#সোনাবৌ,২য় পর্ব
প্রতিটা দিন যেন একেকটা পরীক্ষা।স্বর্ণা ঘরে বসে ট্যাব হাতে নিয়ে সুরা ইয়াসিন পড়ছিল।এইমাত্র আসরের নামাজ পড়ে উঠেছে।সাদা ধবধবে হিজাবে ওকে খুব নিষ্পাপ লাগছিল।এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠল।স্বর্ণা সুরা শেষ না করা পর্যন্ত ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখল।দুই মিনিট পরে সুরার শেষাংশ পড়ে ফোনটা দ্রুত রিসিভ করে সালাম দিল।
ওপাশ থেকে মেরাজের কর্কশ কন্ঠ-“ঘুমাচ্ছিলে নাকি?”
-“জ্বী…না…ইয়ে…!”
-“আচ্ছা,শোনো,আজ জামিলের বাসায় দাওয়াত…তুমি ঐ নীল জর্জেটটা পড়বে,বুঝেছো?”
-“আরে…না..না..আমি কোথাও যাবোনা..আমার মনটা ভালো নেই আজকে।”
-“মন ভালো হয়ে যাবে গেলে।রেডী থেকো!”
স্বর্ণা কিছু বলার আগেই মেরাজ ফোন কেটে দিল।স্বর্ণা ফোনটা হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে এলো।মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে।আবার আজকে তামাশার পাত্রী হতে হবে।তাছাড়া মেরাজের ঐ বন্ধুটা ভীষণ গায়েপড়া লোক।হাত নেড়ে নেড়ে এমনভাবে কথা বলে যেন ছুঁয়ে দিতে চায়!স্বর্ণার খুব অস্থির লাগছে।দুহাতে বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়ালো স্বর্ণা।ডান হাতের মধ্যে মাথা ঠেকিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল।হঠাৎ খেয়াল করল,সামনের বাড়ীটার বারান্দায় সেদিনের সেই লোকটা বসে বই পড়ছে।পা দুটো মেলে দিয়েছে সামনের টি টেবিলের ওপর।বাম হাতে বই রেখে ডান হাত গালের নিচে দিয়ে হেলান দিয়ে গভীর মনোযোগে বই পড়ছেন উনি!হঠাৎ পাতা উল্টাতে গিয়ে সামনের দিকে তাকালেন তিনি।স্বর্ণাকে দেখতে পেলেন।দুটো ভবনের মাঝে একটা আট ফুট রাস্তার দুরত্ব।সবই পরিস্কার দেখা যায়।স্বর্ণা সরে যাবার তাগিদ অনুভব করলো।কিন্তু তার সরে যাবার আগেই দেখলো লোকটি আস্তে করে উঠে চলে গেছে।স্বর্ণা মনে মনে আরেকবার লজ্জিত হলো,তারই তো সরে যাওয়া উচিত ছিল।বেচারাকে বই ফেলে উঠতে হতোনা।
পরক্ষনেই রাতের দাওয়াতের চিন্তায় মনটা আবার ভারাক্রান্ত হলো।
সন্ধ্যের পরপরই মেরাজ এলো-“কই,সোনা…তুমি রেডী তো?মেরাজ আদর করে স্বর্ণাকে সোনা বলে ডাকে!বেডরুমে ঢুকে দেখে স্বর্ণা শান্ত ভঙ্গিতে কাপড় ভাঁজ করছে।
মেরাজ প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেলো,পরে রাগ এসে সেই অবস্থা দখল করল-“তুমি রেডী হওনি কেন?”
-“কারন আমি যাবো না!”
-“মানে? হাউ ডেয়ার ইউ?তুমি আমার মুখের উপর কথা বলছো?”
-“প্লিজ,আমাকে ভুল বুঝবেন না,ঐ সব পরিবেশে আমি খুবই আনইজি ফিল করি!”
-“যেতে যেতেই তো ইজি হবে,যাও রেডি হও,দশ মিনিট সময় দিলাম!”
-“আমাকে মাফ করবেন,আমি যাবোনা!”
মেরাজ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল কটমটিয়ে,তারপর হঠাৎ বলল-“এত্ত ধার্মিক তুমি…স্বামীর আদেশ না মানলে যে সে স্ত্রী জাহান্নামী,তা জানো না? হাদীস খালি তুমি একাই জানো? আমিও জানি..শোনো..একজন নারী চারটি শর্ত পূরন করতে না পারলে সে জান্নাতে যেতে পারবেনা,কি কি তাও তোমাকে মনে করিয়ে দেই…১/পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ।২/রমজানের ত্রিশটা রোজা! ৩/পর্দা আর ৪/স্বামীর সন্তষ্টি।তুমি ৪র্থ শর্ত কিন্তু মানছোনা!”
স্বর্ণা হাসল-“বাহ্..আপনার মুখে এটা শুনে খুব ভালো লাগলো।কিন্তু একটা কথা আপনার জানা থাকা জরুরী যে,যখন আল্লাহর আদেশের সামনে স্বামী কিংবা পিতামাতার আদেশ এসে যায় আর তাদের আদেশ যদি আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে যায়,তখন বাবা-মা কিংবা স্বামীর আদেশ অগ্রাহ্য করতে হবে কেবল আল্লাহর আদেশই মানতে হবে।ধরুন,আপনি আমাকে নামাজ পড়তে মানা করলেন কিংবা পর্দা করতে মানা করলেন বা গান গাইতে বললেন তখন আপনার এসব আদেশ অগ্রাহ্য করে আমি সেটাই করবো যেটা মহাণ আল্লাহর আদেশের সাথে সাংঘর্ষিক নয়।বাকী আপনার সব আদেশ আমার মাথার উপর।”
..
প্রচন্ড রাগে মেরাজ হাতের মোবাইলটা আছড়ে ফেলল মাটিতে তারপর প্রবল চিৎকারে স্বর্ণাকে বকাঝকা করতে লাগল।স্বর্ণা নির্বিকারে বসে রইল।একসময় বেরিয়ে গেল!
…
গভীর রাতে ফিরল মেরাজ।স্বর্ণার সাথে কোনো কথা বললোনা।এমনকি আজ বিছানাতেও সে নির্লিপ্ত।স্বর্ণা তার মান,ভাঙাতে কাছে গেলে সে হাতের ইশারায় স্বর্ণাকে থামিয়ে দিয়ে বাম হাতে মোবাইলটা কানে ধরে বলল-“হাই,কেমন আছো?…আমি আছি…এইতো মোটামুটি…কি?….হা হা হা…,বউ?…বউ আছে তো কি হয়েছে…অকাজের বউ…বুঝলে…তোমাদের মত স্মার্ট না…কি বলছো?…সুন্দর…হ্যাঁ,মাকাল ফল…বলতে পারো..!”ইচ্ছে করেই স্বর্ণাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল মেরাজ!
কথাবার্তার এ পর্যায়ে স্বর্ণা ফুঁপিয়ে কেঁদে বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় চলে এল।ওড়না চোখে চেপে ধরে কাঁদলো খানিক।ভেবেছিলো মেরাজ হয়তো ওকে এসে বারান্দা থেকে নিয়ে যাবে..কিন্তু এলোনা!”
…
দিনকে দিন মেরাজের ব্যবহার উত্তপ্ত হতে থাকলো।আগে তো তবু একবেলা রাগ করলে পরের বেলাতেই আদর করে কথা বলেছে,এখন তো বকাঝকা ছাড়া কথাই বলেনা।স্বর্ণা বুঝতে পারছে..ওর কথামতো ফ্রি মিক্সিংয়ে অভ্যস্ত হতে না পারলে মেরাজ স্বর্ণার ওপর রাগ করা কমাবেনা।
এরই মধ্যে একদিন মেরাজের জন্মদিন উপলক্ষে সব বন্ধুর সাথে এবার কিছু বান্ধবীও এলো।স্বর্ণা মৃদুস্বরে বলতে চেষ্টা করল-“এটা বিজাতীয় কালজার।ইসলামে জন্মদিন পালন করা অনুচিত!”
মেরাজ বাঁকা চোখে তাকাল-“তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি?”
স্বর্ণা চুপ মেরে গেল।
সে আজ আর ড্রইংরুমে গেলোনা,মেরাজও ডাকলোনা।স্বর্ণা রান্নাঘর আর ডাইনিং টেবিলেই ব্যস্ত থাকল।কারন শ্বাশুড়ী আম্মা ঢাকায় নেই,বোনের বাড়ী বেড়াতে গেছেন।তাই স্বর্ণাকেই সব সামলাতে হচ্ছে।হঠাৎ দেখলো মেরাজ একটা মেয়ের কাঁধে হাত রেখে তাকে বেডরুমে নিয়ে যাচ্ছে।স্বর্ণা বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।এটা কিভাবে সম্ভব।সে মনের অজান্তেই ত্রুত বেডরুমে এলো।দেখলো দুজন খুব আড্ডা দিচ্ছে।মেরাজ মজা পেলো স্বর্ণার জেলাসি দেখে।
স্বর্ণা হঠাৎ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল-“আপনি তো একজন বয়স্ক মেয়ে..আপনার কি এতটুকু কমনসেন্স নেই যে আরেকজনের স্বামীর সাথে তার বেডরুমে চলে এসেছেন?
মেয়েটি থতমত খেয়ে গেল-“আসলে ভাবী,আমি তো আসতে চাইনি,মেরাজই নিয়ে এলো!”
-“এসো বললেই আপনি আসবেন?
মেয়েটি হঠাৎ উঠে দাঁড়াল-“মেরাজ,এভাবে আমাকে ডেকে এনে অপমান করার মানে কি?”
মেরাজ নিজেও বুঝতে পারেনি যে,স্বর্ণা এভাবে মীরার উপর চড়াও হয়ে যাবে।সে স্বর্ণাকে কষে একটা ধমক দিলে স্বর্ণা কাঁদতে কাঁদতে রান্নাঘরে চলে যায়।
সব মেহমান বিদায় নিলে মেরাজ স্বর্ণাকে ডাকে।স্বর্ণা তখনো রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিল।তবু কাজ রেখেই ছুটে আসে-“জ্বী?”
-“তুমি আমার গেস্টকে অপমান করলে কোন্ সাহসে? এতক্ষণ গেষ্ট ছিলো দেখে কিছু বলিনি..!”
স্বর্ণা স্বাভাবিক সুরে বলল-“আমি তাকে অপমান করিনি বরং আপনি আমাকে স্ত্রী হিসাবে অপমান করেছেন”।আমার সামনে আপনি…!”
এতটুকু কথার মাঝখানেই মেরাজ প্রচন্ড চড় কষিয়ে দিয়ে বলল-“একশো বার আনবো,তোমার তাতে কি?ভালো না লাগে সোজা বেরিয়ে যাও..তোমার মত মেয়েকে আমার দরকার নেই,গেট লষ্ট!”
স্বর্ণা ভয়ে-বিস্ময়ে চুপ মেরে গেল।কিন্তু মেরাজ উত্তপ্তভাবে কথা বলেই চলেছে।স্বর্ণা একপর্যায়ে বলল-“আপনার অসামাজিক কাজ করি না বলেই আজ আমি আপনার কাছে খারাপ হয়ে গেলাম?
-“হ্যাঁ…অত কথা বুঝিনা,তুমি কালই চলে যাবে..তোমার মত মেয়ের সাথে আমার সংসার চলবেনা,যে আমাকে পথেঘাটে অপমান করবে।তুমি বেরিয়ে যাও,তোমার বাপ ভাইকে ফোন দাও তারা এসে নিয়ে যাক্,আপদ বিদায় হোক্…আমার লাইফটা বরবাদ হয়ে গেছে তোমার জন্য।”মেরাজ জানে স্বর্ণাকে ঘায়েল করার এটাই মোক্ষম অস্ত্র!
স্বর্না কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলল।সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারলোনা,ওদিকে মেরাজ নাক ডাকিয়ে ঘুম।
…
পরদিন সকালেও কথা না বলে নাস্তা না খেয়ে অফিসে যাবার জন্য বেরোতে নিলে স্বর্ণা মেরাজের পা জড়িয়ে ধরলে মেরাজ থেমে গেল।মেরাজের ঠোঁটের কোণে হাসি।স্বর্ণা কেঁদে কেঁদে বলল-“আমাকে মাফ করে দিন,বেআদবী হয়ে থাকলে মাফ চাই,তবু আপনি রাগ করে থাকবেন না,প্লিজ!”
মেরাজ ওর দিকে তাকিয়ে বলল-“তাহলে এখন থেকে যা বলবো,সব শুনবে?”
-“শুধু পার্টি গুলোতে যেতে চাইনা,প্লিজ..ওটার জন্য আমাকে বাধ্য করবেন না,অনেক বাজে ঘটনা ঘটে ওসব জায়গায়!”
-“তাহলে ওসব জায়গা যখন খারাপ তাহলে আমিও খারাপ!খারাপের সাথে থাকবে কেন?বাপের বাড়ী চলে যাও।অফিস থেকে এসে যেন তোমাকে আর না দেখি..! “বলে মেরাজ হনহন করে বেরিয়ে গেল।
সে ভালো করেই জানে,স্বর্ণা কোনোদিনও যাবেনা।সমাজ আর ধর্মের ভয় তার মনে প্রবল।সে যাবার সাহসই পাবেনা।
কিন্তু বিকেলে ফিরে যখন দেখলো স্বর্ণা সত্যি সত্যিই চলে গেছে।তখন মেরাজ একটা ধাক্কামতন খেলো!”বেড সাইড টেবিলে একটা নোট লিখে রেখে গেছে স্বর্ণা।মেরাজ তা খুলে দেখলো-“আপনার বেশরীয়তি শর্ত পূরণে অক্ষম..তাই চলে গেলাম।আমাকে ক্ষমা করবেন!”মেরাজ চিঠিটা পড়ে ছিঁড়ে বাস্কেটে ফেলে দিল।সে ভালো করেই জানে দুতিন দিনের মধ্যে বাপ নতুবা ভাই ঠিকই ঘাড় ধরে এনে দিয়ে যাবে”!
মেরাজ বন্ধু-বান্ধবী-বন্ধুদের বৌদের নিয়ে নিজের আনন্দেই বুঁদ হয়ে রইল।
…
চলবে