সেই মেয়েটি আমি নই
১ম পর্ব
জবরুল ইসলাম
তুলির ফরসা নগ্ন ঘাড় দেখা যাচ্ছে। সদ্য স্নান করে চুল মুছতে মুছতে এসে দাঁড়িয়েছে আয়নার সামনে।
বিছানা থেকে তাকিয়ে আছে ইশতিয়াক। সে চাইলেই এখন উঠে গিয়ে বাহুডোরে বেঁধে ঘাড়ে চুমু খেতে পারে। কারণ রূপবতী তরুণী তার বিয়ে করা পত্নী। তবুও আজ এটা করবে না বলে ঠিক করেছে। আজ রাতেও তুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া থেকে বিরত থেকেছে। এর কোনো বিস্ময়কর ব্যখ্যা নেই। এটা তার নিজের সঙ্গে এক ধরনের খেলা। সে মাঝে মাঝে দূর থেকেও উপভোগ করতে চায় তুলিকে। যেন এই রূপবতী তরুণী তার স্ত্রী নয়- প্রণয়িনী। যেন পাশের বাসার জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা রমণী। যেন গোসল শেষে কোনো বাসার ছাদে বালিকা কাপড় রোদে দিতে এসেছে কিংবা চেয়ারে বসে ভেজা চুল শুকোতে মেলে বসে আছে। তাদেরকে দূর থেকে কেবল মুগ্ধ হয়ে দেখা যায়, প্রেমে পড়া যায়, চাইলেই ছোঁয়া যায় না।
সর্বপরি ইশতিয়াক মাঝে মাঝে তুলিকেও না পাওয়ার বিরহ বেদনা উপভোগ করতে চায়। এ যেন তার ব্যক্তিগত ছেলেমানুষি খেলা। কিন্তু ইশতিয়াক পারলো না। চোখের সামনে তুলির সদ্য স্নান করা উম্মুক্ত পিঠে মুক্তোর মতো জ্বলজ্বল করছে ফোটা ফোটা জল। লাল ব্লাউজের উপরিভাগ খানিকটা ভিজে আছে। তুলি আয়নায় ওর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে শাড়ির আঁচল টেনে ঢেকে নিল পিঠ।
নিজেকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, নিজের সঙ্গে প্রতারণা করে বিছানা থেকে উঠে গেল ইশতিয়াক।
তুলিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে থুতনি মাথায় ঠেকিয়ে আয়নায় তুলির চোখের পানে চোখ রাখে। চোখ নামিয়ে নেয় তুলি। যেন লজ্জা পেয়েছে নববধূ। মাথা থেকে শ্যাম্পুর মিষ্টি ঘ্রাণ নাক দিয়ে ঢুকে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ায় যেন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দাবিতে দেহে মিছিল হচ্ছে। এটা কি শ্যাম্পুর নিজস্ব ঘ্রাণ? কৃতিত্ব কি তার? না-কি রূপবতীদের চুলে গিয়ে আরও মোহময় হয়, মহিমান্বিত হয়।
ইশতিয়াকের নিজের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি এখনও পুরোপুরি ভঙ্গ হয়নি- ক্ষীণ আশা আছে। সে কেবল মাথায় থুতনি ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমনটা প্রেমিক-প্রেমিকারাও করতে পারে।
– ‘তুলি।’
– ‘হু।’
– ‘টাওয়েল দাও আমি মূছে দিচ্ছি চুল।’
– ‘চুল কি ভেজা? মূছে নিয়েছি তো।’
– ‘ভালোভাবে মূছে দেই, দাও।’
তুলি টাওয়েল দেয়।
চুল মূছে দেয়া শেষ করে মুঠো করে ঘাড় থেকে সব চুল সরিয়ে সামনে নেয় ইশতিয়াক। বাহুডোরে বেঁধে নিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় উম্মুক্ত ঘাড়ে। ভেঙে ফেলে প্রতিশ্রুতি।
তুলি গলায় কৃত্রিম বিরক্তি এনে বললো,
– ‘ছাড়ুন তো।’
ইশতিয়াক অবাধ্য বর। সে ছাড়ে না। উল্টো তুলিকে টেনে ঘুরিয়ে চোখে চোখ রেখে বলে,
– ‘খুব রাগ হয়েছিল শাড়ি পরোনি বলে। অথচ এই ভোরে গোসল করে পরে আছো।’
তুলি পুনরায় মোচড়া-মুচড়ি করে বললো,
– ‘ছাড়ুন তো, আমি কারও জন্য পরিনি। এখন ইচ্ছা হইছে তাই পরেছি। ছাড়ুন না প্লিজ, অনেক কাজ পড়ে আছে তো আমার।’
ইশতিয়াক না ছেড়ে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে টেনে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে কানের কাছে গুন-গুন করে বললো, “প্রাণ চায় চক্ষু না চায়….”
তুলি লজ্জায় লাল হয়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ বলছি আপনাকে, আমি সবেমাত্র গোসল করে এসেছি তো ঢং করতে। ছাড়ুন তো, ছাড়ুন বলছি।’
– ‘আমার ছুটির দিনের ভোরটাই সুন্দর করে দিয়েছো শাড়ি পরে। কয়দিন থেকে বলি পরতে, কে শুনে কার কথা।’
– ‘হ্যাঁ জনাব, আর তাই আপনি গতকাল ফাইনালি মেয়েদের মতো অভিমান করেছিলেন, তাই না?’
– ‘আমি অভিমান করেছি কে বললো? সারাদিনে অফিস থেকে এসে ভালো লাগছিল না কিছু।’
– ‘জি আচ্ছা আর বলতে হবে না, আমিও কারও জন্য শাড়ি পরিনি। ছাড়ুন তো, ছাড়ুন বলছি।’
নিজেকে মুক্ত করে নেয় তুলি৷ ফোনটা বেজে উঠলো তখনই। ইশতিয়াক বালিশের পাশ থেকে তুলির মোবাইল এগিয়ে দিয়ে বললো,
– ‘অপরিচিত মনে হচ্ছে।’
তুলির বুকটা কেঁপে উঠে। হাত বাড়িয়ে মোবাইল নিয়ে কেটে দেয় কল।
– ‘কি হলো রিসিভ করলে না যে?’
– ‘অচেনা নাম্বার, গতকালও একবার এসেছিল৷ কেউ ফাজলামো করছে হয়তো। রিসিভ করার দরকার নেই।
যাইহোক, আপনি ফ্রেশ হন, অফিসে যাবেন না?’
ইশতিয়াক আর সেটা নিয়ে ভাবতে গেল না। সে রসিকতা করে কৃত্রিম হতাশা দেখিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
– ‘ম্যাডাম আমাকে তাড়ানোর জন্য এতটাই পাগল হইছে যে, আজ শুক্রবার সেটাই ভুলে বসে আছে।’
তুলি ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠলো। একটু নার্ভাস হলেই সে এরকম ভুল-ভাল বলে বসে। ভাগ্যিস ইশতিয়াক সবকিছু পজিটিভলি নিচ্ছে।
তুলি ফিক করে হেঁসে বললো,
– ‘তাড়ানোর জন্য না, আপনি আজকাল রোজই অফিসে ‘যাচ্ছি যাচ্ছি’ করে দেরি করে যান।’
ইশতিয়াক আবার উঠে দাঁড়ায়, পাশের চেয়ারটা টেনে রাখে তুলির পেছনে। দুই হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বসিয়ে বলে,
– ‘এমন রূপবতী বউ থাকলে অফিস যেতে ইচ্ছা করে না-কি?’
তুলির কাঁচভাঙা হাসিতে রুমটা ভরে উঠলো। ইশতিয়াক হাতের তালুতে তেল নিয়ে ওর চুলে দিচ্ছে। মানুষটাকে আয়নায় তাকিয়ে দেখছে তুলি। দিনকে দিন যেন শিশু হয়ে যাচ্ছে। অথচ মাথায় দু’একটা সাদা চুল উঁকি মারা শুরু করেছে। দেখতে সুদর্শন না বলার উপায় নেই। লম্বা আর সুঠাম দেহের অধিকারী। মাথাভর্তি কালো চুল।
এখন শর্ট প্যান্টের সঙ্গে বেগুনি রঙের পাতলা গেঞ্জি পরে আছে। এরকম পোশাকে একদম বাচ্চা ছেলে লাগে ওকে। অথচ অফিসে যাওয়ার সময় পোশাক পরে নিলে লাগে ভিন্ন কোনো পুরুষ।
– ‘কি হলো এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’
– ‘আপনাকে দেখি।’
– ‘আমাকে দেখার কি হলো।’
– ‘কিছু হয়নি, আচ্ছা শুনুন না, আজ কোথাও বেড়াতে যাই। আমরা কিন্তু বিয়ের পর দূরে কোথাও বেড়াতে যাইনি।’
ইশতিয়াক চুল বেঁধে দিতে দিতে বললো,
– ‘অফিস থেকে লম্বা ছুটি ছাড়া কোথাও বেড়াতে যাওয়া যায়, বলো?’
– ‘তাহলে ঢাকার আশেপাশে কোথাও যাই।’
– ‘সে তো যাওয়াই যায়। আজই বিকেলে যাই, বলো কোথায় যাবে।’
– ‘কাশফুল দেখতে যাব।’
– ‘কাশফুল কোথায়?’
– ‘দিয়াবাড়ি কাশবন আছে না?’
– ‘ও হ্যাঁ, আচ্ছা, তাহলে যাওয়া যায়।’
জুম্মার নামাজ পড়ে এলো ইশতিয়াক। টুপি মাথা থেকে রেখে বললো,
– ‘ক্ষুধা লাগছে, আসো খাই।’
তুলি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। ইশতিয়াকের চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে কথাটা ডাবল মিনিং করে বলেছে সে।
বিছানায় শুয়ে মোবাইল টিপছিল তুলি। মোবাইল রেখে উঠে গেল ইশতিয়াকের কাছে। পরনে পাঞ্জাবি আর খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে মানুষটাকে দেখতে ভীষণ মায়া লাগে। আনমনে তুলি নিজের দু-হাত বাড়িয়ে ওর গালে ধরলো।
– ‘কি হলো?’
তুলি খানিক লজ্জা পেয়ে ওর বুকে মুখ লুকোয়।
ইশতিয়াক ওর মাথায় হাত রেখে বললো,
– ‘চলো খেয়ে নিই, কাশবনে যাবে বলেছিলে তো।’
– ‘হ্যাঁ চলুন।’
– চলবে…