সে_আমার_পৌষমাস,পর্ব_ ৫ (শেষ)

0
2617

সে_আমার_পৌষমাস,পর্ব_ ৫ (শেষ)
সোনালী_আহমেদ

সাইফুল অন্যমনষ্ক হয়ে বললো, -” আমার জীবন প্রজাপতি আর রংধনুর রঙের মতো রঙিন ছিলো, সোহেল। হাসিকান্না,আমোদ-ফূর্তি সবকিছুতেই ভরপুর ছিলো। বাবা-মা আর ছোট্ট বোনের সাথে ঠাট্টামশকরায় কাটিয়ে দিতাম দিনগুলো। কি সুন্দর,কি শান্তির জীবন ছিলো! কিন্তু আমাদের সে জীবন কালবৈশাখী ঝড়ের মতো তচনচ করে দিলো আ্যাসহোলের বাচ্চা দুটো। মন্ত্রী সোলেমান শেখ আর পুলিশ অফিসার নিজাম উদ্দিন। জীবনের একটা শিক্ষা দিয়েছি তাদের আমি।আমার কোনো আফসোস নেই। এখন আর ওরা কোনোদিন কারো বাবা-মাকে মেরে ফেলতে পারবে না আর না পারবে কারো বোনকে মেরে ফেলতে। আর পারবে না। ডু ইউ নো,ওরা আমার চেহারা ছিনিয়ে নিয়েছে সোহেল! আমার চেহারা। গত দুই বছরের বেশি সময় হয়েছে আমি আমার চেহারা হারিয়েছি। শুধুমাত্র ওদের জন্য।”একটু দম নিয়ে বলতে লাগলো,.. আমার বাবা আর নিরার বাবা বন্ধু ছিলেন। অনেক পুরানো বন্ধু। উনাদের বন্ধুত্ব দেখলে তুমিও অবাক হয়ে যেতে। কিন্তু ওই যে বলে না দুধ কলা দিয়ে পোষা সাপ একদিন না একদিন ফণা তুলেলে । ঠিক তেমমন ওই সোলেমানের আসল চেহারা দেখা দিয়েছে সে নিজেই। যেখানে আমার বাবা হওয়ার কথা ছিলো মন্ত্রী, সেখানে ওই আ্যাসহোলের বাচ্চা মন্ত্রী হয়েছিলো। শুধুমাত্র ক্ষমতা আর পদের জন্য আমার পরিবারকে বন্ধুত্বের আড়ালে ষড়যন্ত্র করে মেরে ফেলেছে। এতিম-অনাথ করে দিয়েছে আমাকে। এই দেখে আজ কি হয়ে গিয়েছি আমি? — ” এ পর্যায়ে সাইফুল চুপ করে যায়। শান্তশিষ্ট স্বভাব গায়েব হয়ে উত্তেজিত হলে ভয়ানক পরিস্থিতি হয়ে উঠে। ব্রেইনের নিউরনগুলো কাজ করা যেনো থামিয়ে দেয়। দেহের নির্ভর ক্ষমতা হারিয়ে যায়। এমন অবস্থায় চট করে নিজেকে কন্ট্রোল করার মতো অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে তার। যার ফলে নিজেকে থামিয়ে ফেলেছে সে।

“তাহলে কি আপনাদের পারিবারিক শত্রুতা ছিলো?”

” ছিলো না,কিন্তু ওরা তৈরী করেছে। জানো সব নিজ চোখে দেখেছি আমি। সব দেখেছি। দেখতে পেয়েও কাউকে বাঁচাতে পারি নি আমি। চিন্তা করতে পারো,কতটা অসহায় অবস্থা ছিলো আমার। আমি ছিলাম লন্ডনে ফুফির বাসায়। সেদিন যখন আমার বোনের সাথে ভিডিও কলে কথা বলছিলাম, তখন কথার মাঝে আমার বোন তার আই প্যাড পর্দার আড়ালে বাবা-মায়ের দিকে দেখিয়ে উনাদের কাছে যাচ্ছিলো আমার নামে বিচার দিতে। আমি যাতে সাফাই না গাইতে পারি সেজন্য স্পিকার একদম লো করে দিয়েছিলো। আরিশা যখন মায়ের কাছে পৌঁছে যাচ্ছিলো ঠিক তখনই কথাবার্তার মাঝে হুট করেই নিজাম উদ্দিন আমার বাবার মাথায় বন্দুক তাক করে। আমার বোন যেখানে ছিলো সেখানেই দাড়িয়ে যায়। চমকে উঠেছিলাম আমিও। সাথে সাথে দু-তিনজন লোক এসে আমার বোন আর মায়ের উপরেও বন্দুক তাক করে। ওদের কে ধমকিয়ে একদম চুপ করে দেওয়া হয়। কোনোরকম কথা বলতে দেয় না। আমি দেখেছিলাম আমার বোনের ভয়ার্ত অশ্রুসিক্ত দু নয়ন। কি গভীর আশা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। কিন্তু সে মুহূর্তে চিল্লানো ব্যতীত আর কোনো উপায় ছিলো না আমার। আমার বাবা আর মাকে বেঁধে দেওয়া হলো ঘরের দুপ্রান্তে। আমার বোনকে সোফায় বসিয়ে মাথায় বন্দুক ঠেকানো হলো। শাসিয়ে কিছু বলছিলো। আমার বাবা না শোনায়, আমার বোনের উপর কতকগুলো তেলাপোকা ছেড়ে দেয়। বোনের চিৎকার দেখে আমার বাবার চোখে পানি চলে এসেছিলো। নিরুপায় হয়ে কাগজে কি কি যেনো লিখে দিলেন। ঠিক তখন তারা চলে গেলো। কিন্তু আমার পরিবারকে ছেড়ে দেয় নি। ঘরের মধ্যে আগুন লাগিয়ে দেয়। ঝলঝল করে জ্বলছিলো আমার পুরো পরিবার। সব স্পষ্ট দেখেছি আমি। সব দেখেছি। কিন্তু কিচ্ছু করতে পারি নি। কিচ্ছু পারি নি।” কথা বলতে বলতে ঘোরের মধ্যে চলে গেলো সাইফুল। সোহেল নৈঃশব্দে শ্রবণ করলো। কথা বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। কিছু বলা উচিত। স্যারকে ধরে কি শান্তনা দিবো? নাকি তিনি যা করেছেন সেজন্য বিরোধিতা করবো? ক্ষণেই নিজেকে সামলিয়ে নিলো সাইফুল। কপালের উপর থেকে হাত সরিয়ে বললো, -” কিন্তু আমিও ছেড়ে দেই নি। এক একজন করে শাস্তি দিয়েছি সবাইকে। জানো, আমার ফুফু কেস করতে আসায় ওরা উনাকে হুমকি দেয় আর কেইস বন্ধ করে দেয়। এরপর সিলিন্ডার ব্লাস্ট হয়ে মারা গিয়েছে এমন ভুয়া খবর ছড়িয়ে দেয়। তখন ফুফুর আর আমার লাইফ রিস্কে চলে আসে। সেজন্য ফুফু আমাদের নিয়ে জাপানে শিফ্ট হয়ে যান। সেদিনই ঠিক করেছি এর প্রতিশোধ নিবো। কঠিন প্রতিশোধ। ঠিক সে সেময় আমি আর আমার ফুফাতো ভাই মিলে সব ঠিক করি। ওই দেশে মুখের সার্জারি করিয়ে দেশে পদার্পণ করি। নবনীর ক্রাশ-প্রেমিক সাইফুলের চেহারা নিয়ে নেই। আর তাকে সরিয়ে দেই। নবনীকে বিয়ে করে তাদের বাড়ীতে উঠি। তার বাবার সব সুযোগ নি এবং একদম বিশস্ত হয়ে উঠি। ধীরে ধীরে নবনীকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলি। সবার অগোচরে নবনীর বাবাকে দিয়ে কৌশলে মন্ত্রীকে মেরে ফেলি। কিন্তু সেখানে নিরা এসে বাঁধ সাধে। তাই তাকে বন্ধী করে ঠিক আমার বোনের সাথে করা অত্যাচারের দ্বিগুণ অত্যাচার করি। এরপর এ সব কিছু আপনাআপনি হয়ে গিয়েছে। ”

-” আমি স্বীকার করছি স্যার,আপনার সাথে যা হয়েছে খুব খারাপ হয়েছে। কিন্তু স্যার, নবনী ম্যাডাম আর নিরা ম্যাডামের তো এতে কেনে দোষ ছিলো না। আপনি উনাদের সাথে এমন করলেন কেনো?”

“দোষ তো আমার মা-বোনের ও ছিলো না সোহেল। তাহলে তাদের সাথে কেনো এমন হলো?হোয়াই? ”

“স্যার, আপনি এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। নবনী ম্যাডামের সাথে এত বড় অন্যায় কীভাবে করলেন? তিনি আপনাকে কত ভালোবাসেন। উনার তো কোনো দোষ নেই। উনি কোন দোষে শাস্তি পাচ্ছেন?”

“ইউ আর রাইট,সোহেল। নবনীর কোনো দোষ নেই। কোনো দোষ নেই। শুধু সুন্দর হওয়া ছাড়া। এটাই ওর জীবনের সবচেয়ে বড় দোষ। ওর সৌন্দর্য। এই যে তুমি মনে মনে ওকে এত ভালোবাসো এটা ওর দোষ নয়,ওর সৌন্দর্যের দোষ। যে কেউ এট্রাক্ট হয়ে যায়। আমাকেই দেখে নাও। এসেছিলাম কোন প্ল্যানে আর করেছি কোন প্ল্যান। পুরো পরিবারকে এক চুটকিতে শেষ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু নবনীর জন্য পারলাম না। ওর ভালোবাসা,পাগলামি,ওর দৃষ্টি এ সব কিছু আমাকে নড়বড়ে করে দিয়েছিলো।আমার প্ল্যান বদলাতে হয়েছিলো।”
” তাহলে উনাকে অপরাধী বানিয়ে জেলে দিয়েছেন কেনো?”
সাইফুল হেসে বললো, ” তোমার দেখি খুব চিন্তা আমার ওয়াইফের জন্য। সাউন্ডস ইন্টারেস্টিং। বাট নো টেনশন। মাত্র ৪৮ ঘন্টার জন্য সে জেলে। এরপর ওকে নিয়ে আমি জাপানে ফুরুৎ হয়ে যাবো। আসলে হয়েছে কি, আমি আমার রুলসের বাহিরে যাই না। তাই নবনীকে এটুকু শাস্তি না চাইতেও দিতে হয়েছে।শাস্তিটা কিন্তু প্রতিশোধের জন্য নয়। আই হোপ তুমি বুঝেছো কেনো! ”

সোহেল বিষ্ময় নিয়ে তাকাতেই সাইফুল হেসে হেসে বললো, ” এত টেনশন নিচ্ছো কেনো?মৃত্যুর আগে এত ভাবনাচিন্তা করা উচিত না।”
সোহেল এবার হতভম্ভ হয়ে তাকালো। ঠিক তখন সাইফুল বন্দুক দিয়ে বুক পয়েন্টে তাক করলো। সাথে সাথে বুলেট তার বুক ছিঁরে এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে গেলো। সোহেলকে মারা তার জন্য জরুরী। জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ হলো সে। সোহেল বেঁচে থাকলে তার বাঁচা কষ্টকর হয়ে উঠতো।
সাইফুলের কথামতো ৪৮ ঘন্টা পরপরই নবনীকে জামিন দেওয়া হলো। নিরা নিজ থেকেই কেস তুলে নিয়েছে। মিডিয়া এখনো এর কারণ জানতে পারে নি। তবে নিরা স্পষ্ট বলেছে তাকে কেউ জোর করে নি। আর সেজন্য সে দলবল সাথে করে নিজে এয়্যারপোর্টে এসেছে সাইফুল আর নবনীকে বিদায় দিতে। সময় ঘনিয়ে আসতেই নিরা বসা থেকে উঠে বললো, -” বেস্ট অফ লাক নবনী। শেষে তোমার কথা ই সঠিক হলো। অনেক অনেক ভালো থেকো।”
” আমি জানি না ঠিক কি এমন হয়েছে যে তুমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছো। তবে যদি তোমার কথামত আমি প্রেগন্যান্ট বলে এ ডিশিসন নিয়েছো তাহলে বলবো তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। অনেক অনেক ধন্যবাদ। ”
নিরা ম্লান হেসে বিদায় জানালো। যাবার সময় সাইফুলের দিকে একবারও তাকায় নি। আনমনে হেটে চলে গিয়েছিলো। সে চলে যেতেই নবনী শান্ত স্বরে বললো, “এমনটা কীভাবে হয়েছে বলো তো? নিজে আমাকে ছেড়ে দিয়েছে কীভাবে?”
সাইফুল বললো, ” আমি উনাকে শুধু মিসআন্ডারস্টেন্ডিং টা বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। আর তখন তিনি জানতে পারলেন, তোমার মেডিকাল কন্ডিশন। তুমি মানসিকভাবে যে অসুস্থ সেটা তিনি জানতেন না। আর তারপর তুমি প্রেগন্যান্ট শুনে গিল্টি ফিল করলেন। আর সেজন্যই তোমাকে ছাড়িয়ে দিয়েছেন।”
নবনী হু হা করে মাথা নাড়ায়। তাকে গভীর চিন্তায় ডুবে থাকতে দেখা যায়। সাইফুল তার বাহু টেনে কাছে নিয়ে আসলো। হালকা জড়িয়ে ধরে বললো, ” বাদ দাও তো। সব চিন্তা বাদ। এখন শুধু যে আসবে তার কথা ভাবো। এমনিতে অনেক কষ্টে তোমাকে রাজি করাতে পেরেছি। বাবাও তোমাকে এখান থেকে চলে যাবার জন্য বলেছেন। শুধু শুধু উল্টাপাল্টা চিন্তা করে আবার চিন্তাভাবনা বদলে ফেলো না। ঠিক আছে? ”
নবনী মাথা নাড়ালো। সাইফুল তার মাথায় চুলের উপর চুমু দিয়ে বললো, ” ভালোবাসি নব। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।”
নবনী তার কাছ থেকে হালকা সরে গিয়ে বললো, ” কিন্তু আমি শুধু সাইফুলকে ভালোবাসি।”

সমাপ্ত..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here