#সেদিনও_বৃষ্টি_ছিল (শেষ পর্ব)
৬মাস চলে গেছে… শিহাব এখনো জানে না “শিহাবের বউ” বলে যার সাথে সে কথা বলে সে আসলে কে? এদিকে সে কানাডায় স্কলারশিপের জন্য আবেদন করেছিল সেটা কনফার্ম হয়ে গেছে। সেটা সেই ম্যাসেজ কন্যাকে জানাতেই কন্যা কান্নাকাটি শুরু করে দিল। তাকে ছেড়ে নাকি শিহাবের কিছুতেই যাওয়া চলবে না। শিহাব পড়ল মহা ঝামেলায়। সে মেয়েটাকে বোঝাল সে স্টাডি শেষ করে এসে পড়বে নতুবা তাকে নিয়ে যাবে কিন্তু কন্যা কিছুতেই কিছু শুনতে চায় না। শিহাব কী করবে বুঝতে পারছে না… সে পড়াশোনা ছাড়া কিছু বোঝে না, যে স্কলারশিপ নিয়ে তার এত স্বপ্ন সেটা হাতছাড়া করা তার জন্য অসম্ভব। কিন্তু এই মেয়ে তো কিছুই শুনছে না। সে তো রোজ কথা বলবেই ওর সাথে এখন যেমন বলে। কিন্তু মেয়েটা এমন অদ্ভুত সব কথা বলছে যার কোনো যুক্তিই নেই। সে নাকি কানাডা গিয়ে তাকে ভুলে যাবে, কোনো বিদেশীনিকে বিয়ে করে ফেলবে! অদ্ভুত, সে কেন বিদেশী মেয়ে বিয়ে করবে? ব্রাউন কালার চুলের মেয়েদের দেখতে তো ঘো ড়ার মত লাগে। সে নিশ্চই ঘো ড়ার মত মেয়ে বিয়ে করবে না।
সুপ্তি দুদিন ধরে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বাসার সবাই টেনশনে পড়ে গেছে। কী হয়েছে কিছুই বলছে না শুধু কান্না করে যাচ্ছে। শর্মী অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু তাকেও কিছু বলছে না। সৈকত ফোন করে জিজ্ঞেস করেছে তাকেও কিছু বলেনি। সৈকত অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ঢাকায় চলে এলো।
সবাই সুপ্তির ঘরে বসে আছে। সুপ্তি যা বলেছে তা রীতিমত বোমা ফাটানোর মত সব কিছু নিস্তব্ধ করে দিয়েছে! তার কথা শুনে কী বলবে তা কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। সে বলেছে সে নাকি বিয়ে করতে চায়!
সুপ্তির বাবা উপায় না দেখে বললেন- বিয়ে করবে ভালো কথা পাত্র দেখা শুরু করি কিন্তু এটা নিয়ে এত নাটক করতে হবে কেন?
সুপ্তি তখন বলল- দেখাদেখি করার মত এত সময় সুযোগ নেই তার, সে একজনকে ভালোবেসে ফেলেছে। আসলে তারা দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলেছে তাই তাকেই বিয়ে করতে হবে।
সৈকত জিজ্ঞেস করল- তোর মত একটা স্টুপিড মেয়েকে কে ভালোবেসে ফেলল!?
-আমার চেয়েও বেশি স্টুপিড একটা ছেলে।
-সে যে তোর চেয়েও বড় স্টুপিড সে তো বুঝতেই পারছি। ছেলেটা কে?
-তাকে তোমরা সবাই চেনো।
-চিনি! কে?
-“শিহাব”
নাম শুনে সবাই অবাক আর শর্মী রীতিমত আতকে উঠল। শিহাব!!! কোন শিহাব?
-তোমার ভাই শিহাব।
শর্মী কিছুই বুঝতে পারছে না ঘটনা কী হচ্ছে… শিহাব এমন একটা কাজ করবে সেটা সে কল্পনাও করতে পারে না তাও আবার সম্পূর্ণ তার বিপরীত ধর্মী মেয়ের সাথে! একদিকে তার ভাই অন্যদিকে তার ননদ… কোন দিকে যাবে কাকে কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না…
সৈকত বলল- শিহাবের মত একটা কমনসেন্স ছাড়া ছেলেকে তুই কীভাবে পছন্দ করলি? তোর তো সারা জীবন পড়াশোনা আর রঙহীন পানসে জীবন কাটবে!
শর্মী তখন চোখ পাকিয়ে সৈকতের দিকে তাকাল। সৈকত শর্মীর চাহনি দেখে তাড়াতাড়ি বলল- না মানে আমি বলতে চেয়েছি শিহাব বই ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না আর তুই বই বাদে পৃথিবীর বাকি সব বুঝিস, শিহাব অনেক ভদ্র ছেলে আর তুই একটা ফাজিল মেয়ে তাহলে তোদের মিলল কী করে?
সুপ্তি বলল- মিলবে না কেন? আমাদের মত পার্ফেক্ট কাপল আর একটাও নেই। আমাদের নামেও তো মিল দুজনার নামই “S” দিয়ে। কিন্তু শিহাব স্কলারশিপ নিয়ে কানাডা চলে যাচ্ছে যাবার আগে আমাদের বিয়ে হয়ে যাক সেই ব্যবস্থা করো।
সৈকত বলল- গাধার মত কথা বলিস না। ব্যাঙ্গ করে বলল- “দুজনার নামই তো S দিয়ে” আরে গাধী তোদের বিয়ে হলে তো লোকে ভাইবোন বলবে।
-কেন তোমাদের দুজনের নামও তো S দিয়ে তোমাদের কেউ ভাইবোন বলেছে কখনো?
-আমাদের দুজনার নাম এক কোথায়? আমি সৈকত আর ও বুশ আই মিন বুশরা।
-দেখ ভাইয়া, এসব আজাইরা কথা বলে কোন লাভ নাই। তোমাদের আমার বিয়ের আয়োজন করতেই হবে। কবে ও বাড়িতে কথা বলবা সেটা বলো?
সবাই ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে… এই মেয়ের তো লজ্জাশরম বলে কিছুই নাই! এইভাবে কেউ নিজের বিয়ের কথা বলে?
সুপ্তির বাবা বললেন- ঠিক আছে আমি ওদের সাথে কথা বলব। এখন সবাই যার যার ঘরে যাও। আর শর্মী, তুমি তোমার বাসায় কিছু বলো না। আমিই বলব সব।
শর্মী মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলল। বাকি সময়টায় সবার উত্তেজনা কাজ করেছে কী হবে সেটা ভেবে। সুপ্তির বাবা শর্মীর বাবাকে ফোন দিয়ে বললেন তারা সবাই বিকেলে তার বাসায় আসছে। শর্মীর বাবা শুনে খুশি হলেন।
সবাই শর্মীদের বাড়িতে বসে আছে। সুপ্তির বাবা সব কথা খুলে বললেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন এখন কী করা যায়?
শিহাব তো সব শুনে আকাশ থেকে পড়ল! সে চিৎকার করে বলল- অসম্ভব, আমি এই মেয়েকে ভালোবাসি না, কক্ষনো না। এই মেয়ে তো ভীষণ ফাজিল, আসলে ফাজিল না ভয়ংকর। আপুর বাসায় গেলেই আমার পেছনে লেগে থাকে। আমার একটা শার্ট, একটা টিশার্ট, কলম আরও কত কি রেখে দিয়েছে। জোর করে আমার ফোন নিয়ে ঘাটা, আমাকে দিয়ে গিফট দেওয়ানো, আমার হাত ধরে টানাটানি করা, সারাক্ষণ গায়ে গায়ে লেগে থাকা, চুলে হাত দেয়া কী না করেছে! গেলেই একটা কিছু করবে। পুরা মাস্তান টাইপ মেয়ে, ক্রিমিনাল একটা। এর জন্য আমি আপুর বাসায় যেতেই চাই না। আর একে আমি ভালোবাসব? ইম্পসিবল।
শিহাবের কথা শুনে এবার এবাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটল যেন। সবাই আরেকবার বিদ্ধস্ত হল। সুপ্তি তো বলেছিল ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে এখন তো দেখা যাচ্ছে কাহিনী কেস খেয়ে যাচ্ছে!
সুপ্তি তখন রেগে গিয়ে বলল- আমি মাস্তান? আমি ভয়ংকর? আমি ক্রিমিনাল? সবাইকে দেখাব তুই যে আমাকে রাতভর কত প্রেমের ইতিহাস লিখিস?
শিহাব বলল- এই মেয়ে একদম তুইতোকারি করবে না। কে তোমাকে ইতিহাস লিখেছে? যতসব মিথ্যা কথা।
সুপ্তি তখন তার ফোন বের করে দেখাল। শিহাবের মুখ হা হয়ে গেল, কী বলবে তার ভাষা নেই। একেবারে বোবা হয়ে গেছে। “এই মেয়ে কী করে ঐ মেয়ে হয়!!!” এই প্রশ্নের উত্তর অন্ধের মত খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সে অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছে না…
শিহাবের হা হয়ে যাওয়া নিস্তব্ধ মুখ দেখে সবাই যা বোঝার বুঝে গিয়েছে।
সুপ্তি তখন বলল- কেন বার বার তোমাকে তোমার বোনের শ্বশুরবাড়ি যেতে বলি, কেন আমাদের বাড়ি এলে তোমার সাথে এমন করি সেসব এবার ক্লিয়ার হয়েছে হাদারাম?
শিহাব অনেক্ষণ চুপ থেকে বলল- আমাদের বিয়েটা কবে হচ্ছে তাহলে?
এ কথায় সবাই আরেকবার শক খেল। শর্মীর মা বললেন- তুই শেষ পর্যন্ত একটা ক্রিমিনালকে বিয়ে করবি?
-হ্যাঁ করব। কারণ আমার ক্রিমিনাল পছন্দ।
শর্মীর বাবা শর্মীকে বলল ওদের ভেতরে নিয়ে যা আমরা কথা বলি। আসলে তাদের কথা বলারও কিছু ছিল না। উজবুকের মত দুইটা বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেছে কিছু তো করার নাই। তাই তারা বিয়ের জন্য ভালো দিন খুঁজতে লাগল…।
শিহাবের কানাডা যাওয়ার তারিখ ফিক্সড হয়ে গেছে। তাই একরকম তড়িঘড়ি করে শিহাব আর সুপ্তির বিয়েটা ঠিক করা হয়েছে। বিয়ে ঠিক হবার পর থেকে শিহাবের সাথে সুপ্তির আহ্লাদীপনা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে আর তা শুধু তাদের নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই বাড়ির লোকজনের সামনেই চলছে সব। এসব দেখে সবাই রীতিমত বিরক্ত। সুপ্তির দাদি তো তাকে বেহা*য়া ছেমড়ি বলে ডাকা শুরু করেছে। মেয়ের এমন বেহা*য়া*পনা দেখে মায়ের সাথে বাবার প্রায়ই ঝগড়া লেগে যাচ্ছে। শর্মী অবাক হচ্ছে শিহাবকে দেখে। একটা মানুষের এত পরিবর্তন কীভাবে হয়?
আজ শিহাব সুপ্তির বিয়ে আর দুপুর থেকে টানা গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে সেই সাথে থেমে থেমে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। নভেম্বরের এই অসময়ে বৃষ্টির কী কারণ তা আল্লাহ্ জানেন। বিয়ে উপলক্ষে সবাই ব্যস্ত। শর্মীকে মেয়ে পক্ষ হয়ে কাজ করতে হচ্ছে। একমাত্র ভাইয়ের বিয়ে আর বরযাত্রীতে সে থাকতে পারছে না তার জামাই একমাত্র শালার বিয়েতে জামাইর ভূমিকা রাখতে পারছে না সে নিয়ে তাদের দুঃখের শেষ নেই। যদিও সার্বক্ষণিক তদারকির কাজ ফোনের মাধ্যমে চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কাছে থেকে ভাইয়ের বিয়ে উপভোগ করা গেল না সেই আফসোসে শর্মী জর্জরিত।
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সুন্দর ভাবে হয়ে গেল। সুপ্তিকে বিদায় দিতে গিয়ে দেখা গেল কেউই তেমন কাঁদছে না। কারণ এই ক’দিনে মেয়ের আহ্লাদীপনায় সবাই এত বিরক্ত হয়েছে যে সে বিদায় হলেই সবাই বেঁচে যায় যেন। যত আহ্লাদ জামাইবাড়ি সামলাক। সুপ্তিও বেশ খুশি। ওদেরকে গাড়িতে তুলে দিতে গিয়ে সৈকত কান্নায় ভেঙে পড়ল… একমাত্র ছোট বোন, ও যত দুষ্টুই হোক একটাই তো বোন তাও কত ছোট। সৈকত নিজেকে আর রোধ করতে পারে না। সুপ্তি নিজেও তখন কেঁদে অস্থির হয়ে গেল। সারাক্ষণ ভাইয়ার পেছনে লেগে থাকত অথচ তার ভাই ছিল তার সকল আবদারের ঠিকানা। সবচেয়ে ভালো বন্ধু। সারা পৃথিবী তখন দেখছিল বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে দুটো ভাইবোনের মাঝে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম ভালোবাসা।
সৈকতের বাবা শর্মীকে বরযাত্রীর সাথে চলে যেতে বললেন। তিনি চাইলেন শর্মী একটু হলেও ভাইয়ের বিয়েটা নিজের বাড়ির হয়ে উপভোগ করুক। শর্মী খুশি হয়ে চলে গেল।
ওরা চলে যাবার পর সৈকত বৃষ্টিতে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। যদিও সে কিছুটা ভিজেই গেছে তবু আরও কিছুক্ষণ ভিজল… বৃষ্টির পানিতে তার কান্না ধুয়ে নিতে চাইল।
শর্মী ও বাড়ি গিয়ে ভাইয়ের বউ বরণ করল অতি আনন্দের সাথে। তারপর সব কিছু নিজেই তদারকি করে সব দিক সামলে নিল। শর্মী আসায় ওর মা-ও নিশ্চিন্ত হলেন। সব কাজ গুছিয়ে শেষ করতে করতে এর মাঝে সৈকতের সাথে কথা বলারই সুযোগ হয়নি। সে একেবারে ফ্রেস হয়ে এসে সৈকতকে ফোন দিতে গেল। দেখল সৈকত এর মাঝে তাকে কয়েকটা ফোন দিয়েছে। না পেয়ে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে “সব ঠিক আছে কিনা? সুপ্তি ঠিক আছে কিনা? কিছু লাগবে কিনা? লাগলে ফোন দিও।” শর্মী কল দিল সৈকতকে। সৈকত ফোন রিসিভ করেই বলল-
-খুব ব্যস্ত হয়ে গেছ, একেবারে পাওয়াই যাচ্ছে না!
-তা তো ছিলামই। কী করছ এখন?
-কিছু না সুপ্তি ঠিক আছে?
-হুম, উফফ দুজনে যা ঢং করছে না… সবাই দেখে হেসে গড়িয়ে যাচ্ছে।
-ও…
– তোমার কি সুপ্তির জন্য মন খারাপ লাগছে?
-তা তো কিছুটা আছেই। এখনো বাচ্চা রয়ে গেছে সুপ্তিটা… কবে কীভাবে সব সামলে নিতে শিখবে কে জানে! তবে এটা ভেবে ভালোও লাগছে যে ও তোমাদের বাড়ি আছে। তাই চিন্তার কিছু নেই, ভালোই থাকবে।
-তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন? তুমি ঠিক আছ?
-কই কেমন শোনাচ্ছে? আমি ঠিকই আছি।
-উহু, তুমি ঠিক নেই। কি হয়েছে বলো?
-কিছু হয়নি। সুপ্তির জন্য একটু মন খারাপ লাহছিল। রাখি এখন, বলে সৈকত ফোন রেখে দিল। শর্মী সাথে সাথে সাদকে ফোন দিল। সুপ্তির বিয়ে খেতে সাদরা সবাই এসেছে। তাই ওকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করল সৈকত ঠিক আছে কিনা?
সাদ বলল- ভাইয়াকে তো ঠিকই দেখলাম।
-ওকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো বৃষ্টিতে ভিজেছে কিনা? জেনে আমাকে জানাবে। এক্ষুণি যাও।
সাদ সৈকতের ঘরে গিয়ে দেখল সে শুয়ে আছে।বলল- ভাইয়া শুয়ে আছ যে? শরীর খারাপ নাকি?
-না, শরীর ঠিকই আছে।
-তাহলে চলো গল্প করি?
-ইচ্ছে করছে না তুই যা।
-ভাইয়া তুমি আজ বৃষ্টিতে ভিজেছিলে নাকি?
-হুম… কথা বলতে ভালো লাগছে না। যা, পরে আসিস।
-ঠিক আছে যাচ্ছি।
সাদ সৈকতের ঘর থেকে বের হয়ে শর্মীকে ফোন দিয়ে বলল- ভাবি ভাইয়া তো বৃষ্টিতে ভিজেছে।
-কী করছে এখন?
-শুয়ে আছে। বললাম, চলো আড্ডা দেই? শুনল না।
-আচ্ছা ঠিক আছে। থ্যাংক ইউ। রাখছি, পরে কথা হবে।
ফোন রেখে শর্মী সোজা ওর মায়ের কাছে গিয়ে বলল- মা আমি ওবাড়ি যাচ্ছি।
-এখন!!! কোনো সমস্যা হয়নি তো?
-না মা। আমার নিজের একটু কাজ আছে তাই যাচ্ছি।
-এখন বাজে রাত ১১টা, এই সময় কেউ বের হয়? কী এমন কাজ পড়ল তোর? যেতে যেতে কয়টা বাজবে দেখেছিস?
– আমার যেতে হবে মা। সমস্যা নেই, আমি তো গাড়ি নিয়েই যাচ্ছি। বলে সে সাথে ওর এক কাজিনকে সহ গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল।
রাত প্রায় সোয়া ১ টার দিকে শর্মী বাসায় এলো। সাদকে ফোন করে বলেছে সে যে আসছে সেটা বাসায় কাউকে জানাবার দরকার নেই। সে যেন দরজা খুলে দেয়। শর্মী বাসায় ঢুকে সোজা নিজের ঘরে গেল, গিয়ে দেখে সৈকত ঘুমে আচ্ছন্ন… সে সোজা ওর কাছে গিয়ে ওর কপালে হাত রাখল। হাত রেখেই চমকে উঠল, গা তো পুড়ে যাচ্ছে! যা ভেবেছিল তাই। তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, জানে ভিজলে অসুখ করে তাহলে কেন ভিজল? সে তাড়াতাড়ি মাথায় পানি ঢালা শুরু করল। গা স্পঞ্জ করে দিল। ২ ঘন্টা পর সৈকতের জ্বর নামল। সে উঠে বসে বলল- তুমি! ক’টা বাজে এখন?
-সেটা দিয়ে কী করবে? বৃষ্টিতে ভিজবে? এখনো হচ্ছে চলো বাইরে দিয়ে আসি?
-তুমি মনে হচ্ছে খুব ক্ষেপে আছ?
-পাগল! ক্ষেপব কেন? আমি তো খুব রোমান্টিক মুডে আছি। একেবারে তোমার কোলে বসে জ্যোৎস্না বিলাস করার মুড।
-সৈকত ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখল, সাড়ে ৩টা বাজে! শর্মীর রেগে যাবার যথেষ্ট কারণ সে ঘটিয়ে ফেলেছে। তবু গলায় দুষ্টুমি ঢেলে বলল- বাব্বাহ, এত রোমান্টিক কবে হলে যে রাত ৩টায় সব ছেড়েছুড়ে তোমাকে আমার কাছে চলে আসতে হল? তোমার রোমান্টিক মুড বেশ পাওয়ারফুল দেখছি!
-কাউকে পিটিয়ে মানুষ করবার জন্য আমার এই হাতও যথেষ্ট পাওয়াফুল।
-রোমান্টি মোমেন্টে এত বকতেছ কেন?
-না, বকব কেন? তোমার জন্য একটা বেলা ওবাড়ি গিয়ে থাকতে পারলাম না। এত ভালো কাজ করেছ যে তোমাকে তো ধরে নিয়ে নোবেল দিয়ে দেওয়া উচিৎ।
-অস্কার দেওয়া যায় না? ঐটা হলে বেশি ভালো লাগত…
-ইয়ার্কি হচ্ছে না?
-ডিয়ার বুশ আই মিন ডিয়ার বউ এত রাগ না করে একটু কাছে এসে বসো না?
-আবার বলে বুশ?
-সরি…
শর্মী সৈকতের কথায় পাত্তা না দিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে এটা ওটা করতে লাগল। ঘরের দখিনের জানালাটা অল্প খোলা সেখান থেকে ঠান্ডা বাতাস আসছিল। সৈকত তখন গায়ে একটা শাল জড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে শর্মীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে গান ধরল-
“শোনো গো দখিনও হাওয়া,
প্রেম করেছি আমি…
লেগেছে চোখেতে নেশা,
দিক ভুলেছি আমি…”
শর্মী বলল- একদম ঢং করবে না।
-ঢং করব না?
-না।
-কী করব?
শর্মী কিছু বলল না। সৈকত শর্মীকে নিয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, বলল- একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ? আমাদের বিয়ের দিন এমন ঝুম বৃষ্টি ছিল সুপ্তির বিয়েতেও আজ তাই হল। সেদিনও আমার জ্বর ছিল আজও তাই… সেদিনও তুমি আমায় নিয়ে ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলে আজও তাই… ব্যাপারটা অদ্ভুত না?
-হুম… সেদিনও বৃষ্টি ছিল… একটা কথা বলব?
-হুম…
-সেদিন আরও একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল…
-কী ঘটনা?
-সেদিন সকালে ইমার্জেন্সি কাজে টেইলার্সের কাছে গিয়েছিলাম। যাবার পথে রাস্তায় রিকশা উল্টে পড়ে গিয়ে বিশ্রীভাবে কাদায় মাখামাখি হয়ে গেলাম। আর তখন বাইক নিয়ে তুমি আর সাদ এলে। আমাকে রিকশায় তুলে দিলে। আমার তো তখনই তোমাকে ভালো লেগে গিয়েছিল। বিকেলে যখন সেই তুমিই আবার পাত্র হিসেবে এলে তোমাকে দেখেই আমার হার্টবিট কয়েকটা মিস হয়ে গেল। মনে মনে চেয়েছিলাম বিয়েটা হয়ে যাক। আল্লাহর কী নেয়ামত, সকালে যাকে দেখে হিরোর এন্ট্রি মনে হয়েছিল রাতে সেই হয়ে গেল লাইফ পার্টনার! কি অদ্ভুত তাই না? তবে ভগ্যিস তুমি আমায় চিনতে পারোনি!
-চিনতে পারিনি কে বলেছে?
শর্মী অবাক হয়ে বলল- তুমি আমাকে চিনতে পেরেছিলে?
-হ্যাঁ।
-কীভাবে?
কারণ তোমাকে আর আমাকে যখন বারান্দায় একসাথে কথা বলতে পাঠানো হল তখন বারান্দার কোনায় তোমার সকালে পড়া ড্রেসটা ঝোলানো দেখেছি। তখন চট করে তোমার হাতের দিকে তাকালাম। রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে বাম হাতের কব্জির কিছুটা উপরে কেটে গিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়েছিল তোমার, দেখলাম সেখানে ব্যান্ড-এইড লাগানো। বুঝে গেলাম সকালে দেখা মেয়েটা তুমিই।
-কি আশ্চর্য তুমি জানতে! তাহলে এতদিন কেন বলোনি?
-তুমি আমার সাথে কতটা শেয়ারিং সেটা দেখছিলাম।
-কি দেখলে?
-উম… মোটামুটি শেয়ারিং।
-হুহ, তোমাকে এই ঘটনা আগে বললে তুমি আমাকে সেদিন থেকেই এটা নিয়ে না জানি কি শুনিয়ে যেতে! আমার নামের পাশে “বুশ” এর সাথে সাথে “কোলাব্যাঙ”ও জুড়ে যেত। কারণ তোমরা যে আমাকে কোলাব্যাঙ বলেছ সেটা আমি শুনে ফেলেছিলাম।
-হা হা হা… এখন যে বলে দিলে এখন কোলাব্যাঙ বলব না?
-এখন বলেছি কারণ তুমি যে কেয়ারিং জামাই সেটা বুঝে গেছি।
সৈকত শর্মীর কাধে হাত রেখে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াল। শর্মী তখন সৈকতের কাধে মাথা রাখল। বিয়ের বন্ধনটা একটা অদ্ভুত বন্ধন! দুজন মানুষকে দুই প্রান্ত থেকে ধরে এনে এক সাথে জুড়ে দেয়া হয়। তারপর তারা হয়ে ওঠে একে অপরের পরিপূরক। একে অপরের প্রতি সম্মান আর ভালোবাসার সৌন্দর্যে গড়ে তোলে শান্তি সুখের নীড়।
ভালোবাসায় বাঁচুক পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ।।
সমাপ্ত।