সে আমার অসুখ,পর্ব_০১
লিখা_মুনিয়া_রহমান
ইবতিয়াজের সাথে প্রথম দেখা আমার বড় আপুর বিয়ের দিন। গেটে যখন টাকা পয়সা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল কথা কাটা কাটি হচ্ছে। ঠিক তখন ইবতিয়াজ পেছন থেকে ভীর ঠেলে সামনে এসে দুলাভাইয়ের পাশে দাড়ালো।
—তোমাদের সমস্যাতো বরের ভেতরে যাওয়া নিয়ে। তাহলে এই গরমের মধ্যে আমাদের সবাইকে কেন এভাবে দাড় করিয়ে রেখেছো ?
আমি গলার স্বর উঁচু করে বললাম
—বর মশাইকে তাড়াতাড়ি টাকা দিতে বলেন। তাহলেইতো ঝামেলা শেষ।
ইবতিয়াজ দুলাভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বললো
—দিয়ে দে না দোস্ত! চিন্তা করিস না আমরা সবাই বেশি করে খেয়ে নেবো। তোর টাকা গুলো উশুল হয়ে যাবে।
ইবতিয়াজের এমন কথায় নতুন দুলাভাই মুখ ভয়ংকর রকম কালো করে আমাদের হাতে দশ হাজার টাকা তুলে দিলো।আমি সিওর দুলাভাই তখন মনে মনে বলছে
— নে গরু তোর কথা মত এদের দশ হাজার টাকা দিলাম।এখন যদি গামলা গামলা খেয়ে টাকা উশুল করতে না পারিস। তাহলে আমার সাথে তোর বন্ধুত্ব আজই শেষ।
টাকা গুলো পেয়ে আমার কাজিনরা প্রচণ্ড খুশি হয়ে গেল।আমার খালামণি দুলাভাইকে মিষ্টি খাওয়ালেন আর আমি শরবত। শরবতের গ্লাস দুলাভাইয়ের মুখের সামনে নিতেই। পাশ থেকে ইবতিয়াজ বলে উঠলো।
—রুহান তোর শালী কি শুধু তোকেই সেবা যত্ন করবে? আমাদের দিকেও একটু তাকাতে বল।
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম
—কেন? আপনার সেবা করবো কেন? আপনি কি বর?
—এই জন্য মানুষ বলে উপকারীরে বাঘে খায়। আধা ঘন্টা ধরে চিল্লাচিল্লি করেওতো একটা টাকা খসাতে পারলেনা তোমার আদরের দুলাভাইয়ের কাছ থেকে।এখন একবারে দুলাভাই, দুলাভাই বলে আহ্লাদে দুলাভাইয়ের গলা ধরে ঝুলে পড়ছো। আমি টাকা দিতে বললাম বলেইতো দিলো।এই উপকারের জন্য আমিতো একটু বেশি সেবা যত্ন পেতেই পারি? তোমাদের জন্য আমার বন্ধুর বিরুদ্ধে গেলাম অথচ তা তোমার চোখেই পড়লো না।
—কে করতে বলেছিলো আপনাকে উপকার?বলুন আমি কি বলেছিলাম আমাকে উপকার করুন ?
নতুন দুলাভাই সান্ত্বনা সুরে বললেন
—ইবতিয়াজ চুপ করনা।সবেতো এলি।সেবা পাওয়ার জন্য আরও অনেক সময় আছে সামনে।এবার অন্তত ছেড়ে দে।
পাশ থেকে আর একটা ভাইয়া ইবতিয়াজকে টিপ্পনী কেটে বললো
—দেখিস দেখিস তোদের ব্যাপারটাও আবার যেন ফিল্মি স্টাইলের না হয়ে যায়। প্রথমে ঝগড়া করলি।শেষে আবার চোখের পানি নাকের পানি এক করে ভালোবাসি ভালোবাসি বলে কাঁদিসনা।
ফিতা কেটে বরপক্ষ বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই। আমার কাজিনদের মধ্যে ইবতিয়াজকে নিয়ে মুখরোচক চাপা আলোচনা শুরু হয়ে গেল।আলোচনার ধরন অনেকটা এরকম মেরুন রঙের একটা পান্জাবী সাথে সাদা পাজামা। কোকড়া চুল, বা হাতে একটা সিলভার রঙের বড় ডায়ালের ঘড়ি, পায়ে স্লিপার। এই নরমাল গেটাপেই যেন মানুষটা পুরো ঝলমল করছে। হাত নেড়ে নেড়ে কি সুন্দর সকল আত্নীয় স্বজনের সাথে কথা বলছে। যেন সকলেই তার কত দিনের পরিচিত।
বরকে খাওয়ানোর দায়িত্ব পড়লো বাড়ির অল্প বয়স্ক মেয়েদের উপর। খাওয়ার সময় দুলাভাইয়ের পাশে বসলো ইবতিয়াজ। খাওয়ার পুরোটা সময় ধরে এটা দাও, ওটা দাও বলে কান ঝালা পালা করে ফেললো। গুনে গুনে তিন পিস রোস্ট আর কেজি খানিক খাসির মাংস খেলো ইবতিয়াজ। খাওয়া শেষে ঢেকুর তুলতে তুলতে বললো
—দোস্ত কোথায় বিয়ে করতে এসেছিস বলতো ? এত কিপ্টা তোর শ্বশুরবাড়ির লোক!আমাকে সব কিছু চেয়ে চেয়ে খেতে হলো। আমি যে বরের বাড়ির কুটুম এরা আমাকে সেভাবে পাত্তাই দিলোনা।
পাশ থেকে আমার এক ভাবী অতি উৎসাহে ইবতিয়াজের সাথে গলা মিলিয়ে বললো
–কিরে ঝিনুক! বরের বাড়ির কুটুম উনি। সম্পর্কে তোর বেয়াই। একটু নজর রাখবিতো নাকি ?
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সৃষ্টিকর্তাকে বললাম
—হে সৃষ্টিকর্তা আজ আমার বোনের বিয়ের দিন। নিঃসন্দেহে এটা একটা সুন্দরতম দিন আমার জন্য। আর এই দিনে এমন একটা অদ্ভুত প্রাণীকে আমাদের মধ্যে পাঠানোর কি খুব দরকার ছিলো তোমার ?
বরের হাত ধোঁয়ার জন্য আমরা কাজিনরা সবাই মিলে আবার ধরলাম পাঁচ হাজার টাকা। তবে এবার দুলাভাই তর্ক বিতর্ক ছাড়াই টাকা দিতে রাজি হলো। দুলাভাইয়ের হাত ধুয়া শেষে ফিরে আসতেই। ইবতিয়াজ আমাকে ডাক দিলো।
—নেও এবার আমার হাতটা ধুয়ে দাওতো?
—আমি আপনার হাত ধুবো কেন?
—তুমি আমার হাত ধুয়ে দেবে কারণ আমি তোমাকে সাত হাজার টাকা দেবো।
প্রচণ্ড রাগে আমার শরীর জ্বলে উঠলো।
—আপনি কি আমায় টাকার লোভ দেখাচ্ছেন?
—টাকার লোভ দেখাবো কেন ? আমিতো এসেই দেখতে পাচ্ছি তোমরা টাকার জন্যই সব কিছু করছো। তাই ভাবলাম আমি টাকা দিলে হয়তো আমার টাও করবে।
সাত হাজার টাকার কথা শুনে আমার কাজিনরা খুব এক্সাইটেড হয়ে গেল। ইবতিয়াজের হাত ধুইয়ে দেয়ার জন্য আমাকে বিভিন্ন ভাবে চাপা চাপি করতে শুরু করলো।
এক পর্যায়ে আমার কাজিন রাইদা তো বলেই ফেললো।
—কি হয় যাস্ট দুই মিনিটেরই তো ব্যাপার।পানি ঢালবি, সাবান দিবি ব্যাস! তাহলেইতো হয়ে গেল। আর আমরা সাত হাজার টাকা পেয়ে যাবো।
অবশেষে দুলাভাই নিজে আমাকে রিকোয়েস্ট করলেন
—ঝিনুক! আমার বন্ধুটা যখন এত করে বলছে। তাহলে একটু হাত ধুইয়ে দাও না।
নতুন দুলাভাই তাই তার কথাটা আমি আর না রেখে পারলাম না। প্রচন্ডরকম বাজে একটা গালি দিয়ে আমি ইবতিয়াজের হাত ধুয়ে দিলাম। হাত ধুয়া শেষে ইবতিয়াজ আমার হাতের মুঠোয় একটা পাঁচ টাকার কয়েন আর একটা দুই টাকার কয়েন গুঁজে দিলো।
—সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার আমি। রাত দিন খেটে টাকা রোজগার করতে হয় আমায়। একটা হাত ধুয়ার মূল্য যদি সাত হাজার টাকা হতো। তাহলে সার্টিফিকেট গুলো আলমারিতে তুলে রেখে বিয়ে বাড়িতে হাত ধুয়ানোর চাকরিটাই নিতাম আমি বুঝলে?
রাগে অপমানে আমার চোখে পানি চলে এলো। টাকা গুলো স্টেজে ছুৃঁড়ে ফেলে দৌড়ে রুমে চলে এলাম।বিয়ের বাকি সময় টুকু রুমে শুয়েই কান্না করলাম।এমনকি আপুর বিদায় বেলায় ও সামনে যায়নি।মুরব্বিরা আমার এই কান্না দেখে বলা বলি শুরু করলো
—আহারে!বোনে বোনে কত্ত সখ্যতা।আজ কাল এমন ভালোবাসাতো দেখাই যায় না। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে বলে বেচারী একদম বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে গেছে।
কিন্তুু কেউ টের পেলোনা আমি ওই দিন একজন অদ্ভুত মানুষের উপর ভীষণ রকম অভিমান করে চোখের পানি আর নাকের পানি এক করে কান্না করেছিলাম।
আপুর বিয়ের প্রায় দুই সপ্তাহ পরের ঘটনা। একদিন ভার্সিটি থেকে বের হতেই দেখি ইবতিয়াজ দাড়িয়ে আছে।গায়ে ফরমাল ড্রেস। বোঝাই যাচ্ছে অফিস থেকে এসেছে। কথা বলবো কি বলবো না এমনটা ভাবতে ভাবতেই দেখি ইবতিয়াজ ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি ঝুলিয়ে আমার সামনে এলো।
—কি ব্যাপার ঝিনুক কেমন আছো?
—জ্বি..জ্বি ভালো। আপনি কেমন আছেন?
—আমি আর কেমন থাকি বলো। তোমার দেয়া অভিশাপে দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছি।
—আমি আবার আপনায় কখন অভিশাপ দিলাম?
—এরই মাঝে ভুলে গেলে। ওই যে তোমায় সাত হাজার টাকা দিলাম না বলেইতো তুমি আমায় অভিশাপ দিলে।
বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে এলো আমার।এই মানুষটা এমন কেন ?
চলবে