সে_আমার_অসুখ,পর্ব_০২,৩
লিখা_মুনিয়া_রহমান
পর্ব_০২
ইবতিয়াজ সবার সামনেই আমার হাত ধরে হাঁটা শুরু করলো। পাশের একটা রেস্টুরেন্টে বসেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো
—কি খাবে বলো ? লজ্জা করবে না।
একদম নিজের মানুষ মনে করে খাবে।
—আমি খাবো না।
—তাই বললে কি হয়?দেখো যদিও আমি টাকা পয়সা খরচ করার ব্যাপারে একটু চাপা কিন্তুু তোমার মত মোটেও কিপ্টা নই।
আমার মাথা হুট করে গরম হয়ে গেল। এই মানুষটা সেদিন আমাকে অপমান করেছে। আজ আবার অপমান করতে এসেছে।
–আপনি কি আজ আবার অপমান করার জন্য আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন ?
–ইয়ে ছি ছি কি বলো এগুলো ? সম্পর্কে বিয়েন হও তুমি। তোমার সাথেতো দুষ্টুমির সম্পর্ক আমার। তাই বলে সেটাকে অপমান নাম দিও না।
–তাহলে কি জন্য এখানে নিয়ে এসেছেন ?
–বলি, তার আগে তুমি খাবার অর্ডার দাওতো?
–দেবো না। আপনার টাকার কোন খাবার আমি খাবো না।।
আমার কথা পাত্তা না দিয়ে ইবতিয়াজ নিজের মন মতো খাবার অর্ডার করলো আমাদের দুজনের জন্য।
–বুঝলে ঝিনুক খুব শীঘ্রই আমার বিয়ে। তাই ভাবলাম নতুন জীবন শুরু করার আগে তোমার দেয়া অভিশাপটা কাটিয়ে নেই।
ইবতিয়াজের মুখে বিয়ের কথাটা শুনে বুকের মধ্যে ধক করে উঠলো। মুহূর্তেই বুকের মধ্য খানে এক রাশ ফাঁকা অনুভূতি এসে জুড়ে বসলো। এই মানুষটার সাথে এইবার দিয়ে আমার মাত্র দুইবার দেখা। অথচ তার বিয়ের কথাটা শুনে মনে হচ্ছে আমার প্রিয় জনের বিয়ে। এমন কেন মনে হচ্ছে ?
—তুমি আমায় অভিশাপ দিছো ঠিক আছে। কিন্তুু বিয়ের পর যদি ওই অভিশাপ আমার বউয়ের লাগে তাহলেতো সিরিয়াস অবস্থা। আমার বউ এমনি শুকনা। আরও যদি শুকায় তখন তো মানুষ বলবে ইবতিয়াজ একটা পাট কাঠি বিয়ে করে এনেছে। চল.. চল পাট কাঠি বউ দেখে আসি। দেখা গেল কেউ আবার জ্বালানী হিসেবে আমার বউকে নিয়ে চুলায় ঢুকিয়ে দিলো। ও মাই গড তখন কি হবে ঝিনুক?
আমি যথেষ্ট শান্ত স্বরে বললাম
–আমি আপনায় কোন অভিশাপ দেইনি। হ্যা, আপনি সেদিন ওভাবে সকলের সামনে অপমান করায় অনেক কষ্ট পেয়েছি কিন্তুু পরে সেটা ঠিক হয়ে গেছে। আমি দোআ করবো নিশ্চই আপনারা সুখী হবেন।
–একটু সিরিয়াস ভাবে দোআ কইরো। শুধু দুজনে মিলেতো আর সুখী হওয়া যায় না। সংসার জীবনে সুখী হতে দুটো বাচ্চা কাচ্চার মুখ ও লাগে। সুখী হতে যখন এত কিছু দরকার তখন দোআটাও স্পেশাল হতে হবে।
আহারে! আমি দোআ করবো শুনে মানুষটা কত্ত খুশি হয়ে গেল। অথচ সে জানতেই পারলো না। বিয়ের দিনে ফটোগ্রাফারের তোলা শত শত ছবির মধ্য থেকে তার একটা ছবি আমি আমার কাছে নিয়ে এসেছি এবং গত পাঁচদিন দিন ধরে সেই ছবিটা আলমারীতে আমার পছন্দের হলুদ ওড়নাটার মধ্যে রয়েছে।
—কি হলো ঝিনুক খাচ্ছ না কেন ?
—খাচ্ছি.. খাচ্ছিতো।
আমি অল্প করে ফ্রাইড রাইস চামচে নিলাম। মুখে নিতেই মনে হলো পৃথিবীর সব থেকে জঘণ্য খাবারটা খাচ্ছি কিন্তুু ফ্রাইড রাইস বরাবরই আমার পছন্দের একটা খাবার। আজ এত জঘণ্য মনে হওয়ার কারণ কি ? আমার সামনে সাদা শার্ট পরে বসে থাকা এই ছেলেটা অন্য কাউকে বিয়ে করবে বলেই কি এত জঘণ্য মনে হচ্ছে ?
আমি সবটুকু খাবার রেখে দিলাম। ঢক ঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে চোখ বন্ধ করে একটা স্বস্তির নিশ্বাস নিলাম।
–কি ব্যাপার ঝিনুক! কিপ্টামি করে তোমরা কি বাসায় পানিও খাও না। না মানে যেভাবে পানি খাচ্ছো।
–আপনার বলা শেষ হলে আমি এখন উঠবো।
আমার এমন কথায় ইবতিয়াজ ওয়েটারকে দ্রুত টিস্যু পেপার দিতে বললো। ওয়েটার টিস্যু পেপার দিতেই। ইবতিয়াজ পকেট থেকে একটা সাইন পেন বের করলো এবং টিস্যু পেপারের উপর কিছু একটা লিখলো। টিস্যু পেপারটি আমার হাতে দিয়ে বললো। আমি যেন এটা বাসায় গিয়ে পড়ি।
ইবতিয়াজ বিল পে করে একটা রিকশা ডেকে আমায় উঠিয়ে দিলো। আমার অস্থির মন তখন ছটফট করছে ভেতরে কি লেখা সেটা পড়ার জন্য। আমি রিকশায় উঠে আগে টিস্যুটি খুললাম। ভেতরে নীল কালিতে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা ” প্রাপক, বিপদ জনক বেয়াইন! এই পৃথিবীতে দেখার জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে যে ব্যাপার গুলো। আমি সেই নিষিদ্ধ ব্যাপার গুলো দেখার একজন সুন্দর পার্টনার পেয়ে গেছি। মাকে তার কথা বলতেই মা ও রাজি। এখন অপেক্ষা শুধু একটা কবুল বলার।”
প্রেরক তোমার অভিশাপে শুকিয়ে যাওয়া ইবতিয়াজ।
লেখাগুলো পড়ে আমি টিশ্যুটা মুচড়ে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেললাম। ভয়ংকর ভাবে কান্না আসলো আমার। বাসায় গিয়ে তিনবার বমি করলাম। আমার বমি করা দেখে মা ছুটাছুটি শুরু করলো। স্যালাইন গুলিয়ে পিছন পিছন ঘুরলো। কোন কাজ হলোনা তাতে। কি হয়েছে কি হয়েছে বলে আমার মা পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নিলো। ওদিকে বমি করে আমি তখন বিছানায় শয্যাশায়ী। মাকে জড়িয়ে ধরে আমার তখন বলতে ইচ্ছে করছে আমার অসুখ করেছে মা।এই অসুখের নাম ইবতিয়াজ।
চলবে
#সে_আমার_অসুখ
#পর্ব_০৩
#মুনিয়া_রহমান
ওই দিন ইবতিয়াজের সাথে দেখা করে আসার পর শারীরিক এবং মানসিক ভাবে আমি ভীষণ রকম দুর্বল হয়ে পড়লাম। খাওয়ায় রুচি নেই, রাতে ঘুম নেই। সব মিলিয়ে ভীষণ রকম বাজে অবস্থা। আমার মা হঠাৎ হওয়া এই অসুখের কথা আমার বড় আপুকে জানালো।আপু আমার অসুস্থতার কথা শুনে আমাদের বাসায় এলেন। আপুকে দেখে আমার কষ্ট যেন আরও দ্বিগুণ হয়ে গেল।আপুকে জড়িয়ে ধরে আমি হাউ মাউ করে কান্না করে উঠলাম
–এ কি হাল করেছিস নিজের বলতো ?
— আমার কিছুই ভালোলাগে না।
–ভালো না লাগার কারণটা কি ?
আমি এবার কান্না থামিয়ে আপুর দিকে তাকালাম। মনে সাহস যুগিয়ে বললাম
— ইবতিয়াজ আমাকে পাত্তা দেয়না আপু!
আপু এবার ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন
–ইবতিয়াজ পাত্তা না দিলে তোর কি ?
আপুর এমন কথা শুনে আমার চোখ আবার পানিতে টুই টুম্বুুর হয়ে উঠলো।
–তুমি কেন বুঝতে পারছোনা আপু। আমি ইবতিয়াজকে প্রচণ্ড রকম ভাবে ভালোবেসে ফেলেছি।
–তুই ইবতিয়াজকে ভালোবেসে ফেলেছিস মানে ? তুই ইবতিয়াজের সাথে দেখা করিস, কথা বলিস ?
–উহু! না আপু।
–তাহলে প্রেম হয় কি করে ?
–কেন প্রেম হতে কি কথা বলতে হয়?
দেখা করতে হয়?
–অবশ্যই! দুজনে পাশাপাশি বসে বাদাম খাবি, সারা রাত জেগে ফোনে কথা বলবি। রিকশায় হুট তুলে সারা শহর ঘুরবি। তারপর বাবা -মাকে মিথ্যা বলে সিনেমা দেখতে যাবি। তাহলেই নাহ প্রেম হবে ? ওই যে গত বছর বড় মামী এলো আমাদের বাসায়। ওইবার আমিতো বড় মামীর মেরুন কালার জামদানীটা পরে তোর দুলভাইয়ের সাথে সিনেমা দেখতে গেছিলাম। বাবা কত্ত রাগারাগি করলো ওই দিন।শেষে উপায় না পেয়ে মিথ্যা বললাম যে আমি রুশার সাথে সিনেমা দেখতে গেছি। তুইতো এগুলো কিছুই করলি না ?
আপুর কথায় এবার আমি প্রচণ্ড বিরক্ত হলাম
–আমি উনার ছবিটা আলমারীতে আমার পছন্দের হলুদ ওড়নাটার মাঝে রেখেছি। তুমি জানো যে আমার যে জিনিসটা পছন্দ হয় তা আমি আলমারীতে রাখি।
–তা ভালোতো। ইবতিয়াজকে তাহলে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসে আলমারিতে তুলে রাখ?
আমি এবার আপুর একদম কাছাকাছি এসে বসলাম। আপুর হাতটা আমার কপালে রেখে বললাম
–দেখো তোমার বোন একটা ছেলের জন্য এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে অথচ তুমি কিছুুই করবে না?
–করবো না এটা কখন বললাম?
–করবে এটাওতো বলোনি। তুমি এক্ষুনি ইবতিয়াজের সাথে কথা বলবে। বলে আমার কথা জানাবে?
–আমি জানাবো মানে ? আমি কি প্রেম করবো ? দিন পনেরো হলো একটা প্রেম করে বিয়ে করেছি।আপাতত আর প্রেম করার ইচ্ছে নেই। একটা প্রেম করে বিয়ে করতে গিয়ে যা খাটনি খাটতে হলো আমায় !
আপুর এমন কথা শুনে মনে মনে বললাম
–তোমাকে কে প্রেম করতে বলেছে। প্রেম করবোতো আমি। তুমি শুধু বলে দেবে।
আপু আমাকে অনেক বকাবকি করে ইবতিয়াজ কে ফোন দেয়ার জন্য মোবাইলটা বের করলো।
আমি একটু অবাক হলাম ইবতিয়াজের নাম্বারটা আপুর ফোনে সেভ করা দেখে।
–আপু ইবতিয়াজের নাম্বার তোমার ফোনে সেভ করা কেন ?
–এটা কি ধরনের প্রশ্ন ঝিনুক ? ইবতিয়াজ তোর দুলাভাইয়ের সবচেয়ে কাছের ফ্রেন্ড। আর তার ফোন নাম্বার আমার কাছে থাকবে এটাই স্বাভাবিক বরং না থাকাটাই অস্বাভাবিক। তাছাড়া বেচারা আমাদের প্রেমের সময় অনেক হেল্প করেছে। আমিতো ওকে নিজের ভাই মানি।আমিতো ভেবেছিলাম তোকেও বলবো ওকে ভাইয়া ডাকতে। আর সামনে বাবা মায়ের বিবাহ বার্ষিকীতে ইবতিয়াজকে সারপ্রাইজ গিফ্ট হিসেবে নিয়ে আসবো। তারপর বাবা-মাকে বলবো দেখো আমরা কি সুন্দর রেডিমেড একটা ভাই পেয়েছি।আর তোমরা ছেলে। তুই যে করিস না ঝিনুক!আমার সব প্ল্যানে পানি ঢেলল দিলি।
আমি এবার মনে মনে প্রচণ্ড রকম বাজে একটা গালি দিলাম আপুকে।তোর ইচ্ছা হয় তুই নিজে ভাই বানা ইবতিয়াজকে। আমি মরে গেলেও ওকে ভাই বলবো না। এত অসুস্থ হচ্ছি কি ওকে ভাই বানানোর জন্য হুহ!
আপু ফোন দিলে ইবতিয়াজ কেটে কল ব্যাক করলো। আপু রিসিভ করে স্পিকার অন করে দিলো। প্রথমে ইবতিয়াজ সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করলো। পরে আপু বললো
–তুমি নাকি ঝিনুককে পাত্তা দিচ্ছো না?
— কে বলেছে ? ঝিনুক বলেছে ?
–হুহ!
— আমি আবার কখন ঝিনুককে পাত্তা দিলাম নাহ। আমিতো সেদিন ওকে যাস্ট আমার বিয়ের কথাটা বলেছি মাত্র।
–তোমার বিয়ে?
–হ্যা তো। ওই যে মেয়েটার কথা বলেছিলাম না তোমায়।ওই মেয়েটাকেতো মা ও পছন্দ করলো। এখন শুধু কবুল বলার অপেক্ষা !
–তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল অথচ একবার তুমি জানালেও না। এই তুমি আমায় বড় বোন মানো!
–কি যে বলো না আপু? তুমি পাশে না থাকলে তো আমি কবুলই বলবো না।
ইবতিয়াজ আর আপুর কনভারসেসন শুনে আমার মাথা ভন ভন করে ঘোরা শুরু করলো।নিজের আপুকে ভীষণ রকম পর মনে হলো। আপু নিজের বোনের প্রেমের কথা না বলে।অপরজনের কবুল বলার সাক্ষী হতে চলেছে। আহারে! অথচ আমি এই আপুর বিয়ের জন্য কত কিই না করলাম। বাবা- মা যখন মানবেনা বললো তখন জেদ করে দেড় দিন না খেয়ে থাকলাম। অথচ আজ তার নিজের ভালোবাসার মানুষের সাথে বিয়ে করে সব ভুলে গেল। আহারে দুনিয়া! আহারে সম্পর্ক! চোখের পলক পড়তেই সবাই পর।
আপু ফোন রেখে আমার দিকে রাগী চোখে তাকালো
–তুই জানতিস ইবতিয়াজের বিয়ে ঠিক?
–না মানে ওইতো একটু আর কি?
–ইবতিয়াজের বিয়ে ঠিক এটা জানার পরও তুই কি করে এটা বললি আমায়।ভাগ্যিস আমি বাড়তি করে কিছু বলিনি।
আমি এবার চিল্লিয়ে বললাম
–বিয়ে ঠিক হয়েছে ওনার। বিয়েটাতো হয়ে যায় নি ?
–বিয়ে হয়ে যায়নি তো কি হয়েছে ? ইবতিয়াজ ওই মেয়েটাকে গত দুই বছর ধরে ভালোবাসে। এখন ওই মেয়েটাকে ছেড়ে আমার কথামত কি তোকে বিয়ে করে নেবে?
–আমি জানি না কিচ্ছু জানিনা বলে কান্না শুরু করলাম
ওই রাতে গা কাঁপিয়ে ভীষণ রকম জ্বর এলো সাথে বমি। অবস্থা খারাপ দেখে দ্রুত হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা করা হলো আমাকে। আমার তখন পুরোপুরি সেন্স নেই।আপুর হাত জড়িয়ে ধরে বললাম এই অসুখ হসপিটালে নিলেও ঠিক হবেনা। ইবতিয়াজ না এলে কিচ্ছু ঠিক হবেনা।
চলবে