সে_আমার_অসুখ,পর্বঃ৬
লিখা_মুনিয়া_রহমান
সারাদিন খুব স্বাভাবিক ভাবে গেল। ঝামেলা বাঁধলো সন্ধ্যায়।আপু এবং দুলাভাই ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে বিকেলে বের হয়েছিলো। রাত আটটা বাজতেই তারা ফিরে এলো। আপুর হাত ভরতি শপিং ব্যাগ। আমার মা আমাকে রুম থেকে ডেকে আনলো শপিং দেখার জন্য।
আপু উচ্ছাস ভরা কণ্ঠে বললো,
–কি কপাল তোর দেখ ? বিয়ে হলোনা অথচ তোর বরের কতো চিন্তা তোকে নিয়ে।
আমি ব্যাপারটা বোঝার জন্য আপুকে বললাম
— হঠাৎ করে এত শপিং কেন ? আর আমার বর কই থেকে আসলো ?
আপু একটা সুতি লাল জামদানী শাড়ী আমার গায়ে মিশিয়ে ধরে বললো
–দেখো মা ঝিনুককে কি সুন্দর লাগছে ? ভারী শাড়িতে ঝিনুকের কষ্ট হবে কি না ? সেটা ভেবেই তোমার ছোট জামাই এই শাড়ীটা চুজ করলো।বললো যা গরম পড়ছে অত শত কাজের ভারী শাড়ির দরকার নেই।
আমার মা আমার কপালে একটা আদুরে চুমু এঁকে দিলো।
— আমার মেয়েকে একদম রুপকথার সেই লাল পরীদের মত লাগছে।
এরপর আপু আরও কয়েকটা সালোয়ার কামিজ , স্যান্ডেল, টুকিটাকি আমি যেসব কসমেটিকস ব্যাবহার করি। সেই সব কিছু বের করলো।
আপু খুব শাসনের সুরে বললো
–কাল সকালে উঠে গোসল করবি। আমি নিজে তোকে সাজাবো।
–আমাকে সাজাবে মানে ?
— তো সাজাবো না! কাল তোকে পাত্রপক্ষ আংটি পরাতে আসবে। তুই আমার এক মাত্র বোন। আমার কত শখ ছিলো তোর বিয়েতে কত মজা করবো!তার কিছুইতো হচ্ছে না।
আপুর কথা শুনে আমার মাথা ভন ভন করে ঘোরা শুরু করলো। কোন রকম অস্ফুটস্বরে শুধু বললাম
— কাল এঙ্গেজমেন্ট অথচ আমাকে এখন জানানো হচ্ছে। সারাদিনতো আমাকে কেউ কিছুই বললো না। আর এত শপিং এর উদ্দেশ্য তাহলে এটাই।
রাগে কষ্টে আমার চোখ থেকে টুপ টুপ করে পানি পড়তে শুরু করলো।
আমার চোখের পানি দেখে মা আমার পাশে এসে বসলো। আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললো
–কিরে এভাবে কান্না করছিস কেন ? কাল তো শুধু এঙ্গেজমেন্ট। তোকে তো আর কালই তুলে নিয়ে যাবে না।
আমি এবার মাকে জড়িয়ে ধরে ফুফিয়ে বললাম
–মা আমি এ বিয়ে করবো না।
–কেন? তোর আপাতো বললো তোর নিজের কোন পছন্দ নেই। তাহলে বিয়ে করবি না কেন ?
মায়ের মুখে এমন কথা শুনে আমি আপুর দিকে তাকালাম। দেখলাম সে ফোনে হেসে হেসে কাল আমাদের বাসায় আসার জন্য কাকে যেন দাওয়াত করছে।
–তোর আপুতো নিজে পছন্দ করে বিয়ে করলো। তোর বাবা যতই মেনে নিক। মনে মনে কিন্তুু একটু কষ্ট পেয়েছে। তাই আমি চাইনা তুই ও তোর আপুর মত তোর বাবাকে কষ্ট দিস। তাছাড়া ছেলেতো আমাদের সকলেরই পছন্দ। তোরওতো পছন্দ হও..
–মা! কাকে কি বোঝাচ্ছ। আমরা যা করবো তা ওর ভালোর জন্যই করবো। তুমি বরং যাও কাল কি কি রান্না করবা সেটা গুছিয়ে নাও। আমি ঝিনুকের কাছে আছি।
আপুর এমন কথায় মা আর কিছু না বলেই চলে গেল। আপু আমার পাসে বসতেই আমি উঠে রুমে চলে গেলাম। আপাতত আপুর জ্ঞানী জ্ঞানী কথা শুনতে মোটেই ইচ্ছে করছে না। একা কিছু সময় থাকতে পারলেই যেন শান্তি।
একদিকে যেমন ইবতিয়াজকে ভোলা অসম্ভব। অন্য দিকে বাবাকে কষ্ট দেওয়াটাও অসম্ভব আমার জন্য।দুই টানা পোড়েনে সারা রাত কান্না করে ঘুমুতে গেলাম ভোর পাঁচটা নাগাদ।
ঘুম ভাঙলো বেলী ফুলের মিষ্টি একটা ঘ্রাণে। চোখ মেলতেই দেখতে পেলাম আপু আমার বেড সাইডে বেলী ফুলের গাজরা রাখছে। গোল্ডেন কালারের শাড়ীতে আপুকে ভীষণ রকম মায়াবী লাগছে। আমাকে চোখ মেলে তাকাতে দেখেই আপু পাশে এসে বসলো।
–জলদি গোসল করে আয়। তৈরি হতে হবে তো। এমনেই অনেক বেলা হয়ে গেছে।
রাগ করে আমি অন্য পাশে মুখ ঘুরিয়ে রইলাম।ইবতিয়াজকে যে আমি ভালোবাসি এটাতো আপু জানতো। তারপরও কি করে এত স্বাভাবিক রইছে। অথচ এর আগে আমার দুঃখ, কষ্ট, আমার কি প্রয়োজন এসব কিছুই আমি বলার আগে বুঝে নিয়েছে।
–যা হবে ভালো হবে। সৃষ্টিকর্তা আর আমাদের উপর ভরসা রাখ।
আপুর কথায় উত্তর দিলাম না। উঠে সোজা বাথরুমে চলে গেলাম।
গোসল করে বের হতেই আপু নিজে হাতে আমার পছন্দের ঘি দিয়ে ভুনা খিচুড়ি খাইয়ে দিলো।আমি স্বাভাবিক ভাবেই খেলাম।এরপর খুব যত্ন করে শাড়ী পরিয়ে চুল খোপা করে বেলী ফুলের গাজরা দিয়ে দিলো। সাজগোজ শেষে আপু আমাকে রুমে বসিয়ে রাখলো।
ভেবেছিলাম একবার আপুকে জিজ্ঞেস করবো ইবতিয়াজকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে কি ? পরে ভাবলাম থাক। কি দরকার যে মানুষটা আমার নয় তাকে নিয়ে এত কথা বলার।জীবনে সব কিছু পেতে হবে এটাতো কোথাও বলা নেই। ঠিক তেমন ভাবে সব না পেলে যে মরে যেতে হবে এটাও কোথাও লিখা নেই। সুতরাং যেমনটা হচ্ছে চুপচাপ মেনে নেওয়াতেই শান্তি।
যোহরের নামাজ বাদেই একজন বয়স্ক মহিলা আমার রুমে প্রবেশ করলো। আমি সালাম দিতেই আমার পাশে এসে বসলো
— কি মিষ্টি দেখতে? আমার ছেলের পছন্দ আছে!
বড় আপুকে ডেকে তার হাতে একটা চেইন আর নাকফুল দিলো। আমাকে পরিয়ে দেয়ার জন্য। ভদ্রমহিলা নিজে আমার হাতে আংটি পরিয়ে দিলেন।
–মা! আমার ছেলেটার ভালো মন্দ এখন থেকে তুমিই দেখবা।আমি আর কত দিনই বা বাঁচবো।
ভদ্র মহিলার এমন কথায় আমি কোন জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে রইলাম।
এর কিছু সময় পর দুলাভাই একটা খাতা টাইপ কিছু একটা নিয়ে এসে আমাকে একটা জায়গা সাইন দিতে বললো। আমি অনেক খানি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম এটা কি?
আপু চাপা স্বরে বললো
–কোন রিস্ক নিতে চাই না আমরা। এখন এঙ্গেজমেন্ট করিয়ে রাখলাম। পরে দেখা গেল তুই আবার ইবতিয়াজের জন্য কান্নাকাটি শুরু করেছিস। ওকে বিরক্ত করছিস তাই একবারে বিয়ের সিদ্ধান্ত হু!
আমি আপুর দিক তাকিয়ে একটু হাসি দিলাম।
–ইবতিয়াজকে নিয়ে তোমার কত্ত চিন্তা আপু।দাও খাতাটা দাও। সাইন দিয়ে তোমার ভাইকে সারাজীবনের জন্য মুক্তি দেই।
আমি বুঝতে পারিনি সাইন করার সময় আমার সামনে এত বড় একটা চমক আসবে। পাত্রের সাক্ষরের জায়গা ইবতিয়াজ হোসেন লেখা।
ইবতিয়াজের নামটা দেখে আমার তখন হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলার মত অবস্থা। সকাল থেকে জমিয়ে রাখা কান্নাটা তখন চোখের পানি হয়ে টুপ টুপ করে পড়ছে।
দুলাভাই হেসে বললো
–কি ব্যাপার শালী! আমিতো ভেবেছিলাম তোমাকে বিয়ে করে আমার বন্ধুর কাঁদতে হবে। এখন দেখছি তুমি নিজেই কাঁদছো।
–নে নে তাড়াতাড়ি সাইন কর।আমার ভাইটার গলায় ঝুলবি বলেতো কান্নায় থামাচ্ছিস না। এবার সাইন করে কান্না থামা তো !
আমি পরম যত্নে আমার নামটা লিখলাম। এর আগে কত শত বার নিজের নাম লিখেছি। তখনতো এত আনন্দ লাগেনি।আজ হঠাৎ এত আনন্দ লাগছে কেন ? এই সাইনটা করে সারা জীবনের জন্য ইবতিয়াজকে আমার করে নিয়েছি বলে কি ?
সাইন করে আপুকে জড়িয়ে ধরে নাক টেনে টেনে আধা ঘন্টা কান্না করলাম। গত কিছুদিন ধরে যত রাগ ছিলো আপুর উপর। সব যেন কান্না আর ভালোবাসায় মেখে একাকার হতে শুরু করলো।
বিয়ে শেষে ইবতিয়াজ আমার রুমে আসলো। ইশ! শেরওয়ানিতে মানুষটাকে কি সুন্দর মানিয়েছে। হুট করে এক রাশ লজ্জা যেন আমাকে জেঁকে বসলো।
–তা বেয়াইসাফ থেকেতো একবারে লাফ দিয়ে বউ হয়ে গেলে। আহারে! আমার ওই বউটার কত দুঃখ।
আমি এবার লাজ লজ্জা ভুলে প্রশ্ন করলাম
–কোন বউটার ?
–এর মাঝে ভুলে গেলে। ওই যে যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হলো।তোমাকে বিয়ে করবো এটা জানার পর থেকে বেচারী কান্নাকাটি করে একদম বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে।
প্রচণ্ড অভিমান নিয়ে আমি তখন বললাম
–তাহলে আমাকে বিয়ে করেছেন কেন ? তাকে বিয়ে করলেই পারতেন।
— আমিতো তাকেই বিয়ে করতে চেয়েছিলাম কিন্তুু আপু ফোন দিয়ে কান্না করতে করতে বললো
–ভাই ইবতিয়াজ তুমি চাইলে আরও তিনটা বিয়ে করতে পারবে কিন্তুু আমার একটা মাত্র বোন। ও মরে গেলে আমি কাকে বোন বলবো। ও জেদ ধরে বসে আছে তুমি বিয়ে না করলে মরে যাবে। আপাতত আমার বোনটাকে বিয়ে করো। পরে নাহয় তোমার ইচ্ছামত আরও কয়েকটা বিয়ে করো।
–আপু এরকমটা বলেছে।
–হ্যাতো! তোমার কি মনে হয় আমি মিথ্যা কথা বলেছি ?
— উঁহু না!
কথার মাঝেই ইবতিয়াজ আমার একদম কাছে এসে আমার কপালে চুৃুমু এঁকে দিলো। কি ভীষণ মিষ্টি সে অনুভূতি। এই অনুভূতি পাওয়ার জন্য আমি ইবতিয়াজ নামক অসুখে বার বার পড়তে রাজি।
এরপরের দিন গুলো আমার জীবনে ভীষণ অন্যরকম হলো।আমি প্রতিদিন প্রতি সময় ইবতিয়াজের প্রেমে বিভিন্ন ভাবেপড়তে শুরু করলাম ।
যদিও আমার অনার্স শেষ হওয়ার পর আমাকে উঠিয়ে নেওয়ার কথা ছিলো।কিন্তুু আমি সেসব কিছুর তোয়াক্কা না করেই বিয়ের সতেরো দিনের মাথায় ইবতিয়াজের ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠলাম।
আমাকে দেখে ইবতিয়াজ হেসে বললো
–কি বিয়ানসাফ!নিষিদ্ধ ব্যাপার দেখার এত তাড়া কিসের । আমিতো আর চলে যাচ্ছি না কোথাও।
আমি ইবতিয়াজকে জড়িয়ে ধরে বললাম
— দিন কাল ভালো না। যদি হারিয়ে যাও তাই পাহারা দিতে এলাম।
–তুমি এখানে এসেছো বাবা – মা জানে ?
–শুধু আপুকে বলেছি আমি এখন থেকে তোমার এখানেই থাকবো।
ইবতিয়াজ আর দ্বিমত করেনি। আমি ইবতিয়াজ আর আমাদের নতুন সংসার। আমাদের দু রুমের বাসায় যেন এক টুকরো জান্নাত নেমে আসলো। দুজনে পাশাপাশি বসে চাঁদ দেখার স্মৃতি, ঝুম বৃষ্টিতে এক সাথে ভেজা, শেষ বিকেলে রিকশায় ঘোরা, রঙীণ স্বপ্নে ভবিষ্যত বোনা কতশত স্মৃতি। এই সব কিছুই যেন ইবতিয়াজের প্রতি আমার দুর্বলতা, ভালোবাসা ক্রমে বাড়িয়ে দিলো।
চলবে