সেই_রাতে,পর্ব_3,4

0
1406

#সেই_রাতে,পর্ব_3,4
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_3
.
নিঝুমের ভাবনার ছেদ হয় প্রিতমের ডাকে,
-” কি ভাবছেন এত? মনে হচ্ছে ভাবতে ভাবতে কবি বা সাহিত্যিক একটা কিছু হয়ে যাবেন।”
নিঝুমের এত কষ্টের মাঝেও হাসি পেল। বাহ! লোক টা তো বেশ মজার। এত বিরক্ত করলাম তাও কি সুন্দর করে কথা বলে । নিঝুম ঠোটের কোনে একটু হাসি টেনে বলল,
-” কবি বা সাহিত্যিক কিছুই হওয়ার আশা নেই । আপাতত পেট ভরে খেতে পারলেই চলবে।”
-” এই নিন পেট ভরে খান। খুব ক্লান্ত তো আপনি গায়ে কথা বলার শক্তিও মনে হয় নেই।”
-” এরকম দুই-এক না খেয়ে থাকলে কারো ই কথা বলার শক্তি থাকে না। এগুলো কি এনেছেন?”
-“কেন? ফল এনেছি। এসব খেলে কথা বলার শক্তি হবে ।”
-” আসলে সারাদিন পর এগুলো খেলে বমি করে দেব। আর এখন এগুলো খাওয়ার রুচি নেই। আমি ভাত খাবো। ভাত এনে দিতে পারবেন?”
হায়রে আল্লাহ! আচ্ছা এনে দিচ্ছি। আজকে সারা রাত ই সজাগ থাকতে হবে ।
নিঝুম আর কিছু না বলে মাথা নিচু করে বসে রইল। প্রিতম পা টিপে টিপে আবার ডাইনিং রুমে গেল। কি যে বিপদে পরলাম। ধুর! মেয়ে টা এমন অসহায় ভাবে বলে ফিরিয়েও দিতে পারি না।
-” এই যে নিন। পোলাও আর মাসং ।”
-” আমি তো এগুলোও খেতে পারব না। পোলাও তে তো অনেক তেল আর মাংস খেতে পারব না। আমার এলার্জির প্রোবলেম আছে। সারা দিন পর এত তৈলাক্ত পোলাও খেলে বমি করে দিব। আর একবার যদি বমি শুরু হয় সারা দিনেও থামবে না। আপনার ফ্লোর বমিতে ভেসে যাবে । তার চেয়ে ফল খাওয়াই ভালো ছিল।”
-” এই স্টপ স্টপ! আমি আপনার জন্য কি করব বলেন এইটায় প্রোবলেম ,ওইটায় প্রোবলেম। আসলে আপনি নিজেই একটা প্রোবলেম ।”
নিঝুম মাথা নিচুঁ করে ফেলল । লোক টা কে কত ভালো ভাবছিলাম। মাত্র কি বাজে ভাবে কথা গুলো শুনালো। থাক,এমন বিরক্ত করলে সবাই কথা শুনাবে। গায়ে কথা বলার শক্তি টুকু নেই। সুইসাইড করতে ইচ্ছে করছে। খুব কান্না পেল। হাজার চেষ্টায়ও চোখের পানি আটকে রাখতে পারল না।টপটপ করে গাল বেয়ে পানি পরতে লাগল।
-” হুম,আমি নিজেই একটা প্রোবলেম। আপনায় অনেক বিরক্ত করছি। অনেক উপকার করছেন। আপনি ঘুমিয়ে পরুন আমি কিছু খাব না। ক্ষুদা চলে গেছে।”
-” মেয়ে দের এই স্বভাব ই একটা কিছু বললেই ব্লা ব্লা করে সব ভাসাই দেয়। সরি ওভাবে বলা আমার ঠিক হয় নি। আপনি বসুন আমি ভাত আর ডিম ভাজি নিয়ে আসছি।”
-” বলছি তো খাব না।”
-” দেখেন বিপদে পরলে সব রকম কথা সহ্য করতে হয়। আর আপনি যদি না খান তাহলে আপনায় এখন আবার রাস্তায় রেখে আসব।”
-“ব্লাক মেইল করছেন?”
-“ব্লাক মেইল ,ই-মেইল কিছুই করছি না। চোখ মুছুন। আমার রুমে বসে কাদা যাবে না।”
-” হুম।”
প্রিতম একটু রাগি সুরে বলল,
-” কি হুম? কান্না থামাতে বলছি কিন্তু ।”
নিঝুম ভয় পেয়ে গেল। চোখ মুছে চুপচাপ বসে রইল।
-” এই যে শুনন,ডিম ভাজি করে আনতে হবে । আসতে একটু লেট হবে। দরজা বাইরে দিয়ে ছিটকানি লাগিয়ে গেলাম। ডিম আর ভাতে তো কোন প্রোবলেম নেই?”
-“না।”
প্রিতম মনে মনে খুব বিরক্ত করলে হচ্ছে । মেয়ে টার সামনে তেমন বিরক্তি ভাব প্রকাশ করল না। বাসা থেকে পালিয়ে আসে অথচ কোথায় যাবে ,কোথায় খাবে তা জানে না। যত্তসব!
লাইফে কখনো রান্না ঘরে যায় নি। আর আজকে কোথাকার এক মেয়ের জন্য ডিম ভাজতে হবে। নিজের মাথা ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে । রান্না ঘরে কোথায় তেল,কোথায় লবন কিচ্ছু জানে না।
রান্না ঘর থেকে কিসের যেন শব্দে ঘুম ভেঙে গেল প্রিতমের মায়ের। রান্না ঘরে গিয়ে যেন ভুত দেখার মতো চমকে গেল। তার ছেলে রান্না ঘরে তাও এত রাতে! নিজের চোখকে ই বিশ্বাস করতে পারছে না। যে ছেলে জীবনে কখনো রান্না ঘরে আসে নি সে আজ এত রাতে রান্না ঘরে ডিম ভাজে।
আচমকা কারো ডাক শুনে পিছনে ফিরে প্রিতম । অপ্রস্তুত ভাবে মুখে একটু হাসি টেনে বলল,
-” আম্মু তুমি?”
-“বাবা,তুই ঠিক আছিস তো?”
-“হ্যা আমি ঠিক আছি তো। কেন কি হয়েছে?”
-” তুই এত রাতে রান্না ঘরে? বাসায় ফিরছিস কখন?”
-” একটু আগে ফিরছি।তুমি ঘুমিয়েছিলা তাই ডাকি নি। আর পোলাও, মাংস ওসব খেতে ইচ্ছে করছিল না,হঠাৎ ডিম ভাজি আর ভাত খেতে ইচ্ছে করছে তাই রান্না ঘরে আসলাম।
-“প্রতিদিন আমায় ডাকিস আর আজকে আমার ঘুমের কথা চিন্তা করছিস কাহিনী কি?”
নিঝুম মহিলাদের কন্ঠ পেয়ে বিগড়ে গেল।বুঝতে পারছে হয়তো উনার মা সজাগ হইছে। তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে চলে গেল।
-“আম্মু তুমি ঘুমাও আমি ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে যাব।”
-” তুই ডিম ভাজি আর ভাত নিয়ে রুমে যাচ্ছিস কেন?”
-” আম্মু অহেতুক প্রশ্ন করো না তো। একা একা টেবিলে বসে খেতে ভালো না।”
এবার খুব বিরক্ত হচ্ছে প্রিতম । হচ্ছে করছে মেয়ে টা কে এখন নিয়ে আবার রাস্তায় রেখে আসতে।
রুমে গিয়ে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিল । জানালা সব বন্ধ করে দিল । যাই হোক মেয়ে টার বুদ্ধি আছে। ওয়াশরুমে চলে গেছে।
.
চলবে…..

#সেই_রাতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_4
.
অদ্ভুধ তো! মেয়ে টা ওয়াশরুমেও নেই। এটা মেয়ে নাকি আবার ভুত – পেত্নি। হে আল্লাহ রক্ষা কর!
প্রিতমের চোখ গেল বেলকুনির দিকে।
নিঝুম বেলকুনিতে দাড়িয়ে আছে। জোসনাবিলাশ করছে।জোসনা রাত নিঝুমের খুব ভালো লাগে। কিন্তুু আজ কোন ভালোলাগা কাজ করছে না কেন? এক রাশ হাহাকার আর শূন্যতা উপলব্ধি হচ্ছে। আগে তো মন খারাপ হলে জানালার ফাকে আসা জোসনা টুকু মন ভালো করার জন্য যথেষ্ট ছিল। আজকের রাত টা এত ভিন্ন রকম কেন?চাদেঁর আলো তে বুকের ভেতর টা ভীষন আরও ভারী হয়ে যাচ্ছে। কোন ভুলের শাস্তি এটা?
মেয়ে টা আনমনে দাড়িয়ে এত কি ভাবে?
আহ! উনি কি শান্তি তে জোসনাবিলাশ করছে। যাক আল্লাহ রক্ষা করছে। ভুত- পেত্নি কিছুই না।
-“এই যে শুনছেন? ”
-” হ্যা। আপনার আম্মু সজাগ হইছে তাই না?”
প্রিতম একটু ব্যঙ্গ সুরে বলল,
-“হ্যা তাই। দেখলেন তো কত ডেঞ্জারাস আমার আম্মু । আপনার জন্য কত গুলো মিথ্যা কথা বলতে হলো।
-” হুম শুনলাম তো।”
-” আমার বউ এর থেকেও ডেঞ্জারাস। কোন রকম জানতে পারলে আপনায় তো খুন করবেই ,আমারও রেহাই নেই। হাত- পা ভেঙে আমায় চৌ-রাস্তার মোড়ে বসাই রাখবে। আমার শ্বশুড় খুব পাওয়ারফুল মানুষ। এত্ত চাপ আর নিতে পারছি না।”
নিঝুম এসব কথার কোন উত্তর না দিয়ে বলল,
-” দেন ভাত দেন।”
-” হ্যা এই নিন। খেয়ে আমায় উদ্ধার করেন।” এই আপনি আবার কাঁদতেছেন? বল্লাম না আমার রুমে কান্নার নিয়ম নেই। আমার বউ যখন কান্না করে তখন পাশের রুমে পাঠিয়ে দেই আর বলি,”কান্না- কাটি শেষ করে রুমে এসো!”
নিঝুম ভাতের প্লেট হাতে নিয়ে বেলকুনির ফ্লোরে হাটু ভাজ করে খেতে বলে পড়ল।
-” এই যে মিস কি করছেন এসব ? আমার রুমে যথেষ্ট জায়গা আছে। টেবিলও আছে। টেবিলে বসতে এলার্জি থাকলে খাটে বসে খান ।”
-” টেবিলে এলার্জি মানে?”
-” না আপনার তো সব কিছু তে এলার্জি তাই বল্লাম আর কি।”
নিঝুম আর কোন কথায় কান দিয়ে ফ্লোরে বসে ই খাওয়া শুরু করছে। এমন ভাবে খাচ্ছে মনে হয় সাত দিনের অনাহারি।
-” এই আস্তে খান। গলায় ভাত আটকাবে তো।”
-” আপনি এত আনরোমান্টিক কেন?”
নিঝুমের এমন প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল প্রিতম,
-” মানে?”
-“মানে আবার কি? লবন ছাড়া ভাত খায় কিভাবে বলুন? আর যারা লবন না খায় তারা আনরোমান্টিক।”
-” আমি লবন খাই না আপনায় কে বলল?”
-” আপনি লবন খেলে আমার জন্যও লবন নিয়ে আসতেন।”
-” তৈলাক্ত পোলাও খালি পেটে খাওয়া যায় না,মাংসে এলার্জি এগুলো সব জানেন আর লবন খাওয়া শরীরের জন্য ভালো না এটা জানেন না?”
-” হ্যা জানি। তরকারি তে পর্যাপ্ত পরিমান লবন দেওয়া উচিত যাতে ভাতে কাচা লবন না খেতে হয় কিন্তু আপনি তো ডিমে লবন দেন নি।”
প্রিতম খানিক টা লজ্জা পেল,
-” ইস রে! সরি।আমি কখনো ডিম ভাজি নি তাই এতসব খেয়াল ছিল না।”
-” হুম জীবনে প্রথম ডিম ভাজি তে ই ফেল।”
-” কি?? ফেল মানে?”
-” ফেল মানে হলো ডিম টা ঠিক মতো ভাজতে পারেন নি।”
-” হয়েছে হয়েছে, আপনার ভাগ্য ভালো যে আমি আপনার জন্য ডিম ভাজি করছি। আল্লাহর কাছে শুরকিয়া আদায় করুন।”
-” একটু লবন এনে দিবেন?”
-” আমি এখন ডাইনিং রুমে যেতে পারব না,লবন ছাড়া ই খান কষ্ট করে ।”
-” আচ্ছা । আপনি আনতে পারবেন না লবন তাই না? তাহলে আমি ই গিয়ে লবন নিয়ে আসি?”
-” ওয়াট ননসেন্স? আপনি কি চান বলুন তো? আমায় বাসা থেকে বের করে দেক এটা চান?”
-” আমি এটা কখন চাইলাম? আমি তো যাস্ট লবন চাইছি?”
-” ফাজলামি করেন?”
-” সুযোগ দিচ্ছেন?”
-” আজব! আমি কি সুযোগ দিলাম?”
-” আজব! আমি কি ফাজলামি করলাম? লবন এনে দিবেন নাকি আমি যাব?”
-” বাহ! ভালোই ব্লাইক- মেইল করেন।”
প্রিতম আবার ডাইনিং রুমে গেল। এত রাতে বার বার ডাইনিং রুমে ,রান্না ঘরে দেখলে আম্মু- আব্বু ভাব্বে আমি পাগল হয়ে গেছি। আর মেয়ে টা কি বিচ্ছু! কি যে আজাইরা জামেলায় পরলাম।
প্রিতম বিরক্ত হয়ে বলল,
– ” এই নিন লবন। ভাত অর্ধেক খাওয়া হয়ে গেছে লবন ছাড়া,বাকী অর্ধেক খেতে আবার লবন লাগবে।”
-” জানি আপনি বিরক্ত হচ্ছেন। আপনি ই তো বললেন বিপদে পড়লে সবার সব রকম কথা সহ্য করতে হয়।”
-” বিপদে আপনি পরেন নি,বিপদে আমি পরছি। তাই আপনার সব রকম কথা সহ্য করছি।”
নিঝুম একটু ভাব নিয়ে বলল,
-“হতে পারে। বিপদে যখন পরছেন, তখন পুরোপুরি ই পরেন। পানি নিয়ে আসেন,আর এই অল্প ভাতে আমার পেট ভরে না আরও ভাত নিয়ে আসুন। ডিম লাগবে না।”
-” এই কি শুরু করছেন আপনি? আমি কি সারা রাত রুম টু ডাইনিং রুমে ডিউটি করব?”
-” আমার কি দোষ? আপনি কি পানি ছাড়া ভাত খেতে পারেন নাকি? ”
-” প্লীজ চুপ করুন। রাত 4 টা বেজে গেছে প্রায় সকালে কোন রেস্টুরেন্ট থেকে খেয়ে নিয়েন।এখন আর ভাত খেতে হবে না।”
প্রিতম রুমে গেল পানি আনতে। ধুর! জগে পানি নেই।
-” এই যে পানি না খেয়ে পারবেন না ? রুমে জগে পানি নেই আমি আর ডাইনিং রুমে যেতে পারব না।”
-” কি সব বলছেন ? পানি ভাত সব লাগবে।আপনি যদি এনে দিতে না পারেন আমি গিয়ে আনব।”
-” এজন্য ই মানুষের উপকার করতে নেই। রাস্তা ই ভালো ছিল আপনার জন্য।”
-” দেখেন আপনি আমায় যা বলেন আমি কিছু কেয়ার করব না ,মাইন্ডও করব না। কারন আমি বিপদে পরছি। আর আপনি না বললেন অতিথির আপ্যায়ন না করলে আল্লাহ পাপ দিবে? এটা কোন ধরনের আপ্যায়ন! যান যান নিয়ে আসেন ।”
প্রিতমের কষ্টে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে।কোন উটকো জামেলায় পরল আবার? আর মেয়ে টা কি ডেঞ্জারাস! রাস্তায় থেকে আনা টা ই উচিত হয় নি।
-” এই ভাত ,পানি নেন। সাথে লবন ও আনছি। লবনে কমতি হলে আমার আবার তো ডাইনিং রুমে যেতে হবে।”
-” এই তো বুঝছেন। ধন্যবাদ।”
-” আপনি আপনার ধন্যবাদ দিয়ে লবন খান। আমি ঘুমাবো প্লীজ আর ডাকবে না। ”
-” যথাআগ্গা। কিন্তু আপনার মোবাইল টা একটু দেন। একজনের কাছে ফোন দিব। আমার ফোনে ব্যালেন্স নেই ।”
-” আমার ফোনেও ব্যালেন্স নেই।”
-” মিথ্যা বলেন না তো দেন।”
প্রিতম বাধ্য হয়ে মোবাইল টা দিল।”
মেয়ে টা কার নম্বরে যেন ফোন দিচ্ছে কিন্তু বার বার মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসছে ” আপনার কাঙ্ক্ষিত নম্বরে এই মুহূর্তে সংযোগ প্রধান করা সম্ভব হচ্ছে না”
নিঝুমের ফোন টা আছার দিয়ে ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে। দু চোখ দিয়ে আবার টপটপ করে পানি পরছে।
.
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here