সোনালী [০৯]

0
719

সোনালী [০৯]

রোজান হতভম্বের শেষ প্রান্তে পৌঁছালো যেন। এটা কোন সোনালীকে সে দেখছে?
সোনালীর চুল! সোনালীর মাথায় তো ঘন সোনালী রঙের চুল?
এটা মনে হতেই সে মেয়েটার চুলের দিকে নজর দিলো। নাহ মেয়েটার চুল কালো রঙের।
মেয়েটা অগোছালো বেশ, চুলগুলোও কাঁধ অব্দি ছোট আর উসকোখুসকো। হ্যাঁ মৌয়াল হাবিলের মেয়ে যে এমনই হতে পারে সেটা বিশ্বাসযোগ্য, এমনকি তার স্ত্রীও এমন এলোমেলো।

কিন্তু তাদের সন্তান বলে তার চেনা সোনালীকে বিশ্বাসযোগ্য নয়। আর হবেই বা কেন? আসলেই তো সোনালী তাদের নিজ সন্তান নয়, দিয়ালীর সন্তান। কিন্তু এখানকার কথা শুনে মনে হচ্ছে সেই বৈশিষ্ট্যের মেয়ের বিষয়ে হাবিল সাহেব নিজেই জানেন না। কিন্তু রোজানের চোখ তো ভুল দেখেনি!
তাও কেন জানি রোজানের পা ভয়ংকরভাবে কাঁপছে! বুকেও চিনচিনে কাঁপন! সোনালীর অস্তিত্ব আদৌ আছে তো? কিংবা সোনালী কোনো মানুষ তো? না না কি ভাবছে, নিশ্চয়ই কোনো গন্ডগোল হয়েছে এখানে। সোনালী নিশ্চয়ই আছে।

ঠিক তখনি তার মা প্রবেশ করলো। ভেতরে দেখলো দিয়ালী মেয়েকে না পেয়ে একপাশে বসে বসে কাঁদতেছে, আর রোজানের মামা আর বাবার কপালে চিন্তার ভাঁজ,সাথে তীব্র বিরক্তি। আর বাকি লোকজনদের দুইজন হাত গুটিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
রোজানের মা আস্তে আস্তে বললো,
‘ সোনালী কোথায়?

রোজানের বাবা চোখ দিয়ে ইশারা করে বললো,
‘ এই যে তোমার পুত্রবধূ। দেখে নাও!

বলেই মুখ ঘুরালো। রোজানের মা সেই সোনালীর দিকে তাকিয়ে চমকালো। রোজানের বর্ণনার সাথে কোনো মিল নেই। তবুও এগিয়ে গেলো সোনালীর দিকে! তার মাথায় হাত রেখে বললো,
‘ মেয়েটা যথেষ্ট মায়াবতী, কিন্তু রোজান আমাকে যে ছবি দেখিয়েছিলো, কিংবা সে যাকে ভালোবেসেছিলো এই মেয়ে তো সে নয়।

রোজানের মামা আওয়াজ করে বললো,
‘ সেই মেয়ে হলে কি আমরা এতক্ষণ ধরে এখানে বসে থাকি?

তিনি কিছুটা অবাক হয়ে বললেন,
‘ কোথায় সে? ওই সোনালী কোথায়?

এবার হাবিল রাগান্বিত হয়ে বললো,
‘ দূর বা* আর কোন সোনালী? এইরম কান্ড দেইখা মেজাজটা আগুন হইয়া যাইতাছে আমার। অতগুলি মানুষ আনছেন বইল্লা ভাইব্বেন না আমি নরমই থাহুম। আপনেরা সারা বাড়িত তল্লাশি করতাছেন,কিছু কই কইতাছিনা। কিন্তু বারেবার আমার আর আমার মাইয়ারে নিয়ে আজগুবি কথা কইলে আমি খারাপ করুম কইয়া দিলাম। এরপর আবার আপনারার লোকদেররে জঙ্গলে খুঁজতেও পাঠাইছেন। কিরম ফাইজলামি এইগুলা?

রোজান আর কিছু না শুনে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে শামিমের নিকট দাঁড়ালো। শামিম ধির কণ্ঠে বললো,
‘ ভেতরে কি হচ্ছে স্যার?

রোজান ব্যস্ত স্বরে বললো,
‘ শামিম তুমি সোনালীকে দেখেছিলেনা?

শামিম মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘ জ্বী দূর থেকে দেখেছিলাম তো।

রোজান তার থুতনিতে হাত বুলাতে বুলাতে ইশারা করে বললো,
‘ ভেতরে গিয়ে দেখো আসো আরেক সোনালীকে,এরপর আমাকে জানাও!

রোজানের কথায় শামিম ভেতরে গেলো। রোজান আশেপাশে পায়চারী করছে। তার জানামতে এখানে শুধু সোনালী আর তার মা-বাবা থাকে। কিন্তু হাবিলের মতো দেখতে আরেকজন সোনালী নামে কি করে আসবে? আর যদি সে থাকেই তাহলে ওই সোনালী কোথায়? সোনালী কোথায় যাবে, আর হাবিলই বা কেন মিথ্যা বলবে?

সেসময়ই শামিম বের হলো। সে চিন্তিত চেহেরায় বললো,
‘ স্যার এটা অসম্ভব। আপনার দেখা আর আপনার ড্রোনে রেকর্ড হওয়া সোনালী সে হতেই পারেনা।

রোজান মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললো,
‘ হুম সোনালী প্রায় আমার সমান লম্বা । আর ঘরের মেয়েটা তো অনেক খাটো। আর এতো কাছ থেকে অনূভব করা আমার সোনালী কোনোক্রমেই মিথ্যে কিংবা ভ্রম হতে পারেনা।

শামিম হঠাৎ বলে উঠলো,
‘স্যার সোনালী কি পালিয়ে গেছে? সে কি কোনোভাবে জেনে গিয়েছিলো আমাদের আসার ব্যপারে কিংবা দিয়ালী ম্যামের আসার ব্যপারে?

রোজান এটা শুনে অদ্ভুতভাবে চমকে উঠলো। তাইতো! সোনালী কি টের পেয়ে গিয়েছিল? হ্যাঁ এটা নিঃসন্দেহে ঠিক যে সোনালী বেশ রহস্যময়। এইতো সেদিন তাকে নাম ধরে ডেকে ফেলা, সবকিছু আগেই বলে দেওয়া, আবার হুট করে জড়িয়ে ধরা। কি আছে এসবের পেছনে? সোনালী এসব কীভাবে জানে?

রোজান একবার ভেতরের দিকে তাকাচ্ছে আবার বাইরের দিকে উঁকি দিয়ে পায়চারী করছে। সোনালীর হাতের লেখাও নিখুঁত সুন্দর, এটা ঘরোয়া হাতেখড়িতে সম্ভব বলে মনে হচ্ছেনা, অবশ্যই সোনালী পড়ালেখা করেছে কিংবা করে।

হঠাৎ রোজান ভেতরে একটা মহিলা কণ্ঠে শুনতে পেলো,
‘ আপনি আসল কাহিনি কইতাছেন না ক্যান? এরারে কইয়া দেন, বিশ্বাস করলে করবো না করলে নাই।

রোজান এটা শুনতেই বড় বড় চার কদমে ভেতরে চলে এলো। ততক্ষণে হাবিল সাহেব বলতে শুরু করলো,
‘ আপনেরা শহুরে সাহেবরা বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু কথা হইতাছে এটাই সইত্য। এই এলাকা কোনো সময় নিষিদ্ধ আছিলো, আমি এইহানে যহন আইছিলাম তহন একটা কাক পক্কিও দেখতাম না। হুনছি এইহানে জ্বীন পরীর আবাস আছিলো। কিন্তু আমরা আইয়া যহন ঘর বানলাম, তহন চইলা গেছে, কিন্তু মাঝে মাঝে দেহা দেয়। হইতে পারে সোনালীর যেই কথা কইতাছেন সেইটাও এমন হইবো। আপনারার বর্ণনা অনুযায়ে এমন রূপবতী জঙ্গলে থাকার কথা ভাবনও অসম্ভব।

রোজান হা করে শুনছে। হাবিল এসব কি বলছে? সোনালী পরী হলে ক্যামেরায় আসবে কি করে? নাকি মানুষ রূপে থাকলে এটা সম্ভব?
সে দেখলো সবাই হাবিলের কথাকে বিশ্বাসের সাথে নিয়েছে। নিচু করে তারা যুক্তিকে সায় দিচ্ছে।
রোজান তীব্রভাবে ঘামতে লাগলো! তার মাথায় চলছে সেদিন সোনালী কি করে আগে আগে সবকিছু বলে দিচ্ছিলো। তাহলে কি হাবিলের কথা?
না না এটা কীভাবে মানবে রোজান?

রোজান মানতে না পারলেও হাবিল তাদেরকে তার বাড়িতে আর মানলোনা। সে সবাইকে ঠেলে বের করতে লাগলো। কিন্তু রোজান খেয়াল করছে দিয়ালী এখনো কাঁদছে, এই মানুষটা সেই কতো বছর থেকে সন্তানের জন্য হাহাকার করছে! কিন্তু এবারও পেলোনা।

এবার রোজানকে নিয়েই তার বাবা নৌকায় উঠলো। একবারও জিজ্ঞেস করেনি কীভাবে এইপাড়ে আসলো! দিয়ালী আর লোক হেলিকপ্টারে উঠে গেছে। মাঝ নদীতে রোজান বললো,
‘ মা বাবাকে নিয়ে চলে যেও তুমি। আমি আজকে যাবোনা। শামিমকে নিয়ে ওর বান্ধবীর বাড়ি যাবো।

রোজানের বাবা আড় চোখে তাকিয়েও চুপ থাকলো।
আর রোজানকে যাওয়ার জন্য রোজানের বাবা কোনো জোরও করলোনা।

রাতে রোজান শামিমকে নিয়ে সেই হোটেলেই রাত্রিযাপন করলো। তার বিশ্বাস পরেরদিন গেলে সে ঠিক সোনালীকে দেখতে পাবে।
সেই আশায় আর কিছু ভয়ে সারারাত ঘুমালোনা।
পরেরদিন রোজান জসিমকে দিয়ে আবার সেই কলাগাছের নৌকা বানিয়ে রওয়ানা দিলো। ভেতরে ভীষণ রকম ভয়। কিন্তু জসিম বারবার বলছে হাবিলের কথা সব মিথ্যে, সোনালী অবশ্যই আছে। সবাইকে দেখানো সেই কালো মেয়েটা নয়। সোনালী চুলের অধিকারীর অস্তিত্ব আছেই আছে।

পাড়ে গিয়ে খুব সতর্কতার সাথে রোজান চারদিকে সোনালীর আগমন খুঁজতে লাগলো। কিন্তু নাহ আজকে আর সোনালীকে দেখা যাচ্ছেনা। এভাবে রোজান কোন ভরসায় ওই পাড়ে যাবে?
সে এদিক ওদিক ঘুরছিলো আর বারবার দেখছিলো সোনালীকে দেখা যায় কিনা!
তারপর সিদ্ধান্ত নিলো আজকে ওইপাড়ে গিয়ে বিপদে পড়বেনা, বরং পারাপারের এই জিনিসটা এখানে কোথাও লুকিয়ে রাখবে, সোনালীর দেখা যখন মিলবে তখনই সে যাবে।


এরপরও রোজান অনেক সময় বসে ছিলো। বসে থাকতে থাকতে হঠাৎই ওই পাড়ের একটা জায়গায় তার চোখ আটকে গেলো। কোনো এক আশংকায় সে বলে উঠলো,
‘ আমি এখনি ওইপাড়ে যাবো।

জসিম কিছুটা অবাক হলেও কোনো প্রশ্ন না করে তাকে নদীতে ভাসতে সাহায্য করলো। রোজান খুব তাড়াহুড়ো করে পাড় পর্যন্ত পৌঁছেই একটা দৌঁড়ে সেই গাছটার কাছে গেলো যেখানে সোনালীকে প্রথম দেখছিলো তার চিঠি পুঁতে ফেলতে। সে সেখানে গিয়েই বালি সরাতে লাগলো। কিছু বালি সরিয়েই রোজান একটা সাদা কাগজের অস্তিত্ব পেলো। সে এটাকে তুলে আশেপাশে তাকিয়ে দ্রুত আবার উঠে এইপাড়ে আসতে লাগলো। কেউ দেখার আগেই সে নেমে কোনো রকম গাছের আড়ালে গিয়ে কাগজটা খুলে দেখলো সেখানে লেখা,

‘ তোমার মামা এবং বাবার লোকেরা এখনো আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। তাদের বিশ্বাস তুমি যেহেতু যাচ্ছোনা, সেহেতু আমি নিশ্চয়ই আছি এবং বের হবো। হ্যাঁ রোজান আমি আছি, খুব নিরাপদে আছি। আর খুব শীগ্রই তোমার সাথে আমার দেখা হচ্ছে। ‘

রোজান চরম মাত্রায় চমকে উঠলো। সোনালী ওখানে চিঠি রাখলে যে রোজান খুঁজে পাবে সেটা কি করে ভাবলো?

চলবে…..

লেখাঃ তাজরীন_খন্দকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here