সোনালী রোদ্দুর,পর্ব_৪শেষ

0
4083

সোনালী রোদ্দুর,পর্ব_৪ শেষ
ফারজানা আফরোজ

তারিন এসে স্পর্শীর মাথায় হাত রাখতেই স্পর্শী তখন তারিনের দিকে তাকিয়ে তারিনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।

” আমার আব্বু আম্মু আমাকে আজ মেরেই ফেলবে। কিভাবে মুখ দেখাবো উনাদের? কিই বা বলব আমি।”

নিশীতা এসে বলল,

” তোমার কিছুই করতে হবে না যা করার আবেগ নিজেই করবে তাছাড়া সবকিছু ও আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে।”

স্পর্শী অবাক হয়ে বলল,

” মানে?”

আবেগ কোকের বোতল হাতে নিয়ে বলল,

” সকাল হোক বুঝবে পারবে।”

__________________

স্পর্শীর বাসার সামনে এসে দাঁড়ালো গাড়ি। আবেগ আগে নেমে স্পর্শীকে বলল নামার জন্য। স্পর্শী আজ নিজের বাসায় যেতে বড্ড ভয় করছে তার তবুও ভয়ে ভয়ে বাসার ভিতরে যেতেই সে চমকে উঠলো। আজ তাদের বাড়িটা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। স্পর্শী অবাক হয়ে আবেগকে জিজ্ঞাসা করলো,

” ভাইয়া আমাদের বাসা মনে হয় এইটা না। কজ এখন আমার পরিবার আমার জন্য কান্না করা উচিৎ কিন্তু এইখানে তো মনে হচ্ছে অনুষ্ঠান হবে। এইটা আমার বাসা কিছুতেই হতে পারে না।”

আবেগ হেসে দিয়ে বলল,

” বিয়ের পর মনে হয় তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। নিজের বাসা পর্যন্ত চিনতে পারছো না।”

স্পর্শী এদিক ওদিক তাকিয়ে ভাবতে লাগলো হচ্ছেটা কি? বাসা তো তাদের তাহলে এইভাবে সাজানো হলো কেন? সব কিছুর জানার জন্য নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো সে। রুমে ঢুকেই মাকে দেখতে পেয়ে সন্দিহান নজরে বলে উঠলো,

” আম্মু এইসব কি হচ্ছে?”

” তোমার বিয়ে আজ। তুমি তো চাইতেই পড়ালেখা বাদ দিয়ে বিয়ে করে সংসার করতে সেইজন্যই আজ তোমাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”

” পাত্রকে চিনলাম না জানলাম না আর তোমরা বিয়ে দিয়ে দিচ্ছ মানি না এই বিয়ে।”

” ন্যাকা। নিজে নিজে প্রেম করবে এখন বলছে সে নাকি পাত্রকে চিনে না জানে না। ভাগ্যিস আবেগের সবকিছু বলেছে যদি কিছু না বলতো তাহলে তো তোর চিন্তায় আমরা এতক্ষণে মরে যেতাম।”

” কি বলেছেন উনি?”

” তুই আর আবেগ একজন আরেকজনকে ভালোবাসিস। তোরা তো গতকাল পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলি এইজন্যেই তো সম্মান থাকতে থাকতে বিয়েটা দিয়ে দিচ্ছি। তাছাড়া ছেলেটা ভীষণ ভালো। ছেলের পরিবারও খুব ভালো।”

খাটের উপরে শাড়ি রেখে চলে গেলেন স্পর্শীর মা। স্পর্শী বসে বসে ভাবছে এইসবের পিছনে যে দায়ী সে হলো আবেগ। আজগুবি মিথ্যা কথাগুলো সে ছাড়া আর কেউ ছড়াবে না। হঠাৎ ফোন বেজে উঠায় রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আবেগ বলে উঠলো,

” সারপ্রাইজটা কেমন লেগেছে তোমার? আসলে প্ল্যানটা আমারই ছিলো। এত চিন্তা না করে যাও গায়ে হলুদ হবে একটু পর। ইসলামে বলা হয়েছে, পরিবারের অনুমতি ছাড়া বিয়ে হয় না সেইজন্যই চাচ্ছি পরিবারের অনুমতি নিয়েই বিয়ে করবো। যাও রেডি হয়ে নিজের বিয়েতে আনন্দ উল্লাস করো।”

এক দমে কথাগুলো বলে ফোন কেটে দিলো আবেগ। স্পর্শী বুঝতে পারছে না আবেগেবের মনে কি চলছে। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কি ঘটা করে বিয়ে করার দরকার? মিথ্যা সম্পর্কে জড়িয়ে তাদের বিয়েটা হচ্ছে কিন্তু এইটা কি ঠিক? চিন্তা করতে করতে শাড়ি পরে রেডি হয়ে চলে গেলো হলুদে।

শরীর বড্ড ক্লান্ত স্পর্শীর । চোখটা যখনি লেগে আসবে তারেই মাঝে আবেগের ফোন। বিরক্তি নিয়ে ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে আবেগ বলে উঠল,

” ঘুমিয়ে পড়েছো নাকি আমার সোনালী রোদ্দুর।”

” সোনালী রোদ্দুর কে?”

” তুমি!”

“আমি?”

অবাক হলো স্পর্শী। মনে মনে ভাবছে পাগল তাগল হয়ে গেলো নাকি। মদ গাঁজা খেয়ে হয়তো ফোন দিয়েছে তাই মুখ কুঁচকে বলল,

” মদ খেয়েছেন?”

” তোমাকে খেয়েছি। পাজিল মেয়ে কোথাকার। রোমান্সের মাঝে ভুল কথার এন্ট্রি প্রবেশ করিয়ে মনটাই খারাপ করে দিলো। রাখছি বায়।”

রেগে ফোনটা কেটে দিলো আবেগ। স্পর্শী ভাবছে কি এমন বলল যার জন্য এত্ত রাগ। কাল অব্দি তো দেখতেও পারতো না তাকে।

_______________

পরের দিন ধুমধামে বিয়েটা হয়ে গেলো আবেগ আর স্পর্শীর। বাসর রাতে আবেগের রুমে বসে আছে স্পর্শী। ভয়ে তার শরীর ঠান্ডায় জমে আছে। আবেগ কি তাকে এখন মারবে? থাপ্পড়ের প্রতিশোধ কিভাবে নিবে সে? এইসব ভাবতে ভাবতেই আবেগ এসে হাজির। স্পর্শী আবেগকে সালাম দিয়ে আবারো বিছানায় বসে ফুঁফিয়ে কান্না করতে লাগলো।

” কান্না করার কি আছে আজব।”

” আপনি কি আমাকে খুন করবেন?”

” বিয়ে করা বউকে কেউ খুন করে তার উপর তুমি আমার একটা মাত্র বউ। খুন করলে আমি বউ পাবো কোথায়?”

” মজা করছেন কেন আমি কিন্তু সিরিয়াস। ”

” আরেহ গাঁধী তোমার মাথায় দেখছি আসলেই কিছু নেই। থাপ্পড়ের কারণে কেউ কাউকে বিয়ে করে? সিনেমাতে সম্ভব হলেও রিয়েল লাইফে এইগুলো সম্ভব নয়।”

” তাহলে কেন বিয়ে করেছেন? দুদিনে অবশ্য প্রেম ট্রেম হয়নি যে প্রেম করে বিয়ে করেছেন।”

ঘর কাঁপানো হাসি দিল আবেগ। ড্রয়ার থেকে একটা অ্যালবাম স্পর্শীর হাতে দিয়ে ইশারা করে বলল খুলে দেখতে। স্পর্শী অ্যালবাম খুলে যেনো নিজের চোখেই বিশ্বাস করতে পারছে না। আকাশী রঙের জামা গায়ে দিয়ে বিকালের রোদে, হাতে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। ছবির নিচে ক্যাপশন ও তারিখ দেখলো স্পর্শী,

~বন্ধুদের সাথে ঘুরাঘুরি করার সময় আকাশী রঙের জামা পরিহিতা মেয়েটির দিকে চোখ পড়ল। আকাশের সোনালী রোদ তখন মেয়েটির মুখকে আরো সোনালী করে তুলেছে। আমার চোখ যেন সেই সোনালী পরীর দিকেই আটকে আছে। ইশশ একবার যদি কাছে গিয়ে তার মুখটি স্পর্শ করতে পারতাম……~

দুই বছর আগের তারিখ দেওয়া। স্পর্শী অবাক হয়ে আবেগের দিকে তাকিয়ে রইলো। আবেগ আবারো ইশারা দিয়ে পরের ছবিগুলো দেখতে বলল,

পরের ছবিতে সাদা কালো স্কার্ট পড়েছে স্পর্শী। একদম দুপুরে হাতে আইস্ক্রিম নিয়ে হাঁটছে আর বিড়বিড় করছে। আইস্ক্রিম রোদের তাপে গলতে শুরু করেছে, বিরক্তি নিয়ে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে আর হাঁটছে। ছবিটির ক্যাপশন ছিলো,

~ইশ আজ যদি রোদ হতে পারতাম তাহলে আমিও তোমাকে ছুঁয়ে দিতাম। ভীষণ রাগ হচ্ছে সূর্য মামার উপরে কেন সে তোমাকে এইভাবে বিরক্ত করছে। আইস্ক্রিম পর্যন্ত শান্তিতে খেতে দিচ্ছে না। খুবই খারাপ! ~

এইভাবে দেখতে দেখতে সাতটি ছবি দেখা শেষ করলো স্পর্শী। সব ছবিতেই রয়েছে মনে দাগ কাটানো ক্যাপশন। ছবির থেকে ক্যাপশন যেন বেশি আকর্ষণীয়। নীল শাড়ি পড়া ছবিটার দিকে চোখ পড়তেই হেসে দিলো স্পর্শী, কারণ ছবিটির ক্যাপশন ছিলো,

” এই যে মিস সোনালী রোদ্দুর তোমাকে কিন্তু আমি কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবো। যখনি দেখা হয় তখনই কেন ওই সোনালী ছায়া তোমার উপরে পরে। তোমাকে একবার নিজের করে পাই দেখবে সারাদিন রুমের ভিতর আটকিয়ে রাখবো। রোদকে দেবো না স্পর্শ করতে বুঝেছো?”

আবেগ তখন মাথার চুল টেনে বলল,

” তখন অনেক ইমোশনাল হয়ে গেছিলাম তাই আর কি এইসব লিখেছি।”

লাস্ট ছবিটি হলো যেদিন কলেজে ভর্তি পরীক্ষা ছিলো সেদিনকার। ক্যাপশন ছিলো,

” সাদা জামা পড়তে কে বলছে তোমাকে? আজ ভুল বুঝে আমার গায়ে পানি ঢেলে দিয়েছো কিন্তু ওই পানি আমি তোমার গায়ে দেইনি দিয়েছে রাজু। আর তুমি কিনা আমার সাথে পা বাজিয়ে ঝগড়া করেছো। তোমার সাথের ছেলেটির সাথে এত কথা কি হুম? জানো না আমার কষ্ট হয়।”

স্পর্শী তখন অনেক বড় শ্বাস ছেড়ে বলল,

” ওর নাম উল্লাস। ফ্রেন্ড ছিল আমার। আমাকে যেহেতু এতই ভালোবাসেন তাহলে কেন ময়লা পানি দিয়েছিলেন?”

” কিছুটা রাগ হয়েছিল তোমার উপর সেইজন্যই। আর যখন থাপ্পড় মারলে তখন তো ইচ্ছা করছিলো কাচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলি। শুধু ভালোবাসি বলে কিছু করতে পারিনি সেইজন্যই বিয়ে করে নিলাম। পরে ভাবলাম পরিবারের অমতে বিয়ে করলে সেই বিয়ে ইসলাম মানে না তাইতো তখন বুদ্ধি কাটিয়ে আম্মুকে বললাম, এই মেয়ের সাথে আমার সম্পর্ক। যদি আজকের ভিতর বিয়ে ঠিক না করো তাহলে পালিয়ে বিয়ে করবো। আম্মু আমায় ভীষণ ভালোবাসে সেইজন্য আব্বুকে রাজি করিয়ে তোমাদের বাসায় গিয়ে বিয়ে ঠিক করে আসে। এখন আমরা বৈধ স্বামী স্ত্রী।”

” আসুন সেহেতু আমরা বৈধ স্বামী স্ত্রী তাহলে একত্রে বসে নফল নামাজ পড়ি। আল্লাহ তায়ালা খুশি হবেন।”

দুইজন একত্রে নামাজে বসলো। আজ আবেগের এতদিনের মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা ভালোবাসা বৈধ সম্পর্কে আবদ্ধ হলো।

সমাপ্ত,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here