স্ত্রী
পর্বঃ ১১
লেখিকা ঃতাওহীদা
–কেনো করলেন এতবড় সর্বনাশ আমার?আমাকে তো খুব আশার আলো দেখিয়েছিলেন,,,আমাকে আগের জীবনে ফিরে যেতে দেবেন,,আমাকে সাহায্য করবেন,,আমাকে শুধু আপনার মায়ের সামনে কিছুদিনের জন্য সংসার করার অভিনয় করে যেতে হবে!! এখন? এখন কি বলবেন আপনি? কিভাবে আমি একটা স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবো বলুন!!
চুপ করে আছেন কেন,, বলুন,,কি করবো আমি?
(রায়ান ঘরে ঢোকার সাথে সাথে,, রায়ানের সামনে দাড়িয়ে চিৎকার করে বললো জিনাত)।
রায়ান চুপ করে আছে, কি বলবে কিছুই ওর মাথায় ঢুকছে না।জিনাতের প্রতি ওর একটা মায়া পড়ে গেলেও,,ও জোর করে জিনাতকে সেই মায়ার বাধনে আটকে রাখতে চায় নি।সময় হলে ঠিকি তাকে মুক্ত করে দিতো।কিন্তু এখন যে সব ওলট পালট হয়ে গেলো।একদিকে একটা নিষ্পাপ প্রান অন্যদিকে জিনাতকে দেয়া রায়ানের ওয়াদা।কোন দিকে যাবে সে? রায়ানের মনে একটা প্রশ্ন উকি দেয়,,আচ্ছা এটা তো জিনাতেরও সন্তান,, ও কি পারে না,,এই সন্তানের জন্য হলেও এই মিথ্যে সংসারের অভিনয়টা সত্যি করতে?
রায়ানের চুপ থাকা দেখে জিনাতের মেজাজ বিগ্রে গেলো।ও রেগে গিয়ে রায়ানের কলার চেপে ধরলো।
-কি হলো চুপ করে আছেন কেনো? কি ভেবেছেন চুপ করে থাকলে পার পেয়ে যাবেন?আপনাকে জবাব দিতেই হবে! কি করবো আমি আপনার সন্তানকে নিয়ে বলুন?(চিৎকার করে বললো জিনাত)
রায়ান ওর দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,,,বাচ্চাটা তো তোমারো জিনাত,,তুমিই ঠিক করো না,কি করবে ওই নিষ্পাপ প্রানটাকে?
এই কথাটা বলেই রায়ান ওর কলার থেকে জিনাতের হাতটা আস্তে ছাড়িয়ে নিয়ে বেলকনিতে চলে গেলো।আর জিনাত ধপ করে বসে পরলো বিছানায়।
জিনাত বসে ভাবতে লাগলো,,, সত্যিই তো,ও তো আমারো সন্তান, আমার মাঝেই বেড়ে উঠছে ও।আমি ওকে ছাড়ার কথা ভাবি কিভাবে? কিন্তু ওকে নিয়েও তো আমি আগের জীবনে ফিরতে পারবো না,,আর ওকে দুনিয়ায় আনতে হলে তো আমাকে সারাজীবনের জন্য এই সংসারেই থাকতে হবে,,,কিন্তু এই মানুষটাকে তো আমি ঘৃনা করি!! আল্লাহ! একি দোটানায় ফেললে তুমি আমায়।
হঠাৎ কিছুক্ষণ পরে শিমুর চিৎকার শোনা যায়,,,ভাইয়া,,,ভাবিগো তাড়াতাড়ি আসেন,,আম্মায় অসুস্থ হইয়া পরছে,,,,
শিমুর চিৎকারএ জিনাত আর রায়ান দুজনেই দৌড়ে আসে রায়ানের মায়ের রুমে।এসে দেখে প্রচন্ড কাশছে সে,,কাশির সাথে রক্ত বমি হচ্ছে,,আর জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে।
রায়ান ওর মাকে দেখে,,মা,,,বলে চিৎকার দিয়ে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে।আর শিমুকে বলে দ্রুত ওর মোবাইল টা নিয়ে আসতে।শিমু দৌড়ে চলে গেলো।জিনাতও এসে অন্য পাশ থেকে ধরলো তাকে।
রায়ান তাড়াতাড়ি ফারদিনকে ফোন করে অন্যদের নিয়ে এম্বুলেন্স এর ব্যাবস্থা করতে বললো।তারপর ডাক্তারকে ফোন দিয়ে,,ট্রিটমেন্টএর সব ব্যাবস্থা করতে বললো।
মিনিট ২০ এর মাঝেই এম্বুলেন্স এসে হাজির হলো।কিন্তু ততক্ষণে প্রচন্ড কাশি আর রক্তবমির জন্য জ্ঞান হারিয়েছে রায়ানের মা।রায়ান তাই দেখে চিৎকার দিয়ে কাদতে লাগলো। জিনাতেরো চোখ ভরে উঠলো। ওর শাশুড়ীর এই অবস্থা দেখে হাত পা কেমন যেন অসার হয়ে আসছিলো তার।কিন্তু, ও নিজেকে শক্ত রাখলো,,কারন সবাই অস্থির হয়ে পরলে চলবে না।তাই ও রায়ানের কাধে হাত দিয়ে বললো,,দেখুন আমাদের হাতে কান্নাকাটি করে নষ্ট করার মতো সময় নেই।যত দ্রুত সম্ভব মায়ের চিকিৎসা শুরু করতে হবে।বাইরে এম্বুলেন্স এসে গেছে,, আর দেরি করা ঠিক হবে না।জিনাতের কথায় রায়ানের হুশ ফিরলো।
তাই সে,, ফারদিন আর মনিরকে নিয়ে ধরাধরি করে মাকে এম্বুলেন্স এ তুললো।জিনাত কোনোমতে বোরখাটা গায়ে জড়িয়ে দ্রুত এম্বুলেন্স এ গিয়ে উঠলো।
★★
সকাল ৭ টা।
রায়ান আর জিনাত বসে আছে জরুরি বিভাগের সামনে। রায়ানের চোখের পানি যেনো বাধ মানছেই না।রাতে ওর মাকে ক্লিনিকে নিয়ে আসার পরে,,ডাক্তার ওর মাকে দেখে ওর কাধে হাত দিয়ে বলেছে,,,মনকে শক্ত করো বাবা,,আল্লাহকে ডাকো।আমাদের হাতে আর কিছু নেই এখন। এখন একমাত্র আল্লাহই ভরসা।এই শুনে একদম ভেঙে পরেছে রায়ান।সারাটা রাত চরম অস্থিরতায় কেটেছে তাদের।
হঠাৎই ডাক্তার বেরিয়ে বললো,,,,রায়ান,তোমার মায়ের জ্ঞান ফিরেছে।তোমাকে আর তোমার স্ত্রীকে দেখতে চাইছে। তোমরা ভিতরে এসো।
এই শুনে ওরা দুজন একরকম দৌড়ে ভিতরে গেলো।
রায়ান ওর মায়ের মাথার কাছে হাটু গেড়ে বসলো।টলমল চোখে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আস্তে ডাক দিলো,,,
-মা!
রায়ানের মা ধীরে ধীরে চোখখুলে রায়ানের দিকে চাইলো।খুব কষ্ট করে মুখে একাটা শুকনো হাসি হেসে বললো,,,
-খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলি,, তাই না বাবা!
মায়ের এই কথা শুনে রায়ান মাকে হালকা করে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেদে উঠলো।
রায়ানের মাও ছলছল চোখে,,ছেলের মাথায় আস্তে হাত বুলাতে লাগলো,, আর কাপাকাপা কন্ঠে বললো,,,
-পাগল ছেলে,,মা কি কারো চিরদিন থাকে নাকি! মনটাকে শক্ত কর বাবা।আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন।আল্লাহর উপর ভরসা রাখ।দেখিস,,আল্লাহ ঠিক তোকে ছোট্ট একটা ফুটফুটে মা পাঠিয়ে দেবেন।তখন দেখবি এই বুড়ো মা টাকে আর মনেই পরবে না!
রায়ান এই কথা শুনে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলো না।মাকে জোরে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেদে উঠল।
রায়ানের মা জিনাতের দিকে তাকালো।চোখের ইশারায় তাকে কাছে ডাকলো।জিনাত এসে তার অন্য পাশে বসলো।
সে স্যালাইন পুশ করা হাতটা আলতো করে জিনাতের হাতের উপর রাখলো।তারপর চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে কাপাকাপা গলায় বললো,,তোমাকে অনেক কথা বলার ছিলো মা,,কিন্তু হয়তো পারবো না।শুধু এই মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের একটা অনুরোধ রাখো মা,,আমার এই ছেলেটা বড্ড একা হয়ে যাবে মা।তুমি কোনোদিনও আমার এই ছেলে আর ছেলের সংসার ছেড়ে যেও না মা।ওর যে তোমাকে ভীষণ প্রয়োজন।
এইটুকু বলেই প্রচন্ডজোরে শ্বাস টানতে শুরু করলো সে।রায়ান ডাক্তার ডাক্তার বলে চেচাতে লাগলো।কেবিনে থাকা নার্স টা ছুটে গেলো ডাক্তারকে ডাকতে।
রায়ানের মায়ের শরীর থরথর করে কাপতে লাগলো,,,সে রায়ানের হাত চেপে ধরে,,অস্ফুট স্বরে কলেমা উচ্চারণ করতে লাগলো।রায়ান অস্থির হয়ে মা,মা, করতে লাগলো। কিন্তু হঠাৎই রায়ানের মায়ের হাত টা আলগা হয়ে এলো।আর শরীর টাও নিথর হয়ে গেলো।রায়ান কাপাকাপা হাতে ওর মায়ের গাল ধরে বললো,,মা,,এই মা,,কথা বলছো না কেনো?
এর মধ্যে ডাক্তার চলে এলো।সে রায়ানের মায়ের পালস চেক করে, একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,,মনটাকে শক্ত করো বাবা,,তোমার মা আর বেচে নেই!
এই কথা শুনে রায়ান মা,,আ,,,আ,,আ,, বলে একটা চিৎকার দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাদতে লাগলো।
জিনাত ধপ করে বসে পরলো ফ্লোরে।দুহাত দিয়ে মুখ চেপে ফুপিয়ে কেদে উঠলো সে।(চলবে)