#সোনাবৌ,৪র্থ পর্ব
মোর্শেদা খাতুন
চেহারায় পানির ঝাপটা খেয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল স্বর্ণা।খুব ভয় পেয়ে গেছে ও।উঠে বসে সামনে তাকিয়ে দেখে ‘আলিফ’ হাসিমুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।স্বর্ণাকে ওভাবে হাঁপাতে দেখে ওর মুখ থেকে হাসি মুছে গেল-“কি হয়েছে..ভয়ের স্বপ্ন দেখেছেন?”
স্বর্ণা চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়ল।ডান হাত দিয়ে চুলগুলো খামচে ধরল।আলিফ নরম সুরে বলল-“স্যরি…এভাবে ভয় পেয়ে যাবেন,ভাবিনি।আমি তো কেবল সুন্নত পালনের নিয়্যতে অল্প পানির ছিটা দিয়েছি,কারন স্বামী /স্ত্রীকে নামাজের জন্য এভাবে জাগানোর কথা হাদীসে বলা আছে!”
স্বর্ণা জোর করে মুখে হাসি টেনে বলল-“না..ভালো করেছেন”!
বলে খাট থেকে নেমে পড়ল।ওর মেরাজের গ্লাস ভর্তি পানি মুখে ছুঁড়ে মারার কথাটা মনে পড়ে গেছে।
অযু সেরে বেরিয়ে দেখল আলিফ ওর জন্য অপেক্ষা করছে।স্বর্ণাকে দেখে বলল-“,আসুন,আজ আপনাকে নিয়ে নামাজ পড়ি,অন্যান্য দিন তো মসজিদেই চলে যাই!”
স্বর্ণা আলিফের পেছনে নামাজে দাঁড়ালো।আলিফের তেলাওয়াৎ শুনে স্বর্ণা মুগ্ধ হয়ে গেল।
নামাজ শেষে আলিফ কোনো কথা না বলে কুরআন নিয়ে বসে গেল।ওর দেখাদেখি স্বর্ণাও বসল।জীবনে এমন পরিবেশ পাবে তা কখনো কল্পনাও করেনি।মেরাজ তো এসময়ে…..যাক্,ওর কথা এসময়ে না ভাবাই ভালো।
…..
আলিফের কলেজ বন্ধ থাকায় ও বাড়ীতেই সারাক্ষণ।তবে ওর বই পড়ার নেশা খুব বেশী।বিভিন্ন ধরনের বই ওর কালেকশনে।স্বর্ণা অবসর সময়ে ওর সেলফের সামনে দাঁড়িয়ে বইগুলোর নাম পড়ছিলো।একেবারে ওপরের তাকে সমরেশ মজুমদার,সূনীলের বইও আছে।এককোণে দস্যু বনহুরের কালেকশনও আছে।স্বর্ণা আপন মনে হেসে ফেলল,মনে মনে বলল,বেশ চৌকস লোক তো!স্বর্ণা নিজেও একসময় সেবা রোমান্টিক,দস্যু বনহুরের বইয়ের খুব ভক্ত ছিল।সমরেশও পড়েছে কিছু।স্বর্ণা চারিদিকে তাকিয়ে ছোট টুল টেবিল খুঁজল,একটা খাড়া টুল পেয়ে তাতে সাবধানে উঠে দাঁড়ালো।
অনেক দিন পর নিজের পছন্দের বইগুলো হাতের কাছে পেয়ে খুব ভালো লাগছে।কিন্তু বইয়ে হাত দিতেই পেছন থেকে আলিফের ধমক শুনলো-“একি!আপনি এটার উপর দাঁড়িয়েছেন কেন?”
হঠাৎ আকস্মিক ডাক শুনে স্বর্ণা হকচকিয়ে গেল!ওদিকে টুলটাও নড়ে ওঠায় ব্যলান্স হারিয়ে ফেলে সোজা মাটিতে….নাহ্,মাটিতে পড়ার আগেই আলিফ প্রায় লুফে নিয়েছে ওকে।সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিয়ে আলিফ বলল-“এই টুলটাতো ভাঙ্গা,না ধরলে তো পড়ে ব্যথা পেতেন।”
-“আপনি ওভাবে না ডাকলে তো আমি পড়তাম না!আপনিই তো জোরে ডাকলেন…!”
স্বর্ণা এখনো কাঁপছে।হঠাত ওভাবে পড়ে যাওয়ায় লজ্জাও পেয়েছে কিছুটা।
-“আরে…আমি আবার কি করলাম…!”আলিফ হাসল।তারপর বলল-“যাক্…কোথাও লাগেনি তো?”
স্বর্ণা মাথা নাড়লো!
আলিফ ফের বলল-“কোন বই নামাবেন আমাকে বলুন,আমি নামিয়ে দিচ্ছি।”
স্বর্ণা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল-“ঐ যে ওটা…!”
আলিফ ওর মাথার সাথে নিজের মাথা ঠেকিয়ে উপরের দিকে তাকাল-“কোনটা?”
লজ্জা পেয়ে স্বর্ণা সরে যেতে নিলে আলিফ হঠাৎ নিচু হয়ে ওকে উঁচু করে ধরে বলল-“নিন্,নামান,কোনটা নামাবেন।
হঠাৎ আলিফের এই আচরণে স্বর্ণা ভীষন চমকে চিৎকার দিলো ভয় পেয়ে-“ইয়াল্লাহ…নামান আমাকে পড়ে যাবো…নামান..প্লিজ!”
আলিফ ওকে শক্ত করে ধরে অটল দাঁড়িয়ে থেকে বলল-“একটুও পড়বেন না।নিন্,বই খুঁজুন।আমি ধরেছি!”
স্বর্ণা ভীষন অস্বস্তি বোধ করছে।আলিফ ওর উরুর কাছে শক্ত করে ধরে আছে।আলিফের মাথাটা স্বর্ণার পেটের কাছে।
আলিফ ইচ্ছে করেই কিনা কে জানে,একবার দুলুনি দিয়েছে আর তাতে স্বর্ণা ভয় পেয়ে আলিফের মাথাটা আঁকড়ে ধরছে।একবার রেগে বলল-“ধ্যুৎ,বই লাগবেনা,নামান তো আমাকে!”
আলিফ হাসলো-“আপনার ওড়নার জন্য কিছু দেখতে পাচ্ছিনা আমি,আমার কি দোষ!”
-“তবু…নামান..!”কাতর স্বরে বলল স্বর্ণা।
আলিফ ওকে হঠাৎ ছেড়ে দিলে স্বর্ণা “মাগো” বলে আলিফকে জড়িয়ে ধরে আস্তে বেয়ে নিচে নামল।তারপর-“ফাজিল একটা”!
বলে রাগ করে দুড়দাড় করে চলে গেল সেখান থেকে।আলিফ হা হা করে হেসে উঠল।
….
স্বর্ণা ঘরে এসে চুপ করে বসে আছে।আলিফ একটা বই হাতে নিয়ে ঢুকল।স্বর্ণা লজ্জায় সংকোচে ওর দিকে তাকাতে পারছিলোনা।আলিফ বইটা বাড়িয়ে ধরে বলল-“এই নিন্,আপনার সেই বই!”
স্বর্ণা অনিচ্ছাসত্ত্বেও বইটা হাতে নিল।কিন্তু দেখল আলিফ বইটার অপর প্রান্ত এখনো ধরে রেখেছে।স্বর্ণা অবাক হয়ে আলিফের দিকে তাকাল,বেহায়ার মত হাসছে সে।স্বর্ণা লজ্জা পেয়ে বইটা ছেড়ে দিল।আলিফ বলল-“আরে কই নিন্ না!”
-“আপনিই তো দুষ্টুমী করছেন !”
-“আচ্ছা,আর করবোনা,এবার নিন।”
স্বর্ণা বই নিল।আলিফ ওর পাশে বসে বলল-“কি নাম বইয়ের?”
স্বর্ণা পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল-“তুমি আমার”!
আলিফ হেসে ওর দিকে তাকিয়ে বলল-“অবশ্যই…..আমি তো তোমারই!”
স্বর্ণা বইটা রেখে উঠে দাঁড়াল-“আপনার জন্য চা নিয়ে আসি!”
আলিফ কৌতুকের দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে ওর চলে যাওয়া দেখল।স্বর্ণা রান্নাঘরে এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল,আলিফ যে এতো দুষ্ট তা স্বর্ণার ধারনা ছিলোনা।কিন্তু নিজের মনে উঁকি দিয়ে দেখলো আলিফের দুষ্টামীগুলো ওর ভালো লেগেছে।মেরাজ কখনো এমন করেনি।ওর যাবতীয় ভালোবাসা কেবল একটা জায়গায়……!”থাক্..স্বর্ণা আর বাকিটা ভাবতে চায়না!”
আলিফ ওর স্বামী,ওর পূর্ণ অধিকার আছে স্বর্ণার ওপর।কিন্তু স্বর্ণার পোড়ামন এখনো আলিফের ডাকে সাড়া দিতে প্রস্তুত নয়!
চা বানিয়ে ঘরে এসে দেখল আলিফ বইয়ে ডুবে গেছে।ওর সামনে চা রেখে স্বর্ণা নিজের বইটা হাতে নিতেই শুনল আলিফ বলছে-“এহ্ হে..চিনি দেননি?”
স্বর্ণা দ্রুত চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলল-“সে কি চিনি দেইনি?”
-“চুমুক দিয়ে দেখুন?”
-“ন্..না থাক্,আবার দিয়ে নিয়ে আসি!”
-“বেশী হয়ে গেলে?এজন্যেই তো বলছি,চুমুক দিয়ে দেখুন না!”
স্বর্ণা কিছুটা ইতস্তত করে ছোট্ট চুমুক দিয়ে নার্ভাস কন্ঠে বলল-“ঠিকই তো লাগছে!”
আলিফ অবাক হয়ে বলল-“তাই নাকি? দেখি?”
তারপর যেপাশটা দিয়ে স্বর্ণা চুমুক দিয়েছে সেপাশটা দিয়ে আলিফ চুমুক দিয়ে বলল-“হমম্…তাই তো!”
স্বর্ণা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে বিছানায় গিয়ে বই নিয়ে বসল।আলিফও হেসে বইয়ে মন দিল।
….
পরদিন আলিফ সকাল বেলা নাস্তা খেয়ে চা টেনে নিল।স্বর্ণা নিরবে এটা ওটা ওকে এগিয়ে দিচ্ছে।আলিফ পুরোনো কান্ডটা আবার করল।মা’কে ডেকে বলল-“আম্মা,তোমার বউমা তো চায়ে চিনিই দেয়নি!”
শ্বাশুড়ী স্বর্ণার দিকে তাকিয়ে বলল-“দাও,ওকে আরেকটু চিনি দাও।ও চিনি বেশী খায়!”
স্বর্ণা সুগার পটটা নিয়ে এগিয়ে গেল-“কতটুকু চিনি দেবো?”
-“খেয়ে দ্যাখো…আমি জানি?”
আলিফ ওকে তুমি করে বলছে।
স্বর্ণা কথা না বাড়িয়ে ছোট্ট চুমুক দিয়ে বলল-“আমার কাছে তো ঠিকই লাগছে।আপনি কি বলেন?আরেকটু দেবো?”
আলিফ চায়ের কাপ টেনে নিয়ে চুমুক দিয়ে বলল-“আমার কাছেও ঠিক লাগছে!” বলে স্বর্ণার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।স্বর্ণার বুকের ভেতরে সে হাসি কাঁপন তুলল।
…..
…..
রাতে শুতে গিয়ে স্বর্ণা নানান কথা ভাবছিলো।আলিফের আচরন একজন বিশ্বস্ত বন্ধুর মত,দুষ্টামী করলেও সীমা ছাড়ায়নি।কিন্তু স্বর্ণা নিজে এখনো সহজ হতে পারছেনা।আলিফ যদি বিশেষ কিছু দাবী নিয়ে আসে তাহলে সময় চাইবে স্বর্ণা।
এমন সময় আলিফকে ঘরে ঢুকতে দেখে স্বর্ণা ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে মুখ গুঁজে রইল।হার্ট এতো জোরে বিট করছে ওর।মনে হচ্ছে আলিফ শুনতে পাবে!কেবলি মনে হচ্ছে,এই বোধহয় আলিফ ওকে ডেকে তুললো যেমনটি মেরাজ করতো।
কিন্তু হঠাৎ যখন নিজের গায়ে ভারী কাপড় অনুভব করল তখন বুঝলো ওর গায়ে চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে।
মিনিট পাঁচেক পরে আস্তে চোখ খুলে দেখল আলিফ একমনে বই পড়ছে।
স্বর্ণার মনটা প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল।….
….
চলবে