#সেদিনও_বৃষ্টি_ছিল (পর্ব – ৫)
সকালে নাশতার টেবিলে বসেছে সবাই। সৈকতের মা শর্মীকে বলল-
-কয়েকদিন তো হয়ে গেল, তুমি চাইলে বাবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে পারো। বাড়ি গেলে ভালো লাগবে।
শর্মী খুশি হল। বলল- ঠিক আছে।
-তাহলে শিহাবকে ফোন করে বলে দাও ও এসে যেন তোমাকে নিয়ে যায়।
-ঠিক আছে।
সৈকতের দাদী বললেন- ঢং, আমরা বিয়া হইছে পরে বাপের বাড়ির চেহারাই আর দেখি নাই। আর এখন দেখি সব নতুন হিসাব!
সৈকতের মা বললেন- মা, আপনার নিশ্চই তখন বাবার বাড়ির জন্য খুব মন পুড়ত? তাহলে আর ওকে আটকাব কেন? যাক না?
শর্মী তাড়াতাড়ি বলল- দাদী আমি দু’দিন থেকেই চলে আসব। এর বেশি থাকব না।
যাও যাও, ঘুরে আসো।
তাদের আলাপের মাঝখানেই কলিংবেল বেজে উঠল। শর্মী উঠতে চাইলে সৈকতের মা বললেন- আমি দেখছি, তুমি খাও।
দরজা খুলতেই দেখলেন শিহাব দাঁড়িয়ে! ওকে ভেতরে আসতে বলে শর্মীকে ডাকলেন- শর্মী দেখ কে এসেছে…
শর্মী এগিয়ে এসে দেখে শিহাব! সে অবাক হয়ে বলল- তুই এত সকালে? বাসার সবাই ভালো আছে তো?
সবাই ভালো আছে। গতকাল রাতে ভাইয়া ফোন করেছিল, বলল তোমাকে নিতে আসতে। আর আমি যেন ভোরে উঠেই চলে আসি। সেজন্য সে সকাল ৬টায় আমাকে ফোন করে জাগিয়ে তুলেছে।
সৈকতের এই ব্যাপারটা শর্মীর খুব ভালো লাগল। সে শিহাবকে বলল- ভালো হয়েছে, আয় বস। আমরা তো সবাই খেতে বসেছি, তুই খেয়ে এসেছিস?
-এত সকালে কী খাবো, পাগল নাকি তুমি?
শর্মী তার শ্বাশুড়ির দিকে তাকাতেই তিনি বললেন- তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? ওর খাবারের ব্যবস্থা করো। শিহাব তুমি ফ্রেস হয়ে সোজা ডাইনিং এ চলে এসো। আমরা নাশতাই করছিলাম।
শিহাব বলল- আন্টি আমি এত সকালে এসেছি যে মিষ্টি টিষ্টি কিছু আনতে পারিনি… মাছের বাজার পেয়ে গেলাম তাই দুটো মাছ নিয়ে এসেছি। মাত্রই মাছ বাজারে এসেছে একদম তাজা রুই আর কাতলা মাছ।
-তুমি বাচ্চা ছেলে তোমাকে এসব কে করতে কে বলেছে? আচ্ছা যাও ফ্রেস হয়ে খেতে এসো আগে।
শর্মী শিহাবকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসতেই দাদী বলে উঠলেন- ওরে তো দেখি আগেই আসতে বইলা রাখছ তাইলে আর এতক্ষণ নাটক করলা কেন?
শর্মী করুণ মুখে বলল- দাদী আমি সত্যিই জানতাম না শিহাব আসবে।
শিহাব বলল- দাদী, সৈকত ভাইয়া আমাকে কাল রাতে বলেছে আসতে। আমার আসার কথা আপু কিছু জানে না কারণ ভাইয়া বলতে মানা করেছিল। তিনি চেয়েছিলেন আপুকে সারপ্রাইজ দিতে।
ও… হুহ ঢং দেখি বাঁচি না, যত্তসব।
এমন সময় সুপ্তি এলো। এসেই শিহাবকে দেখে চমকে উঠল… আরে এই ছেলে এখানে কী করছে? এত সকালে এর তো আসার কথা না। নাকি আমিই এখনো ঘুমে আছি? নিশ্চই ঘুমে আছি। ধুর ভাইয়ার বিয়েতে একে দেখার পর থেকে কখন জেগে আছি, কখন ঘুমিয়ে আছি টেরই পাচ্ছি না! যত জোরে মানুষ আছাড় খায় তার চেয়ে জোরে এর উপর ক্রাশ খেয়ে বসে পড়েছি। আসলে বসেও না, একেবারে আটার বস্তার মত চিৎপটাং হয়ে গেছি! উফফ কী দরকার ছিল ভাবির ভাইটার এত কিউট হবার?
সুপ্তিকে এমন করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর মা বলে উঠলেন- ওই যে এসেছেন নবাবজাদী। এত সকালেই উঠলি কেন? ১২টা তো এখনো বাজে নাই। যা যা আবার শুয়ে পড়।
সুপ্তি ভাবল, এই আম্মুটা না… ঘুমের মাঝেও কেমন বকে! সে মায়ের কাছে গিয়ে বলল- মা ঘুমের মধ্যেও তো দুটো ভালো কথা বলতে পারো নাকি? তখন ওর আম্মু ওর কান টেনে ধরে বললেন- লাগছে না কানে? বোঝা যাচ্ছে কিছু?
সুপ্তি আ আ করে চিৎকার করে কান ছাড়তে বলল। তার মা কান ছেড়ে দিতেই সুপ্তি দেখল শিহাব হাসছে। আহ্ সে কী হাসি! দেখলেই কলিজায় লাগেরে… এই ছেলেকে তো ধরে নিয়ে বিয়ে করে ফেলতে হবে। এ বাড়িতে সে আসবে জামাই হয়ে। আর সে লাল টুকটুকে শাড়ি পরে সেজেগুজে তাকে খাবার সার্ভ করবে। তখনই তার মনে পড়ল এই মুহূর্তে সে অতি পুরানো আলখাল্লা টাইপ টিশার্ট আর ট্রাউজার পরে আছে। ভালো করে তাকালে টিশার্টে ২/৪টা ফুটোও হয়ত দেখা যাবে। বর্ষার ভ্যাপসা গরমের কারণেই কাল রাতে এটা পরেছিল ঘুমাতে। আর আজই ক্রাশকে আসতে হল? তার উপর আলুথালু চুল। দেখেই বাড়ির কাজের মেয়ে মনে হচ্ছে। কী অবস্থা! শিহাব আসবে জানলে ভালো দেখে টপস আর লেগিংস পরে থাকা যেত। ফুটো টিশার্টের মত তার কপালটাও ফুটো করে ফেলেছে সে! তারপর আম্মুকে চাপা গলায় বলল- মা যেখানে সেখানে আমাকে এইভাবে অপদস্ত করো কেন ?
-যেখানে সেখানে কই করলাম?
-সুপ্তি এখানে আর না দাঁড়িয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। ঘরে গিয়ে পায়চারি করছে আর ভাবছে ক্রাশের সামনে কীভাবে যাওয়া যায়? দিন রাত যাকে নিয়ে স্বপ্নে দৌড়ে বেড়ায় বাংলা সিনেমার “লা লা লা লা লা…” সুরে সে আজ নিজের বাড়িতে এসে বসে আছে। তার তো এখন উচিত শিহাবের কাছে গিয়ে মাছের মত চোখ গোল গোল করে তার দিকে তাকিয়ে থাকা। আর সেখানে সে শিহাবের সামনে জমপেশ কানমলা খাচ্ছে, ভাবা যায়? এটা কেমন জুলুমরে ভাই? তার সাথেই কেন এসব হতে হবে? কিছু একটা করতে হবে… কিন্তু করবেটা কী? তখনই একটা আইডিয়া চলে এলো। ইয়েস, “চা”!!! নাশতা শেষ এখন তো চা লাগবেই আর পৃথিবীর সব প্রেমের শুরু চায়ের কাপে। বাহ্ ভালো আইডিয়া আছে তো আমার মাথায়! চায়ের কাপে তো ঝড় তুলতেই হবে আজ। হবে হবে আমাকে দিয়ে এসব প্রেম ভালোবাসাই হবে, ছাতার পড়শোনা কী আমার কাজ? তাছাড়া সুন্দরী মেয়েদের এত পড়তে হয় না। ওসব ছেলেদের কাজ। তারা কষ্ট করে পড়বে তারপর ভালো চাকরি-বাকরি, ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করবে তার মত সুন্দরীদের পাবার জন্য। যাই, চায়ের ব্যবস্থা করি…
সুপ্তি রান্নাঘরে গিয়ে দেখল ভাবি চা বানাচ্ছে, সে বলল- ভাবি দাও চা আমি নিয়ে যাচ্ছি?
শর্মী ওর দিকে অবাক চোখে তাকাল আর পাশ থেকে আম্মু বলে উঠল- জিন্দেগিতে তোকে রান্নাঘরে কোনো একটা কাজে টেনে আনা যায় না, ছাগলের মত খুটি গেড়ে বসে থাকিস। আজ হঠাৎ কী হলো?
-কারণ এই এমুহূর্ত থেকে রিয়ালাইজ করতে পারছি এসব না করলে জিন্দেগি বরবাদ হয়ে যেতে পারে। বলে সে কথা না বাড়িয়ে দুকাপ চা নিয়ে ড্রইংরুমে এগিয়ে গেল। গিয়ে দেখে তার বাবা আর শিহাব গল্প করছে। সে তখন টিউব লাইটের মত ফিউজ হয়ে গেল। কারণ সে চেয়েছিল চা নিয়ে সে আর শিহাব গল্প করবে…
সুপ্তিকে দেখেই ওর বাবা বললেন- কিরে চা আনতে এত সময় নিচ্ছিস কেন? আর যেভাবে চা নিয়ে হাঁটছিস উষ্ঠা খেয়ে পড়ে গিয়ে তো নাক, মুখ ফাটিয়ে ফেলবি। সুপ্তি করুণ চোখে বাবার দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে শিহাবকে চা দিল। তখন ওর বাবা বললেন- দেখ দেখ শিহাবকে ভালো করে দেখ… (সুপ্তি তখন মনে মনে বলল- আমি তো দেখতেই চাই কিন্তু ভালো করে দেখতে আর দিচ্ছ কই?) শিহাবের সাথে গল্প করে খুব ভালো লাগছিল (সুপ্তি আবার মনে মনে বলল- ভালো তো তোমার চেয়ে আমার বেশি লাগে কিন্তু তাতে হচ্ছেই বা কী? তোমার কারণে আমার প্রেমের উড়োজাহাজটা ফ্লাই করতে পারছে না সেটা কখন বুঝবা?) ছেলেটা পড়াশোনায় এত ভালো! বুঝলে শিহাব, আমার এই মেয়েটা হয়েছে একটা, পড়াশোনা কিচ্ছু মাথায় ঢোকে না সারাদিন শুধু সাজগোজ নিয়ে পড়ে থাকে! রেজাল্ট খারাপ করেও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই যে একটু ভালোভাবে পড়তে হবে।
সুপ্তি মনে মনে প্রমাদ গুনল… তার ফ্যামিলি এমন কেন? তাকে কী ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে এনেছে যে সব সময় সব জায়গায় তার প্রেস্টিজ ফিউজ করে ছাড়তে হবে? আড়চোখে তাকিয়ে দেখে শিহাব এসব শুনে হাসছে। হাসবেই তো। সে বাবাকে রাগ দেখিয়ে চলে যাচ্ছিল তখন ওর বাবা বললেন- এই যে পড়াশোনার কথা বলেছি আর এখন চলে যাচ্ছে!
এসব দেখে শিহাব শুধু নিরবে হেসে গেল।
শিহাব শর্মীকে বলেছে সে বেশি দেরি করবে না।- তাড়াতাড়ি যেন ব্যাগ গুছিয়ে নেয়।
শর্মী ব্যাগ গুছানোর আগে সৈকতকে একটা ফোন দেয়। সৈকত ফোন রিসিভ করে বলল-
-হ্যালো হ্যান্ডসাম জামাইর বউ…
-কী করছেন?
-একটু ঘুরতে বের হয়েছি?
-কোথায়?
-তোমার মনের মাঝে।
-আচ্ছা? তাহলে তো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় আছেন।
-কিন্তু আমি তো সেখানে শাকচুন্নি, ভূত, পেত্নী এসবও দেখতে পাচ্ছি!
-ভুল দেখছেন। ওসব আপনার মনের শ্যাওড়া গাছে দল বেঁধে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে।
সৈকত শব্দ করে হেসে ফেলল।
-শুনুন… আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
-ধন্যবাদ কেন?
-শিহাবকে এভাবে পাঠানোর জন্য। আমি রেডি হচ্ছি বাড়ি যেতে। আপনি আসবেন তো আমাকে নিতে?
-তুমি যাচ্ছ যাও আবার আমাকে টানাটানি করছ কেন?
-আপনাকে টানব না তো কি শাকিব খানকে টানব?
-আই ডোন্ট মাইন্ড। জায়েদ খান বা মিশা সওদাগর না হলেই চলবে।
-ডিপজলকে ডাকি? ওটা তো আরও ভালো অপশন।
-ডাকতে পারো। তবে তার আগে ডিপজলের ১০টা ডায়লগ বলতে হবে।
-পারব না।
-তাহলে এটা বলো যে, মনে মনে আমাকে কি নামে ডাকো?
শর্মী ১০ সেকেন্ড চুপ থেকে বলল-“হ্যান্ডসাম জামাই”।
-হ্যান্ডাসাম জামাইকে কেউ এমন শুকনো করে “ধন্যবাদ” দেয়?
-কীভাবে দিব?
-বলবা “লাভ ইউ জামাই, উম্মাহ”
-ইস, সব সময় ঢং…
-তুমি তো দেখছি দাদীর ডায়লগও শিখে গেছ!
-আরও অনেক কিছু শিখেছি বাড়ি আসুন সব দেখবেন। আসছেন তো নিতে?
-আমি আসতে না পারলে শিহাবকে নিয়ে চলে আসতে পারবে না?
-পারব তবে আপনি এলে ভালো হত।
-“ভালো হত” নাকি “ভালো লাগত” কোনটা?
-“ভালো লাগত।”
-এমন প্রেম প্রেম টাইপ কথা বলো কেন? চাকরি বাকরি ছেড়ে দিয়ে ঘর জামাই হয়ে যাব কিন্তু।
-“আপনার প্রেমে পড়েই…” এই পর্যন্ত বলে শর্মী চোখ বন্ধ করে জিভ কাটল… ইসস কী বলে ফেলছিল সে!
-কী বললে? লাইনটা শেষ করো?
-কিসের লাইন? আমি কিছু বলিনি। আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসবেন। ফোন রাখলাম…
সৈকত মুচকি হেসে বলল- ঠিক আছে, চেষ্টা করব… সাবধানে যেও।
শর্মীর শ্বাশুড়ি দুপুরে খেয়ে যেতে পিড়াপীড়ি করেছিল খুব কিন্তু ওরা তার আগেই বের হয়ে গেছে। এখান থেকে ওদের বাড়ি যেতে দু’ঘন্টা সময় লাগে। শর্মীর মনে হচ্ছে কয়েক বছর পর বাড়ি যাচ্ছে সে। বাড়ির মানুষ, বাড়ির আকাশ কতদিন দেখে না সে…
সৈকতের চেয়ে সুপ্তি বয়সে অনেক ছোট। সুপ্তি সবে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে। ইন্টারে পড়ুয়া আর সব মেয়েদের মত সেও প্রজাপতির রঙিন ডানায় উড়ে বেড়ানো টাইপ। পড়াশোনা ছাড়া অন্য সকল বিষয়েই তার ব্যাপক আগ্রহ। নাটক সিনেমার প্রায় সব নায়কের উপর ক্রাশ খাওয়া তার প্রিয় অভ্যাস। অবশ্য কারো উপরই বেশিদিন এই ফিলিংস তার থাকে না। তবে সম্প্রতি সে ভাইয়ের বিয়েতে গিয়ে ভাবির ছোট ভাইয়ের উপর ক্রাশ খেয়ে ফেলেছে। তার কাছে মনে হচ্ছে এবার সে সিরিয়াস টাইপ ক্রাশ খেয়েছে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে শিহাবকে বাসায় দেখে তার মনে নতুন উদ্যমে প্রজাপতি উড়তে শুরু করেছে। রয়েল ব্লু শার্টে ছেলেটাকে দেখে তার হার্টবিট আটকে গিয়েছিল। কীভাবে কী করা যায় সকাল থেকে সেই চিন্তায় সে মগ্ন। তার মাথায় একটা আইডিয়া অবশ্য ইতিমধ্যেই এসে গিয়েছে, সেটা এখন শুধু কাজে লাগাবার পালা। তারই সূত্রে সে ফেসবুকে নতুন একটা একাউন্ট খুলে ফেলল। নাম দিল “শিহাবের বউ?” প্রফাইল পিকে দিয়ে দিল পেছন দিকে দাঁড়ানো এক কাপলের ছবি যারা হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে একটা হার্ট চিহ্ন দেয়া। বায়োতে লিখল “শিহাব আমার জান”। একাউন্ট খোলা হয়ে গেল, এবার শিহাবকে ধরার পালা। শিহাবের আইডি খুঁজে বের করল তারপর তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিয়ে একটা গান লিখে ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিল-
“প্রেমে হাসিয়া ভাসিয়া উতলা হাওয়ায়, চলো নিরালায়, চলো নিরালায়…
আমি আর আমি নই… তোমাতে ডুবিয়া রই…দিয়েছ পাগল করিয়া… উথাল পাথাল মন দরিয়া…
পরাণে শয়নে নয়নে নয়নে তুমি শুধু মনে…
তুমি আর একা নও, আমাতে মিশিয়া রও… দেখিয়া রাখিব তোমায়, পিয়াসি মনের গালিচায়…
শয়নে, স্বপনে, আষাঢ়ে, শ্রাবণে তুমি প্রতিক্ষণে…
প্রেমে হাসিয়া, ভাসিয়া উতলা হাওয়ায়, চলো নিরালায়, চলো নিরালায়…।”
ম্যাসেজ পাঠিয়ে সে রিপ্লাইয়ের অপেক্ষা করতে লাগল। এই ম্যাসেজ দেখে শিহাবের মনে কোন গান বাজতে শুরু করবে সেই ভাবনায় সে অস্থির।
শিহাব শর্মীর থেকে দুই বছরের ছোট। পড়াশোনায় ভালো, ভালো মানে বেশ ভালো। ভদ্র ছেলে। আসলে ঠিক ভদ্র না, একটু বোকা টাইপ। পড়ুয়া ছেলেরা আবার চালাক হয় কই? তারা চোখে চশমা নিয়ে গাদা গাদা বইয়ের ভেতরে ঢুকে বোকার রাজ্যে বাস করে। শিহাবও অনেকটা তাই। এমন মানুষদের বন্ধু খুব কম থাকে। শিহাবও এর ব্যতিক্রম না। শুধু রাত জেগে সে পড়াশোনা করে এমন না, দিনেও বইয়ে মুখ গুজে পড়ে থাকে। রাত ৩টা পর্যন্ত পড়ে প্রায়ই। পড়া শেষ করে ঘুমাতে যাবার আগে সে ফেসবুকে ১০ মিনিটের জন্য ঢু মারে। আজও ঢুকল, দেখল একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আছে, সেটা থেকে আবার ম্যাসেজ রিকোয়েস্টও আছে। আইডির নাম দেখে সে তাজ্জব বনে গেল! আর ম্যাসেজ দেখে তো তার অজ্ঞান হবার জোগাড়। কে এই মেয়ে? কী চাইছে সে? তার বউ ই বা কবে থেকে হলো? একে তো সে চেনেই না! আইডিতে নিজের ছবি নাই, ম্যাসেজে কী সব লিখেছে… ছিঃ ছিঃ মেয়েটার তো একেবারেই লজ্জা নেই! সে ফোন রেখে শুয়ে পড়ল। যেন ফোন রেখে দিলেই ম্যাসেজ দাতা আর কিছু করতে পারবে না।
শিহাব সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখল ঐ আইডি থেকে আবার কয়েকটা ম্যাসেজ এসেছে, সে ইনবক্সে গিয়ে দেখল লিখেছে-
“বাবু ম্যাসেজের রিপ্লাই দিলা না?”
(শিহাবঃ আমাকে কেন “বাবু” ডাকছে? এই মেয়ের তো মাথায় সমস্যা আছে।)
“সকালে উঠে কিন্তু প্রথম ম্যাসেজ আমাকে দিবা। দিবা কিন্তু, নাহলে খুব রাগ করব”
(শিহাবঃ সকালে উঠে একটা অপরিচিত মেয়েকে কেন ম্যাসেজ পাঠাব? আজব!)
(এরপরের ম্যাসেজ সকালে এসেছে)
“আমার বাবুতা এখনো ঘুমায়? ওলে বাবালে, তুমি দেখি আমার চেয়েও বেশি ঘুম কাতুরে! আহা যখন আমরা একসাথে ঘুমাব তখন পাল্লা দিয়ে ঘুমাব, ঠিক আছে?”
(শিহাবঃ এগুলো কী লিখেছে? এমন তোতলামো কেন করছে? আর আমি কেন এর সাথে ঘুমাব!)
“উড়ে গেছে চিন্তা ভাবনা ঘুম, মনে মনে একশ রঙ বেলুন… চুপিচুপি গল্প হবি আয়, তোকে আজ লেগেছে দারুণ”
(শিহাবঃ কী অসভ্য, ছিঃ!)
শিহাব ফোন রেখে বিছানা ছাড়ল। ম্যাসেজ পাঠানো যে মেয়েটাকে শিহাবের এখন অসভ্য মনে হচ্ছে সে জানত না, এমন একদিন আসবে যখন এই মেয়েটা ম্যাসেজ না পাঠালে তার দিন শুরু হবে না, রাত শেষ হবে না। সে জানত না এই মেয়েটাই একদিন তার প্রাণের অংশ হয়ে যাবে! তারও গাইতে ইচ্ছে হবে-
“মনে মনে তোকে মন দিয়েছি, ক্ষণে ক্ষণে তোর পিছু নিয়েছি… জানে আকাশ, জানে বাতাস, জানে শত প্রহর…”
আজ বৃহষ্পতিবার, সৈকত ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হচ্ছে। রাতের বাসে সে চট্টগ্রাম ছাড়ছে ঢাকার উদ্দেশ্যে। তবে সে নিজের বাড়ি না গিয়ে শর্মীদের বাড়ি যাচ্ছে। সে যে ওখানে যাচ্ছে সেটা অবশ্য শর্মী জানে না। ভোর ৭টা বাজার আগেই সে শর্মীদের বাড়ি পৌছে যাবে ইনশাআল্লাহ। বাসে ওঠার আগে শর্মীর সাথে ফোনে কথা বলে নিয়েছে। যেন বাসে উঠে কথা বলে ধরা পড়ে না যায়। তার বাস চলতে শুরু করলে সে ঘুমাবার চেষ্টা করল। চোখ লেগে আসতেই ফোন এলো… তাকিয়ে দেখে তিথি। তিথির সাথে সেদিনের পর কাজ ছাড়া আর কোন কথাই হয়নি। এখন কেন ফোন করেছে? সে ফোন ধরল না কিন্তু তিথি ফোন দিয়েই যাচ্ছিল। বাধ্য হয়ে ফোন রিসিভ করে চুপ করে রইল… প্রথমে তিথিই কথা শুরু করল-
-কেমন আছ?
-অফিসে তো দেখা হলই, এই রাতে ফোন দিয়ে আবার কেন জিজ্ঞেস করছ?
-ফোন দেয়াও কী নিষেধ?
-না, নিষেধ না। কী প্রয়োজন তাই বলো?
-প্রয়োজন ছাড়া তাহলে ফোন দিতে পারব না?
-কেন কথা বাড়াচ্ছ শুধু শুধু? বলো না কী বলবে?
তিথি বেশ কিছুক্ষণ চুপ রইল তারপর বলল- আমি ভালো নেই সৈকত… তুমি কী ভাবলে জানালে না?
সৈকত এবার বিরক্ত হল। মেয়েটা এখনো এটা নিয়ে পড়ে আছে? সে বিরক্তিটা চেপে রেখে শান্ত গলায় বলল- তিথি, আমি তোমাকে যা বলার সেদিনই বলে দিয়েছি। এটা এমন কোন বিষয়ও না যে দুদিন ভাবলাম আর আবেগে পড়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। আমি সেদিন যা বলেছিলাম তা জেনে বুঝেই বলেছি। এমনটাও নয় যে এখন মত পাল্টে যাবার কোন অপশন আছে। এটা সম্পূর্ণই মনের ব্যাপার। এভাবে কোনো কিছু হওয়া অসম্ভব। তুমি বিয়েটা করে ফেল সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার ঘুম পাচ্ছে, ফোন রাখি?
-তিথি আর কথা বাড়াল না সে ফোন রেখে দিল। সৈকত ভাল জব করে, দেখতে সুদর্শন তার উপর এর সাথে তিথির আন্ডারস্ট্যান্ডিংও ভালো তাই ওকে কিছুতেই হাত ছাড়া করতে চাইছিল না তিথি। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতে চাইছিল কিন্তু সৈকত তো পাত্তাই দিল না! অন্য রাস্তা ধরতে হবে। সে যে সৈকতকে ভালোবাসে সেটা অফিসে সে কয়েকজনকে বলে ফেলেছে। সে আসলে শিওর ছিল সৈকতও তাই কিন্তু ব্যাপারটা যে এমন হবে তা সে ভাবেইনি! সবার কাছে সে ছোট হবে এটা কিছুতেই হতে পারে না। সে “না” শুনেও অভ্যস্ত নয়। ব্যাপারটা এখন তার ইগোতে লাগছে। ছুটির দিন শেষ হোক তারপর সৈকতকে কীভাবে বাগে আনতে হয় দেখা যাবে।
সৈকত শর্মীদের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। তার শ্বাশুড়ি মা দরজা খুলে দেখেন সৈকত! সে ভীষণভাবে অবাক হলেন। বললেন-
-কী আশ্চর্য তুমি আসবে সেটা তো শর্মী আমাকে বলেনি। সে তো এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। এমন গাধা মেয়ে হয়? কেমন আছ বাবা?
-ভালো আছি। আমি যে আসব শর্মী কিছুই বলেনি আপনাকে?
-না! আর তুমি যে আসবে ও জেগে থাকবে না? দাঁড়াও ডেকে নিয়ে আসছি…
-না না ডাকতে হবে না। আমি দেখছি।
-ঠিক আছে। আমি তোমার খাবারের আয়োজন করি সারা রাত জার্নি করে এসেছ তোমার তো খিদে পেয়েছে…
-তা তো পেয়েছেই।
-ঠিক আছে তুমি ঘরে গিয়ে ফ্রেস হয়ে এসো।
সৈকত শর্মীর ঘরে গিয়ে দেখল ও ঘুমাচ্ছে। সে আস্তে করে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে সোজা ওয়াশরুমে গিয়ে খুব সাবধানে ফ্রেস হয়ে এসে শর্মীর পাশে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখল ওকে। কী আশ্চর্য ঘরে এত কিছু হয়ে যাচ্ছে আর এর ঘুমই ভাঙছে না! মাথার পাশেই শর্মীর ফোন রাখা। সে ফোন হাতে নিয়ে দেখল স্ক্রিনে তারই ছবি দেয়া। ফোনটা লক করা নেই! বাহ্ বেশ ভালো মেয়ে তো। কিন্তু ফোনটা সাইলেন্ট করা। সে তার ফোন বের করে একটা কল দিল শর্মীর ফোনে। তার দেখার ইচ্ছে শর্মী তার নাম্বার কী নামে সেভ করেছে? কল দিতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল “Mr. bitter” সৈকত হাসল… ভালোই তো নাম দিয়েছে “জনাব করলা”। তারপর ফোন রেখে সৈকত আস্তে করে শর্মীকে জড়িয়ে ধরল। সাথে সাথেই শর্মীর ঘুম ভেঙে গেল… তাকিয়ে সৈকতকে দেখে সে লাফিয়ে উঠতে চাইল কিন্তু সৈকত তাকে উঠতে দিল না। বলল-
-একদম নড়বা না। এত ঘুম কিসের তোমার? ঘরে যে এত কিছু হয়ে যাচ্ছে তুমি ঘুমিয়েই আছ! কেউ ধরে নিয়ে গেলেও তো টের পাবা না।
-শর্মী কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। তার মাথা হ্যাঙ হয়ে গেছে… শুধু বলল- আপনি এখানে?
-আমি না তো কে হবে এখানে? এই তুমি কী অন্য কাউকে আশা করেছিলে?
-আপনি আসবেন সেটা জানাননি কেন?
-জানিয়ে এলে এসেই তোমাকে এভাবে পেতাম বলো?
-আচ্ছা ছাড়ুন… উঠব…
-বলছি না, উঠবা না। তোমার জন্য আসছি তাই আমি যতক্ষণ না চাইব ততক্ষণ উঠতে পারবা না।
শর্মী আর নড়ল না। সৈকত এভাবে আসায় তার নিজের কাছেও অনেক ভালো লাগছে। তার ভেতরে কতটা আনন্দ হচ্ছে সেটা বলে বোঝানো যাবে না। তার এই পাগলা জামাইটা এত রোমান্টিক কেন?