সোনালী [০৪]
সোনালী আবারও আশেপাশে কাউকে দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু সে ব্যর্থ হলো।
আড়াল থেকে কেন জানি রোজানের ইচ্ছে করছে সামনে আসতে । কিন্তু সে সোনালীর দৃষ্টিভঙ্গি ভালো করে বুঝার জন্য তা আর করলোনা ।
মনে মনে ভাবছে, সোনালী যদি চিঠিটা ফেলে দেয় তাহলে বুঝে নিবে এই মেয়ের থেকে পাত্তা আদায় করা খুব কষ্টকর। আর যদি চিঠিটা নিজের সাথে করে নিয়ে যায় তাহলে আশার আলো আছে!
এদিকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে রোজানের পায়ে লাল পিঁপড়া ইতোমধ্যে দুইটা কামড় বসিয়েছে। সে নিঃশব্দে সহ্য করে শুধু পা উঠানামা করছে, তবুও এখান থেকে নড়ছেনা, যেন এতে সোনালীকে দেখায় বিরাট ব্যঘাত ঘটে যাবে। সোনালী যতক্ষণ আছে এক পলকের জন্যও আড়াল হতে দেওয়া যাবেনা।
কয়েক মূহুর্তের মধ্যেই সোনালী গুটিগুটি পায়ে সোজা রাস্তায় না গিয়ে বামে মোড় নিলো। রোজান একটু একটু করে সরে তাকে লক্ষ্য করতে লাগলো। দেখলো সোনালী তার দুইরকম চিন্তাকে তুড়ি মেরে দিয়ে চিঠিটা একটা গাছের নিচে বালির নিচে চাপা দিচ্ছে।
চাপা দিয়ে সেখান থেকে উঠে আর পেছনে তাকালোনা, ভেজা পোশাকে হনহন করে তাদের বাড়ির ভেতরে চলে গেলো।
রোজান এবার নিচে বসে গেলো। বালির নিচে কেন রেখে গেলো? এমনও করতে পারতো সে পানিতে ফেলে দিতো কিংবা ছিঁড়ে ফেলতো। কিন্তু এভাবে কবর দিয়ে দেওয়ার কি প্রয়োজন ছিল?
এরই মধ্যে রোজান হাঁটুতে ভর করে উঠে দাঁড়ালো শামিম আর জসিম কি করে দেখার জন্য। সে উঠে দাঁড়াতেই শুনলো তার ডানদিক থেকে পাতার মড়মড়ে আওয়াজ আসছে! রোজান হতবিহ্বল হয়ে ভেতরে প্রবেশ করেই দেখলো শামিম আর জসিম পুরো দমে আলাপ আলোচনা করেই চলেছে। শামিম তার মায়া’র গল্প শুনাচ্ছে, তাদের কীভাবে প্রেম হলো, কতটা ভালোবাসে ইত্যাদি। আর জসিম নিজের অবিবাহিত একাকী জীবনের পুরো ইতিহাস শামিমকে উজাড় করে বলছে।
রোজান সেখানে পা ফেলতেই ওরা বললো,
‘ আপনার কাজ শেষ?
রোজান মাথা নেড়ে বললো,
‘ হুম, তবে আমি এখানে কারোর আওয়াজ শুনেছি। আমাদের আশেপাশে আমরা ছাড়াও কেউ লুকিয়ে আছে।
রোজানের কথা শুনে জসিম হাসতে হাসতে বললো,
‘ কতো মানুষই থাকবার পারে বাপ। অহন কও তুমি যাইবা কহন?
রোজান তার কান খাঁড়া রেখেই জবাব দিলো,
‘ সোনালী এই পাড়ে একা আসে, এখানে যদি কেউ থেকে থাকে নিশ্চয়ই খারাপ মতলব। আমি এভাবে যেতে পারবোনা।
রোজানের কথা শুনে শামিম এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ স্যার আপনি ওই মেয়েটার জন্য এমন পাগল পাগল হয়ে গেছেন কেন? আমাদের বলুন তো আপনার ভেতরের খবরটা? কি বিপদে নিজে পড়তে যাচ্ছেন আর আমাদেরও ফেলতে চাচ্ছেন?
রোজান ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারা করলো, চুপ থাকতে। তারা তার চুপ হয়ে গেলো আর কান পাতলো। সত্যিই শুকনো পাতার উপরে কারো উপস্থিতি বুঝা যাচ্ছে, খুব কাছেই তার অস্তিত্ব হবে। সেও সাবধানে হাঁটছে এতে কোনো সন্দেহ নেই,তবুও আওয়াজ রোধ করতে পারছেনা।
এদিকে জসিম বন্দুক তাক করে বললো,
‘ চিতাবাঘ হইবো। আইয়ুক, একদম গুলি কইরা দিমু।
রোজান চিতাবাঘের কথা শুনে এবার হুঁশে এলো। সে যা ভাবছে তা হবে না, মনে হয় কোনো জন্তু জানোয়ারই আশেপাশে। এখন আরো ভয় লাগছে!
কাঁপা কাঁপা চোখে সে জসিমের দিকে তাকালো। জসিমও ভয় পাচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করতে চাচ্ছেনা।
তিনজনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে চোখ আওড়াচ্ছে। হঠাৎ পাতার মড়মড়ে আওয়াজটা তীব্র গতিতে বেড়ে উঠলো। মনে হচ্ছে পাতার উপরে দৌঁড়াচ্ছে। তারা দুজন বুকে হাত চোখ বন্ধ করে ফেললো, কিন্তু জসিম বন্দুক তাক করে আছে।
আর সেই আওয়াজটা ক্রমশ ছোট হতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই শব্দটা পুরোপুরি থেমে গেলো।
নাহ এখন আর শোনা যাচ্ছেনা।
রোজান বড় একটা নিঃশ্বাস নিলো।
শামিম রোজানের হাত ধরে বললো,
‘ জলদি চলেন স্যার। জান থাকতে পালাই।
রোজান কি ভেবে যেন বললো,
‘ আচ্ছা চলো আজকে।
শামিম রাগের সাথে বললো,
‘ আর আসতে বলবেন না প্লিজ।
তখনি রোজান শুনলো পেছনে একটা ঢিল ছোঁড়ার আওয়াজ। সে ওদেরকে রেখে এক দৌঁড়ে চলে গেলো। শামিম মাথায় দিয়ে বললো,
‘ স্যার আপনি মরে গেলে কিন্তু সবাই আমাকে ফাঁসিয়ে দিবে। প্লিজ বুঝার চেষ্টা করুন।
কে শুনে কার কথা। রোজান যেই ভাবনায় এসেছে ঠিক তাই হলো। সে যে পাথরটায় কাগজ মুড়িয়ে ওইপাড়ে ছুঁড়েছিলো সেটাই সোনালী এখানে নিক্ষেপ করে চলে যাচ্ছে। একবারও পেছনে তাকাচ্ছেনা, সোনালীর পরনের লাল ওড়নার একটা অংশ বাতাসে দুলছে, সাথে তার অবয়ব অদৃশ্য হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সোনালী চলে গেলো।
রোজান পাথর থেকে কাগজটা খুলে দেখলো, সোনালী লিখেছে…
‘ কাল যেভাবেই পারেন এই পাড়ে আসবেন। বাবা সকালে মধু সংগ্রহের কাজে বের হবে, হতে পারে সারাদিন নাও আসতে পারে। আমি আপনার সাথে সামনাসামনি কথা বলতে চাই। ‘
এটা দেখেই রোজান খুশিতে হুহাহাহাহা বলে লাফিয়ে উঠলো। তার এই আওয়াজ শুনে শামিম আর জসিম অবাক হয়ে উঁকি দিয়ে বললো,
‘ কি হয়েছে? পাগল টাগল হয়ে গেলেন?
রোজান দৌঁড়ে তাদের কাছে এসে বললো,
‘ কাল আমি ওইপাড়ে যাবো। মৌয়াল হাবিল যাবে মধু সংগ্রহ করতে। সোনালী নিজে আমাকে লিখেছে।
জসিম একটু অবাক হয়ে বললো,
‘ সোনালী পড়ালেখা জানলো কেমনে? হেইদিকে তো ইশকুল নাই।
রোজান জসিমের কথাকে ঘুনাক্ষরেও পরোয়া করলোনা। পড়ালেখা জানার কতো অপশনই তো থাকে। হতে পারে সোনালীর মা বাবা কেউ শিক্ষিত, তারা নিজেরাই হাতেখড়ি দিয়েছেন!
তারা কথা না বাড়িয়ে ফিরে গেলো। রোজান আগেরদিনের মতো আবার জসিমকে একটা চেক ধরিয়ে দিলো। আর বলে গেলো ওইপাড়ে যাওয়ার জন্য আজকের মধ্যে যেভাবেই হোক উপায় বের করতে, তাহলে তাকে আরো উপহার দিবে।
‘
পরেরদিন আবার শামিমকে নিয়ে রোজান যথারীতি জসিমের বাড়ির সামনে হাজির। দেখলো জসিমের বাড়ির সামনে কয়েকটা কলাগাছ দিয়ে কি যেন একটা বানিয়ে রেখেছে। জসিমকে ডাকতেই সে বের হয়ে বললো,
‘ এই দেহো উপায়। এইটা দিয়াও পানিতে নওকার মতো ভাইসা যাওয়া যায়।
রোজান অবাক বললো,
‘ এটা ডুবে গেলে? আর আমি তো নৌকা চালাতে জানিনা।
জসিম শামিমকে নিয়ে এটাকে উঠাতে উঠাতে বললো,
‘ সেইটা তুমি উইঠাই শিখকা নিবা। আমরারে তো আর ওই মাইয়ার সাথে দেখা করাইতে নিতানা, নাইলে জানি আমিই চালাইতাম।
রোজান মাথা নাড়লো। আর তারা এটা নিয়ে রওয়ানা দিলো। একবার একজন ধরে, আরেকজন খালি হেঁটে বিশ্রাম নেয়, এভাবে বহু কষ্টে এটা নিয়ে পৌঁছালো। সমস্যাটা হলো ওইখানে কোনো কলাগাছ নেই, থাকলে অবশ্য এমন কষ্ট করা লাগতোনা।
অতঃপর শামিম আর জসিম সেটাকে পানিতে নামালো, আর রোজানকে একটা লম্বা বাঁশ বৈঠা হিসেবে দিয়ে ছেড়ে দিলো। প্রথমবারের মতো রোজান মাঝি হওয়ার কষ্ট উপলব্ধি করলো।
সে কোনোভাবেই ঠিকঠাক যেতে পারছিলোনা। শুধু হেলছিলো, দুলছিলো!
চোখের দেখা অল্প জায়গাটা পার হতে প্রায় ২০ মিনিট লাগলো।
তারপর পৌঁছে রোজান ওইপাড় থেকে হাত নাড়িয়ে জসিম আর শামিমকে নৌকা বিজয়ের অভিবাদন জানালো,আর তাদেরকে ভেতরে কোথাও বসতে বললো।
‘
এখন রোজান অপেক্ষা করছে কবে আসবে সোনালী। আজকে সে কাছ দেখলে দেখবে সোনালীর সোনালী চুল, নীল চোখ, রক্তবর্ণ ঠোঁটের হাসি, আর শুনবে তার মুখের কথা। এমন মোহিত সুন্দরীকে দেখে সে স্থির থাকতে পারবে তো?
বহু ভাবনায় এসে শুধু পায়চারী করছে, আর দেখছে এপার থেকে ওপারটা কেমন দেখা যায়।
এরই মধ্যে তার অপেক্ষার অবসান হলো!
পেছন থেকে হুট করেই মৃদু কণ্ঠে আওয়াজ আসলো,
‘ মিস্টার তাসফিক রোজান! অনেক্ষণ হলো নাকি এসেছেন যে?
রোজান চমকে উঠলো। সোনালী তার নাম জানে কি করে? সে ফিরে তাকাতে সাহস পাচ্ছেনা! পেছনে সোনালী দাঁড়িয়ে আছে তো?
কিন্তু তার নিশ্চুপ থাকার ভেতরে সেই কণ্ঠে আবার আওয়াজ আসলো, সে বলছে..
‘ আমাকে একজন কোটিপতি ভীনদেশী মহিলার হাতে তুলে দিতেই এতো সংগ্রাম তাইনা? কিন্তু আমি যে মুসলিম পরিবারে বেড়ে উঠে একটা খ্রিষ্টান মহিলাকে মা মানতে পারবোনা জবাব!
রোজান আরো চমকে উঠলো। সোনালী তাহলে সবই জানে! কে জানালো তাকে? এটা ভাবতে ভাবতেই সে ধিরে ধিরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো।
চলবে……
লেখাঃ তাজরীন_খন্দকার