সে_আমার_পৌষমাস,পর্ব-২
সোনালী_আহমেদ
“ওয়েলকাম টু হেল নিরুপাখি।” চোখ খুলতেই কথাটি শুনতে পেলো নিরা। ভয়ে জান বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। কম্পিত ঠোঁটে বিরবির করে কিছু একটা বললো। স্পষ্ট শোনা গেলো না। সে আবারো চোখ বুজে ফেললো। এ মুহূর্তে তাকিয়ে থাকার মতো সাহস হচ্ছে না। শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। হৃদপিন্ড ক্রমাগত দুরুদুরু করছে। নিঃশ্বাস নেওয়া যখন কষ্টকর হয়ে পড়লো তখন রাশভারী কন্ঠের আওয়াজ শুনতে পেলো সে। চোখ বন্ধ রাখা স্বত্ত্বেও দিব্যি টের পেলো, লোকটা হাসছে।
-” জান, তোমার এ ভয় দেখার জন্য আমি কতটা উন্মাদ ছিলাম! তুমি জানো?ওহ,তুমি জানবে কীভাবে? তুমি তো ছিলেই না। কিন্তু কথা হলো, আমাকে এত ভালো করে চেনার পরেও তোমার সাহস কীভাবে হলো ওই দুইদিনের ছোকরার হাত ধরে পালিয়ে যাবার? ইউ নো, আই এম টোটালি সারপ্রাইজড! টেল মি,হাউ?”
ধীর গতিতে চোখের পাতা মেললো নিরা। ভেতরটা অবশ হয়ে গিয়েছে। ডিসেম্বরের খর বাতাস পর্দাগুলো দুলিয়ে দিচ্ছে অনবরত। মুখের উপর উপছে পড়ছে রাশি রাশি চুল। উলের কম্বল ভেদ করে তার শরীরে কামড় বসাচ্ছে সেই বাতাস। ভেতরের অবশ স্বত্ত্বা কোনো শীতল স্পর্শ টের পাচ্ছে না। ভয় জিনিসটা হুট করে যেনো কীভাবে গায়েব হয়ে গেলো। যেনো ভেতর থেকে অজানা এক উদ্যম শক্তি, আত্মবিশ্বাসী হতে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে।
” যাকে আমি এখনো পর্যন্ত দেখি নি তাকে ভয় পাবো? নাকি যে চেহারা লুকিয়ে কাপুরুষের মতো নিজেকে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে তাকে ভয় পাবো? বলেন? ভয় আমি না আপনি পাচ্ছেন। সেজন্যই তো চোরের মতো নিজেকে লুকিয়ে রাখছেন।”
“উম,জান! তোমার জিহ্বা দেখি অনেক লম্বা হয়ে গিয়েছে। বুঝেছি,স্পেশাল ট্রিটমেন্ট চাই তাই তো? চিন্তা করো না, আমি অলরেডি তৈরী করে ফেলেছি। এক্ষুণি..”
“এক্ষুণি কি? টর্চার করবেন তাই তো? আর কি ই বা পারবেন। কাপুরুষরা তো এগুলোই করে। লুকিয়ে লুকিয়ে… আ আ আ.. ”
“কি হলো জান, চেচাচ্ছো কেনো? বলো, বলো। আমিও শুনতে চাই। কি হলো বলছো না কেনো?কষ্ট হচ্ছে? অও, দেখি দেখি। ইশশ! রক্ত বের হচ্ছে। এখন কি হবে জান? কথা বলো? বলতে পারছো না…. হা হা হা।”
নিরা চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। একটা সময় এসে চুপ হয়ে গেলো। চেঁচামেঁচি করার মতো দেহে অবশিষ্ট শক্তি বেঁচে নেই। না আছে সহ্য করার ক্ষমতা। ধীরে ধীরে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো সে……
——
হাসপাতালের শয়নকক্ষজুড়ে সাদা রঙের অবারিত বিচরণ। স্নিগ্ধ ভোরের স্তব্ধকালে ক্লান্ত-অসাড় দেহে ঘুমাচ্ছে রাত্রিজাগ্রত কন্যা। প্রকৃতির শুভ্র হাওয়ায় খানিকটা পূর্বে শান্তিতে চোখ লেগে এসেছে যুবতির। বেকায়দায় ঘুমিয়ে যাওয়া রমনী হালকা নড়েচড়ে উঠতেই ঘুমেকাতুর চোখদুটো মেললো সাইফুল। বেডের উপর উবু হয়ে একহাত জড়িয়ে ডানপাশে শুয়ে আছে নবনী। বসার চেয়ার টি বেড থেকে খানিকটা দূরে সরে যাওয়ায় বিছানায় মাথা রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে তার। সাইফুল ঘাড় কাত করে আলতো ছোঁয়ায় টেনে বেডের একপাশে উঠিয়ে নিলো তাকে। নবনীর বিড়ালছানার মতো তার পেট ঘেষে মুখ গুজলো। তা দেখে মৃদু হেসে উঠলো সাইফুল। মেয়েটার ঘুম কুম্ভকর্ণের মতো। কেউ দশবার ঘর-দোর লুট করে নিলেও একটুখানিও টের পাবে না। হঠাৎ ডানহাত ব্যাথায় টনটন করতেই সে খেয়াল করলো ক্যানেলারে রক্ত উঠে গিয়েছে। বোধহয় নবনীকে টেনে তুলতেই এমনটা হয়েছে। তৎক্ষণাৎ ব্যাথায় দাত চেপে চোখ বুজে রইলো। সৌভাগ্যবশত,সেকেন্ড না পেরোতেই নার্স এসে রুমে প্রবেশ করলো চেক-আপের জন্য। ‘ডক্টর নবনী’ বলতেই সাইফুল চোখ মেললো। ইশারায় তাকে বারণ করে দিলো না ডাকতে। ক্যানালার ইশারা করে দেখিয়ে দিলো।
-“ও ঘুমাচ্ছে। ঘুমাতে দিন।” হিসহিসিয়ে বললো সাইফুল।
-” জ্বি,স্যার।” মুচকি হেসে সম্মতি দিলো নার্স। চেক-আপ শেষ করে সে চলে গেলো। যাবার আগে ক্যানালার ঠিক করে দিলো সে। সেজন্য অবশ্য কৃতজ্ঞা প্রকাশ করেছে সাইফুল। কপালের দুপাশে আঙ্গুল চেপে ক্ষণকাল চোখ বুজে রইলো সে। অস্পষ্ট স্মৃতি মাথা নড়াচড়া দিয়ে উঠছে। হাসপাতালের এ কক্ষে সে মাসে দু-তিনবার আসে। না,নবনীকে দেখতে নয়, আঘাত পেয়েই আসে। কিন্তু এবারের আঘাতের কারণ টা স্পষ্ট মনে পড়ছে না। যতদূর মনে পড়ছে, নবনী তাকে আওয়াজ দিতেই পায়ে কিছু একটা হয়েছিলো। সাপ! হ্যা,মনে পড়েছে। অনেকটা মাটির মতো দেখতে মাঝারি আকারের সাপ কামড় দিয়েছিলো পায়ে।তার কয়েক মুহূর্তবাদে চোখ আপনাআপনি বন্ধ হয়ে এসেছিলো। স্মৃতিচারণ শেষ না হতেই সাইফুল ” মিস নিরা” বলে ধড়ফড়িয়ে বসলো। নবনী ভূত দেখার মতো চমকে জেগে উঠলো। ক্ষণেই বলতে লাগলো, ” কি হয়েছে? ব্যাথা করছে?আমাকে বলেন ন..”
অস্থির কন্ঠে সাইফুল বললো, -” মিস নিরা!মিস নিরা, কোথায় নবনী? উনি কই? উনার কিছু হয় নি তো?”
-” রিলাক্স! সে ঠিক আছে।”
-” আমি এক্ষুণি দেখা করতে চাই।” কন্ঠে জেদ প্রকাশ পেলো তার।
-” এখন ঘুমাচ্ছে। একটুপর… ”
-” একটুপর? কিন্তু কেনো? আমার সাথে মিথ্যা বলছো,তাই না? আমি জানি ওই দানব নিয়ে গিয়েছে উনাকে। ওহ,নো! যদি কিছু করে ফেলে তো….” সাইফুল বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বললো।
-” হ্যা,হ্যা নিয়ে গিয়েছে। এবার শান্তি?” চিৎকার করে বললো নবনী।ধৈর্য্যের বাঁধ এবার ভেঙ্গে গিয়েয়েছে। সারা রাত না ঘুমিয়ে না খেয়ে পাশে বসে ছিলো, অথচ চোখ মেলে একটিবারও তার কথা জিজ্ঞেস করলো না। না নিজের কথা। বললো সেই মেয়ের কথা। রাগ যেনো শিরায় শিরায় বইতে লাগলো।
সাইফুল অসহায় কন্ঠে বললো,
-” নব, তুমি কীভাবে পারলে যেতে দিতে?”
-” কারন, আমার কাছে কোনো অপশন ছিলো না। সাপে কেটেছে আপনাকে। ওই মেয়েকে যেতে না দিলে আপনাকেও হসপিটালে নিয়ে যেতো দিতো না। ”
সাইফুল দেওয়ালে থাপ্পর দিয়ে বললো,
-” রাবিশ!”
সেকেন্ড খানেক সবকিছু নিস্তব্ধ রইলো।
-” আপনি চিন্তা করবেন না। ওই মেয়ের কিছু হবে না, লোকটা তাকে ভালোবাসে। ” আশ্বাস দিয়ে বললো নবনী।
-” অত্যাচারকে তুমি ভালোবাসা বলছো?”
– “যেখানে ভালোবাসা, সেখানেই ব্যাথা। তাছাড়া, সবার ভালোবাসার ধরন এক নয়, সবাই আপনার মতো করে যত্ন করে ভালোবাসবে তা নয়। একেকজন একেকরকমে ভালোবাসে।”
কথাটি শোনামাত্রই রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ক্যানালারে জোরে লাথি দিলো সাইফুল। সাথে সাথে ক্যানালার ছিঁটকে ফ্লোরে পড়ে গড়াগড়ি খেলো। নবনী কেঁপে উঠলো। ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে একপাশে সরে আসলো। সাইফুল এগিয়ে এসে নবনীর বাহু খামছে ধরলো। উচ্চস্বরে বললো,
-” ভালোবাসা? হ্যা, ভালোবাসা?কেমন ভালোবাসা যেখানে কাউকে তেলোপোকা, ইঁদুরের সাথে অন্ধকার রুমে বন্ধ করে দিনের পর দিন অত্যাচার করা হয়। ঠান্ডা পানি আর বরফ মিক্স করে বক্সে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে রাখা হয়! হাতে-পায়ে জ্বলন্ত সিগারেট চেপে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বিশ কোটি টাকার সম্পত্তির জন্য মাসের পর মাস অত্যাচার করতে থাকে। এটা ভালোবাস? হ্যা, বল.. এটাকে ভালোবাসা বলে? বল! কি হলো চুপ কেনো? কথা বল। ভালোবাসার ধরন অন্যরকম, তাই না? রিয়েলিটি বুঝো?রিয়েলিটি? আমি তোমার সাথে একবার কথা কাটাকাটি করলে, ভাত খাওয়া ছেড়ে দাও, কান্নাকাটি করে মায়ের কাছে ফোন দাও। দুই-তিন দিন আমার সাথে কথা বলো না। সেখানে যদি একটা চড় দেই তাহলে তো কথা -ই নাই। আর একটা মেয়েকে দিনের পর দিন মারধর করাকে বলছো ভালোবাসা?”
-“সে আর আমি এক? তুমি তার সাথে আমার তুলনা করছো? মাত্র সাতদিনে সে তোমার কাছে এত বড় হয়ে গেলো?” কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো নবনী। বারবার গলায় আটকে যাচ্ছে কথাগুলো। তার কন্ঠস্বর বলছে সাইফুলের কাছে এ ধরনের ব্যবহার নিশ্চই সে কখনো আশা করে নি। যেনো একদম কল্পনার বাহিরে। নবনীর মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। ওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে নিজেকে সামলালো। বাতাসের সাথে শাড়ীর আঁচল বুকের উপর থেকে খানিকটা সরে গেলো। অথচ সেদিকে বিন্দু পরিমাণ খেয়াল নেই তার। সে তো একদৃষ্টিতে তাকিয়েই রয়েছে সাইফুলের দিকে…
চলবে….
সোনালী আহমেদ