সে_আসবে_বলে(৫ম এবং শেষ পর্ব)

0
869

#সে_আসবে_বলে(৫ম এবং শেষ পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda

কথা কেঁদে উঠলো।

– আমার সন্তান কোথায়? ওকে প্লিজ আমার কাছে এনে দাও।

– সম্ভব নাহ। ও এখন আমাদের থেকে অনেকটা দূরে চলে গেছে। ওকে আমি দিয়ে দিয়েছি এক নিঃসন্তান দম্পতি কে।

– মানে কি আবিদ? তুমি কি আমার সাথে ইয়ার্কি করছো? আমাকে দেখে তোমার মনে হয় যে আমি ইয়ার্কি করার মতো অবস্থায় আছি?

– ইয়ার্কি হবে কেন? সত্যিই বললাম।

– কিসের সত্যি? কি বলছো এসব?

– ঠান্ডা মাথায় আমার কথা শোনো তুমি। আমি তো তোমার ভালোর জন্যই এসব করেছি। ওকে নিয়ে এত কষ্ট করেছো এক ন’মাস। সামনে তো আরো কষ্ট হবে। আর তাছাড়া আমি আছি না? ওকে তোমার কেন লাগবে?

– তুমি আছো বলে আমার সন্তান লাগবে না? এটা কেমন কথা বলছো তুমি? কি করে এসব অনর্থক কথা বলতে পারো তাও এই মুহূর্তে? আমি কিছু জানিনা আমার কাছে আমার সন্তান কে এখনই এনে দাও।

– কেন? এখন সন্তান চাইছো কেন? তোমার কাছে তো মা সন্তানের সম্পর্ক একেবারেই তুচ্ছ। তোমার কাছে শুধু স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক টা গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি স্বামী হিসেবে তোমার সব দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেছি। কিন্তু তুমি মা হওয়ার যোগ্য ই না। তুমি আমার মাকে তার সন্তান এর থেকে দূরে করে দিয়েছো। তাই আমার সন্তানকে আমি তোমার থেকে দূরে করে দিয়েছি। তোমার তো কষ্ট হওয়ার কথা না। তোমার কাছে সন্তান বা মা দুটোই মূল্যহীন। আর এমনিতেও তোমার তো এতে খুশি হওয়ারই কথা। কারণ বাচ্চা থাকলে তো আমি ওকে বেশি সময় দিতাম, ভালোবাসতাম। তুমি তখন কষ্ট পেতে। তাই না?

– এসব তুমি কি বলছো আবিদ? নিজের সন্তানের সাথে আমি আমার ভালোবাসার তুলনা কি করে কর‍তে পারি?

– তুমি আমার মায়ের সাথে যখন তুলনা করতে পারো, তাহলে আমার সন্তানের সাথেও পারবে।

এটা বলে আবিদ কথার কেবিন থেকে বের হয়ে চলে যায়। কথা আবিদকে ডাকতে থাকে। কিন্তু আবিদ ওর কোনো কথা না শুনে চলে যায়। যাওয়ার সময় নার্স কে বলে যায় কথাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দিতে।

হস্পিটালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আবিদ নিজের চোখের পানি মুছছে। কথার জন্য ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কথার এই অবস্থার জন্য সে নিজেই দায়ী। আবিদ চাইলে প্রথম দিকেই কথাকে শাসন করতে পারতো। কিন্তু সেরকম করলে ওর মনে থেকে মায়ের জন্য তিক্ততা কখনোই কাটতো না। বরং আরো বাড়ত। তাই সে সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করেছে। যাতে সন্তানের মাধ্যমেই কথা বুঝতে পারে মা আর সন্তানের সম্পর্ক টা ঠিক কেমন হয়।

এমন সময় আবিদের মা এসে আবিদ এর কাঁধে হাত রাখে। ও পেছনে ফিরতেই ওদের মেয়েকে আবিদের কোলে তুলে দেয়। আবিদ মেয়ে কোলে নিয়ে বলতে থাকে,

– তুই আসবি বলে এতদিন অপেক্ষা করেছি। আমার এক মা এসে আরেক মা কে আমার কাছে এনে দিবে বলেই এত অপেক্ষা। তুই আসবি বলে আমার মা কে এতদিন আমার কাছে দূরে রেখেছি। এখন তুই সব ঠিক করে দিবি। কি দিবি তো?

ছোট মেয়েটা আবিদের আঙুল টা শক্ত করে ধরলো। আবিদ একটু মুচকি হেসে ওর মাকে বললো,

– কথা ঘুম থেকে জাগার আগে ওকে গিয়ে খাইয়ে নিয়ে এসো। কথা যেন বুঝতে না পারে ও আমাদের কাছে আছে। ওর একটু শিক্ষা দরকার।

– এটা ঠিক হচ্ছে না বাবা। কথা তো ছেলেমানুষ। তাই এমন করেছে। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।

– না মা। ও আগে বুঝুক সন্তান কি জিনিস। আর মা কি জিনিস। তারপর আমি ওকে সব বলবো। আমি এতদিন শুধু এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করে আছি।

আবিদ এর মা বুঝতে পারলো যে এখন আবিদকে এসব বলে কোনো লাভ নেই। তাই সে ওদের বাচ্চাকে নিয়ে কথার কেবিনে গিয়ে বাচ্চাকে খাইয়ে আবার চলে গেলো। হস্পিটালের একদম পাশের একটা বাসায় আবিদ ওর মাকে এনে রেখেছে বাচ্চার দেখাশোনা করার জন্য।

কথার ঘুম ভাঙে প্রায় তিন চার ঘন্টা পরে। ঘুম থেকে জেগে কথা ওর বাচ্চাকে খোঁজে। কিন্তু বাচ্চাকে পায় না। আবিদ কথার মাথার কাছে ই বসে ছিলো। কথা আবিদের হাত দুটো ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

– আমার সন্তান কোথায় আবিদ? প্লিজ ওকে আমার কাছে নিয়ে আসো। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। প্লিজ প্লিজ আমার কাছে এনে দাও? তুমি যা বলবে আমি তাই করবো। আমি।আর কখনও কিচ্ছু চাইবো না তোমার কাছে। প্লিজ এনে দাও না? প্লিজ!!

– কিভাবে এনে দিবো? তুমি বুঝতে কেন পারছো না কথা? আমি তোমার ভালোর জন্যই তো ওকে অন্যের কাছে দিয়ে দিয়েছি। আমি ভেবেছি ওর জন্য এত কষ্ট পেয়েছো, হয়তো ওর প্রতি ভীষণ বিরক্ত হবে তুমি। তাই ওকে দিয়ে দিলে তুমি আমার ওপর খুশি হবে। কিন্তু এখন তো দেখছি উল্টো।

কথা চিৎকার দিয়ে বলল,

– পাগল হয়ে গেছো তুমি, হ্যাঁ? এসব কথা কিভাবে মাথায় আসে তোমার? একজন মায়ের কষ্ট বুঝতে পারো তুমি? একটুও কি মনুষ্যত্ব বোধ নেই তোমার ভেতর? আমার বাচ্চাটাকে আমি ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখতে পারলাম না। ও কোথায় আছে, কেমন আছে, কি করছে, কান্না করছে কিনা, খেতে পাচ্ছে কিনা কিছুই জানি না আমি। আর তুমি এখানে বসে বসে ফাজলামি করছো আমার সাথে?

– মোটেই না। ফাজলামি তো তুমি করছো আমার সাথে। মায়ের মমতা বুঝো তুমি? মা আর সন্তান সম্পর্কে কথা বলার অধিকার তোমার নেই। একদম চুপ থাকো।

এরই মধ্যে কেবিনে একজন নার্স ঢুকলো একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে। কথার কাছে গিয়ে বললো,

– ম্যাডাম, আপনি কি এই বাচ্চাটাকে একটু দুধ খাওয়াতে পারবেন? আসলে বাচ্চাটার মা খুবই অসুস্থ। এদিকে বাচ্চাটার খিদে পেয়েছে। কষ্ট পাচ্ছে খুব। আপনি যদি ওকে একটু খাওয়াতেন তাহলে খুব উপকার হতো।

কথা কিছু না বলে চোখের পানি মুছে বাচ্চাটাকে দুহাত বাড়িয়ে কোলে নিলো। বাচ্চাটা খেতে খেতে কথার কোলেই ঘুমিয়ে যায়। কথা অবাক হয়ে বাচ্চাটার ছোট ছোট হাত পা দেখতে থাকে। কি মিস্টি! কি শান্তি ওর কোমল স্পর্শে! কথা বাচ্চাটাকে বুকে নিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে। কিন্তু বেশিক্ষণ রাখতে পারে না। নার্স এসে জোর করে বাচ্চাটাকে নিয়ে যায়। কথা কাঁদতে থাকে। যদিও বাচ্চাটি কথার ই ছিলো। আবিদ ই নার্সকে পাঠিয়েছিলো। আর সেটা কথাকে জানাতে মানা করেছিলো।

পরদিন কথা আবিদকে ডেকে বলে,

– আবিদ আমাকে একটু মায়ের কাছে নিয়ে যাবে?

– কেন?

– আসলে আমি মায়ের কাছে ক্ষমা চাইতে চাই। আমি মায়ের সাথে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি।

– কিসের অন্যায়??

– এই যে মাকে তোমার থেকে দূরে করে দিয়েছি। আমি তো আমার বাচ্চাকে শুধু ন’মাস নিজের গর্ভে ধারণ করেছি। ওকে দেখতেও পাইনি। তাতেই ওর দূরত্ব আমাকে এত কষ্ট দিচ্ছে। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। আর মা তোমার জন্য তার পুরো জীবন টা স্যাক্রিফাইস করে দিয়েছে, এত কষ্ট করে বড় করে তুলেছে। আর আমি কিনা তার কাছ থেকে তোমাকে দূরে করে দিয়েছি। না বুঝে কত বড় অন্যায় করে ফেলেছি আমি। মাতৃত্ব কি জিনিস এখন বুঝতে পারছি। তুমি প্লিজ আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাও। আমি বাচ্চা চাই না আমি শুধু মায়ের কাছে ক্ষমা চাই। আমি মায়ের সন্তান হয়ে থাকতে চাই।

কথা আবিদের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। আবিদ কথাকে তুলে ওর মাকে ফোন করে আসতে বলে। আবিদের মা ওদের বাচ্চাকে এনে কথার কোলে তুলে দেয়। কথা বাচ্চাকে আবিদের কোলে দিয়ে আবিদের মায়ের পা ধরতে যায়। আবিদের মা কথাকে নিজের বুকে তুলে নেয়। কথা বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছে। আবিদের মা কথাকে বুকে জড়িয়ে চোখে পানি নিয়ে মুচকি হাসছে। আবিদ কথাকে বলে,

– জানো কথা একজন পুরুষের সবথেকে প্রিয় দুজন নারী হচ্ছে তার মা এবং স্ত্রী। যখন এই দুজন মিলেমিশে থাকে তখন একজন পুরুষ সবচেয়ে বেশি খুশি হয়। কিন্তু যখনই তারা দুজন দুজনকে শত্রু ভাবতে শুরু করে তখন সবথেকে কষ্ট কিন্তু সেই পুরুষের হয়। যে পুরুষ তার মা এবং স্ত্রী কে খুশি রাখার জন্য সারাদিন পরিশ্রম করে, তার জন্য কি নারীদের একটু স্যাক্রিফাইস করা উচিত না? একজন মানুষ সবদিক থেকে পারফেক্ট হয়না। তাই মায়ের সব জিনিস তোমার ভালো লাগবে না, অথবা তোমার সব জিনিস মায়ের পছন্দ হবে না। কিন্তু সেগুলো মানিয়ে নিতে হবে। আমাদের সমাজে কিছু মা আছে যারা তার ছেলেকে, ছেলের বউ এর থেকে দূরে রাখতে পছন্দ করে। আবার কিছু স্ত্রী আছে যারা তাদের স্বামী কে মায়ের বিরুদ্ধে রাখতে পছন্দ করে। অথচ তাদের এই কাজের জন্য একজন পুরুষ মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অসুখী হয়, পরিবারের শান্তি নষ্ট হয়। এইজন্য কিছু কিছু অপছন্দ মানিয়ে নিতে হয়। নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করতে হয়। দিনশেষে একজন পুরুষ মানসিক শান্তি চায়।

– আমি বুঝতে পেরেছি আবিদ। কথা দিচ্ছি আর কখনো অভিযোগ করতে দিবো না। শেষবারের মতো একটা সুযোগ দাও আমাকে।

আবিদ মুচকি হাসলো।

৬ মাস পরে খাবার টেবিলে তিনজন একসাথে খেতে বসলো। তখনই ওদের মেয়ে ঘুম থেকে উঠে কান্না শুরু করে। কথা খাবার রেখে উঠে যায়। পেছন পেছন আবিদ ও যায়। কিছুক্ষণ পরে আবিদের মা হাতে একটা প্লেট নিয়ে এসে আবিদ আর কথাকে একসাথে খাইয়ে দেয়। কথার চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। মনে মনে ভাবছে, “ইশ এই ভালোবাসা টা আগে কেন মিস করলাম!”

আবিদ কথাকে ডাক দিয়ে সামনে আনলো। কথার পরিবারও আছে সবার সামনে। সবাই আসার পরে আবিদ কথার বাবাকে বললো..

– আপনারা হয়তো আমার উপরে রেগে আছেন। আমার ছোট্ট মেয়ে মৃদুলা আসার পরে কথার কাছ থেকে একটু দূরে সরিয়ে রাখছিলাম,ব্যাপারটা আপনারা মেনে নিতে পারেন নি। আপনাদের কি একটাবারও জানতে ইচ্ছা হয়নি আপনার মেয়ে আমার মাকে কতটা ভালোবাসে। বা আমার পরিবারে কেমন আছে। তা জানতে চাননি। আপনারা জানেন আপনার মেয়ে আমার মায়ের সাথে কেমন ব্যবহার করেছে?

আমি চাইলে ডিভোর্স দিতে পারতাম,কিন্তু এটা সমাধান নয়। আমি চেয়েছিলাম কথা নিজ থেকে ঠিক পথে আসুক।

মৃদুলাকে কোলে নিয়ে আবিদ বললো..

“সে আসবে বলে” আমি এতদিনের অপেক্ষায় ছিলাম। পরবর্তীতে যদি কখনো আমার মা কষ্ট পায় তাহলে ওর সাথে এইবার আমি সম্পর্ক বিচ্ছেদ করব, সেই সাথে আমার মেয়েকে কেড়ে নিব।”

কথার বাবা একদম চুপ। আর কথা আবিদের হাতটা শক্ত করে ধরে চোখের পানি ফেলছে। মৃদুলার গালে একটা চুমু একে দিলো আবিদ।

#সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here