি?
কেন প্রতি দিন এতো রাত করে বাসায় ফিরো?
অফিসে তোমার এতো কিসের কাজ? বাসায় তোমার বউ আছে মা ভাই সবাই আছে তাদের সময় না দিয়ে পুরো সময় টা অফিসে কাটাও এভাবে মানুষের জীবন চলতে পারে না।
ইফান রিহার কথা শুনে রেগে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে ফুলদানি টা নিয়ে জোরে ছুঁড়ে মারলো। ফুলদানি টা ছিটকে এসে রিহার কপালে লাগে। কপাল অনেক টা কেটে যায়। রক্ত বের হতে লাগলো। ইফান ভাবতে পারেনি ফুলদানি টা রিহার কপালে এসে লাগবে।
রিহা কপালে হাত ধরে অভিমানী চোখে ইফানের দিকে তাকিয়ে আছে। রিহা ভেবেছিল ইফান তার কাছে আসবে দেখবে কপাল টা কতটুকু কেটেছে। তবে রিহার সব ধারণা ভুল প্রমান হলো। ইফান কিছু না বলে এমন ভাব করলো যেন কিছুই হয়নি। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বেডে গিয়ে শুয়ে পড়লো।রিহা মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে চোখ থেকে গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ইফান এতটা নিষ্ঠুর হলো কিভাবে। রিহার জন্য কি ইফানের একটু ও মায়া হয় না। রিহা কি ইফানের চোখে এতটাই খারাপ।
সকালে রিহা কিচেনে রান্না করছে। ইশিতা কিচেনে ঢুকতে ঢুকতে
— আরে রিহা এতো সকালে কি রান্না করছো?
আজ তো দেখি তুমি আমাকেও পেছনে ফেলে দিলে।
রিহা কাজ করতে করতে নিচের দিকে তাকিয়ে
— ইফানের জন্য খাবার বানাচ্ছি। রাতে কিছু খায়নি। না খেয়েই শুয়ে গেছে। এখন অফিসে যাওয়ার আগে কিছু বানিয়ে দিচ্ছি। অফিসে কি যেন খাওয়ায় কে জানে?
— বাব্বাহ স্বামীর দেখছি অনেক সেবা যত্ন করছো। ভালো ভালো।
রিহা ইশিতার কথা শুনে একটু হাসলো। ইশিতা রিহার দিকে তাকাতে লক্ষ্য করলো রিহার কপালে ব্যান্ডেজ করা।
— তোমার কপালে কি হয়েছে রিহা?
রিহা ইশিতার কথা এড়ানোর চেষ্টা করে
— কই কি হয়েছে। কিছু হয়নি তো।
— কিছু হয়নি কি করে দেখি। এদিকে তাকাও।
ইশিতা জোর করে রিহা কে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দাঁড় করালো।
— কি হয়েছে বলো?
— একটু কেটে গেছিল।
— কিভাবে কাটলো?
— দরজার সাথে লেগে।
— আমার কাছেও মিথ্যা বলছো?
রিহা কিছু না বলে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিল।
— ইফান এখনও তোমার সাথে এরকম করে?
— ইফান একদিন ঠিক নিজের ভুল বুঝবে। আর আমাকে মেনে নিবে আমি সেই দিনের অপেক্ষা করে নাহয় ইফানের দেওয়া কষ্ট গুলো সহ্য করে নিলাম।
ইশিতা কি বলবে। বলার মত কোন কথা খুঁজে পাচ্ছে না। রিহা যখন খারাপ ছিল তখন ইফান ঠিকই ওকে বিশ্বাস করতে। আজ রিহা ভালো হয়ে গেছে তার পরও ইফান এখন ওকে বিশ্বাস করতে চাইছে না।
নাজমা চৌধুরী ইয়াশ রিহা ইশিতা সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। ইফান সিঁড়ি দিয়ে নেমে সোজা বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে নিচ্ছিল। এমন সময় ইয়াশ পেছন থেকে ইফান কে ডেকে উঠে।
— ইফান।
ইফান ইয়াশের ডাক শুনে পেছন ফিরে তাকিয়ে
— হ্যাঁ ভাই কিছু বলবি?
— এতো সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছিস?
— অফিসে।
— ব্রেকফাস্ট করেছিস?
— না। অফিসে গিয়ে করে নিব।
ইফান চলে যেতে নিলে ইয়াশ আবার ডাকলো।
— এদিকে আয়। ব্রেকফাস্ট করে তার পর যেখানে ইচ্ছে যা।
— না ভাই আমি যাই লেট হয়ে যাচ্ছে।
— এদিকে আসতে বলছি?
কিসের এতো কাজ অফিসে, যে না খেয়ে তোকে প্রতি দিন অফিসে চলে যেতে হবে।
ইফান ইয়াশের সাথে কথা না বাড়িয়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসে।
রিহা তাড়াতাড়ি করে ইফান কে খাবার দিলো। ইফান রিহা কে কিছু না বলে শুধু একবার রিহার দিকে তাকিয়ে আবার নিচের দিকে তাকিয়ে খাওয়া শুরু করলো।
— হুম তো এতো কি কাজ অফিসে?
— তুই তো জানিস ই ভাই অফিসে কি কি কাজ থাকে।
— জানি বলেই তো জিঙ্গেস করছি। আমি ও এতদিন অফিস সামলিয়েছি। এখনও বাসায় বসেই অফিসের সব কাজ করি। তোর মত তো এতো সকালে বের হয়ে শেষ রাতে কখনও বাসায় ফিরিনি।
দেখ ইফান এভাবে কখনও কারো জীবন চলতে পারে না।
ইফান খাওয়া শেষ করে উঠে গেল। ইয়াশের কথার কোন উত্তর দিল না।
ইফান চলে গেলে ইয়াশ নাজমা চৌধুরী কে বলতে লাগলো
— আমাদের ইফান টা এমন কেন হয়ে গেল মা।
আগে জোর করেও অফিসে পাঠানো যেত না। আর এখন অফিস থেকে বাসায় ফিরতে চায় না। কাজ থাকলেও আর না থাকলেও অফিসেই বসে থাকে। বাসায় ফিরে না। আমি খোঁজ নিয়েছি। ইফান নিজেকে অফিসের মধ্যে বন্দী করে নিয়েছে মা। ওকে কে বুঝাবে এভাবে জীবন চলে না।
নাজমা চৌধুরী আঁচল দিয়ে চোখ মুছে।
— জানি না বাবা। আমার ইফান টা কবে আবার আগের মত হবে। সারাক্ষণ হেসে খেলে ছুটে বেড়ানো ছেলেটা হঠাৎ এমন ভাবে পাল্টে যাবে তা আমি কখনও ভাবিনি।
ইশিতা পাশে বসে সব কিছু শুনছে আর মনে মনে ভাবছে ও যদি ইফান কে বুঝায় তাহলে নিশ্চয়ই ইফান বুঝবে। ইফান এখন ইশিতার সাথে ও তেমন কথা বলে না। ইশিতা কে ফিরে পাবার জেদ টা ও কমে গেছে। এখন শুধু ইফানের একটাই চাওয়া ও যেকোন ভাবে রিহা কে ডিভোর্স দিবে।
বিকেলে রিহা রুমে ছিল।এমন সময় ফোন বেঁজে উঠলে রিহা ফোন রিসিভ করে কানে তুলে নেয়।
— কে রকিব?
— চিনতে পারছিস তাহলে?
— চিনবো না কেন?
বল এতদিন পর কি করে মনে পড়লো?
— তোর সাথে খুব জরুরি কিছু কথা আছে। তুই কি আমার সাথে একটু দেখা করতে পারবি?
— দেখা করতে হবে?
— হুম। খুব দরকারি কথা। যা তোকে বলতেই হবে।
— এখন তো আমি তেমন বাসা থেকে বের হই না। তবে দেখি। কবে কোথায় দেখা করতে হবে?
— পারলে কাল ই দেখা করিস। তোর সময় হলে আমাকে ফোন দিস আমি তোকে কোথায় আসতে হবে তা বলে দিব।
চলবে…….