সোনালী [১০]
রোজানের সারা শরীর জুড়ে এক অদ্ভুত শিহরণ! চিঠিটা হাতে নিয়ে সে কাঁপছে।
ভেতরে উত্তাপ তবুও হাতদুটো বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে। সোনালী? এই সোনালীর পেছনে ছুটতে ছুটতে কোনো বিপদে পড়তে যাচ্ছেনা তো? রোজান নিজেও এটা আঁচ করতে পারছিলো তার মামা আর বাবার লোকেরা চারপাশে থাকবে। কিন্তু সোনালী কোথায় থাকছে? তাকে তো পুরো জঙ্গলেও তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। কি এমন জায়গায় সে এতো নিরাপদে অবস্থান করছে বললো?
রোজানের বিশ্বাস ভিন্ন মোড় নিচ্ছে!
সে এক পা দু পা করে শুধু পিছিয়ে যাচ্ছে।
শামিম বিষয়টা খেয়াল করে বললো,
‘ স্যার আপনি ঠিক আছেন? এমন করছেন কেন?
রোজান চোখ তুলে তাকিয়ে বললো,
‘ হাহ? তুমি কি কিছু বলছো?
শামিম আরেকটু এগিয়ে বললো,
‘ আপনি কাঁপছেন স্যার!
রোজান চোখ কচলে বললো,
‘ তুমি এটা পড়ো শামিম।
শামিম চিঠিটা পড়ে বললো,
‘ ওখানকার বালির নিচে পেয়েছেন?
রোজান মাথা নেড়ে বললো,
‘ হ্যাঁ! কিন্তু আমি সেই বালির নিচে কিছু আছে কিনা এমন সন্দেহে ওখানে গেলাম কেন শামিম? আর সোনালী আমার প্রথম চিরকুটটা যে ওখানে পুঁতেছিলো সেটাও আমি লুকিয়ে দেখেছিলাম, সে কি করে জানে যে আমি সেই জায়গা চেক করবো?
শামিম এবার ভয়ে ভয়ে জসিমের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আঙ্কেল! কিসব হচ্ছে? এখানে কি আসলেই অদ্ভুত কিছু রয়েছে?
জসিম একটু ভেবে বললো,
‘ অহন তো আমারই ডর লাগতাছে। আমি তো এমনডা জানতাম না। তয় অইডা জানতাম হাবিলের সুন্দর মাইয়া আছে, যার লাইজ্ঞা হে ওইপাড়ে কাউরে যাইতে দেয়না। বলছিলাম না নজর দেওনের অপরাধে ঘুরতে আওয়া এক ছেলের হাত অবশ কইরা ফালাইছিলো?
রোজান চোখ ঘুরিয়ে বললো,
‘ তাইতো! তাহলে তো নিশ্চয়ই আছে সুন্দরী মেয়ে।
এটা বলেই আবার থেমে গেলো। কান্না কান্না স্বরে বললো,
‘ আমার এমন লাগছে কেন ? শামিম আমার সবকিছু এলোমেলো লাগছে! প্লিজ হোটেলে ফিরে চলো। আমি আর আসবোনা এখানে। মনে হচ্ছে আমি সত্যিই কোনো একটা ঘোরের মধ্যে আছি। আমার চারপাশের সবকিছু আমার ভ্রম। প্লিজ শামিম আমাকে নিয়ে চলো! এসব মিথ্যে।
শামিম বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। জসিম রোজানের শরীর ছুঁয়ে বলছে,
‘ হঠাৎ তোমার কিতা হইলো বাপ?
রোজান একটু সরে গিয়ে মাথায় চেপে ধরে বললো,
‘ কিছু হয়নি, আমার কাছে সবকিছু অবাস্তব লাগছে। একদম সবকিছু। আপনাদেরকেও আমার বিশ্বাস হচ্ছনা, আসলেই আপনাদের সাথে স্বশরীরে আছি নাকি ভ্রমের মধ্যে দেখছি, বুঝতে পারছিনা। প্লিজ আমি ফিরে যেতে চাই, আমি ফিরে যেতে চাই। আমাকে সাহায্য করুন, আমি কালকেই আমার মা’র কাছে ফিরে যেতে চাই।
শামিম বোকার মতো কিছুক্ষণ রোজানের কথা শুনলো, তারপর আশেপাশে তাকিয়ে রোজানের হাত ধরে বললো,
‘ আসুন স্যার। আপনি প্লিজ শান্ত হোন। আসলে এতগুলো প্রশ্ন রেখে চলছে মেয়েটা যে আপনি কিছু বিশ্বাস করতে পারছেন না।
রোজান আড়চোখে শামিমের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আরে মেয়ে থাকলে তো! কেউ নেই, এমন মেয়ে নেই। সব চোখের ধোকা, সব ধোকা শামিম।
শামিম আর কথা বাড়ালোনা। বুঝতেও পারলোনা রোজানের হঠাৎ কি হলো! সে রোজানের হাত ধরে জঙ্গল পেরুলো। হোটেলে গিয়ে রোজানের গায়ে কম্বল মুড়িয়ে দিয়ে সে বললো,
‘ আপনি শুয়ে থাকুন স্যার, আমি মায়াকে দেখতে যাবো। আপনার গাড়ীটা নিয়ে যাচ্ছি কেমন? ফিরে আসবো শীগ্রই।
রোজান চোখ পিটপিট করে খুলে বললো,
‘ মায়া আসলে আছে তো? নাকি সোনালীর মতো!
শামিম হাসলো। আর চাবি হাতে বেড়িয়ে গেলো। নির্ঘুম কাটিয়ে, এতো এতো চিন্তা আর ধাঁধার মধ্যে পড়ে তার বসের মাথা ঠিক নেই, আর কারই বা থাকবে? শুধু মনকে বারবার বুঝাচ্ছে বলে শামিমও সোনালীকে অদ্ভুত কিছু ভাবতে পারছেনা। সে এটা মনে হওয়ার আগেই নিজেকে বলে, না সে নিজে দেখেছে সোনালীকে, সোনালী জলজ্যান্ত মানুষ ছাড়া কিছু না।
শামিম ফিরলো সন্ধ্যায়। ফিরে দেখলো রোজান ঘুমিয়ে আছে। সে প্রথম ভাবলো খাবার জন্য শামিমকে ডাকবে। দুপুরেও খায়নি। তারপর আবার ভাবলো জিজ্ঞাসা করে নেওয়া উচিত। এই অবস্থায় উনি খাবে কিনা কে জানে!
শামিম আস্তে আস্তে রোজানের কাছে গিয়ে কম্বলের উপরেই হাত রেখে বললো,
‘ স্যার কি খাবেন?
হাত রাখতেই শামিম চমকে উঠলো, কম্বল তীব্রতর গরম হয়ে আছে। সে দ্রুত কম্বল সরিয়ে কপালে হাত রাখতেই আরো আৎকে উঠলো। রোজানের গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে! কোনো ভয়ংকর রকম ভয় থেকে জ্বর আসলো নাকি?
শামিম দৌঁড়ে হোটেল রুমের বাইরে গিয়ে একজনকে ডেকে বললো,
‘ প্লিজ আমাকে সাহায্য করুন, আমার বন্ধু ভীষণ অসুস্থ। তাকে এখনি হাসপাতাল নিতে হবে।
লোকটা এগিয়ে আসলো। রোজানকে ধরে গাড়ীতে তুলে দিলো। ডক্টরের কাছে যাওয়ার পরে ডক্টর অভয় দিয়ে বললো, আপাতত জ্বর ছাড়া সমস্যা নাই। একদুইদিন রিলাক্স থেকে ঔষধগুলো খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। আর একটা ইনজেকশন পুশ করে বললো,
‘ উনি বাসায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। নিয়ে যেতে পারুন।
শামিম একজনের সহায়তায় রোজানকে আবার তুলে হোটেলে চললো। এখানকার কেবিনগুলো জরুরী অবস্থায় সব রোগী দিয়ে বুক হয়ে আছে, তাই এখানে ডক্টর রাখতে ইচ্ছুক নন। কোনো উপায়ন্তর না দেখে ভয়ে ভয়ে শামিম হোটেলে ফিরলো।
কিন্তু হঠাৎ জ্বর আসার কারণ হিসেবে ধরতে পারলো রোজানের ভেতরকার ভয়! সে সোনালীকে গভীর থেকে ভাবতে গিয়ে যেন কিছুই মিলাতে পারছেনা, সবশেষে সে তার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করছে, আর এসবেই বেশ ভয় পাচ্ছে। আর তাই বোধহয় এমন ভয়ংকর জ্বর আসছে!
রাতে সবকিছু ঠিক ছিলো। রোজান বেশি কথা বলেনি, কিন্তু শামিম রোজানের সর্বোচ্চ দেখাশোনা এবং যত্নে বিভোর ছিল। সারারাত কপালে পানিপট্টি দিয়েছে। রোজানও বারবার চোখ খুলে শামিমের ভীত চেহেরা দেখছিলো। রোজানের এমন অবস্থা দেখেই হয়তো তার এই ভীতি। শামিম সারারাত ঘুমালোনা।
ফজরের আজান দিচ্ছে। শামিম তখন ঘুমে কাতর, রোজান দেখছিলো শামিম ঘুমে ঢুলছে! রোজান তাকে ঘুমাতে যাওয়ার জন্য ধমক দিলো। তারও এখন কিছুটা ভালো লাগছে। জ্বরটা কমেছে,কিন্তু মস্তিষ্ক অস্বাভাবিকরকম বিপর্যস্ত লাগছে।
আগেরদিন সারা বিকেল, আবার সারারাত ঘুমিয়ে তার আর ঘুম নেই। শামিম শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে!
সে শামিমের দিকে তাকিয়ে দেখছিলো সারারাত পাগলের মতো ছুটাছুটি করে কতো সুন্দর করে এখন ঘুমাচ্ছে। আসলেই শামিমের তুলনা হয়না, এবার ফিরেই শামিমকে ম্যানাজার পদে নিয়োগ করবে বলে ভাবলো নিলো সে, আর তার বেতন তিনগুণ করে দিবে।
ভোরের আলো প্রায় ফুটতে চলেছে। রোজান তখনও ভেতরে ভেতরে সোনালীকে ভেবে ভয় পাচ্ছে। আর সেসময়ই হঠাৎ দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হলো। রোজান শামিমকে না ডেকে নিজেই ধির পায়ে দরজার দিকে এগুলো। ভাবলো রুম চেকিং দিতে কেউ আসছে বোধহয়।
রোজানের চোখে ভীষণ ব্যথা, অদ্ভুত রকমের লালও হয়ে আছে। আর রাতের করুণ অবস্থায় এখন ঝাপসা দেখছে সবকিছু। তবুও সে দরজা খুলে না তাকিয়েই বললো,
‘ এতো সকালে কি?
তারপর সামনে সে একজনের ছায়া দেখে চিৎকার মেরে বললো,
‘ শামিম ভূত। দেখো দেখো ওর চোখ নীল।
শামিম লাফিয়ে ওঠে তাকালো। দেখলো বোরকা পরিহিত একজন দাঁড়িয়ে আছে। শামিমকে ওঠতে দেখেই মেয়েটা বললো,
‘ আমি সোনালী।
এটা বলা শেষ না হতেই রোজান জোরে দরজা বন্ধ করে বললো,
‘ এ মানুষ নয়, ও এখানেও চলে আসছে!
কিন্তু রোজান শুনতে পাচ্ছে বাইরে থেকে বলতেছে,
‘ আরে আমি সোনালী, দরজা খুলো রোজান। আমি তোমার অসুস্থতার সংবাদে ছুটে এসেছি।
রোজান বুকে শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
‘ শামিম আমাকে ধরো প্লিজ। আমার ভীষণ ভয় লাগছে।
শামিমও অবাক চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে ভাবছে, রোজানের অসুস্থতার কথা সোনালী কীভাবে জানতে পারলো?
চলবে…….
লেখাঃ তাজরীন_খন্দকার