সোনালী [১১]
রোজানের সাথে সাথে এবার শামিমও ভয় পাচ্ছে। সে কোনো ভুল দেখছে নাতো? সোনালী দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে? তাও এতো সকালে?
তবুও শামিম নিজের আস্থা হারাতে দিলোনা। সে মনকে বুঝালো সোনালী মানুষ না হলে কি দিনের আলো ফোটার পরে আগমন ঘটাবে?
রোজানের একটা হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বললো,
‘ স্যার মেয়েটা এভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলে আরো বিপদ হবে। কেউ দেখলে তাকে সন্দেহ করবে।
রোজান শামিমের হাতে আরেকটা হাত দিন উল্টো চেপে ধরে বললো,
‘ প্লিজ শামিম, বাইরে কেউ নেই। কেউ থাকলে তো বিপদ হবে! ওটা কোন অশরীরীর ছায়া।
তখনি আবার ঠকঠক আওয়াজের সাথে সোনালী বললো,
‘ শামিম ভাইয়া রোজান দরজা বন্ধ করলো কেন? প্লিজ আপনি দরজাটা খুলুন।
শামিম রোজানের হাতটা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। রোজান দেখলো শামিম দরজা খুলতে যাচ্ছে। রোজান ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বিছানায় চলে গেলো, কম্বল দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে নিলো।
এদিকে শামিম দরজা খুলতেই সোনালী দ্রুত পায়ে প্রবেশ করে বললো,
‘ রোজান কোথায়?
শামিম আঙুল দিয়ে দেখালো। সোনালী অবাক চোখে বললো,
‘ এভাবে লুকিয়ে পড়লো কেন?
শামিম স্বাভাবিক স্বরে বললো,
‘ আপনি তো সবই জানেন। এটাও বলে দেন কেন লুকাতে পারে!?
সোনালী শামিমের কথায় অবাক না হয়ে বললো,
‘ ভয় পাচ্ছে?
শামিম গলায় জোর এনে বললো,
‘ তো কি পাবেনা? আমরা কি মানুষ না? আর মানুষরা তো ভূত প্রেতকে ভয় পাবোই তাইনা?
সোনালী বিছানার দিকে এগুতে চাইলো। শামিম হাত দিয়ে ইশারা করে বারণ করলো। সোনালী বিরক্ত গলায় বললো,
‘ এসব কি হচ্ছে শামিম ভাইয়া? আর ভূত প্রেত মানে কি?
শামিম রোজানের দিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে বললো,
‘ তাহলে উনার জ্বর আসলো কেন?
সোনালী আবার এগুতে চাইলেই শামিম আরো জোরে বললো,
‘ আপনি যাবেন না।আপনার জন্যই উনি অসুস্থ। নিজেকে স্পষ্ট করুন মিস সোনালী। আপনি অদ্ভুতুরে কাণ্ডকীর্তি দেখাচ্ছেন। এসব দেখে দেখে উনি গতকাল ভয়ে জ্ঞানহীন হয়ে পড়েছিলেন।
সোনালী কি বুঝে যেন ফিক করে হেসে ফেললো।
আর সামনে পা না বাড়িয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। আর কম্বলের আড়ালে থাকা রোজানের উদ্দেশ্যে বললো,
‘ রোজান তুমি আমার বাবার কথাকে বিশ্বাস করে এমন ভয় পাচ্ছো? তোমারও মনে হচ্ছে আমার অস্তিত্ব নেই? এই যে দেখো আমি ভোরের আলোয় বসে আছি, দেখো আমার চোখ, হাতে চিমটি কেটে দেখো না হয়!
রোজান তবুও মুখ খুললোনা। শামিম ভ্রু ভাঁজ করে চিন্তিত চেহেরায় বসে আছে। সোনালী শামিমের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আপনি ভয় পাচ্ছেন না কেন?
শামিম ভার মুখে জবাব দিলো,
‘ কারণ আমি আপনাকে ভেবে ভেবে বিভোর হইনি।
সোনালী হাসির তোড়ে বললো,
‘ তাইতো, আপনার মায়া থাকতে আপনি আর কাকে নিয়ে গবেষণা করবেন?
শামিম বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ এই যে এইসবের জন্য স্যারের জ্বর আসছে। এতকিছু আপনি কি করে জানেন?
সোনালী তাচ্ছিল্য করে বললো,
‘ সিরিয়াসলি? সে এসবের জন্য আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেনা? তার বুকে এতো কম সাহস? অথচ সে কিনা আবার আমাকে পেতে পৃথিবী জয় করে নিবে বলছিলো। হাহাহাহা!
রোজান এবার মুখ থেকে কম্বল সরালো। চোখদুটো একটুখানি বের করে বললো,
‘ আচ্ছা আমরা না দেখে কিংবা না বুঝে আপনাদের কোনো ক্ষতি করেছিলাম?
সোনালী নীল রঙের চোখের মণিদুটো বড়বড় করে রোজানের দিকে নিক্ষেপ করলো। রোজান ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। এবার সোনালী শামিমের বাঁধা না মেনে চলে গেলো রোজানের কাছে।
রোজান সোনালীর অস্তিত্ব বুঝতেই বললো,
‘ দূরে থাকুন, আপনি যা চাইবেন তাই দিবো। ২০ মণ মিষ্টি চাইলে সেটাও দিবো। শুধু আমাকে ছেড়ে দিন।
সোনালী এমন অদ্ভুত কথাতে হাসতে হাসতে নুয়ে পড়ছিলো। তারপর রোজানের গাল ছুঁয়ে বললো,
‘ এই দেখো আমি মানুষ। তোমাকে আমি ছুঁতে পারছি। দেখো!
রোজান একটু মিরমিরি করে তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে ফেললো। সোনালী ধিরে ধিরে বললো,
‘ আমাকে না তুমি ভালোবাসো ?
রোজান চোখ বন্ধ অবস্থায় চুপ করে রইলো। সোনালী কপালে হাত বুলিয়ে আবার বললো,
‘ রোজান!
রোজান চুপ করেই আছে৷ জোর করে চোখ বন্ধ রাখতে চাচ্ছে! সোনালী রোজানের ভয়কে বুঝতে পেরে হাতটা সরিয়ে নিলো। আর সোজা হয়ে বসে বললো,
‘ রাইসার কথা মনে আছে?
রাইসার নাম শুনতেই রোজান আৎকে উঠলো। শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠে বসে গেলো। সোনালীর দিকে খুব সুক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে বললো,
‘ সত্যি করে বলোতো তুমি কে?রাইসাকে কীভাবে চিনো?
সোনালী হাসতে হাসতে বললো,
‘ রাইসা আপু! উনি তো আমার ভীষণ কাছের আত্মীয়।
রোজান আড়মোড়া ভেঙে শামিমের দিকে ভ্রুক্ষেপ করলো। শামিমও মনোযোগ দিয়ে শুনছে।
সোনালী মুচকি হেসে বললো,
‘ ক’দিন আগে রাইসা আপ্পির একটা মেয়ে হয়েছে শুনেছো?
রোজান মাথা নিচু করে বললো,
‘ আমি রাইসার সাথে কথা বলিনা।
সোনালী একটু চুপ থাকলো। রোজান কম্পিত গলায় প্রশ্ন করলো,
‘ তুমি আমার ব্যপারে কি জানোনা বলো?
সোনালী উচ্চস্বরে হেসে ফেললো। শামিমের ভার মুখে তাকিয়ে আবার রোজানের ভীতু চেহেরায় নজর টেনে বললো,
‘ সব জানি। সব জেনেই তো তোমাকে ভালোবাসি। আমাকে আজীবন রাখবে তোমার সাথে?
রোজান মাথা ঝাকিয়ে বলে উঠলো,
‘ রাইসা তোমাকে বলেনি আমি প্রেমিক হিসেবে কতটা কেয়ারলেস!? শুনোনি আমাদের বিচ্ছেদের কারণ কি ছিল? কেন ভালোবাসো তাহলে? আর কি করে জানো আমি কখন কীভাবে কোথায় যাচ্ছি, আসছি, থাকছি! আর ওই মেয়েটা কে? যাকে তোমার বাবা সোনালী বলে পরিচয় দিচ্ছিলো?
সোনালী তার মুখের দিকের হিজাবের পিনটা খুলে ফেললো। পেছনে শামিম দেখতে না পেলেও রোজান দেখতে পাচ্ছে। রোজানের খুব চেনা একটা মুখ, সেই একবারই দেখেছিলো, তবুও কেন জানি তার মনে হয় এই মুখ তার বহু বছরের চেনা৷
সোনালী তার মুক্তোর মতো চকচকে দাঁত বের করে হেসে বললো,
‘ রোজান আমি জানি আসলেই আমি কার সন্তান। আর এও জানি আমার পালিত বাবা হাবিল সাহেব, আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেন না। মানুষটা আমার জন্য লোকালয় ছেড়ে দিয়েছেন, আত্মীয় ছেড়ে দিয়েছেন, আমাকে রক্ষা করতে সিংহবেশ ধারণ করেছেন। সেই বাবাকে ফেলে আমি কি করে দিয়ালী নামক মহিলার কাছে যাবো বলো? আর দিয়ালীর থেকে আমাকে বাঁচাতেই এতো সংগ্রাম বাবার। আমাদের ওখানকার জঙ্গলে কে কখন আসছে যাচ্ছে সব আমরা জানি। তবে আমি জঙ্গলে বলে যে অপূর্ণ রেখেছেন তা ভেবোনা।
পড়ালেখা করছি ছদ্মবেশে, স্বাধীন চলাফেরাও করছি। শুধু উপরে দিয়ালীর মেয়ের বৈশিষ্ট্যগুলো আড়াল করে। হ্যাঁ তোমার অফিসের মান্নান সাহেবের বিয়েতে সেদিন তুমি আমাকেই দেখেছিলে, একটা মেকাপের প্রলেপে। যেখানে আমার পিঠের দাগটা সম্পূর্ণ আড়াল করা সম্ভব হয়ে উঠেনি।
রোজান তীব্রমাত্রায় চমকালো। নিজের চোখ কচলে ভালো করে সোনালীর দিকে নজর করলো! তাকে কি মেকাপ করলে ওরকম লাগবে? আর চুল!
সোনালী মৃদু হেসে আবারও বললো,
‘ সেদিনই আমি তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। কতবার যে তোমাকে সামনে কিংবা আড়াল থেকে দেখতে চেয়েছি, তুমি অবশ্য বুঝেছিলে সেটা আর বেশ বিরক্তও হয়েছিলে!
রোজানের আরো গড়বড় লাগছে। সোনালীর সত্য কথাগুলোও কেমন অবিশ্বাস্য, এগুলোও তার মাথা এলোমেলো করে দিচ্ছে!
চলবে….
লেখাঃ তাজরীন_খন্দকার