স্ত্রী
পর্বঃ ৪
লেখিকা ঃ তাওহীদা
জিনাতের কান্না শুনে রায়ান ঘুম থেকে উঠে বসলো।ওকে এভাবে কান্না করতে দেখে খুব খারাপ লাগছিলো রায়ানের।কাল রাতের জন্য খুবই অনুতপ্ত ও।কিন্তু এখন জিনাতকে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না।কারণ যাই বলুক না কেনো, জিনাত আবার গালিগালাজ শুরু করবে,,আর রায়ানের আবার মাথা গরম হয়ে যাবে।রায়ান কিছুক্ষণ চিন্তা করে বিছানা থেকে উঠে, মোবাইলটা হাতে নিলো,,,
-হ্যালো মনির,,,,আমার শশুড় শাশুড়ীর সেবাযত্ন করতে কয়জনকে রেখেছিস,,,কিহ!!মাত্র ৪ জন!!না,না, ৭/৮ জন রেখে দে।আর আমি বলা মাত্রই সেবাযত্ন শুরু করে দিবি।
রায়ানকে মোবাইলে এই কথা বলতে শুনে,,জিনাত চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকালো।
-আমাকে পুরোপুরি শেষ করেও আপনার শান্তি হয়নি?আমার বাবা মায়ের পিছু ছাড়ছেন না কেনো এখনো?
-পিছু ছেড়েছিলাম বলেই তো,, কাল রাতে এতো কথা বলার সাহস পেয়েছিলে,,যার ফল তোমাকেই ভুগতে হলো। এখনো বলছি,, খবরদার আমার মাথা গরম করাবে না,,তাহলে তার ফল তোমার সাথে সাথে তোমার বাবা মাকেও ভুগতে হবে।মনে রেখো আমার লোকজন সবসময়ই তোমার বাবা মায়ের উপর নজর রাখছে।আমার একটা ইশারায় তাদের অনেক বড়ো ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।আর তোমাকে সাবধান করছি,,, খবরদার, আমার মাকে কোনোরকম অসন্মাম করবে না,,যদি আমার মায়ের মনে একটু কষ্টও লাগে,,তবে আমার সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ দেখবে তুমি।
যদি ভালো চাও,, যা হয়েছে চুপচাপ মেনে নিয়ে,,ভালো মেয়ের মতো সংসার করো,এতেই সবার মঙ্গল ।
জিনাত চুপ করে এতোক্ষণ শুনলো,তারপর ঠান্ডাগলায় বললো,,,বেশ ভালো মেয়ের মতোই সংসার করবো।শুধু আমার বাবা মাকে রেহাই দিন।দয়া করুন।
–তুমি যদি ঠিকঠাক চলো,,তবে আমিও কথা দিচ্ছি আমি থাকতে তাদের কোনো অসুবিধা হবে না।
-আমি বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে চাই।তারা নিশ্চয়ই আমার চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে।
– উহুম,,এখন না,,কয়েকদিন যাক,তারপর। আগে তুমি দেখাও,,কেমন ভালো মেয়ের মতো সংসার করো,,,তারপর দেখা যাবে।
জিনাত বুঝলো কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।মাথা গরম করে কিছু বললে ওর বাবা মায়ের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।তাই ও আর কিছু না বলে, ওর ব্যাগ থেকে একটা থ্রি পিছ বের করে চুপচাপ বাথরুমে ঢুকে গেলো।
বাথরুমে আয়নার সামনে দাড়ালো জিনাত।একদিনেই কেমন বিধ্বস্ত চেহারা হয়ে গেছে তার।নিজের সর্বনাশের কথা ভেবে ঢুকরে কেদে উঠলো ও।কিছুক্ষণ কাদার পরে ওর মনে হলো, যে ওর এতোবড়ো সর্বনাশ করলো,,,তার উপর প্রতিশোধ নেবে ও।চরম প্রতিশোধ!!
বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখে ঘরে রায়ান নেই,,রুমের দরজাটা খোলা।ও রুম থেকে বের হবে কি হবে না ভাবতে লাগলো। পরক্ষণেই ওর মনে হলো ,এটা তো ওর কাছে কোন সাধারণ বিয়ে না যে,,বিয়ের পরদিন সকালে সেজেগুজে মাথায় ঘোমটা টেনে শাশুড়ী মায়ের কাছে যাবে।তাই ও মাথায় ওড়না টেনে ওখানেই বসে রইলো।বসে রুমটায় চোখ বুলাতে লাগলো ও।রুমে খুব সাধারণ কিছু ফার্নিচার। তবে সবকিছু বেশ সাজানো গোছানো।ও অবাক হয়ে গেলো, রুমে একটা বুকসেলফ দেখে।আরো অবাক হলো,বুকসেলফ টা তিন গোয়েন্দা,, কিশোর পত্রিকা,,মাসুদ রানা,,ফেলুদা,,রবিন সন ক্রুসো,, বিভিন্ন ভূতের কাহিনী এসব দিয়ে ভরা।
ও বিষ্ময় ভরা দৃষ্টিতে এসব দেখছিলো।ভাবছিলো,,একটা গুন্ডা মাস্তানের রুমে বুক সেলফ,,তাও আবার এসব দিয়ে ভরা!
কিছুক্ষণ ওসব দেখার পরে বেলকনির দিকে চোখ গেলো ওর।আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে বেলকনির দিকে পা বাড়ালো জিনাত।
বেশ চওড়া বেলকনিটা।বেলকনির সামনের দিকের দুই কোনায় দুটো করে ফুলের টব রাখা আছে।আবার বেলকনির সাম্নের অংশে কয়েকটা ছোট্ট ঝোলানো টব।একপাশে একটা ছোটো গোল কাচের টেবিল,,তার চারপাশে চারটা উচু টুল।আর অন্যপাশে একটা বেতের দোলনা ঝোলানো।
জিনাত বেলকনির গ্রিলের কাছে এসে বাইরে তাকালো।সাথে সাথে ওর চোখ বড়বড় হয়ে গেলো।
বাড়ির চারপাশে অনেকটা খোলা জায়গা,,পুরো জায়গাটাই সমান কচি সবুজ ঘাসে ঢেকে আছে।বাড়ির একপাশে বিভিন্নধরনের ফুলের বাগান,আর অন্যপাশে সবজির বাগান।ফুলের বাগানের পাশেই একটা চওড়া আর লম্বা দোলনা লাগলো।
জিনাত মনে মনে ভাবলো,,, এতো সুন্দর পরিবেশ!!যে কোনো মানুষের মন ভালো করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু আফসোস,,এই সৌন্দর্য পাপের টাকায় তৈরী।
হঠাৎ জিনাত দেখলো রায়ান একটা ঝাঝরি হাতে ফুলের বাগানে ঢুকলো।পরম যত্নে আস্তে আস্তে ফুলগাছগুলোয় পানি দিতে লাগলো ও।এবার জিনাত সবচেয়ে বেশি অবাক হলো,,একটা ক্রিমিনাল এভাবে ফুলের বাগানের যত্ন নিতে পারে,,তা ওর ধারনার বাইরে ছিলো।
–ভাবি,,আপনে উইঠা গেছেন,,তাইলে চলেন নাস্তা করতে।আম্মায় আপনের জন্যে বইসা আছে।(পেছন থেকে এসে বললো শিমু)
শিমুর কথায় জিনাত চমকে উঠে পেছনে তাকায়।কিছুক্ষণের জন্য চিন্তার জগতে ডুবে ছিলো ও।
–হ্যাঁ চলো,,,
–জে আসেন ভাবি।
জিনাত নাস্তার টেবিলে এসে দেখে রায়ানের মা অনেক রকমের খাবার সাজিয়ে বসে আছেন।রায়ানের মা জিনাতকে দেখেই, হাসিমুখে কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন,
– এসো জিনাত,বসো।কাল রাতে তো কিছুই খেলে না।এখন ভালো করে খেতেই হবে।নয়তো অসুস্থ হয়ে পরবে তো!!
রায়ানের মায়ের এই আহ্লাদ জিনাতের অসহ্য লাগছে।মনে মনে ভাবছে,ছেলেকে দিয়ে আমাকে তুলে আনিয়ে আবার আদিখ্যেতা দেখানো হচ্ছে।ইচ্ছে করছে, এই মহিলাকে কিছু উচিৎ কথা শুনিয়ে দেই।শুধু আমার বাবা মায়ের কথা ভেবেই কিছু বলতে পারছি না।নইলে যে অমানুষ, জানোয়ার ছেলে তার,,বাবার বয়সী লোকের গায়ে হাত তুলতেও তার বাধবে না।
-কি হলো বোসো,,
-হ্যা বসছি(মলিন মুখে বললো জিনাত)
এর মাঝে রায়ান এসেও বসলো নাস্তা করতে।ওকে দেখেই জিনাত মাথা নিচু করে রইলো।
রায়ানের মা জিনাতকে অনেক কিছু সাধাসাধি করতে লাগ্লেন।কিন্তু জিনাত প্লেটে তেমন কিছুই নিলো না।শুধু একটু সবজি আর একটা পরোটা নিয়ে আস্তে আস্তে মুখে দিতে লাগলো।
কোনো রকমে খাওয়া শেষ করে,আস্তে উঠে গেলো জিনাত।ও চলে যেতেই রায়ানের মা রায়ানকে বললেন,,,রায়ান,,তোর কাছ থেকে এটা আমি আশা করিনি বাবা।
— কেন মা,, আমি আবার কি করলাম!
-জিনাতের যে অবস্থায় বিয়ে হয়েছে,তাতে যেকোনো মেয়েরই রাগারাগি,চেচামেচি করা স্বাভাবিক। তোর উচিৎ ছিলো মাথা ঠান্ডা রেখে ওর সাথে কথা বলা,,ওকে সময় দেয়া,,কিন্তু তুই কি করেছিস,,ওর সাথে রাগারাগি করে, ওকে আঘাত করেছিস!
রায়ান চিন্তায় পরে গেলো।তবে কি জিনাত ওর মাকে সব বলে দিলো,,
-কেনো মা,,জিনাত কি তোমাকে কিছু বলেছে?
-আমি তোর মা,,আমাকে কি সব বলে দিতে হবে।জিনাতের গালে পাচ আঙুলের আবছা দাগ,,ঠোটের কাটা জায়গাটা কি এমনি এমনি হয়েছে!
রায়ান মাথা নিচু করে রইলো।
-দেখ বাবা,,তুই আমার সব ইচ্ছেই পূরণ করছিস,তাই আমার ইচ্ছের জন্যে হলেও ওর সাথে সবসময় ভালো আচরণ করিস বাবা।ও খুব ভালো মেয়ে,, ওকে ভয় দেখিয়ে নয়,,,ভালোবাসা দিয়ে মানাতে হবে।আমি শুধু এই টুকুই চাই,,,আমি না থাকলেও যেনো,,,তুই অন্ধকারে তলিয়ে না যাস।কেউ একজন যেনো,,তোকে আদর দিয়ে শাসন দিয়ে,বেধে রাখে। আর আমি জানি, সেটার জন্য জিনাতই উপযুক্ত মেয়ে।ওর মূল্যায়ন করিস বাবা।
এই বলে তিনি ওখান থেকে চলে গেলেন।
আর রায়ান? ওখানে বসেই মায়ের কথাগুলো ভাবতে লাগলো,,আর নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলো।রাগের মাথায় কতটা নিচে নেমে গেলো ও জিনাতের কাছে।(চলবে)