সে আসবে বলে(১ম পর্ব)

0
1597

সে আসবে বলে(১ম পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda

“তোমার গোলামী করতে আসিনি আমি। এত মানুষ মরে আমি কেন মরি না।”

উপরের কথাগুলো বললো আবিদের স্ত্রী। খাবার টেবিলে শাশুড়ী মা কে আসতে দেখেই রাগ দেখিয়ে খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলো কথা। ওর উঠে যাওয়া দেখে আবিদ মোটেও অবাক হলো না। বরং চুপচাপ মা কে সাথে বসিয়ে খেয়ে নিলো। খাওয়া শেষ করে প্লেটে করে কথার জন্য খাবার নিয়ে গেলো।

কথা রুমে এসে নিজের বিছানায় বসে রাগে গজগজ করছে। ওর শাশুড়ী কে কেন যেন প্রচন্ড বিরক্ত লাগে। এমনিতে এতটা খারাপ না ওর শাশুড়ী। কিন্তু ওর মনে হয় ওর শাশুড়ীর জন্য ওরা ব্যক্তিগত একান্ত কিছু সময় আলাদা করে ঠিকভাবে কাটাতে পারছে না। সবসময় আবিদ ওর মাকে দুজনের মাঝে নিয়ে আসে। যেটা কথার কাছে মাত্রাতিরিক্ত খারাপ লাগে। কোথাও ঘুরতে গেলে বেশিরভাগ সময়ই মাকে সাথে নিয়ে যায়। অথচ কথার ইচ্ছে ছিলো বিয়ের পরে স্বামীর সাথে ইচ্ছেমতো ঘুরবে।

আবিদ রাতে অফিস থেকে ফেরার আগেই কথা ওর শাশুড়ী কে খেয়ে নিতে বলেছে। কারণ ওর ইচ্ছে ছিলো এক প্লেটে দুজন খাবে। কিন্তু শাশুড়ী মায়ের সামনে বসে তো সেটা যায়না। কিন্তু ওর শাশুড়ী তখন বলেছে আমি পরে খাবো মা। কথা ও আর ডাকে নি। কিন্তু আবিদ এসে ওর মা কে সাথে নিয়েই খেতে বসেছে। এটা দেখে কথার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। বিয়ের পরে আবিদ সবসময়ই ওর মাকে সাথে নিয়ে খেতে বসে। একদিন ও দুজন আলাদা ভাবে খেতে পারেনি।

আবিদ প্লেট নিয়ে রুমে আসার পরে কথাকে খাওয়ানোর জন্য যায়। কথা বলে উঠে….

– দেখো আবিদ। ন্যাকামি করবে না একদমই। তোমাদের তো খাওয়া হয়ে গেছে। তাহলে এখন আবার এখানে আসছো কি জন্য??

– কারণ আমার বউটা না খেয়ে আছে।

– তাতে তোমার কি? আমার ইচ্ছের কোনো মূল্য আছে নাকি এ বাসায়?

– এটা কেমন কথা বললে তুমি? তোমার কোন ইচ্ছে আমি অপূর্ণ রাখি বলো তো?

– আমার কোনো ইচ্ছেই পূরণ হচ্ছে না। এই বাসায় আমি কোনো প্রাইভেসি ই পাচ্ছি না। আমরা কত ইচ্ছে করে দুজন একসাথে বসে খাই। কিন্তু না, প্রতি বেলায় তোমার মাকে সাথে বসাতেই হবে। কেন সবসময় ছেলের পিছেই লেগে থাকতে হবে কেন তার? আমাদের কি আলাদা করে সময় কাটাতে ইচ্ছে করে না?

আবিদ ভাতের লোকমা কথার মুখের সামনে ধরে বললো,

– আসলে ছোটবেলা থেকে মা কখনো আমাকে রেখে খায়নি। আমার ফিরতে যত রাত হোক সে আমার জন্য অপেক্ষা করেছে। কখনো আমাকে খাইয়ে দিয়েছি, কখনো আমি মাকে খাইয়ে দিয়েছি। আমি ছাড়া মা খেতে পারে না ভালো মতো। অভ্যাস হয়ে গেছে যে!

– এখন অভ্যাস টা চেঞ্জ কর‍তে বলো। এখন তোমার যত্ন নেয়ার জন্য তোমার বউ আছে৷

– বউ আসলে কি মায়ের ভালোবাসা কমে যায়? তাছাড়া আমি চাইনা আমার মায়ের এই অভ্যাস চেঞ্জ হোক।

– তাহলে যাও গিয়ে মায়ের সাথে খাও। গিয়ে তার সাথে গল্প করো।

– মায়ের সাথে তো খেয়েছি। এখন তোমার সাথে ও খাবো। তাছাড়া মায়ের সাথে বসে খেলে কি প্রবলেম? মা তো আমাদের আগেই উঠে যায়। তখন তো আমি তোমাকে আমার প্লেট থেকে খাইয়ে দেই প্রায় সবসময়ই। তাহলে মাকে নিয়ে কি সমস্যা?

– কোনো সমস্যা নেই। তোমার যা ভাল্লাগে তাই করো।

আবিদ কথাকে বুঝানোর চেস্টা করলে সেও আর কথা বাড়ায়নি। চুপচাপ খেয়ে নিলো। কিন্তু শাশুড়ী আর আবিদের প্রতি রাগ টা কমেনি। মনে মনে চিন্তা করলো শাশুড়ীর এই অতিরিক্ত স্বভাব কিছুতেই আর সহ্য করবে না।

পরদিন আবিদ অফিসে যাওয়ার পরে কথা তার শাশুড়ির কাছে গেলো। গিয়ে কিছুটা ঝাঁঝালো কণ্ঠে জিগ্যেস করলো,

– আচ্ছা মা আপনার কি বিবেক বলতে কিছু নেই?

সুফিয়া বেগম বসে বসে তার নাতী/নাতনীর জন্য ছোট ছোট কাঁথা সেলাই করছেন। যদিও আবিদ আর কথা এখনই বাচ্চা নেয়ার চিন্তা ভাবনা করছে না। তবুও যখন আসবে তখনকার জন্য নিজ হাতে সুন্দর সুন্দর কাঁথা সেলাই করে রাখছেন এখন থেকেই। কথার হঠাৎ এমন প্রশ্নে বেশ খানিকটা অপ্রুস্তত হয়ে গেলেন। বিয়ের চার মাস না যেতেই শাশুড়ির সাথে এমন আচরণ দেখে তিনি মনে মনে কষ্ট পেলেও মুখে বললেন না।

– কেন মা? কি হয়েছে? হঠাৎ এমন কথা বলছো কেন?

– মা আপনার ছেলের এখন বিয়ে হয়েছে। আপনার এটুকু তো বোঝা উচিত যে এখন তার স্ত্রীর সাথে কিছুটা সময় একান্ত ব্যক্তিগতভাবে কাটাতে ইচ্ছে করে। আপনার তো কিছুটা স্পেস দেয়া উচিত আমাদের।

কথার এমন কথা শুনে সুফিয়া বেগম বেশ লজ্জায় পড়ে গেলেন। লজ্জা এবং অস্বস্তিতে কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি কি এমন করেছেন যার জন্য কথা এসব বলছে সেটা ভেবে পাচ্ছেন না। তাকে চুপ থাকতে দেখে কথা আবার ও বললো,

– এখনো কেন আবিদের পছন্দের খাবার আপনার রান্না করতে হবে? এখন আমি চলে এসেছি। আমিই তো ওর জন্য রান্না করতে পারি। নাকি আপনি চান না আবিদ আমার ওপরে খুশি থাকুক, আমাকে ভালোবাসুক? যদি এমনই চান তাহলে বলে দিন। আমি কালই চলে যাবো এখান থেকে।

এটা বলে শাশুড়ির উত্তরের অপেক্ষা না করে রাগে গজগজ করতে কর‍তে নিজের ঘরে চলে গেলো কথা।

আবিদ একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে বেশ ভালো পজিশনে জব করে। স্ত্রী আর মা কে নিয়ে তার ছোট সংসার। চার বছর বয়সে নিজের বাবাকে হারিয়েছে। তখন থেকে মা-ই সব। মা শুধুমাত্র আবিদের কথা ভেবে আর বিয়ে করে নি। একটা বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করে আবিদকে প্রতিষ্ঠিত করে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। আবিদ ওর মায়ের প্রতি একটু বেশিই অনুগত। আবিদের কাছে ওর মা সবকিছু। কিন্তু কথা আবিদের এই বেশি আনুগত্য একদমই পছন্দ করে না। আবিদ প্রতিদিন ওর অফিসে যাওয়ার সময় মাকে বলে যায়, আবার ফেরার পরে রাতে মায়ের সাথে ঘন্টা খানিক বা তার বেশি সময় গল্প করে। আবার খাওয়ার সময় মাকে সাথে নিয়ে খায়। ঘুরতে গেলে বা শপিং করতে গেলে কখনো কখনো মাকেও নিয়ে যায়। আবার মাঝে মাঝে মাকে ওর পছন্দের খাবার রান্না করতে বলে। যেটা কথা একদমই পছন্দ করে না। ও চায় আবিদ অফিস বাদে সবটুকু সময় ওকেই দিক। বাসার রান্না বান্না ও নিজেই করে। একজন বুয়া এসে অন্যান্য কাজ করে দিয়ে যায়। তাই ও চায় আবিদের সব পছন্দের রান্না গুলো ও নিজেই করবে।

কথা চলে যাওয়ার পরে ওর শাশুড়ী চোখের জল ছেড়ে দিলো। কথাকে সে নিজের মেয়ের মতো ই জানে। আবিদের মতো কথাও তার আরেক সন্তান। কিন্তু ও এসব কি বললো? সে নিজেই আবিদকে বলে কথা কে নিয়ে ঘুরতে যেতে। আবিদের পছন্দের সব রান্না সে নিজেই কথাকে শিখিয়ে দিচ্ছে আস্তে আস্তে। তার একটা কথা’ই বারবার মনে হতে থাকলো, বিয়ের পরে সন্তান কি এতটাই পর হয়ে যায় যে তার সাথে দুটো কথাও বলা যাবে না সারাদিন বাদে? বা তার পাশে বসে খাওয়া যাবে না? সন্তানকে নিজের সামনে তৃপ্তি নিয়ে খেতে দেখলেই তো মায়ের মন ভরে যায়। এটা কি খুব বেশি অন্যায়? সে সন্তান স্কুল থেকে ফিরে এক সেকেন্ডের জন্য মাকে না পেয়ে মা মা করে সারাঘর মাথায় তুলে ফেলতো, সে সন্তানের সাথে এক ঘন্টা গল্প করা কি খুব বেশি আবদার?

জানালার কাছে দাঁড়িয়ে চোখ মুছে নিলেন। মনে মনে ভাবছেন, “কথা হয়তো না বুঝে কথা গুলো বলেছে। ও তো মা হয়নি তাই হয়তো বুঝতে পারেনা সন্তানের জন্য ভালোবাসা কেমন হয়! আর তাছাড়া ওর ও তো নতুন বিয়ে হয়েছে। ওর ও তো ইচ্ছে করে স্বামীর সাথে সময় কাটাতে। আচ্ছা থেকে আমি আর ওদের সাথে খেতে বসবো না। আবিদ বোকা টা বুঝে না কিছু।”

পরেরদিন ভোর বেলা আবিদ আর ওর মাকে পেলো না। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গিয়েছে এখনো মায়ের খবর নেই। আবিদ কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলো। কথার কাছে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না আবিদ।

অন্য দিকে কথা বেশ হাসিখুশিতে আছে। কথার মাঝে আনন্দের ছাপ। কেনো যেনো মনে হলো কথা জানে ওর মা কোথায় আছে……

[চলবে…….]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here