#সেই_রাতে,পর্ব_21,22
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_21
প্রিতম পিছনে ফিরে দেখে ওর বাবা ,মা আর শৈলী দাঁড়ানো। প্রিতমের আর বুঝতে বাকী রইল না। নিঝুম মাথা নিঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ভেবেই পাচ্ছে না প্রিতম কেন এমন টা করতে গেল? আর উনারা এমন টাইমে আসছে ,নিশ্চই খুব খারাপ ভাবছে।
প্রিতমের বাবা রাগ কন্ট্রোল করে বলল,
-” নিঝুম কে নিয়ে বাসায় আসো।”
প্রিতমের মা বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । নিঝুম প্রায়ই তাদের বাসায় যেত। কিন্তু কখনো ওদের আচরনে মনে হয় নি ওদের মাঝে অন্য কোন সম্পর্ক আছে।
প্রিতমের কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে,প্রিতমের বাবা রাগ চাপিয়ে আবার বলল,
-” কি বলছি কানে যায় নি নাকি?”
প্রিতম কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। আর যাই হোক শৈলীকে ছাড়বে না। ওরে এখন চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। চেহেরায় কোন রাগের ছাপ নেই প্রিতমের । বরংচ সংকোচ হচ্ছে বাবা মা কে কি বলবে? আর যাই হোক নিঝুম কে হারাতে পারবে না। শৈলীকে সময় মত দেখে নিবে।
প্রিতমের অনুতপ্তের সুরে বলল,
-” আসছি।”
উনারা ছাদ থেকে চলে গেল। নিঝুমের কি বলা উচিত বুঝতে পারছে না। বিপদ যেন পিছুই ছাড়ছে না ওর। প্রিতম নিঝুমকে বলল,
-“তুমি একটাও কথা বলবে না । যা বলার আমি বলল।”
নিঝুম নিরাশ হয়ে বলল ,
-” আপনি কেন এমন টা করলেন? আপনার সাথে কি অন্য কোন সম্পর্ক আছে আমার?”
-” এই মেয়ে তুমি সম্পর্কের কি বুঝো? তুমি নিজের মন কে প্রশ্ন করো সম্পর্ক আছে কিনা?”
দোটানায় ভুগছে নিঝুম। ও তো প্রিতম কে ভালোবাসে না তবে কেন এমন টা হচ্ছে? ওর মনে তো এখনও হৃদয়ের বসবাস। এখনও প্রতি রাতে ওর জন্য বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদে। আর প্রিতম কেও কষ্ট দিতে পারবে না। কেমন অনুভূতি এটা?
প্রিতম আর নিঝুম ধীর পায়ে হেটে প্রিতমের বাসায় গেল। প্রিতমের বাবা সোফায় বসে আছে। প্রিতমের মায়ের মুখে চিন্তার ছাপ। সবাই ভালো করে জানে প্রিতমের বাবার রাগ সম্পর্কে। প্রিতমের বাবা ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল,
-” আমি এত রাতে সিন ক্রিয়েট করতে চাই না। চেঁচিয়ে লোক জড়ো করে আমার ছেলের গুনোগান শুনাতে চাই না।”
সবাই মাথা নিঁচু করে আছে । নিঝুম জানে উনাদের কসম করে বললেও এখন নিঝুমের বলা সত্যি কথা গুলোও বিশ্বাস করবে না। তাই চুপ থাকাই শ্রেয়। আড় চোখে প্রিতমের দিকে বার বার তাকাচ্ছে শৈলী। ব্যাপারটা উপভোগ করছে ও। এখন রাগ দেখানোর সময় না তাই চুপ করে আছে প্রিতম । সবাই কে চুপ দেখে প্রিতমের বাবা বলতে লাগল,
-” নিঝুম তুমিই বলো তুমি এই ফ্যামিলির বউ হওয়ার যোগ্য?”
নিঝুম কিছু একটা বলতে চাইল কিন্তু প্রিতম ওর দিকে তাকালো। নিঝুম বুঝতে পারছে প্রিতম ওকে চুপ থাকতে বলছে ।
প্রিতমের বাবা আবার বলল,
-” কি হলো উত্তর দেও না কেন? তুমি আমাদের অফিসে কাজ করো। আমার একমাত্র ছেলের বউ হওয়ার জন্য এই পরিচয় কি যথেষ্ট? লোকে আমায় কি বলবে? আচ্ছা তোমার বাবা কি করে নিঝুম? ”
নিঝুম বলল,
-“আংকেল আপনি ভুল বুঝছেন।”
প্রিতম নিঝুমের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালো ।নিঝুম চুপ হয়ে গেল।
রাগের সময় প্রিতমের বাবার মুখের উপর কেউই কথা বলে না । উনার রাগ বেশী কিন্তু স্থায়ীত্ব কম।
প্রিতমের ফুফু বলল,
-” আমার মেয়ে নাকি খারাপ । এবার বুঝলেন আপনার ছেলে কেন আমার মেয়েকে সহ্য করতে পারছে না? ”
প্রিতমের ফুফু নিঝুমকে উদ্দেশ্য করে আবার বলল,
-” ওদের মত মেয়ের কাজই হলো বড় লোকের ছেলের দেখে লাইন দেওয়া।”
রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে নিঝুমের। তবুও স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে।
প্রিতমের বাবা বলল,
-” যা হইছে আর না হইছে এসব নিয়ে কথা বলে আমার মান-সম্মান নষ্ট করতে চাই না।নিঝুম তুমি এই বাসা ছেড়ে কালকেই চলে যাবে।”
প্রিতম এবার আর চুপ করে থাকতে পারল না ।বলল,
-” আব্বু তুমি যা বলার আমায় বলো। নিঝুমকে কথা শুনাচ্ছো কেন? আমি নিঝুমকে ভালোবাসি । আর তোমার ছেলের বউ হয়ে যদি এবাড়িতে কেউ আসে নিঝুমই আসবে ।”
নিঝুম অবাক হয়ে প্রিতমের দিকে তাকিয়ে আছে। কত সহজেই ভালোবাসার কথা বলল । একবার ও কি জানতে চেয়েছে আমি উনাকে চাই কিনা? অনেক সময় দুজন সাথে থেকে হয়ত উনার জন্য খুব বেশী মায়া জন্মে গেছে,সে মায়া টা যদি ভালোবাসাও হয় তাহলে আমি সেটা কে গলা টিপে হত্যা করব। উনার বউ হওয়া এসব কখনো আমি ভাবিও নি। আমি আজও হৃদয় কে ভুলতে পারি নি,হয়ত ওর জন্য ভালোবাসা টা ঘৃন্য,রাগ,অভিমানের নিচে চাপা পড়েছে।
প্রিতমের কথা শুনে প্রিতমের বাবা স্তব্ধ হয়ে গেছে। প্রিতমের মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-” শুনলে তোমার ছেলের কথা? আমাদের আদর্শবান ছেলে মুখের উপর কত সুন্দর কথা বলে ।”
হ্যাঁ বাবা-মা সন্তান কে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসে। সব সময় সন্তানের মঙ্গল কামনা করে । কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের ইচ্ছা কে সন্তানের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। তাঁরা ভাবে এতেই তাঁদের সন্তান ভালো থাকবে,আদো কি তাই? ফ্লোরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে এসব ভাবছে প্রিতম।
প্রিতমের বাবা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
-” যে মেয়ের ফ্যামিলি বলতে কেউ নেই। বাবা-মায়ের পরিচয় নেই । নিম্ন ফ্যামিলির মেয়ে হলেও মেনে নেওয়া যেত। এমন একটা বেয়ারিশ মেয়ে কে আমার ছেলের বউ করব?”
কথা গুলো নিঝুমের বুকে আঘাত করল। বাবা-মা নিয়ে কেউ এভাবে বললে কারই বা রাগ না হয় ? এই মুহূর্তে সব চেয়ে বেশী রাগ হচ্ছে প্রিতমের উপর।
ছোট বেলা থেকেই প্রচুর রাগ নিঝুমের। এবার আর চুপ থাকতে পারল না। রাগ সংযত রেখে ঠান্ডা গলায়ই বলল,
-” আমার বাবা-মায়ের পরিচয় নেই আপনায় কে বলল? আমি আমার সম্পর্কে কত টুকু জানেন? কারো সম্পর্কে কিছু বলার আগে সব কিছু জেনে নেওয়া উচিত। হ্যাঁ আমি আপনার অফিসে কাজ করি। এটা আমার আত্মসম্মান। সিচুয়েশনের কারনে আজ এই অবস্থা । আপনি বললেন না যে আপনার বাসার বউ হওয়ার জন্য আমি যোগ্য না? আপনার ছেলে আমার বাবার মেয়ের জামাই হওয়ার কি যোগ্য? আপনাদের মত অযথা টাকার গরম আর অহংকার নিঝুম দেখায় না।”
সবাই থ হয়ে আছে। প্রিতমের মাথায় কিছু যাচ্ছে না। এই প্রথম নিঝুমের রাগ দেখল ,পুরো নাক-মুখ লাল হয়ে গেছে। যেন আগুনের মেঘ। নিঝুম আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে।
সবাই ঝিম থেকে গেছে। এরকম একটা ঠান্ডা মেজাজের মেয়ে এভাবে কথা শুনাবে কেউ ভাবতেও পারে নি।আর মেয়ে টার পরিচয়ই বা কি? সবটাই রহস্যময় লাগছে প্রিতমের কাছে। ও তো বলল ওর বাবা নাকি মারা গেছে,সৎ মা।
সবার নিরাবতা ভেঙে প্রিতমের ফুফু প্রিতমের বাবা কে উদ্দেশ্য করে বলল,
-” দেখলেন ভাইয়া কিভাবে কথা গুলো বলে গেল মেয়ে টা? ওই মেয়ের পরিচয় টা কি? বাবার এত নাকি টাকা তো মানুষের অফিসে কাজ করে কেন? ”
নিঝুমের কথা গুলো শুনে মোটেও রাগ করে নি প্রিতমের মা। কথায় কথায় টাকার গরম একদম পছন্দ না তাঁর।প্রিতমের বাবা কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল,
-” শৈলীর সাথে কালকে তোর বিয়ে।”
যেন এই কথা টার ই অপেক্ষা করছিল শৈলী আর ওর মা। প্রিমত বলল,
-” আব্বু তুমি তোমার ইচ্ছা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারো না। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার মত যথেষ্ট বয়স আমার হয়েছে। মানুষে জাত-বংশই আসল পরিচয় নয়। নিঝুমের ফ্যামিলি নিয়ে এত কথা বলা আমাদের কি দরকার? আমি যদি বিয়ে করি নিঝুমকেই করব এটাই ফাইনাল।”
এই বলে প্রিতম রুমে চলে গেল । প্রিতমের বাবা সোফায় বসে রইল। প্রিতমের বাবা শৈলী আর ওর মাকে বলল,
-” তোমরা যাও ঘুমাও।”
প্রিতম মা আর বাবা সোফায় বসে আছে। দুই জনের মাঝেই নিরাবতা বিরাজ করছে। প্রিতমের মা বলল,
-” তোমার মনে আছে আমাদের বিয়ের কথা? আমায় তোমার ফ্যামিলি মেনে নেয় নি। কত বাজে ভাবে অপমান করছে আমার আব্বা কে?”
প্রিতমের মা – বাবার ও সম্পর্কের বিয়ে। প্রিতমের মা ছিলো মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির মেয়ে।এজন্য প্রিতমের দাদা-দাদি উনাকে মেনে নেয় নি । মুহূর্তেই সব মনে পড়ে গেল প্রিতমের বাবার।
প্রিতমের বাবা বলল,
-” তুমি কি চাইছো আমি ওই মেয়েকে ছেলের বউ করে আনব?”
-” প্রিতম যখন চায় আমাদের আপত্তি কিসের । ওর নিজস্ব পছন্দ থাকতে পারে না?”
-” হু।”
-” আজকে বাবার আসনে বসে তুমি টাকার অহংকার দেখাচ্ছো। সেদিনের কথা ভেবে দেখো যেদিন তুমি প্রেমিক ছিলে।”
প্রিতমের বাবা খানিকটা লজ্জা পেলো। বলল,
-” প্রিতম কি সুখী হবে?”
-” সুখ-দুঃখ সব আল্লাহর কাছে । এটার গ্যারান্টি কি কেউ নিতে পারে? কি দরকার ছেলের মতের বিরুদ্ধে কাজ করার? ওর জীবন এ সাজিয়ে নেক। আমাদের কোন দায়-ভয় থাকবে না । আমরা কি সুখী হয় নি?”
-” হুম হয়েছি। মেয়েটা আমার মুখের উপর কিভাবে কথা বলল দেখলা?”
-” কারো বাবা-মা, ফ্যামিলির নিয়ে বললে সবাই বলে। ওর জায়গায় যে কেউই বলত।”
-” এখন ঘুমিয়ে পড়ো সকালে এসব নিয়ে কথা হবে ।”
.
রাতে আর ঘুমায় নি নিঝুম । প্রিতম চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ছিলো। সকাল হতেই ব্যাগ গুছাতে লাগল নিঝুম । এখনই চলে যাবে বাসা ছেড়ে। আর উনাদের অফিসের চাকরির কোন দরকার নেই। ব্যাগে যা গহনা আছে তা বিক্রি করেই চলতে পারবে । কান্না করতে করতে নাক- মুখ ফুলে গেছে ।
প্রিতমের মাথায় বার বার একটা প্রশ্নই ঘুরছে নিঝুমের রহস্য টা কি?
প্রিতমের বাবার মনও কিছু টা নরম হয়। খুব বেশী বলে ফেলছে মেয়েটাকে। এতটা বলা উচিত হয় নি।
সকাল হতেই নিঝুমের বাসায় গেল প্রিতম। গিয়ে দেখে নিঝুম ব্যাগ গুছাচ্ছে।
-” কি ব্যাপার নিঝুম ব্যাগ গোছাচ্ছ কেন?”
নিঝুম স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো,
-” বাসা টা ছেড়ে চলে যাচ্ছি । খুব মিস করব আপনাদের ।
প্রিতম অবাক হয়ে গেছে। নিঝুম এমন ভাবে বলছে যেন রাতের ব্যাপারটা স্বপ্ন ছিলো ।
-” নিঝুম আমার আব্বুর বিহেভের জন্য আমি সরি।”
-” ইট’স ওকে ।”
-” নিঝুম এভাবে বলছো কেন?”
-” তো কিভাবে বলা উচিত? আর শুনেন আপনায় কি কখনো আমি বলছি আমি আপনায় ভালোবাসি?”
-” সব কথা বলতে হবে কেন আমি তো জানি।”
নিঝুম প্রচন্ড রাগ নিয়ে বলল,
-” মন গড়া কথা বলা বন্ধ করুন।”
-” নিঝুম তুমি যদি এ বাসা ছেড়ে যাও। কসম করে বল্লাম আমি সুইসাইড করব।”
থমকে যায় নিঝুম। সামনে পা বাড়াতে গিয়েও থেমে যায়।
-” প্রিতম আপনিই বলুন এগুলোর কোন মানে হয়?”
প্রিতম চিৎকার করে বলল,
-” হয়,হয় মানে হয়।”
-” আমি তো আপনায় ভালোবাসি না।”
-” বাসো।”
প্রিতম পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখে প্রিতমের মা-বাবা আসছে। প্রিতমের বাবা বলল,
-” নিঝুম আমি তোর বাবার মত না?”
-” হু।”
-” বাবার উপর অভিমান করে চলে যাচ্ছিস?”
নিঝুমের চোখ ছলছল করে উঠে।বলল,
-” না,আমি কারো উপর অভিমান করি না ।”
প্রিতম নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছে। বাবা-মা এখানে! আর বাবা কত মায়া দেখিয়ে নিঝুমের সাথে কথা বলছে।
প্রিতমের মা বলল,
-” এই মিষ্টি মেয়েকে আমার ছেলের বউ করবো।”
-” আন্টি আপনারা ভুল করছেন..
নিঝুমের কথা শেষ না হতে থামিয়ে দিলো প্রিতমের বাবা।বলল,
-” নিঝুম আমরা দুজন তো তোর ছেলে মেয়ে। আর ছেলে মেয়ে ভুল বুঝতেই পারে আম্মু।”
প্রিতমের বাবার কথা শুনে অবাক হয়ে যাচ্ছে নিঝুম । এখন কি ভালো বিহেভ করছে! আর রাতে কি সব বলল।
প্রিতমের মা বলল,
-” তোর ফ্যামিলির কাউকে লাগবে না। শুধু তুই পর্যন্ত যথেষ্ট । তুই যখন তোর ফ্যামিলি থেকে বিছিন্ন তখন ওসব আমরা জানতে চাইব না।”
নিঝুম বুঝতে পারছে উনারা কি বলছে। কিন্তু প্রিতমের সাথে বিয়ে মন সায় দিচ্ছে না নিঝুমের।
-” তুই এই বাসা থেকে কোথায়ও যাবি না। দুই দিন পর আমাদের বাসা নিয়ে যাব।”
প্রিতম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর বাবা-মায়ের কথা শুনে অবাক হচ্ছে ।এসব যে ওর মায়ের অবদান তা বুঝতে বাকী রইল না।
নিঝুম হাত থেকে ব্যাগ রেখে বিছানায় বসে আছে। কেউ ওর কথা বুঝতে চাচ্ছে না।
চলবে..
#সেই_রাতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_22
.
প্রিতম চেয়ারে বসে আছে। আর নিঝুম খাটে বসে আছে।
এমন টা হবে নিঝুম কখনো ভাবতেও পারে নি। আজকে আর নিঝুমের কাঁন্না পাচ্ছে না। রাগ, দুঃখ, জিদ,ক্ষোভ হচ্ছে নিজের প্রতি। এই অবস্থার জন্য ও নিজেই দায়ী। মা-বাবা কখনো ক্ষমা করবে বা বাসায় ফিরে গেলে জায়গা দিবে সেটাও নিশ্চিত না। পুরোই নিরুপয় অবস্থা । কিন্তু এখন যা হচ্ছে তার চেয়ে বাসায় ফিরে যাওয়া ভালো। মায়া জিনিস টা এখন একদম ভালো লাগে না নিঝুমের। বিশ্বাস ভাঙে একজন,আর বিশ্বাস উঠে যায় সবার উপর থেকে কিংবা দ্বিতীয় বার কাউকে বিশ্বাস করার সাহস কখনো হয়ে উঠে না । কিন্তু প্রিতম কে এতদিনে যতটুকু চিনছে তাতে নিঃসন্দেহে ভালো মানুষ। খুব ভালো মেন্টালিটির। কিন্তু হৃদয়ও তো এমন ছিল,পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ মনে হত হৃদয় কে। এখন তো খুব ঠকানো ঠকাইছে,এমন ভাবে ঠকাইছে বেঁচে থাকাই অনিশ্চিত হয়ে গেছিলো
নিঝুমের। প্রিতম যে ঠকাবে না তার গ্যারান্টি কি? মানুষ এমনই একবার ঠকলে কাউকে বিশ্বাস করার সাহস হয় না। এসব চিন্তা ভাবনায় নিঝুম নিজেকে মগ্ন করে ফেলছে।
প্রিতম এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এত কি ভাবে ও? মনে হয় পৃথিবীর সব ভাবনা চিন্তা ওর উপর ভর করছে। একদম উদাস লাগছে ওকে।
-” ঘোমরা মুখে কি ভাবছো নিঝুম?”
নিঝুম একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-” আপনি আমায় বিয়ে করতে চান এই তো?”
-” হুম।”
-” কেন বিয়ে করতে চান?”
নিঝুমের প্রশ্নে অবাক হয়ে যায় প্রিতম । এটা আবার কেমন প্রশ্ন?
প্রিতমের কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে নিঝুম আবার বলল,
-” আমার প্রতি ভালোবাসা নাকি সাময়িক মোহ?”
প্রিতম স্বাভাবিক ভাবে বলে,
-” ভালোবাসা । কোন সন্দেহ আছে? ”
-“কখনো জানতে চেয়েছেন আমি আপনাকে চাই কিনা? ”
প্রিতম দমে যায়। নিঝুম ওকে এমন প্রশ্ন করবে আশা করবে নি। প্রিতম ঠোঁটের কোনে হাসি টেনে বলল,
-” আমি জেনেছি তোমায় ।”
নিঝুম কিছুক্ষন চুপ করে রইল। আনমনে কি যেন ভাবছে । খাট থেকে উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
-” দেখুন আপনার সাথে থাকতে থাকতে আপনায় মায়ায় জড়াই গেছি । হোক সেটা ভালোবাসা। আমি চাইনা সেটা পূর্নতা পাক।আসলে আমি আপনায় বিয়ে করতে পারব না। জীবনের প্রতি খুব অনীহা আমার । সাত বার সুইসাইড করার ট্রাই করছি। কিন্তু পাপ-পুন্যর হিসাব করে ব্যর্থ হয়েছি বার বার। আমি এই ব্যর্থতা,অনীহা,উদসতা,বিষন্নতা, কষ্ট-দুঃখ,অনিশ্চয়তা নিয়ে কারো লাইফের সাথে জড়াতে পারব না।”
-” তুমি বিয়েতে রাজি না এই তো?”
-” হুম।”
-” আমি তোমায় বাধ্য করব না। কিন্তু নিঝুম সত্যি খুব বেশী ভালোবাসি । এতটাই বেশী ভালোবাসি যে তুমি আমার শরীরের শিরায়-উপশিরায় মিশে গেছো। তুমি আমার অভ্যাসে পরিনত হয়েছো। নিঝুম নামক অনুভূতি আমার পুরো মন টাকে বশ করে রেখেছে। হ্যাঁ তোমার লাইফ তোমার সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে। যদি ইচ্ছে হয় ফিরে এসো। বাবা-মা হয়ত বিয়ের আয়োজন শুরু করে দিছে। তাঁদের কি বলল জানি না।”
প্রিতমের গলা আটকে যাচ্ছে । বুকের ভিতর টা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে । চোখে জল ছলছল করে । চোখের পলকেই পড়ে যাবে হয়ত। এর সব টাই উপলব্ধি করতে পারছে নিঝুম । প্রিতম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলল,
-” যে তোমায় ঠকালে ,তোমার বিশ্বাস ভাঙলো তাঁর জন্য আমায় ফিরিয়ে দিলে । ভেবে দেখো আমি কি বিশ্বাসের যোগ্য না? আমি তোমায় ভাবার জন্য সময় দিচ্ছি। কালকে সকালে ভেবে চিন্তে বলো ।”
প্রিতম নিঝুমের দিকে আর না তাকিয়ে রুম থেকে চলে গেল ।এই মুহূর্তে নিজেকে সব চেয়ে বেশী অপরাধী মনে হচ্ছে প্রিতমের । নিঝুম এভাবে ফিরিয়ে দিবে ভাবতেও পারি নি,আর মা-বাবা যে একদম বিয়ের আয়োজন করে ফেলবে তাও ভাবতে পারে নি।কি জবাব দিবে তাঁদের? প্রিতম বাসায় ফিরে যেতেই প্রিতমের মা হাসি মুখে জিঙ্গেস করল,
-” এবার খুশি তো তুই? আগামী চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই বিয়ে। হুট করে সব আয়োজন বুঝিস তো অনেক জামেলা।”
কথা বলার মাঝে প্রিতমের মা প্রিতমের মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে যায়।
-” কিরে কি হয়েছে তোর? সব ঠিক আছে তোর? এমন লাগছে কেন তোকে?”
প্রিতমের এই মুহূর্তে মোটেও কথা বলছে ইচ্ছা হচ্ছে না। আর মায়ের কথার উত্তর না দিলে একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাবে।
-” আম্মু রাতে ঘুম হয় নি তো তাই খারাপ লাগছে ।”
প্রিতমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-” আচ্ছা বাবা রুমে গিয়ে রেস্ট নে।”
প্রিতম রুমে চলে আসে । শৈলীর মা শৈলী কে নিয়ে চলে গেছে। মা-বাবা কে কিভাবে এসব বলবে ভেবে পাচ্ছে না প্রিতম । আর বিয়ে এভাবে ভেঙে গেছে তা জানলে ফুফুও বাবা-মা কে অনেক কথা শুনাবে। নিঝুমের উপর প্রচন্ড ঘৃন্য হচ্ছে প্রিতমের । সিল্পিং পিল খেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে প্রিতম।
.
ফ্লোরে বসে বসে চোখের পানি ফেলছে নিঝুম । শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে । প্রিতম খুব বেশী স্বার্থপর ভাবছে। খুব বেশী কষ্ট দিয়ে ফেলছে। যে মানুষ টা কোনকরম স্বার্থ ছাড়াই এতটা উপকার করে গেছে তার প্রতিদান এভাবে দিলো । নিজের উপর ঘৃন্য হচ্ছে নিঝুমের। কিন্তু কি করবে ও? উনার বাবা-মা বিয়ের আয়োজন করে করে ফেলছে। উনাদের মান-সম্মানের প্রশ্ন এটা।
সারা সকাল কেটে যায়। নিঝুম প্রতিদিনের অভ্যাস মত বিকালে ছাদে যায় কিন্তু প্রিতমের কোন খোঁজ নেই। এই বুঝি প্রিতম ফোন দিলো কিন্তু না। উনি কি আর কখনো আসবে না? কথা বলবে না? ছাদে যাওয়ার জন্য ফোন দিবে না? এসব ভাবতেই বুকের ভেতর কেঁপে উঠে নিঝুমের। নিঝুম খুব করে চাচ্ছে প্রিতম ওকে ফোন দিয়ে ছাদে যেতে বলুক। সব কিছু আগের মত হয়ে যাক। কিন্তু নিঝুম নিজেই তো ওকে ফিরিয়ে দিয়েছে? খুব করে অনুভব করছে প্রিতম কে।এটা কেমন অনুভব বুঝতে পারছে না নিঝুম । হয়ত হৃদয়ের জন্য ওর মনের কোনে অনাদৃত ভাবে এখনও ভালোবাসা,মায়া পড়ে আছে। নয়তো ঘৃন্য,রাগের নিচে চাপা পড়ে আছে ভালোবাসা। যে মানুষ টা ওকে এমন ভাবে ঠকালো তার জন্য প্রিতম কে কষ্ট দিবে? যে ওকে নতুন করে বাঁচতে শিখালো। আর কিছু ভাবতে পারছে না নিঝুম।
.
সারা দিন প্রিতমের হুঁস নেই। ঘুমের ওষুধ খেয়ে বেহুঁস হয়ে ঘুমাচ্ছে। নিঝুম ফোন দেয় অনের বার কিন্তু ফোনটাও অফ। এখন কি উনাদের বাসায় যাওয়া উচিত হবে?
প্রিতমের মা অনেক বার ডাকছে প্রিতম কে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠছে না । হয়ত রাতে ঘুমায় নি ক্লান্ত লাগছে তাই আর ডাকে নি।
নিঝুম আর নিজেকে আটকে রাখতে পারছে। লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে প্রিতমের বাসায় হাজির। প্রিতমের মা-বাবা দুজনই হেসে দেয়। প্রিতমের বাবা বলে,
-” দেখলা আমাদের কি ভাগ্য! বউ নিজে একা একা বাসায় চলে আসছে ।”
প্রিতমের মা চোখ রাঙিয়ে বলে,
-” ধুর! তুমি মেয়েটা কে লজ্জা দিও না তো।”
নিঝুম লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে । এই মুহূর্তে উনাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে যে লজ্জা পাচ্ছে, এমন লজ্জা সারা জীবনেও পায় নি। তার মানে প্রিতম এখনও বাসায় বলে নি যে আমি বিয়েতে রাজি না।
নিঝুম দাঁড়িয়ে আছে । কি বলবে বুঝতে পারছে না।
প্রিতমের মা বলল,
-” নিঝুম দাঁড়িয়ে আছো কেন বসো মা। আরে লজ্জা পেতে হবে না মা-বাবার কাছে আবার কিসের লজ্জা ।”
নিঝুম এবার কিছুটা ইজি ফিল করছে। বাধ্য মেয়ের মত বসল। প্রিতমের বাবা বলল,
-” পিচ্ছি মেয়ে বেশী বেশী খেয়ে মোটা হতে হবে। তোমায় দেখলে তো এখনও মনে হয় বাচ্চা মেয়ে।”
প্রিতমের মা বলল,
-” এই তুমি চুপ করবে? পিচ্ছিই ভালো। নিঝুমকে একদম পুতুল পুতুল লাগে আমার কাছে। ”
নিঝুম উনাদের কথা শুনে ভীষন লজ্জা পাচ্ছে । উনারা কত কি ভাবে আমায় নিয়ে? উনাদের কাছে কি ভাবে প্রিতমের কথা জিঙ্গেস করবে ভেবে পাচ্ছে না।
প্রিতমের মা নিঝুমের ভাবনা টা বুঝতে পারছে। বলল,
-” নিঝুম প্রিতম সেই কখন থেকে মরার ঘুম ঘুমাচ্ছে ,ওকে একটু ডেকে তুলো তো।”
নিঝুম যেন এই কথা টার ই অপেক্ষা করছে। মাথা নিঁচু করে বলল,
-” আচ্ছা।”
নিঝুম দ্রুত পায়ে হেটে প্রিতমের রুমে গেলো। গিয়ে দেখো এখনও ঘুমাচ্ছে। নিশ্চয়ই সিপ্লিং পিল খেয়েছে। ইস! কি মায়া ভরা মুখ। নিঝুম পা টিপে টিপে প্রিতমের কাছে গেলো। ওর মাথায় কাছে বসছে। মাথায় হাত দিয়ে দেখে গায়ে জ্বর নেই। তার মানে স্লিপিং পিলই খেয়েছে।
অনেকক্ষন প্রিতমের দিকে তাকিয়ে ছিলো। প্রিতমের চুল গুলে ধরে টানছে খুব সুন্দর ঘ্রান আসছে উনার চুল থেকে। আগে জানত মেয়েদের চুলের ঘ্রান নেয় আর ও প্রিতমের চুলের ঘ্রান নিচ্ছে। নিজের পাগলামীর কথা ভেবে নিজেই লজ্জা পাচ্ছে । উনি নিশ্চই খুব বেশী কষ্ট পেয়েছে। নিঝুমের খুব ইচ্ছা করছে ওর কপালে একটা চুমো খেতে। নিজের ইচ্ছা টাকে দমাতে পারছে না নিঝুম । প্রিতম তো এখন ঘুমাচ্ছে কোন প্রোবলেম নেই। নিঝুম প্রিতমের কপালে ঠোঁট ছোঁয়াতেই প্রিতম ওকে টান দিয়ে বুকের মাঝে নিয়ে যায়। নিঝুম ভাবতেও পারে নি উনি সজাগ। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
চলবে…