#সোনাবৌ,৫,৬
মোর্শেদাহাবিবঃ
৫
দেশে ফিরেই গ্র্যান্ড পার্টি দিলো মেরাজ।সব বন্ধুদের তাদের পরিবার সহ দাওয়াত দিলো।আলিফের বাসায়ও এসেছে দাওয়াত দিতে।বেল বাজলে আলিফই দরোজাটা খুলে দিলো।
স্বর্ণা ডাইনিং স্পেসে দাঁড়িয়ে ছিল।হঠাৎ মেরাজকে দেখতে পেয়ে দেয়ালের সাথে সেঁটে গেল।
ভয়ে ওর কন্ঠনালী শুকিয়ে গেছে।
আড়ালে দাঁড়িয়েই স্বর্ণা শুনতে পেলো মেরাজ বলছে-“তুই তো শালা বিয়ে করে ফেললি হুট করে,খবরও দিলিনা”!
আলিফ হাসল-“কিভাবে খবর দেবো?তুই তো দেশে ছিলিনা”!
-“হ্যাঁ,তা অবশ্য ঠিক।তোর নতুন ভাবীর সাথে এসে পরিচিত হয়ে যাস!ভালো লাগবে!”
আলিফ কোনো মন্তব্য করলোনা।মেরাজ দাঁড়িয়ে গেল-“আজ উঠিরে…!যাস কিন্তু,ভাবীকে নিয়ে যাস্..!”
-“ও..আসলে এ ধরনের প্রোগ্রামে কমফোর্ট ফিল করেনা!”
-“ওওহ্…আচ্ছা,,পারলে তুই যাস,গেলাম!ভাবীকে আমার সালাম শুভেচ্ছা দুটোই রইল।”
মেরাজ চলে যাবার পর গেট আটকে আলিফ ভেতরের দিকে তাকালো,একটু আগে স্বর্ণাকে ডাইনিঙে দেখেছিল।এখন নেই।
…..
স্বর্ণা দৌড়ে নিজের ঘরে এসে হু হু করে কেঁদে ফেলল।দুহাতে মুখ চেপে কাঁদতে লাগল।কেন কাঁদছে ও নিজেও জানেনা।এমন সময় আলিফের পায়ের শব্দে দ্রুত চোখ মুছে স্বাভাবিক হবার চেস্টা করলো।
আলিফ ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে হাতের ঘড়িটা খুলে রাখছে ঠিকই কিন্তু ওর চোখ ড্রেসিং টেবিলের আয়না দিয়ে স্বর্ণাকে পর্যবেক্ষণ করছে।
স্বর্ণা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে।
আলিফ ওর এই স্বাভাবিক হবার অভিনয়ে ম্লান হাসল।তারপর স্বর্ণার সামনে গিয়ে বসল।স্বর্ণা ওকে এভাবে বসতে দেখে নড়েচড়ে বসল।আলিফ জিজ্ঞেস করল-“কি হয়েছে,মন খারাপ?”
স্বর্ণা মৃদু হেসে বলল-“না তো!”
…
আলিফ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে বলল-“যে চোখ ভালোবাসতে জানে সে চোখকে ফাঁকি দেয়া এতো সহজ না।”
স্বর্ণা কান্না চাপলেও সে যে আবেগাক্রান্ত তা ওর নিঃশ্বাসের ওঠানামা দেখলেই বোঝা যায়।আলিফকে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্বর্ণা ওড়না টেনে অযথাই নিজেকে আরো ভালভাবে ঢা
আলিফ একটা ট্যিসু এগিয়ে দিয়ে বলল-“চোখটা মোছো!”
স্বর্ণা ট্যিসুটা নিয়ে চোখের কোণে চেপে ধরতেই চোখের থেমে থাকা অশ্রুগুলো গড়গড়িয়ে নেমে এলো।আলিফ ওর শান্ত হবার অপেক্ষা করল।কিছুক্ষণ পর স্বর্ণা নিজেই বলল-“আমি জানি,আপনি আমার উপর রাগ করছেন!কারন আমার কান্না করা উচিত না”!
-“ভুল জানো!”(আলিফ মৃদু স্বরে বলল)বরং এটাই স্বাভাবিক।তুমি না কাঁদলেই বরং অবাক হতাম!”
স্বর্ণা অবাক হয়ে তাকালে আলিফ ওর গালে মৃদু চাপড় মেরে উঠে গেল।
স্বর্ণা নিজেও উঠল,পেছন থেকে বলল-“আ..আমাকে মাফ করে দিন!”
আলিফ চলে যাচ্ছিল।
একথা শুনে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল-“কিসের জন্য?”
-“এই যে,আপনার মনে কষ্ট দিলাম!…আসলে আমি আবেগ চাপতে পারিনি!”
আলিফ স্বর্ণার মুখোমুখি হয়ে বলল-“এক শর্তে মাফ করতে পারি..”!
স্বর্ণা তাকালে বলল-“যদি তোমার সুখ- দুঃখ সব কিছুতে আমাকে বন্ধু মনে করে তার ভাগ দাও তো!”
স্বর্ণা কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে মাথা নাড়ল।
…
আলিফ দুহাত দুদিকে বাড়িয়ে ধরল।স্বর্ণা সেদিকে তাকিয়ে আস্তে করে আলিফের বুকে মাথাটা ঠেকাল।আলিফ ওর মাথাটা নিজের বুকেরসাথে চেপে ধরল।স্বর্ণার মনে হলো ওর ছাব্বিশ বছরের জীবনে এর চেয়ে প্রশস্ত জায়গা সে আর পায়নি।
…
….
পরদিন মা’কে বলে স্বর্ণাকে নিয়ে বেরুলো আলিফ।লাইব্রেরী থেকে বই কিনলো,স্বর্ণার জন্য দুটো ভালো বোরকা আর জিলবাব কিনল।কেনাকাটা শেষে একটা চাইনীজে রাতের খাবার সেরে বেরোতে যাবার পথে মেরাজের সাথে মুখোমুখি হয়ে গেল ওরা।
মেরাজই ওদের প্রথম দেখল-“আরে,বন্ধু তুই…পরিচয় করিয়ে দেই,ও..জেসমিন!আমার ওয়াইফ!”
আলিফ সেদিকে তাকালোনা কারন মেরাজের কনুই ধরে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে সে যথেষ্ট খোলামেলা আধুনিক পোষাক পড়েছে।
…
মেরাজ স্বর্ণার দিকে তাকাল।স্বর্ণার মুখ নিকাবে ঢাকা থাকায় চিনতে পারলোনা বটে তবে মেরাজ তাকিয়ে যেন একটু থমকে গেল।স্বর্ণা আলিফের পেছনে প্রায় লুকিয়ে যেতে চাইল।
মেরাজ হেসে বলল-“নিশ্চয়ই ভাবী এটা!ভাবি,আমার শুভেচ্ছা রইল আপনাদের দুজনকে।একদিন আসবেন বাসায়….চলি রে!”আলিফের দিকে তাকাল।
…
আলিফ বেরিয়ে গেলে মেরাজ ভেতরে ঢুকে ভালো টেবিল খুঁজল বসার জন্য।হঠাৎ কি মনে হতেই জেসমিনকে ‘আসছি’বলে দৌড়ে বাইরে বেরুল।
আলিফ আর স্বর্ণা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে।মেরাজের বুকের ভেতর হাতুড়ীর ঘা পড়ল।মেয়েটির দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি,চোখ সবকিছু স্বর্ণার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে আজ মেরাজকে।মুখ নিচু করে ভাবতে ভাবতে সামনে তাকিয়ে দেখল ওরা নেই।চলে গেছে।
মেরাজ ফিরে গেল চাইনীজে।কিন্তু অনেক বড় একটা চিন্তা ওর সামনে প্রশ্ন হয়ে দেখা দিলো!আলিফের বউকে ওর এতো চেনা মনে হলো কেন?কে সে?
……
…
এক অদ্ভুত তাড়না কাজ করছে মেরাজের মধ্যে।তার মন বলছে ওই মেয়েটাকে সে চেনে।কিন্তু কিভাবে সম্ভব?নানান ভাবনায় মনটা আচ্ছন্ন হয়ে আছে।পরদিন সকালে বারান্দায় অনেকখন পায়চারী করলো একবার না একবার তো দেখা যাবেই মেয়েটিকে।না দেখা পর্যন্ত মেরাজের মন শান্ত হবেনা।জানতে হবে কে ঐ মেয়ে?
….
সেদিন…তারপরদিন….তারপরদিন…প্রতিদিন যতক্ষণ বাসায় থাকে মেরাজের নজর থাকে বারান্দায়।কিন্তু গত সাতদিনে একবারের জন্যেও মেয়েটি বারান্দায় আসেনি।আলিফ আসে,বসে বই পড়ে।বুয়া আসে কিন্তু মেয়েটা আসেনা।
অবশেষে একদিন ধরা পড়লো সে মেরাজের চোখে।মেরাজের মনে হলো ও শ্বাস নিতে ভুলে গেছে।মেয়েটি চারপাশে হালকা চোখ বুলিয়ে বারান্দির গেটে দাঁড়িয়েই নিজের ভেজা চুলগুলো টাওয়েল দিয়ে হালকা কয়েক চাপড় দিলো।
মেরাজের বিস্মিত চোখের সামনে টাওয়েল মেলে দিয়ে সরে যাবার আগেই মেরাজ বারান্দায় বেরিয়ে এলো।স্বর্ণা নিজের জায়গাতেই জমে গেল।মনে হলো ওর পা দুটো কেউ স্ক্রু দিয়ে মাটির সাথে গেঁথে দিয়েছে।মেরাজের চোখে বিস্ময় না বেদনা তা বোঝা গেলোনা।
…
চলবে….
#সোনাবউঃ
৬ষ্ঠ পর্বঃ
মোর্শেদা খাতুনঃ
**************
সম্বিত ফিরে পেতেই স্বর্ণা দ্রুত ঘুরে ঘরের দিকে যেতে নিলো কিন্তু ওর বেগতিক নড়াচড়ায় পা স্লিপ করে গেলো,দ্রুত হাত বাড়ীয়ে দেয়াল ধরতে পারলেও কপালটা ঠুকে গেল গ্রীলের সাথে।স্বর্ণা সাথে সাথেই কপালে হাত দিয়ে “উহ্..মা..” বলে বসে পড়ল।
মেরাজ অজান্তেই হাত বাড়াল যেন ওখান থেকেই স্বর্ণাকে ধরে তুলবে কিন্তু অক্ষম আক্রোশে গ্রীলের গায়ে ঘুষিটা বসালো।
….
“ঠং” শব্দ পেয়েই আলিফ দৌড়ে এলো।স্বর্ণাকে মাটিতে হাঁটুগেড়ে বসে থাকতে দেখে দ্রুত ওকে ধরে কপাল তুলে দেখলো কপালটা ফুলে গেছে, সামান্য ফেটেও গেছে।আলিফ দ্রুত স্বর্ণাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে রুমে নিয়ে আসলো।মেরাজ অসহায়ের মত চেয়ে রইল।বেচারী ওর জন্যই তো ব্যথাটা পেলো!
..
হঠাৎ পেছনের একটি দিনের কথা মনে পড়ল….”বিয়ের পরপর একদিন স্বর্ণা আঙ্গুল কেটে ফেলেছিলো,আর তা থেকে রক্ত ঝরছিলো।মেরাজ তা দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলে স্বর্ণাই বলেছিলো,সিনেমার নায়করা তো নায়িকাদের হাত কাটলে মুখে নিয়ে নেয়,আপনিও চাইলে তেমন করতে পারেন”বলে স্বর্ণা নিজের আঙ্গুলটা ওর মুখের সামনে ধরেছিলো।মেরাজ হাত দিয়ে ওর হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলেছিল,ন্যাকামী আমার একদম পছন্দ না!”
সেসব দিনের কথা মনে পড়ে আজ প্রথম বারের মত মেরাজের মনে হলো সে স্বর্ণাকে আসলে কষ্ট দিয়েছে।বিষন্নমনে ঘরে ঢুকে দেখলো জেসমিন ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে।ওকে দেখে সে বাইরে চলে গেল।মেরাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর কথা শেষ হবার অপেক্ষা করতে লাগলো।কিন্তু জেসমিন বারান্দারর দোলনায় বসে কথা বলছে দুনিয়া ভুলে গিয়ে। ঘন্টাখানেক পর মেরাজ বারান্দায় উঁকি দিয়ে বলল-“কি ব্যপার..তোমার কথা শেষ হবেনা?আমি বাইরে যাবো!”
জেসমিন ফোনটা চেপে ধরে বলল-“বাইরে যাবে যাও,তোমাকে আটকে রেখেছি নাকি..ঢং..!”বলে আবার কথা বলতে শুরু করলে মেরাজ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে এগিয়ে গিয়ে সোজা জেসমিনের কান থেকে মোবাইলটা টেনে নিয়ে দেয়ালে ছুঁড়ে মারল।জেসমিন হতভম্ব হয়ে বলল-“এটা কি করলা তুমি?”
-“আমার চে বেশী ইমপরটেন্ট কি তোমার ফোন?”
জেসমিন অক্ষম আক্রোশে চেঁচিয়ে উঠল-“এ্যাই..কুত্তা..আমি কি তোর বান্দী দাসী নাকি যে যখন আঙ্গুল নাচাবি দৌড়ে আসবো?তুই আমার ফোন কিনা দিবি,আজই…এক্ষুনি..!”
-“তোর ফোনের আমি নিকুচি করি!”
-“আর আমি তোর নিকুচি করি!”সমান তেজে জবাব দিলো জেসমিন।তার একটু পর মেরাজ গাড়ী নিয়ে একদিকে আর জেসমিন আরেক গাড়ী নিয়ে আরেক দিকে চলে গেল।
….
…..
কপালটা টনটন করে ব্যথা করছে।আলিফ প্রায় ঘন্টাখানেক বরফ ধরে রেখেছে বলে ফোলাটা অনেক কমে এসেছে।আলিফ ফার্ষ্ট এইড বক্স এনে ওর কপালে ব্যান্ডেজ করে দিলো। তারপর নিজে গিয়ে ফ্রিজ থেকে দুধ এনে স্বর্ণাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিল।স্বর্ণা বারবার আপত্তি করছিলো,আপনি তো আমাকে পুরোদস্তুর রুগী বানিয়ে ফেলবেন,দেখছি।আমি এখন ঠিক আছি!”বলে বিছানা থেকে নামতে গেলে আলিফ ওকে ধরে বিছানায় ফের শুইয়ে দিয়ে বলল-“চুপ করে শুয়ে রেষ্ট নাও।উঠলে খবর আছে!”
-“এভাবে শুয়ে থাকতে বোর লাগে তো!”
-“তাই..? দাঁড়াও আমিও এসে পাশে শোবো তাহলে…আর বোর লাগবেনা..কি আসবো..?”
স্বর্ণা কড়া চোখে তাকিয়ে ঝট করে পাশ ফিরে শুলো।আলিফ হেসে বারান্দায় চলে গেলো!
….
রাতে কপালের ব্যথাটা কমে এলে স্বর্ণা উঠে রান্নাঘরে এলো।ও জানে আলিফ রাতে একবার চা খায়।চা বানিয়ে আলিফের টেবিলে রাখতেই ও মুখ তুলে তাকালো-“তুমি আবার এতো রাতে চা করতে গেলে কেন?”
-“সমস্যা নেই..খান।”
-“চলো বারান্দায় গিয়ে বসে চা টা খাই..আজ খুব সুন্দর জোৎস্না,চলো যাবে?”
স্বর্ণা খানিকটা ভেবে বলল-“চলুন যাই!”
বারান্দায় এসেই স্বর্ণা চোরা চোখে সামনের বারান্দার দিকে তাকাল।নাহ্..অন্ধকার হয়ে আছে।স্বর্ণা এবার কিছুটা সহজ হয়ে বসল।আলিফ কয়েক চুমুক খেয়ে স্বর্ণাকে দিলো-“নাও,তুমিও খাও,ভালো লাগবে।স্বর্ণা হাত বাড়িয়ে কাপটা নিয়ে তাতে চুমুক দিলো।আলিফ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল-“আজকের চাঁদটা অন্যান্য দিনের চে বেশী সুন্দর লাগছে!’
-“তাই..! কিন্তু কেন?”স্বর্ণা প্রশ্ন করল!
আলিফ ওর দিকে তাকিয়ে বলল-” কারন আজ যে তুমি আমার পাশে আছো, এজন্য..!”
স্বর্ণা মুখ টিপে হাসলো।
আলিফ ওর হাত ধরে ওকে পাশে বসিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখল-“আচ্ছা..তোমাকে একটা প্রশ্ন করি দেখিতো উত্তর দিতে পারো কিনা!”
স্বর্ণা হাসিমুখে তাকালে,আলিফ ওর কানে কানে কথাটা বলতেই স্বর্ণা ওকে কিল মারা শুরু করল।
আলিফ প্রথমে কাত হয়ে কিলগুলো পিঠে সয়ে নিচ্ছিল পরে হঠাৎ স্বর্ণাকে টেনে জড়িয়ে ধরতে গেলে স্বর্ণা লাফ দিয়ে উঠে গেলো।আলিফ খপ করে ওর ওড়না ধরে উঠে স্বর্ণাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে থুতনী রেখে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কিছু বলতে লাগল আর তা শুনে স্বর্ণা দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলল তারপর হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে আলিফের বুকে মুখ লুকালো!
..
আলিফ আর স্বর্ণা যেভাবে দাঁড়িয়ে আছে তাতে মনে হচ্ছিল ওরা দুজন না একজন।ওরা কি বলছে তা সবটা স্পষ্ট না হলেও ওদের দেখতে কোন সমস্যা হচ্ছেনা।তবে ওরা এদিকটা দেখেনি,নইলে একটু খেয়াল করলেই দেখতে পেতো অন্ধকারে একটা জ্বলন্ত আগুন কিছুক্ষণ পরপর উঠানামা করছে,যার অর্থ হলো কেউ ওখানে একজন সিগারেট খাচ্ছে!
…….
…..
….
পরদিন সকালে মেরাজের ঘুম থেকে উঠতে লেট হয়ে গেলো।জেসমিনকে বলে লাভ নেই কারন গত দুদিন ধরে সে কথা বলছেনা,তারপরেও মেরাজ নিজেই বলল-“তাড়াতাড়ি নাস্তা দাও…বেরিয়ে যাবো…এমনিতেই দেরী হয়ে গেছে।
জেসমিন লেপের তলা থেকেই উত্তর দিলো-“আমি উঠতে পারবোনা,ময়নার মা’কে বলো গে!”
মেরাজ কিছুক্ষণ কড়া চোখে তাকিয়ে থাকল।
মনে পড়ে গেলো পুরোনো দিনের কথা..”স্বর্ণাকে কোনদিনও মেরাজ ওঠার পরেও শুয়ে থাকতে দেখেনি বরং নাস্তা তৈরী করে সে মেরাজকে ডাকতে আসতো,এর জন্য কখনো বকাও খেতে হতো ওকে!”দীর্ঘশ্বাস ফেলে নামতে গিয়ে মনের ভেতর কেউ যেন আচমকা বলে উঠল ওকে -‘তুমি নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছো।”
…
বিছানা থেকে নামতে গিয়ে মনে হলো শীতটা আজকে বেশীই।তাছাড়া কাজ না থাকলে সাধারনত মেরাজ এতো সকালে উঠেনা।বাথরুমে যাবার সময় অভ্যাসবশতঃ পর্দা সরিয়ে ঐ বারান্দায় উঁকি দিল।নিজের জায়গাতেই স্থির হয়ে গেলো।ওড়না পেঁচিয়ে গায়ে শাল জড়িয়ে স্বর্ণা বসে আছে।কোলে একটা প্লেট তাতে সম্ভবত পিঠা।সে ছোট ছোট করে ভেঙ্গে আলিফের মুখে দিচ্ছে।আর আলিফ রাজা বাদশাহর মত বই পড়তে পড়তে সেই পিঠা খাচ্ছে।
মেরাজের সর্বাঙ্গে যেন কেউ বিছুটি পাতার রস মাখিয়ে দিয়েছে।সে পর্দার আড়াল থেকে লোভীর মত সে দৃশ্য দেখছে,হঠাৎ স্বর্ণা “উউ” করে উঠলে আলিফ বই ফেলে ওর হাত আঁকড়ে ধরল।মনে হয় কামড় লেগে থাকতে পারে।তারপরের দৃশ্যগুলো মেরাজ আর দেখতে পারলোনা।এই কদিনেই ওদের মাঝে এতো ভালোবাসা জন্ম নিলো কি করে,দেখে মনে হয় যেন জন্ম জন্মান্তরের বন্ধুত্ব।
চোখ বন্ধ করে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে অক্ষম আক্রোশে মনে মনে ফুঁসতে লাগল।
….
…
আলিফের মুখ থেকে টান মেরে নিজের আঙ্গুল ছাড়িয়ে নিলো স্বর্ণা-“সেভেন আপ খাচ্ছেন নাকি?”
-“তার চেয়েও মজা!” বলে আলিফ স্বর্ণাকে নিজের কোলে টেনে নিলে স্বর্ণা চারিদিকে তাকিয়ে বলল-“আরে..লোকে দেখলে কি বলবে?”
-“এতো ভোরে লোক কোথায়? তাছাড়া আমাদের আশেপাশে তো ঐ দুটো বিল্ডিং ছাড়া আর কোনো বিল্ডিংও নেই।বসো তো!”
স্বর্ণা বসলে আলিফ ওর হাত টেনে বলল-“বেশী লেগেছে? স্যরি…খেয়াল করিনি..!”
স্বর্ণা মাথা নাড়ল-“না..বেশী লাগেনি!”
-“কি শীত পড়েছে দেখেছো?”
স্বর্ণা শালটাকে আরো ভালোভাবে গায়ে পেঁচিয়ে বলল-“হুঁ…!”
-“তোমার শালটা খোলো!”
-“কেন?”স্বর্ণা অবাক হলো।আলিফ দুহাত ঘষে বলল-“দাওনা…দুজনে শেয়ার করে নেবো!”
-“ইস্..সরেন এখান থেকে!”
-“কি?”আলিফ আহত স্বরে বলল!
-“বসেন,আরেকটা শাল এনে দিচ্ছি!”
-“লাগবেনা…..যাও!”
বলে আলিফ অন্য দিকে তাকিয়ে বসে রইল।স্বর্ণা চারপাশ দেখল,সামনের বারান্দা দেখল।সে ভালো করেই জানে মেরাজ এতো ভোরে জীবনেও উঠবেনা।
তারপর লাজুক মুখে আলিফের পাশে বসে নিজের শালটা খুলে তাতে আলিফকেও জড়িয়ে নিল।
আলিফ স্বর্ণার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল-“কুরআনের ঐ আয়াতটা মনে পড়ছে,স্বামী আর স্ত্রী একে অন্যের লিবাস।তুমি আমার পোষাক আর আমি তোমার পোষাক…আর এই শীতে পোষাক না হলে বাঁচি কি করে বলো তো”!
স্বর্ণা মৃদু হেসে বলল-“হমম!”
ভালোবাসার উষ্ণতায় দুজনই বুঁদ হয়ে রইল।
….
আর ওদিকে হিম হিম ঠান্ডায় উষ্ণতার অভাবে আরেকজন কাতরাতে লাগল।দেয়ালে কপাল ঠেকিয়ে তাতে হাত মুঠো করে ঘুষি বসাতে লাগল।
……
…..
আজ জামিলের বাসায় গেট টুগেদার পার্টি রাখা হয়েছে।মেরাজ জেসমিনকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত।জেসমিন নিজেই মেরাজকে সেদিন স্যরি বলে ওকে রাজী করিয়ে পার্টিতে নিয়ে এসেছে।কেন যেন আজ বন্ধুদের হৈ হুল্লোড়ে মন বসাতে পারছেনা মেরাজ।চোখের সামনে ভোরবেলা দেখা বারান্দার দৃশ্যটা চোখে ভাসছে।
আলিফের কোল ঘেষে এক শালের নিচে বসে থাকা স্বর্ণার চেহারাটা সুখী কবুতরীর মত লাগছিল! আর সেই দৃশ্যটা মেরাজের বুকের বামপাশে চিনচিন করে ব্যথা দিতে লাগলো !
….
ঘোরে ঘোরে কয় পেগ গিলেছে তা মেরাজ বলতে পারবেনা।মদের নেশায় চুর হয়ে মাথা তুলতে পারছেনা সে।চোখের সামনে কেবল স্বর্ণা,বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন ঢঙে ওকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে।টলতে টলতে কোনোরকম বেসিনের নিচে এসে মাথা ঝুকিয়ে কল ছেড়ে দিলো।খানিক পানি ঢালার পর অনেকটা সহজ বোধ হতে থাকল।দুহাতে চুল গুলো পেছনে ঠেলে ভাবল বাসায় চলে যাওয়া দরকার।জেসমিনকে খুঁজল।সে এই ফ্লোরে নেই।কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করতে একজন হাত দিয়ে দোতলা দেখিয়ে দিল।সামান্য টলে উঠে গ্রীল ধরে দোতলায় উঠে দরোজাটা ধাক্কা দিতেই তা দরাম করে খুলে গেলো।মেরাজের মনে হলো সে ভুল দেখছে।
ওকে দেখে জেসমিন দ্রুত উঠে দাঁড়াল।জামিলও সংকোচ নিয়ে পাশ ঘেষে বেরিয়ে গেল।জেসমিন মেরাজকে দেখে ফাঁকা হাসি হেসে ওকে ধরতে আসলে মেরাজ নিজের অজান্তেই প্রচন্ড জোরে এক চড় কষালো যে তাতে জেসমিন ছিটকে পড়ল।
..
…..
…….
আজকাল ভোরে ঘুম ভাঙ্গার একটা অভ্যাস তৈরী হয়ে গেছে।আর ঘুম ভাঙলেই জানালার পর্দা সরিয়ে ঐ বাড়ীর বারান্দাটা একনজর দেখে নেয়াটাও অভ্যাসে পরিণত হয়েছে মেরাজের।
আজ মাথাটা তুলতে গিয়ে একটু ভার বোধ হতে লাগল।মনে পড়ল গত রাতের কথা।জামিলের সঙ্গে একটা তুলকালাম বেঁধে গিয়েছিল।জেসমিনকে ফেলেই চলে এসেছে মেরাজ।দুহাতের কনুই হাটুতে ভর দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে ভাবল-“নাহ্..আর না..এ জীবনে ভুলের বোঝা বড় বেশী ভারী হয়ে গেছে।এটা আরো বড় করতে চায়না মেরাজ।স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে।আজই জেসমিনকে ডিভোর্সের কাগজপত্র পাঠিয়ে দেবে।ওকে গলাটিপে মেরে ফেলতে পারলে বেশী খুশি হতো মেরাজ।চোখ পড়লো বেড সাইড টেবিলে ওর আর জেসমিনের বিয়ের ছবির দিকে।প্রচন্ড রাগে ভেতরটা ফুঁসে উঠল।হাতের কাছের পেপার ওয়েটটা ছুড়ে মেরে ছবিটা চুরমার করে হিসহিস করে বলল-“তোর জন্য আজ আমি আমার সোনার বঊটাকে হারিয়েছি।তোর জন্য….বজ্জাত মহিলা!”
মেরাজের দুচোখে লোনাজল।বিড়বিড় করে বলতে লাগল-“আমাকে মাফ করো স্বর্ণা!প্লিজ…আমাকে মাফ করো…বলে ডুকরে কেঁদে উঠল মেরাজ।
…..
….
দুবার নামতে গিয়েও বেরোতে পারেনি স্বর্ণা।আলিফ ওকে আটকে ফেলছে-“আরে….এতো যাবার জন্য অস্থির কেন!আমি নাস্তা পরে খাবো,চুপ করে শুয়ে থাকোতো!এই শীতে কেউ এতো সকালে উঠেনা!”
-“আপনার যতক্ষন মন চায় লেপমুড়ি দিয়ে পড়ে থাকুন না কে মানা করেছে…আমার কাজ আছে না?”স্বর্ণা প্রতিবাদ জানালো।
-“মমম…না..কোনো কাজ নেই।”আলিফ বলল।
স্বর্ণা হঠাৎ আলিফের পিঠে জোরে চিমটি দিতেই লাফিয়ে উঠল-“আউফ্..!দেখি নখগুলা?”
-“আমার নখ নেই,দেখুন!”খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ল স্বর্ণা।
আলিফ ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল-“চিমটি দিলে কেন?এর জন্য এবার শাস্তি পেতে হবে!”
স্বর্ণার হাসি বন্ধ হয়ে গেল।
…..
মেরাজ নাস্তা খেতে খেতে ময়নার মা’কে ডাকলো!ময়নার মা ত্রস্তে এসে দাঁড়ালো!-“জ্বী,ভাইজান!”
মেরাজ মানিব্যাগ থেকে একটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে তার হাতে দিলে ময়নার মা চোখ গোল করে বলল-“এইডা কিসের ট্যাকা ভাইজান?”
মেরাজ বলল-“ময়নার মা, তুমি এ বাড়ীতে কাজ করছো কত বছর হলো?”
-“তা তো বাইজান পিরায় পিরায় সাত বচ্ছর হইবো।কেন বাইজান?”
-“তোমাকে তাহলে বিশ্বাস করতে পারি?”
-“একশ বার বাইজান,কেন করবেন না?”
-“তাহলে শোনো,তুমি কি জানো তোমার আগের ভাবী যে রাস্তার ঐ পারের বাড়ীটাতে থাকে?”
ময়নার মা কাচুমাচু মুখ করে বলল-“হ্….জানি তো!”
মেরাজ একটা ছোট্ট খাম ওর হাতে দিয়ে বলল-“এটা লুকিয়ে তোমার ঐ ভাবীর হাতে দিবে,কিভাবে দিবে তা তুমি জানো,শর্ত একটাই কেউ যেন না জানে..! মনে থাকবে?”
-“ক্..কিন্তু…বাইজা..ন!”
-“পাঁচশ আপাতত রাখো,চিঠি পৌঁছাতে পারলে আরো একহাজার পাবে।এখন বলো কাজটা পারবে? না পারলে বলো লোক আছে!”
-“না..না..বাইজান..এইটা কুনু কাম,আমি আইজকাই দিয়া আমু..কাকপক্কীও ট্যার ফাইবোনা…!”
-“গুড..!” বলে মেরাজ পানি খেয়ে উঠে অফিসে চলে গেল।
….
চলবে