সে_আমার_অসুখ,পর্ব_০৪

0
1398

সে_আমার_অসুখ,পর্ব_০৪
লিখা_মুনিয়া_রহমান

আমি সুস্থ হলাম তিন দিন পর। ডক্টর এক গাদা টেস্ট দিলেন। আমার মা এটা ওটা প্রশ্ন করে ডক্টরকে একদম বিরক্ত করে ফেললেন। রিপোর্ট সবই ভালো।তারপর ডক্টর বললেন হয়তো অতিরিক্ত মানসিক টেনশনের কারণেই আমার এই বেহাল দশা। তাছাড়া এই বয়সের ছেলে মেয়েদের মানসিক বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে সেগুলো সম্পর্কে একটু বললেন। আমার মা বড় বড় চোখ করে ডক্টরের কথা হজম করলো। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে আমার আপু কিছুই বললো না এ ব্যাপারে। একটু সুস্থ হতেই ইবতিয়াজের কথা মনে হলো। মানুষটা আমাকে দেখতে আসেনি।একবার মনে হলো আপুকে জিজ্ঞেস করি।আমার অসুস্থতার কথা ইবতিয়াজকে জানিয়েছিলো কি না? সকাল এগারোটা নাগাদ বাবা এলো তারপর আমাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ দিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো।
বাড়িতে এসে আমি আমার রুমে ঢুকতেই পিছু পিছু আপু এলো
—যার শোকে মরতে বসেছিলি। তুই মরলে সে তো তোর জানাজায়ও শরিক হতে পারতো না।
–কার জন্য মরতে বসেছিলাম আমি ?
–ঢং করবি না, একদম ঢং করবি না। আমার ভালোবাসার মানুষ, সাধের সংসার সবকিছু ফেলে এই তিন দিন তোর অনেক ঢং সহ্য করেছি আমি। নেহাৎ মা সাথে ছিলো।না হলে হসপিটালের বেডেই দুটো থাপ্পড় দিতাম তোকে আমি।
–তুমি এমন করে কথা বলছো কেন আপু ?
— এমন করে কথা বলবো নাতো তোকে শাহাজাদী মেনে ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে কথা বলবো। কত ভালো কাজ করেছেন আপনি যার জন্য আপনাকে এখন আমার শাহাজাদী মানতে হবে ?
আমার এবার প্রচণ্ড রাগ হলো
–আমি কি বলেছি তুমি আমাকে শাহাজাদী মানো ? আমাকে তোমার শুধু বোন মানলেই হবে। আর কিছু মানতে হবে না।
— থাক! ওতো কিছু বলতে হবে না আমাকে। শোন তোর পিয়ারের ইবতিয়াজকে তোর অসুস্থতার কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছিলাম। দেখি ফোন বন্ধ পরে বাধ্য হয়ে তোর দুলাভাইকে বললাম ইবতিয়াজের সাথে যোগাযোগ করার জন্য। সে জানালো ইবতিয়াজকে ওর কোম্পানী থেকে সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়েছে পনেরো দিনের জন্য।
পরে অবশ্য ইবতিয়াজের সাথে আমার কথা হয়েছিলো। ওকে তোর অসুস্থতার কথা বলতেই বললো ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করিস না তাই তুই অসুস্থ হয়ে পড়েছিস।
–আমি যে উনাকে পছন্দ করি এ ব্যাপারে কিছু বলো নাই ?
–বলেছিলামতো! বললাম ইবতিয়াজ তোমার সাথে আমার পার্সোনাল কথা আছে কিছু।
–সে কি বললো?
–বললো আপু আমি এখন আমার প্রফেশনাল কাজের জন্য দেশের বাইরে আছি। তোমার পার্সোনাল কথা দেশে এসে শুনবো। তুমি গরুর মাংস ভুনা আর ঘন করে মুগডাল রান্না করে আমায় দাওয়াত দিও। জমিয়ে খাবো আর তোমার সব পার্সোনাল কথা শুনবো ।
আমি বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম ভালো হয়েছে উনি জানতে চায়নি। তুমি আর উনাকে আমার ব্যাপারে কিছু বলো না।
–সে কি রে! না বললে ইবতিয়াজ জানবে কি করে ?
–আমি চাইনা সে আর জানুক কিছু।
–তিন দিনে তোর ভালোবাসা শেষ! আগেই বলেছিলাম এটা ভালোবাসা না।
–উহু! ভালোবাসা একটা ব্যাখ্যাতীত ব্যাপার আপু। এর সুনির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা বা ছক কষা কোন নিয়ম নেই। এটা শুধু মাত্র অনুভূতির এক জাদুকরি খেলা। আর এই জাদুকরি খেলাটা খেলতে মন যাকে সায় দেয় ভালোবাসাটা তার প্রতি সৃষ্টি হয়।
— বাব্বা! এই তিন দিন হসপিটালের বেডে শুয়ে কি সুন্দর সাহিত্য শিখে ফেলেছিসরে তুই ?
–এটা সাহিত্য নয় আপু।এটা আমার অভিজ্ঞতা। তুমি এবার যাও। আমি একটু ঘুমাবো পরে ফ্রেশ হয়ে অনেক অনেক আড্ডা দেবো।
–আচ্ছা ঠিক আছে তুই ঘুমা আমি আসি।
আপু রুম থেকে বের হতেই আমি রুমের দরজা লাগিয়ে দিলাম।আমার রুমের আলমারীটা খুলে হলুদ ওড়নার মাঝ থেকে ইবতিয়াজের ছবিটা বের করলাম। কি সুন্দর হাস্যজ্জ্বল ছবি! হাত নেড়ে কাউকে হয়তো কিছু বলতেছিলো। আমি ছবিটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ময়লার ঝুড়িতে ফেললাম। যার কাছে আমার অনুভূতির দাম নেই। আমার জন্য সময় নেই সেই মানুষটার ছবি এত যত্নে তুলে রাখারও কোন মানে নেই।
এত বড় হয়ে যাওয়ার পরও জন্মদিন নিয়ে সব সময় বাড়াবাড়ি রকমের মাতামাতি আমার। আমার মায়ের ভাষায় যাকে বলে আদিখ্যেতা। পনেরো দিন বাদেই আমার জন্মদিন তাই প্ল্যান শুরু করলাম। এবার কি কি করবো এবং মজার ব্যাপার হলো এই ব্যাপারটা খুব কাজ করলো ইবতিয়াজ নামক অসুখটা থেকে বের হওয়ার জন্য। জন্মদিন নামক ব্যাস্ততায় আমি নিজেকে ডুবিয়ে রাখলাম। আমার মা আমার জন্মদিন নিয়ে এই অতি ব্যাস্ততা দেখে হা হুতাশ করে বললো
— অন্তত এবার একটু দুঃখ কর। বয়স বেড়ে যাচ্ছে তোর! শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় এসে গেল যে !

শ্বশুর বাড়ির কথা শুনে আমার বুকের মধ্যে ধক করে উঠলো। আমার বিয়ে হবে অথচ যার সাথে বিয়ে হবে সেই মানুষটা ইবতিয়াজ না। এই কথাটা ভাবতেই কেমন জানি লাগলো।

জন্মদিনের দিন আমি এবার কালো রঙের একটা গাউন পরলাম। বাবা আমাকে দেখে বললো
— মাই লিটিল প্রিন্সেস। আজতো তোমার জীবনে সবথেকে খুশির দিন। তাহলে ড্রেসে আজ কালো রঙটাকেই কেন চুজ করলে ?
–কেন বাবা? এই রঙে কি আমায় ভালো লাগছেনা।
— আমার প্রিন্সেসকে সব রঙেই সুন্দর মানায়। বরং কালো রঙটায় আরও বেশি মানায়।
–আমি তোমাদের অনেক ভালোবাসি বাবা
–আমিওতো আমার এই ছোট্ট প্রিন্সেসকে অনেক ভালোবাসি।
–আমি মোটেও ছোট্ট নই বাবা। আমার এবার বিশ বছর হবে। আমিও এখন আপুর মত বড়।
–আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি আজ থেকে আমার বুড়ি মা।
তারপর বাবাকে জড়িয়ে ধরে রইলাম। ধ্যান ভাঙলো আপুর কথায়
–বাবা! ওকে এমন করে জড়িয়ে ধরে আছো কেন? এমন একটা ভাব করছো যেন আজ তোমার মেয়ের বিয়ের দিন। এখন মেয়েকে বিদায় দিচ্ছ। অবশ্য আমার বিয়ের দিনতো খুব ব্যাস্ত হওয়ার ভান করলে। তোমার গলা ধরে দুই মিনিট শান্তিতে একটু কান্নাও করতে পারলাম না আমি।
–আয় আয় তুই ও আমাদের সাথে।
–নাহ! এখন কান্না করে আমার কাজলটা আর ঘাটতে চাইনা। তোমাদের কান্না শেষ হলে ওদিকে চলো। সবাই ওয়েট করছে।

আপুর কথায় আমি আর বাবা হেসে দিলাম। বাবা আমার মাথায় হাত রেখে অনেক অনেক দোআ করলো।

সবার করতালির মধ্যে দিয়ে আমার কেক কাটা শেষ হলো। কেক কাটা শেষ হতেই দেখতে পেলাম দুলাভাইয়ের সাথে ইবতিয়াজও আসছে। অফ হোয়াইট কালারের একটা পান্জাবী পরা। মুখে সেই ঝলমলে হাসি। হাতে একটা লাল গোলাপের বুকে। আচ্ছা ওই বুকে টাকি আমার জন্য এনেছে। যদি আমার জন্য এনে থাকে তাহলে আমি কখনওই নেবো না।যে মানুষটা নিষিদ্ধ ব্যাপারগুলো আমার সাথে দেখতে চায় না।তার কোন গিফ্টও আমি নেবোনা।
বাবা -মা, আপু সবার সাথে কুশল বিনিময় করে অবশেষে ইবতিয়াজ আমার সামনে এসে হাসিমুখে দাড়ালো
–আসসালামু আলাইকুম বেয়াইনসাফ। কেমন আছেন বেয়াইনসাফ।

আমি সালামের উত্তর দিলাম। এরপর মনে মনে বললাম ওরে গরু! তুই কি ভেবেছি আমি এখন তোর গলা ধরে বলবো ভালো নেইগো বেয়াই।আমি একদম ভালো নেই। বুকের মধ্যে নয়া প্রেমের জ্বালা। আপনি এখন আমায় ভালোবেসে আমার বুকটা শিতল করে দিন।
এরপর মুখে বললাম
–কেন দেখতে পাচ্ছেন না কেমন আছি ?
–দেখতেতো পাচ্ছি অনেক কিছুই কিন্তুু যেটা দেখতে পাচ্ছিনা সেটাই শুধু জানতে চাচ্ছি।

ইবতিয়াজের কথায় আমার কেমন যেন লাগলো। একদম মাদক, মাদক। আচ্ছা, ইবতিয়াজ নামক অসুখটা কি আমার কাছে আবার আসতে চাইছে। ও মাই গড! এই বার অসুখটা বুঝি আমার প্রাণ না নিয়ে রেহাই দেবেনা।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here