গল্প:- সেদিন ছিল পূর্ণিমা
পর্ব:- এক (০১)
লেখা:- এম.ডি. সাইফুল ইসলাম।
মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
” তোর শশুর কিছুক্ষণ আগে কল দিয়েছিল, কালই জামাইর সঙ্গে তোর ডিভোর্স হবে। ”
” বাবা জানে? ”
” তোর বাবার কাছেই কল দিয়েছিল। সবকিছু শুনে সেই থেকে বসে আছে। ”
” মন খারাপ করার কি দরকার মা? সুখের আশায় তো বিয়ে দিলে, সুখ কপালে নাই তাই বিচ্ছেদ হয়ে যাবে। মেনে নিতে হবে মা। ”
” অবন্তী? ”
” বলো মা! ”
” তোর বাবা বারবার বলছে যে মেয়েটার জীবন নিজেদের হাতে নষ্ট করলাম। ”
” ছি মা, এসব কি ধরনের কথা? আগামীকাল কি হবে আজ সেটা আমরা জানি না সেজন্যই পৃথিবী অনেক সুন্দর। ”
মা আরো কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইল। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেল। আমার বেশ ঠান্ডা লাগতে শুরু করেছে। আমি জানালা দিয়ে একটুও সরে দাড়ালাম না।
পরদিন আমি ও ছোট চাচা মিলে উপজেলা কাজি অফিসে গেলাম। আমার শশুর ও স্বামী দুজনেই এসেছে। সবকিছু বন্দোবস্ত করা ছিল, একটা সিগনেচার দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে সাত মাসের সংসার সমাপ্তি হলো।
বাড়িতে ফিরে জানতে পারলাম বাবা সকাল থেকে অসুস্থ হয়ে গেছে। অধিক শোকে নিজেকে তিনি অপরাধী ভেবে অসুস্থ হয়ে গেলেন। বাবার সেই অসুস্থতা আর সুস্থ হলো না। সেদিন রাতেই বাবা স্ট্রোক করলেন।
পনের দিনের মধ্যে বাবার চিকিৎসার জন্য প্রায় দু লাখ টাকা শেষ হয়ে গেল। বাবার সারাজীবনের সঞ্চয় এই টাকা ছিল। না না ভুল কথা, আমার বিয়ের সময় তিনি দেড় লাখ টাকা খরচ করেছিল।
আরো পনেরদিন পেরিয়ে গেল। সংসার যেন প্রায় অচল হয়ে গেল। এতবড় সংসার, তার উপর বাবা অসুস্থ। মা রাতদিন কান্না করেন, আমি ডিভোর্সের পর থেকে কথাবার্তা কারো সঙ্গে বলতাম না। মাঝে মাঝে বাবা যখন হাহুতাশ করতেন তখন তাকে দু একটা কথা বলতাম।
অবশেষে গ্রাম ছেড়ে শহরে যাবার পরিকল্পনা করতে লাগলাম। কিন্তু আমার তেমন কোনো পরিচিত মানুষ নেই। অবশেষে রাবুর কথা মনে পড়ে গেল। ক্লাস টেনে পড়ার সময় রাবুর বিয়ে হয়ে গেছে। সে তার স্বামী শশুর শাশুড়ীর সঙ্গে ঢাকা শহরে থাকে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তার কোনো মোবাইল নাম্বার নেই আমার কাছে।
পরদিন সকালে উঠে রাবুদের বাড়িতে গেলাম। রাবুর মা আমাকে দেখে খুশি হলেন। তারপর কেন বিচ্ছেদ হলো ইত্যাদি প্রশ্ন করতে লাগলো। আমি রাবুর নাম্বার নিয়ে চলে এলাম। কল দিয়ে নিজের বিপদের কথা বললাম।
রাবু বললো,
” দু একদিনের মধ্যে ঢাকা চলে আয়। চাকরির ব্যবস্থা হয়ে যাবে চিন্তা করিস না অবন্তী। মানুষের জন্য পৃথিবীতে সমস্যা আবার মানুষই সেগুলো সমাধান করে। হোঁচট খেয়ে রাস্তায় যতক্ষণ পড়ে থাকবি ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ তাকিয়ে থাকবে। কিন্তু যত তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াবি তত তাড়াতাড়ি উপহাস থেকে বাঁচবি। হাঁটতে না পারলেও অন্তত উঠে দাঁড়িয়ে থাকবি, তবুও কাউকে বুঝতে দিবি না তুই আহত।! ”
দুই হাজার টাকা ধার করে মা-বাবার কাছে বিদায় নিয়ে দ্বিতীয় রমজানের দিন ঢাকা রওনা দিলাম।
★★
দুদিন হলো আমি ঢাকায় রাবুর বাসায় এসেছি।
ইফতারের সময় পানির জগটা আমি হাতে নিতেই হাত ফসকে পড়ে গেল। সব খাবারগুলো একসঙ্গে পানিতে ভিজে গেল। এটা আমার বান্ধবীর বাসা। একটা চাকরির জন্য দুদিন আগে গ্রাম থেকে এই বাসায় এসেছি।
আমি মাথা নিচু করে সবকিছু গোছাতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। আমার বান্ধবী রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এসে কি বলবে বুঝতে পারছিল না। ওর স্বামী, শশুর শাশুড়ী সবাই তাকিয়ে আছে।
সবকিছু পরিষ্কার করে আমরা ইফতার করলাম। আমাকে কেউ কিছু বলেনি। কিন্তু নামাজের পরে আমার বান্ধবী রাবু কে চুপিসারে কিছু বলবে এটা নিশ্চিত।
গ্রাম থেকে যখন এসেছিলাম তখনই রাবু আমাকে বলেছিল,
” শহরে থাকার যায়গা দেবার বড্ড অভাব রে অবন্তী। তুই বিপদে পড়েছিস তাই না করতে পারি না। নাহলে আমি আমার এখানে কোনভাবেই আনতাম না। ”
নামাজ পড়ে রাবু আমাকে নিয়ে বের হয়ে গেল। রাস্তায় নেমে জিজ্ঞেস করলাম,
” কোথায় যাচ্ছি আমরা? ”
” তোর চাকরির জন্য কথা বলতে। ”
” কিন্তু এই রাতের বেলা কেন? এখন কি কোনো অফিস খোলা পাওয়া যাবে নাকি? ”
” তোকে টগর ভাইয়ের কাছে নিয়ে যাবো। ”
” টগর কে? ”
” এতো প্রশ্ন করিস কেন অবন্তী? ”
” যার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি তার সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারবো না? ”
” টগর ভাই আমার পরিচিত, খুব ভালো মানুষ। তাকে বললে যেকোনো একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন। ”
” তিনি কি চাকরি করে নাকি বিজনেস? ”
” কি করে জানি না, তবে চাকরি জোগাড় করা তার কাছে খুব সহজ ব্যাপার। ”
” গুন্ডা নাকি? ”
রাবু আমার এই প্রশ্নের জবাব দিল না। চুপচাপ রিক্সার মধ্যে বসে রইল। আমাদের দুই বান্ধবীকে নিয়ে রিক্সা এগিয়ে যেতে লাগলো।
★★★
লোকটাকে দেখে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। দেখতে ভালো হলেও চেহারার মধ্যে একটা বখাটে ছেলেদের ছাপ স্পষ্ট বোঝা যায়। এরকম একটা লোকের কাছে এখন চাকরির জন্য কথা বলতে হবে। চাকরিটা খুব দরকার আমার কিন্তু তাই বলে এমন লোকের কাছে অনুরোধ করবো?
” নাম কি তোমার? ”
রাবু বললো, ” তোকে জিজ্ঞেস করেছে। ”
আশ্চর্য, ছেলেটা আমাকে তুমি করে বলছে কেন? সামান্য ভদ্রতা বজায় রেখে মানুষ আপনি করে তো বলতে পারে। আমার প্রচুর রাগ উঠে গেল। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
” অবন্তী। ”
” চাকরির বাজার আজকাল খুব খারাপ। মনে হয় ইদের আগে কোনো ব্যবস্থা হবে না। ”
রাবু বললো,
” অনেক বিপদে পড়েছে টগর ভাই। ওর বাবা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে গেছে। ওরা চার বোন, অবন্তী সবার বড় তাই ওর কাঁধে দায়িত্ব। একটা কিছু ব্যবস্থা করতে হবে নাহলে সম্পুর্ণ পরিবার কষ্টে থাকবে। ”
” কি ধরনের চাকরি দরকার? ”
আমি বললাম,
” যেকোনো চাকরি হলেই চলবে। ”
” রান্না করতে পারো? ”
” পারি! ”
” আমার পরিচিত এক বড়ভাইয়ের বাসায় দুবেলা রান্না করার জন্য এক রাধুনি দরকার। তুমি কি চাকরিটা করতে পারবে? ”
রাগ এবার মাথা খারাপ করে দিল। আমি তাকে বললাম,
” মেয়েদের দেখলে কি ফাজলামো করতে ইচ্ছে করে সবসময়? ”
” তুমিই তো বললে যেকোনো চাকরি হলেই চলবে তাই এরকম অফার দিলাম। ”
রাবু বললো,
” করোনার জন্য অনার্স শেষ হয়নি। অবন্তী খুব ভালো ছাত্রী টগর ভাই। আপনি যেকোনো একটা অফিসে ওর চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। ”
” ঠিক আছে কালকে সকালে উঠে এখানে তাকে পাঠিয়ে দিও। তোমার বান্ধবী তাই কিছু একটা তো করা দরকার। কিন্তু যে রাগ দেখাচ্ছে সেরকম রাগ মেয়েদের পক্ষে ঠিক না! ”
” কিছু মনে করবেন না টগর ভাই। ”
” ঠিক আছে এখন যাও তাহলে। আর আবারও বলছি, মেয়ে মানুষের এতো রাগ ঠিক না। কেমন যেন প্রকৃতির বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে মনে হয়। ”
এতক্ষণ রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। আমি আর রাবু হাঁটা শুরু করলাম, কিন্তু রাবু আবার গেল ছেলেটার কাছে।
” টগর ভাই! ”
” আবার কি? ”
” দুই হাজার টাকা দিতে পারবেন? ওর বাড়িতে টাকা পাঠাতে হবে, বাড়ির অবস্থা বেশি ভালো না। বেতন পেলে তখন দিয়ে দেবে। ”
” এখনো চাকরি হলো না আর বেতনের নাম করে টাকা ধার শুরু হয়ে গেল? ”
” টাকাটা নাহয় আমাকে ধার দিলেন। আমি পরে দিয়ে দেবো টগর ভাই। ”
” রাকিবকে আমার কথা বলে নিয়ে যেও। ”
” ধন্যবাদ টগর ভাই। ”
আমরা এবার রিক্সার কাছে গেলাম। হঠাৎ করে রাবু আবার চলে গেল। আমি একটু দাঁড়িয়ে থেকে আমিও সঙ্গে গেলাম।
রাবু বললো,
” টগর ভাই? ”
” আজকের রাতটা তোর বাসায় থাকুক, আমি কালকে দিনের মধ্যে থাকার ব্যবস্থা করে দেবো। স্কুলের গলিতে একটা মেয়েদের মেস আছে। ”
” কীভাবে বুঝলেন আমি থাকার জন্য বলবো? ”
” এটা বুঝতে গোয়েন্দা হতে হবে নাকি? তোদের বাসার পরিস্থিতি তো আমি জানি। তাছাড়া তুই একদম বিপদে না পড়লে কোনদিন আমাকে স্মরণ করিস না আমি জানি। চাকরির ব্যবস্থা হয়ে গেলে থাকার স্থান দরকার , এতটুকু বোঝার মতো জ্ঞান তো আছে নাকি? ”
★★★
সকাল বেলা রাবু নিজেই আমাকে নিয়ে বাসা থেকে বের হলো। বাসা থেকে বের হয়ে আমরা দেখি টগর ভাই বাসার সামনে একটা দোকানে বসে আছে। আমাদের দেখে তিনি বেরিয়ে এলেন।
টগর ভাই তার বাইক নিয়ে আমাকে বললো,
” গতকাল রাতে আপনাকে সরাসরি তুমি করে বলার জন্য দুঃখিত। উঠুন। ”
” মানে? আমি কি আপনার সঙ্গে বাইকে করে যাবো? ”
” হ্যাঁ, কোনো সমস্যা? ”
আমি রাবুর দিকে তাকালাম, রাবু চোখের ইশারা করলো। যার অর্থ ‘ কোনো সমস্যা নেই বস। ‘
বাইকে চড়ার অভ্যাস ছিল না। মিনিট দশেক যাবার পরে হঠাৎ চোখের সামনে সবকিছু ঘুরতে লাগলো। আমি হাত দিয়ে টগর ভাইকে খামচে ধরে বললাম,
” টগর ভাই দাঁড়ান। ”
” কি হয়েছে? ”
এমন সময় আরেকটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেল। বাম দিকের একটা লোকাল বাস হুট করে মোড় নিল। দুই সেকেন্ডের মধ্যে আমরা ছিটকে পড়ে গেলাম রাস্তার পাশে। তারপর আর কিছু মনে নেই আমার।
★★
” আমি তো ভেবেছিলাম আপনি অবিবাহিতা। আপনার বিয়ে হয়েছিল এটা বুঝতেই পারিনি। ”
ঘাড় ফিরিয়ে দেখি আমার পাশে বসে আছে টগর ভাই। আমি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। আমার পাশে টগর ভাই প্রশ্নটা করেছে।
” আপনি যে অন্তঃসত্ত্বা সেটা তো জানতাম না। এরকম অবস্থায় সাবধানে থাকতে হয়। আগে যদি বলতেন তাহলে আপনাকে সিএনজি ঠিক করে নিয়ে যেতাম। নাহলে সাবধানে বাইক চালাতাম, পেটে সন্তান নিয়ে এরকম জার্নি ঠিক হলো না। ”
আমি অবাক হয়ে রইলাম। বেশ কিছুদিন ধরে আমারও এরকম কিছু মনে হচ্ছে। কিন্তু সন্তানের বিষয়টা আমি নিজেও পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। তাহলে টগর ভাই জানলো কীভাবে? রাবুকেও আমি এ ব্যাপারে কিছু বলিনি।
আমি বললাম,
” কীভাবে জানলেন যে আমার পেটে সন্তান? ”
” ডাক্তার বললো। আমি তারপর রাবুর কাছে কল দিলাম। রাবু তখন বললো যে আপনার নাকি বিয়ে হয়েছিল, সম্প্রতি ডিভোর্স হয়েছে। ”
আমি আর কিছু বললাম না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। টগর ভাই বললো,
” আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, দশ মিনিট পরে ফিরে আসবো। আপনি থাকেন। ”
এ কথারও কোনো জবাব দিলাম না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে, টগর ভাই বের হয়ে গেছে বোঝা যাচ্ছে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে সশব্দে কেবিনের দরজা খুলে গেল। আমি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি চারজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। একজন কানে মোবাইল ধরে আছে, সে বললো,
” এই মেয়ে, তোমার নাম অবন্তী? ”
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। এদের কাউকে চিনতে পারি নাই। লোকটা তার মোবাইলে কাকে যেন বললো,
” পাওয়া গেছে স্যার, এখানেই শেষ করে দেবো নাকি হাত-পা বেঁধে তুলে নিয়ে আসবো? ”
আমার কলিজা কেঁপে উঠল। লোকটা মোবাইল পকেটে রেখে তার সঙ্গের আরেকজনকে বললো,
” একে নিয়ে যেতে হবে, হাত-পা বেঁধে ফেল। ”
#চলবে….