সোনালী [০৫]
প্রথমবারের মতো রোজান তার স্বপ্নের সোনালীকে কাছ থেকে দেখলো। তাও সম্পূর্ণ নয়, সোনালী ওড়নাটা নাক পর্যন্ত টেনে হিজাবের মতো পেঁচিয়ে রেখেছে । শুধু তার নীল চোখগুলো দেখা যাচ্ছে।
ভ্রুর রঙগুলোও কালো নয়, চুলের মতোই সোনালী। তবে সেটাও বেশ আকর্ষণীয়! সত্যি তার নামটা সোনালী দেওয়ার পেছনে যৌক্তিকতা আছে। এই নাম তার জন্য সার্থক!
এদিকে রোজান কিছু বলতে গিয়ে তোতলাচ্ছে। তার বুক অদ্ভুত শিহরণে বারবার কেঁপে ওঠছে। তার পেছনে একটা দুইটা নয়,বহু কারণ! তার উপর সোনালী তার সম্পর্কে সবকিছু জানে।
সোনালী ওড়নাটা যতটা সম্ভব হাত দিয়ে আটকে রাখায় ব্যস্ত। রোজানকে চুপ থাকতে দেখে সে আবারো বললো,
‘ শুনেন,আপনি এখানে থাকলে বাঁচবেন না, আমার বাবা আপনাকে মেরে ফেলবে! আমাকে কেউ নিয়ে যাওয়া তো দূরে থাক, আশেপাশে আসলেও বাবা তার অস্তিত্ব রাখবেনা। একটা কথা মাথায় রাখবেন আমাকে রক্ষা করতে বাবা দুনিয়ার সবকিছু করতে পারে!
রোজান জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজালো, গলাও শুকিয়ে আসছে তার! তবুও এসব এড়িয়ে বললো,
‘ আমাকে তু তুমি কি করে চিনো ?
এই প্রশ্ন শুনে সোনালী আওয়াজ করে হেসে উঠলো। রোজান মুগ্ধ হয়ে হাসির শব্দ শুনছে! ভেতরে ভেতরে সে পাগল হয়ে গেছে! তবে বুঝেনি হাসির পেছনে কি কারণ, সে যেন বুঝতেও চায়না। কিন্তু তার ইচ্ছে করছে এখনি সোনালীকে বলে দিবে, সে তাকে প্রচন্ডরকম ভালোবেসে ফেলেছে।
সোনালীকে রক্ষা করার দায়িত্ব সেও নিতে চায়!তাকে কোনো কিছুর বিনিময়েও ভীনদেশে যেতে দিবেনা, তার কাছেই যত্ন করে রেখে দিবে! খুব লুকিয়ে রেখে দিবে, যেমন তার বাবা নিজের মেয়েকে নিয়ে লোকালয় ছেড়ে নির্জনে আছে, ঠিক এমন একটা জায়গা সেও খুঁজে নিবে, যেকোনো মূল্যে!
কিন্তু বলতে পারলোনা।
এদিকে সোনালী গলা ঝেড়ে জবাব দিলো,
‘ এতটা অচেনা কেউ আমি সোনালীর সম্মুখে দাঁড়ানোর যোগ্যতা রাখেনা রোজান সাহেব! আমি আপনাকে খুব ভালো করেই চিনি, আর চিনি বলেই ডেকে সতর্ক করে দিচ্ছি যেন ওই খ্রিষ্টান মহিলাকে মা পরিচয় দিয়ে আমাকে নিতে না আসেন!
রোজান এবার প্রতিবাদী গলায় বললো,
‘ সোনালী মা’র কোনো ধর্ম হয়না। মা শুধুই মা, একজন মুসলিম মা যতটা কষ্টে সন্তানকে দুনিয়ার আলো দেখান, ভিন্ন ধর্মের মায়েরা ততটাই কষ্ট করে, আর সন্তানের জন্য ততটাই ভালোবাসা পুষেন।
ধর্ম তো কাউকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায়না, তুমি যা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করো, তুমি তাই মানবে। দিয়ালী ম্যামও তো তার সন্তানকে শুধু সন্তান হিসেবে দেখতে চান, আর কিছুতে নয়।
সোনালী ধমকে বলে উঠলো,
‘ চুপ করুন! আমার মা জাহানারা খাতুন, আমার বাবা হাবিল রহমান। এটাই সত্য! এখন দুনিয়া আমার পায়ের কাছে কোটি প্রমাণ নিয়েও যদি চিৎকার করে আমি তাদের আসল সন্তান নয় আমি অন্য কারো সন্তান, আমি বিশ্বাস করবোনা।
রোজান চুপ করে রইলো। সেও এসবের পরোয়া করছেনা। সোনালী যাকে মানুক না মানুক,শুধু তাকে একবার ভালোবাসার সুযোগ দিলেই সে ধন্য।
সোনালীর সামনে দাঁড়িয়ে রোজান কয়েক যুগ পার করে দিতে পারবে, তার জন্য ওই চোখ দুটোই যথেষ্ট। সোনালীর পুরো মুখটা একসাথে দেখতে তার মন ব্যকুল হয়ে উঠছে! যেন এই মুখশ্রীও দেখার ইচ্ছেও একটা প্রাণঘাতী তেষ্টা! কিন্তু কি করে এটা বলবে?
সোনালী রোজানের এক দৃষ্ট চোখে একবার নজর করলো। তারপর হাত নেড়ে বললো,
‘ এই যে, মনে থাকে যেন! এইখানে আর কখনো আসবেন না! আসলে এই নদীতেই আপনার লাশ ভেসে যাবে।
রোজান আস্তে আস্তে বললো,
‘ তোমার বাবা কি তোমাকে আজীবন এভাবেই রাখবে? বিয়ে দিবেনা?
সোনালী কেমন করে যেন লজ্জাময় হাসি হাসলো। তারপর বললো,
‘ না দিবেনা, সারাজীবন তার ঘরের খুঁটি বানিয়ে রাখবে।
রোজান লাজুক হাসির সাথে বললো,
‘ আমাকে তো চিনোই। কীভাবে চিনো জানিনা,জানতেও চাইনা। তবে আমি কিন্তু ছেলে হিসেবে খারাপ না।
সোনালী মুখ ফিরিয়ে বললো,
‘ ভালো থাকতে তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যান। আসছি আমি।
বলেই তাড়াহুড়ো করে পা বাড়ালো। রোজান নিজের অজান্তেই এক বুক সাহস নিয়ে সোনালীর হাত চেপে ধরলো।
চোখ দুটো বড়বড় করে সোনালী ফিরে তাকালো আর হাতটা ছিঁটকে সরাতে চাইলো, কিন্তু রোজান তা দিলোনা। শক্ত করে ধরে রেখে একটা বোকাহাসিতে বললো,
‘ আজীবন ধরে রাখতে চাই! আমি লাশ হয়ে ভেসে যেতে রাজী! কিন্তু আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে নারাজ।
সোনালী ভ্রু কুঁচকে রাগে ফুঁসতে লাগলো। রোজানের চোখের দিকে তাকিয়ে বিভিন্ন হুশিয়ারি দিলো। কিন্তু রোজান নাছোড়বান্দা।
সোনালী কিছু না পেরে জোরে জোরে বললো,
‘ আব্বা আপনি আসছেন? দেখুন দেখুন এই ছেলে কি করছে!
রোজান আৎকে উঠে হাত ছেড়ে দিলো। আশেপাশে তাকাতে তাকাতেই সোনালী চোখের পলকে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে দূরে চলে যেতে থাকলো।
রোজান মৃদু হাসলো। তার কাছ থেকে পালাতেই সোনালী মিথ্যে বলেছে।
রোজান সোনালীকে ধরা সেই হাতটা বুকে চেপে ধরলো, সে বিরাট স্পর্ধা নিয়ে সোনালীকে স্পর্শ করেছে! সোনালীর কোমল হাত তার শক্ত হাতের মুঠোয় কত তীব্রভাবেই না আবিষ্ট ছিলো! সোনালী অনেক জোর করে ছাড়াতে চাইছিলো, নিশ্চয়ই হাত লাল হয়ে গেছে। সেও কি ঘরে গিয়ে হাতের দিকে তাকিয়ে কিছু অনূভব করবে? রোজান যেমন অনূভব করছে, হাতে নয় বুকের মধ্যখানে! একদম তীর গাঁথার ন্যায় ব্যথা!
রোজান চোখ বন্ধ করে মাথা উপরে তুলে সোনালীর সবগুলো কথাকে কল্পনা করতে লাগলো। প্রেমের যন্ত্রণাময় অনূভুতিগুলোও এতো মধুর কেন?
কিছুক্ষণ যেতেই চোখ বন্ধ অবস্থায় রোজান আচমকা লাফিয়ে উঠলো। তাকে এলোপাতাড়ি হয়ে কেউ জড়িয়ে ধরেছে।
চলবে…
লেখাঃ তাজরীন_খন্দকার