#সেদিনও_ছিলে_তুমি ❤,১০,১১
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১০
২৬.
‘অবাক’! আমি চরম ‘অবাক’! ঠিক কতটা ‘অবাক’ হলে একটা মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে আমি জানিনা। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি অতিরিক্ত ‘অবাকের’ চোটে হতবুদ্ধি হয়ে বসে আছি। আদ্রে’র সাথে আমার দুর্ঘটনাজনিত কারণে আমার বিয়ে হয়েছে আজ একমাস। আর এই একমাসে আদ্রে’র প্রতি আমার অনুভূতি অনেকখানি পাল্টে গিয়েছে। দায়িত্ববোধের তাড়নায় বিয়েটা মেনে নিতে হয়েছিলো, কিন্তু এখন আমার দুনিয়া এই সংসারটাই! ছোট্ট একটা সংসার, অথচ সবার প্রতি সবার ভালোবাসাটা অসীম। ভিসি স্যার মানে আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি আর তার গুণধর ছেলের ভালোবাসা দেখে আমিও অনেকটাই ওদের প্রতি কোমল হয়ে গিয়েছি।
‘এতিম’ বলে ওনারা আমার প্রতি দয়া দেখাননি, যেটা দেখিয়েছে সেটা আমার প্রতি একরাশ ‘সম্মান’ আর একবুক ‘ভালোবাসা’! চোখের আড়াল হলেও যে তিনটা মানুষ আমার চিন্তায় চিন্তায় পাগল হয়ে যায়, তাঁদের প্রতি সম্মানটা তো এমনিতেই এসে পড়ে, তাই না?
কিন্তু আমার অবাক হওয়ার কারণ আমি যখন এই একমাসে একটু একটু করে এই আদ্র’টার প্রেমে পড়ছি, ওনার উল্টাপাল্টা কাজগুলোকে অভ্যাস হিসেবে মেনে নিয়েছি তখনই এটা ঘটলো।
আমি দুপুরের খাবার শেষ করে রুমে এসে বসতেই আদ্র বললো, ‘এই মেয়ে, এখানে আসো!’
আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম, ‘কেন?’
চোখ রাঙিয়ে আদ্র বললো, ‘আসতে বলেছি আসো!’
—“আসবো না।”
—“কিহহহ?”
—“শুনতে পাননি?”
—“আসবে কি আসবে না?”
—“বললাম তো, আসবো না!”
আদ্র বাঁকা হেসে বললেন, ‘এসো না। তাতে আমার কিছু যায় আসবে না!’
আমি ভেংচি কেটে রুম থেকে বেরিয়ে আসতে গেলেই আদ্রটা আমার ওড়না টেনে ধরে বললো, ‘দাও না একটু মাথা’টা টিপে! আমার খুব মাথা ধরেছে মেয়ে!’
আহা! ওনার মুখে আজকাল ‘মেয়ে’ শব্দটা শুনতে কতই না মধুর লাগে! আর আগে যখন বলতো তখন আমি রেগে একাকার হয়ে যেতাম। কিন্তু এই মুহূর্তে ওনার কিউট করে বলা কথাটা শুনে আমি মেজাজ দেখিয়ে বললাম, ‘আপনার মাথা ধরেছে, আমাকে না বলে দেওয়ালের সাথে বারি দিন। ফটাফট ঠিক হয়ে যাবে!’
আদ্র আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে চুলে মুখ গুজে বললো, ‘তুমি আজও সেদিনের মতো নির্দয়ই রয়ে গিয়েছো মেয়ে!’
—“এমনই থাকবো…!”
—“এমন থাকলে কিভাবে চলবে মেয়ে?”
—“এই আপনি যান তো। এসব ন্যাকামি ভালো লাগে না।”
—“আমি ন্যাকা?”
—“জ্বি। ইভেন আপনি একটা খারাপ মানুষ। আপনি কি ভেবেছেন আমি সবকিছু ভুলে গিয়েছি? না, আমি আপনার কর্মকাণ্ড কিছুই ভুলিনি।”
আদ্র রেগে গেলো। আমাকে ওনার মুখোমুখি দাড় করিয়ে বললো, ‘এই মেয়ে, তুমি মাঝেমাঝে এটা কেন বলো? এমন ভাবে বলো যেন আমি ভয়ংকর কিছু করে ফেলেছি তোমার সাথে। বিষয়টা কি বলো তো!’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘বিষয়টা এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন?’
—“আরে কোন বিষয় সেটা না বললে আমি জানবো কি করে?”
আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম, ‘বড়লোক নেতাদের এসব কুকীর্তি মনে থাকেনা।’
ওনি রেগে বললেন, ‘কুকীর্তি মানে? আমি কি কুকীর্তি করেছি?’
আমি বললাম, ‘ভুলে গেলেন? এত তাড়াতাড়ি?’
আদ্র রেগে বললো, ‘তুমি বলবে কি কুকীর্তি করেছি আমি?’
আমি একটা উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললাম। কিন্তু আমাকে তো জানতেই হবে সেদিন ওনি কেন আমার সাথে এরকম করেছিলেন। সেজন্য আমি বললাম, ‘আপনি যেদিন আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় আপনার বাসায় নিয়ে যান, তারপরের দিন যখন আমি ম্যাসে ফিরে যাই তখনই ঘটনাটা আমি দেখি!’
—“কি ঘটনা?”
—“এই যে, আমার গলায়, গালে আপনিই তো কামড় দিয়েছিলেন। আমার সরলতার সুযোগ নিয়েছিলেন, তাই না মিস্টার আদ্র?”
আদ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। অকপটে বললো, ‘হ্যাঁ আমিই দিয়েছিলাম। কিন্তু সরলতার সুযোগ বলতে তুমি কি বুঝাচ্ছো?’
—“ওহহ, এটাও এখন আমাকে বলে দিতে হবে? ওয়েট বলছি, আমার না নিজেকে মাঝেমধ্যে প্রস্টিটিউট মনে হয়, সেদিন রাতে আপনি কি করেছিলেন সেটা ভেবে।”
আদ্র এবার ভয়ংকর রেগে গেলো। ঠাস করে একটা চড় মেরে বললো, ‘শুনে রাখো মেয়ে! আমি সেদিন তোমার মায়াবী চেহারার মায়ায় পড়ে গিয়েছিলাম, নিজেকে কন্ট্রোল না করতে পেরে জাস্ট এটুকুই করেছি। এর বাইরে বেশিকিছুর কথা আমি ভাবতেও পারিনা, ভাবিনিও! এতদিন যে আমাদের বিয়ে হলো আমি কি তোমার সাথে সেইধরনের কোনো খারাপ বিহেভ করেছি মেয়ে? আর তুমি কিনা আমাকে বাজে লোকের সাথে মেলাচ্ছো আর নিজেকে প্রস্টিটিউটদের সাথে তুলনা করছো!’
আমি গালে হাত দিয়ে কান্না করছি। সত্যি ওনাকে কতটা ভুল বুঝলাম আমি, এতদিন একসাথে থেকেও ওনার প্রতি এতোটা ভুল ধারণা পুষতাম আমি? ছিহ!
২৭.
ওনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিয়ে চিল্লিয়ে বললেন, ‘চোখ মুছো মেয়ে, তোমার এসব আকাশপাতাল উল্টাপাল্টা চিন্তা মুছে কাউকে ভালোবাসতে চেষ্টা করো। আর না পারলে দ্যাটস এনাফ, ভালো। সেদিন ভার্সিটিতে যা হয়েছিলো সেটাও এক্সিডেন্টলি। তুমি ভার্সিটি ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিলে তাই আমি আটকাতে চেয়েছিলাম। আর বিয়ের বিষয়টা নিতান্তই স্যার আর আব্বুর মতামতের উপর ভিত্তি করে হয়েছে। সেজন্য তুমি আমাকে হাজব্যান্ড হিসেবে মেনে নিতে না পারলে বা আমার কাছে আসতে না চাইলে আমি কিছু মনে করবোনা বা জোর করবো না। আদ্র কখনোই নিজের অপমান মেনে নেয় না, মাইন্ড ইট!’
বলেই ওয়াশরুমে চলে গেলো। কয়েক মিনিটের মাঝে রুমে একটা টর্নেডো বয়ে গেলো যেন। সব কথা মাথার উপর দিয়ে গেলো।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে কাপড়চোপড় পরে রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলেন। একবারও আমার দিকে তাকালেন না। হুহ, যত্তসব ঢং।
২৮.
বিকেল গড়িয়ে রাত হয়ে গেলো, কিন্তু আদ্র এখনো বাসায় ফিরেনি। শ্বাশুড়ি মা দু’বার ফোন করলেন কিন্তু ফোন সুইচড অফ। রাতের খাবার খেয়ে ওয়েট করতে লাগলাম ওনার জন্য, কিন্তু নাহ! বেচারা আদ্র বাসায় ফিরলোই না। শ্বশুর মশাই কিছুক্ষণ রাগে গজগজ করতে করতে বকাঝকা করলেন। ওনি নাকি আগেও কয়েকবার এমন করেছেন, তবে ফোন করে জানিয়ে দিতো। কিন্তু আজ, ফোন না করায় সবাই দুশ্চিন্তা করছে।
ওনি যে আমার সাথে রাগ করে বেরিয়ে গিয়েছেন সেটা বলার সাহস পেলাম না। ওনাদেরকে অনেক কষ্টে সামলে নিলাম। বললাম, ‘ওনার ফিরতে রাত হবে, আপনারা ঘুমিয়ে পড়ুন!’
ওনারাও কিছুক্ষণ গাই-গুই করে শুয়ে পড়লেন। আমি রুমে এলাম। ফোন করবো কিনা ভাবছি, কিন্তু কিভাবে দিবো? আমার কাছে তো ওনার সেলফোনের নাম্বার নেই। মানে, কোনোদিন ফোনে কথা হয়নি। সেজন্য প্রয়োজন পড়েনি ওনার নাম্বার। ড্রইংরুমে গেলাম, মায়ের ফোনটা টেবিলের উপর রাখা ছিলো। লিস্ট থেকে ওনার নাম্বারটা কালেক্ট করলাম। মা ওনার নাম্বারটা ‘আদু’ দিয়ে সেইভ করে রেখেছেন, ফলে আমি সহজেই পেয়ে গেলাম। মা সবসময় ওনাকে ‘আদু’ বলেই ডাকেন।
আমি রুমে এসে নাম্বারটা ডায়াল করতেই আমার চক্ষুচড়ক গাছ! এই নাম্বার থেকেই তো এক সকালে আমার গোপন প্রেমিক ফোন করে বলেছিল, ‘তুমি ঘুমিয়ে থাকলে এতো মায়াবী লাগে কেন? আর বেশিক্ষণ ঘুমিও না, তাহলে হার্টের পেশেন্ট হয়ে বিয়ের আগেই মরে যাবো!’
তারমানে এটা আদ্র’ই? ওহ মাই গড! আই কান্ট বিলিভ দিস। এটা কি করে হতে পারে? আদ্রে’র মতো একটা ম্যাচিউরড ছেলে, সে নাকি আমার ঘুমন্ত চেহারা দেখার জন্য রাতের বেলা চুপিচুপি আসতো। চুপিচুপি একটা ফাগুনী শাড়ি দিয়ে গিয়েছিলো! আর আমি চোরটাকে সারাক্ষণ আশেপাশে রেখে, একমাস সংসার করার পর চিনতে পারলাম? লোকটা এতদিন ধরাও দেয়নি আমাকে? এমন একটা ভাব করতো যেন ওনি পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্পাপ, গম্ভীর, রাগী, ফাজিল, অসভ্য একটা মানুষ। আসলে ওনি যে প্রথম থেকেই আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন সেটা অতি সন্তপর্ণে গোপন করে গেলেন।
সেদিন শাড়ির সাথে ছোট্ট একটা চিরকুটও ছিলো। প্যাঁচানো কথাবার্তা। লিখা ছিলো,
“মায়ারাণী,
‘তোমার সাথে আমার দেখা সেদিন, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে যুগযুগ ধরে তোমার সাথে আমার পরিচয়। কেন এমন মনে হচ্ছে জানিনা। তোমাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম, তখনই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। তুমি হয়তো আমার গভীর সেই চাহনি লক্ষ্য করোনি, করলে ঠিকই বুঝতে পারতে ওই চোখ তোমার প্রেমে অন্ধ হয়ে গিয়েছে। এই ‘যুগ’ ‘যুগ’ ধরে আমার অতি কাল্পনিক একটা স্বত্ত্বার সাথে তোমার মিল পেয়ে আমি নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান মনে করছি। তোমার কপালে উষ্ণ পরশ দিয়ে আমার রাতের ঘুমটা ভালো হয়, ম্যাজিকের মতো। আচ্ছা! যাইহোক, কাব্যিক কথাবার্তা আমার ততোটা আসেনা। ফাগুন রঙের শাড়িটা তোমার জন্য। ভালোবাসা এক আকাশ সমান,
ভালোবাসা একটা পৃথিবীর সমান!’
তোমার অচেনা পুরুষ!”
সেই চিঠি পড়ে আমি যে সেইরাতে কত হেসেছি, বুঝাতে পারবোনা। কিন্তু এখন যখন জেনে গেলাম এটা আদ্র সাহেব, তখনই আমার হাত-পা তার কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি চাইলেই এই ফোন নাম্বার দিয়ে আরও আগেই এই ব্যাটাকে ধরতে পারতাম। শিট,,লোকটা তলে তলে এতকিছু করে ফেললো আর আমি সেই আদিকালের নারীর মতো পিছিয়েই আছি? নাহ, আমাকেও জ্বলে উঠতে হবে। আমার সাথে লুকোচুরি খেলবে আর আমি সারাজীবন বোকা বউ হয়ে সব মানবো তা তো হতে পারেনা, তাই না?
?”মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত!”
চলবে….ইনশাআল্লাহ! ভুল-ভ্রান্তি মাফ করবেন।
#সেদিনও_ছিলে_তুমি❤
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১১
২৯.
আমি কাঁদছি, প্রচুর কাঁদছি। তিনদিন হয়ে গেলো আদ্র বাসায় আসেনা। কোথায় আছে সেটাও বলছে না। মা’কে ফোন করে কথা বলে, আমি কথা বলতে চাইলেই ফোন কেটে দেয়। আমি বুঝতে পারছি না ওনি কি আমার উপর রাগ করেছেন, নাকি পালাচ্ছেন? আমাকে না দেখে এই তিনদিন ওনি থাকতে পারলেন? আমার খুব অভিমান আর রাগ হচ্ছে। ওনাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে ঘুমাতে আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে, অভ্যাসটা বদ-অভ্যাসেই পরিণত হয়েছে। আর আজ তিনদিন ওনি আমার থেকে দূরে আছেন, হুহ।
আমি মুখ গোমড়া করে বসে আছি। এমন সময় শ্বাশুড়ি মা আসলেন। বসলেন আমার পাশে। আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললেন, ‘রাগ করেছো মা?’
আমি বললাম, ‘নাহ তো!’
বলে চোখের কোণা মুছে নিলাম। তাঁর ছেলের জন্য যে আমি ভেতরে ভেতরে পুড়ে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছি, সেটা বোধহয় মা বুঝতে পারলো। বললো, ‘লুকিয়ে যাচ্ছো?’
—“কি লুকাবো…!”
—“আমি মা। আমি সব বুঝতে পারছি, আদু’র জন্য মন খারাপ হচ্ছে, তাই না?”
—“তেমনটা নয় মা…! ”
মা আমার হাতটা মুঠোয় নিলেন। একটু হেসে বললেন, ‘কি জানো তো, ছেলেটা একটু অভিমানী। একটু কিছুতেই বিরাট কান্ড করে বসে থাকে। তার উপর জেদ। নিজের জেদ বজায় রাখতে প্রিয় মানুষগুলোকেও মাঝে মাঝে কষ্ট দিয়ে ফেলে, নিজের অজান্তেই। ওর কোনোদিন কোনো মেয়ের প্রতি ইন্টারেস্ট ছিলোনা। ফারিন ওর এতো ভালো ফ্রেন্ড, কিন্তু কোনোদিনও ও ফারিনকে বন্ধু ছাড়া অন্য চোখে দেখেনি। সবসময় পড়াশোনা নিয়েই বিজি থাকতো, তারপর পলিটিক্সে জড়িয়ে গেলো। কতবার বলেছি বাবার সাথে ব্যবসাটা সামলাতে। কিন্তু নাহ, ওর জেদ। ব্যবসা করবে না, রাজনীতিই করবে। ওর আব্বু বললো, করুক। যা ইচ্ছে করে করুক। আমিও বাঁধা দিইনি। কতবার বললাম, আদু তোর যা ইচ্ছে হয় কর। কিন্তু আমার জন্য একটা মেয়ে নিয়ে আয়। আদু কি বললো জানো?’
আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। প্রশ্ন করতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি?’
—“বললো ও নাকি চিরকুমার থাকবে, বিয়ে নাকি করবেনা। প্রেম করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তাই প্রেমও নাকি করবেনা।”
—“তারপর?”
—“ওর এই কথা শুনে ওর আব্বু আচ্ছা করে এক ধমক দিলো। বকাঝকা করলো, কিন্তু ছেলে বিয়ের জন্য কিছুতেই রাজি হলো না। তারপর ফারিনের সাথে হলো ওর বন্ধুত্ব, আমরা ভাবলাম এবার বোধহয় ছেলের মতি ফিরেছে। কিন্তু ফারিনের বিষয়ে যখন ওর সাথে কথা বলতে গেলাম, তখন ও বললো, ‘ফারিনের মতো মেয়েদের নিয়ে নাকি ফটোশুট করা যায়, ঘর সংসার নয়।”
—“তারপর।”
মা হাসলেন। বললেন, ‘এরপর আরও নানাভাবে ছেলেকে বোঝাতে লাগলাম, কিন্তু ও ওর সিদ্ধান্তে অটলই থাকলো। শত শত মেয়েদের সঙ্গে উঠাবসা করতো, কিন্তু একটা মেয়ের প্রেমে ও পড়েনি। আমি আর ওর আব্বু ভাবলাম ছেলে বোধহয় চিরকুমারই রয়ে যাবে। কিন্তু একদিন রাতে বাসায় ফিরেই ও কেমন অস্থির অস্থির বিহেভ করছিলো। কারণ জিজ্ঞেস করাতেই ও বললো, ‘ও একটা দুপুরের প্রেমে পড়েছে। আমরা মানে বুঝলাম না।”
এটুকু বলে মা থামলেন। পানি খেয়ে আবারও বলতে শুরু করলেন, ‘ওর সাথে নাকি এক দুপুরে একটা মেয়ের দেখা হয়, প্রথম দেখায় ভালো লাগে মেয়েটিকে। কিন্তু দ্বিতীয় দেখায় কিছু ছিলো একটা, যাতে আমার ছেলে প্রেমেই পড়ে গেলো। সেদিন একথাটা শুনে আমি আর ওর আব্বু যা খুশি হয়েছিলাম বোঝাতেই পারবোনা। আর সেই মেয়েটা তুমিই ছিলে, ও তোমার একটা ছবি সোশ্যাল সাইট থেকে কালেক্ট করে আমাদের দেখিয়েছিলো। তারপর ভার্সিটির ঝামেলাতে আদ্রে’র আব্বু যখন তোমাকে দেখতে পায়, তখনই ভিসি স্যারের বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে তোমাকে পুত্রবধূ করে নিয়ে আসে। তোমার ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে নয় মা! তুমি আমাদের ব্যবহারে কষ্ট পেলে ক্ষমা করে দিও মা, আমার ছেলেটাকে কষ্ট দিও না।’
৩০.
আমার কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে। কিসব শুনছি আমি। আমার মতো একটা মেয়েকে প্রথমবার দেখেই কেউ প্রেমে পড়তে পারে, আমি ভাবতেও পারিনা। কিন্তু ঘটেছে তো এটাই। আমি মা’কে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমি ওনাকে কষ্ট দেবোনা।’
মা হেসে চলে গেলেন। বললাম তো কষ্ট দেবোনা, কিন্তু লোকটা তো আগেই কষ্ট পেয়েছেন। আমার কথায় কষ্ট পেয়ে বাড়ি থেকেই নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছেন। আমি শেফাকে ফোন লাগালাম। ম্যাস ছেড়ে দিয়েছি আমরা। কারণ আমিতো এখন এখানেই থাকি, আর শেফা একা একা থাকতে পারবেনা বলে বাসায় চলে গিয়েছে। কিছুক্ষণ রিং হবার পরে শেফা ফোন ধরলো। ও বোধহয় ঘুমাচ্ছিলো।
—“হ্যালো…!”
—“শেফা?”
—“হুম, আপনি কে?”
—“নাম্বার দেখস নাই, আমি আরশি!”
–“ওহহ, আরশি! কি বলবি বল। কিছু হয়েছে নাকি?”
—“হুম!”
—“কি?”
আমি বললাম, ‘আমার ঘরে রাতের বেলা যে চোরটা আসতো…!’
শেফা বললো, ‘কিছু চুরি কইরা নিয়া গেসে নাকি?’
—“আরে শোন!”
—“শোনার জন্যই তো বইসা আছি, কইয়া ফেল!”
—“যে চোরটা রাতে ঘরে আসতো সেটা তোর আদ্র ভাই ছিলো রে!”
শেফা অবাক হয়ে বললো, ‘সত্যি?’
—“হুম।”
—“তুই কিভাবে জানলি?”
—“আরে ওনি আমাকে যে ফোন থেকে কল করেছিলেন, সেই নাম্বার তো আমার কাছে ছিলো না। ওইদিন যখন ওনি ফোন বাসায় রেখে হাওয়া হয়ে গেলেন, তখন আমি ধরতে পেরেছি। আর তাছাড়া আজকে আম্মুও বলেছে আদ্র সাহেব যেদিন আমাকে প্রথম দেখেছিলো সেদিনই নাকি প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো। আচ্ছা শেফা, তুই বল তো। প্রথম দেখায় আমার প্রেমে পড়ার মতো কোনো বৈশিষ্ট্য কি আমার আছে?”
শেফা সব শুনে ৪৪০ ভোল্টের শক খেয়ে বসে আছে। বললো, ‘তোর মায়াবী একটা চেহারা আছে না? তোকে আমি যেদিন প্রথম দেখি সেদিনই তো মনে মনে পছন্দ করে ফেলেছিলাম। লজ্জ্বায় বলতে পারিনি, কারণ আমি মেয়ে। নইলে আদ্র ভাইয়ের আগেই তোকে তুলে নিয়ে বিয়ে করতাম, বুঝলি?’
আমি রেগে বললাম, ‘হারামখোর মাইয়া।’
—“এখন তো এসবই বলবি।”
—“তোর সাথে কথা নাই, লুচু মেয়ে।”
—“লুচু না, লিচু বল। কারণ আমি একটা মিষ্টি মেয়ে।”
—“ফোন রাখ ডাফার!”
–“জামাইয়ের সাথে প্রেম করো, হুহ!”
আমি রেগে ফোন কেটে দিলাম। শেফার কথা শুনে আমি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু কই? আমার নিজের চেহারা তো আমার কাছে মায়াবী লাগছেনা। তাহলে বাইরের মানুষেরা আমার মায়াবী চেহারা দেখে কিভাবে?
৩১.
মায়ের সাথে ড্রইংরুমে বসে আছি। দুজন কথাবার্তা বলছি। একটু পর মা উঠে রুমে চলে গেলেন, ফোনটা টেবিলের উপর রেখেই। অনি যেতেই ফোনটা বেজে উঠলো। আমি হাতে নিলাম, দেখলাম আননোন নাম্বার। আমি রিসিভ করে কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে বললো, ‘আম্মু এত দেরি করে ফোন রিসিভ করো কেন? রাগ ওঠে আমার!’
আমার সারা শরীর দিয়ে কাঁপুনি বয়ে গেলো যেন। তিনদিন পর ওনার গলা শুনছি। আমি ওনার কথার পিঠে কোনো কথা না বলে দৌড়ে ফোনটা নিয়ে ছাদে চলে গেলাম। দূরে গেলে নাকি ভালোবাসা গভীর হয়, আমিও একটু একটু টের পাচ্ছি। ওনাকে আচ্ছামতো সাইজ করার জন্যই আমার ছাদে আসা। তাই আমি গলা ঝেড়ে বলে ওঠলাম, ‘মিষ্টার আদ্র, আমি আপনার আম্মু নই। আর খবরদার ফোন কাটবেন না।’
ওপাশ থেকে ওনি বললো, ‘একশো বার কাটবো। কেটে দিচ্ছিও, তুমি কি করবা করে নাও।’
আমি কি উত্তর দেবো ভেবে পেলাম না। আচমকা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো, ‘আপনি যদি ফোন কেটে দেন এবং বাসায় না ফিরেন তাহলে আমি এক্ষুনি ছাদ থেকে লাফ দিয়ে সুসাইড করবো!’
ওপাশ থেকে ওনি জোরে বললেন, ‘কিহহহ?’
আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম, ‘বিশ্বাস করলেন না? তাহলে প্রুফ দিচ্ছি। ওয়েট করুন আমার মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার জন্য। বাই!’
আমি রেলিংয়ের উপর দাঁড়ালাম। সাথে ফোনটাও কেটে দিলাম। চারতলার ছাদ, এখান থেকে নিচে পড়ে গেলে আমি আর আমি থাকবোনা। আমার নিজেকে উড়ন্ত পাখি মনে হচ্ছে। বদ্ধ উন্মাদ না হলে আমার মনে হঠাৎ এই চিন্তাটা আসতো না, হঠাৎ প্রেমে পাগল হওয়ার মতো। ষোলো বছর বয়সের কিশোরীদের আবেগী প্রেমের মতো! টিনএজারদের প্রেম? আমি আলতো হাসলাম। এখান থেকে পড়ে গেলে আমি মুক্ত, স্বাধীন।
?”মহান আল্লাহ তায়ালা’র রাগের চেয়ে দয়ার পরিমাণ অনেক বেশি!”
~ আলহামদুলিল্লাহ
চলবে….ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।