#স্নিগ্ধ_গাংচিল,পর্ব ১
#নাজমুন_বৃষ্টি
-‘আপু, রিফাত ভাইয়া অন্য একটি মেয়েকে বৌ করে নিয়ে আসছে। দ্রুত নিচে আয়।’
ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে বৌ সাজে বসে মনের সব অনুভূতি মিশিয়ে কানের দুল পড়তে গিয়ে ছোটবোনের কথায় থেমে গেল মুন। আজ তার আর রিফাতের বিয়ের কথা ছিল। এমন তো না যে রিফাতকে কেউ মুনের সাথে জোর করে বিয়ে করাচ্ছে! রিফাত নিজেই তো বিয়ের কথা তুলেছিল এতদিনের প্রেমের পরিনাম হিসেবে। কালকে রাতেও যে মানুষটা মুনকে বিয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিলো হঠাৎ করেই একদিনের ভেতর কী এমন হয়েছে যে রিফাত অন্যকাউকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে! নাহ, এটা কিছুতেই করবে না রিফাত। দুইবছর প্রেমের পর বিয়ের দিন এমন কিছু ভুলেও করবে না। আর রিফাত তো মুনকেই ভালোবাসে। এসব ভাবতেই ছোট বোন মীরার দিকে রাগী চোখে তাকালো মুন।
-‘মিরু, সবসময় ফাইজলামি পছন্দ করি না আমি। ফাইজলামি’র একটা সীমা থাকা উচিত।’
-‘আপু, আমি সত্যি বলছি। তুমি নিচে এসে দেখো।’
মীরার কথা শুনে মুন আবারো রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই নিচ থেকে বড়ো বাবার ধমক শোনা গেল।
মুন বুঝতে পারলো না বড়ো বাবার হঠাৎ এতো গরম হওয়ার কারণ। উনি তো সহজে কাউকে ধমক দেন না। তার মানে কী মীরা যা বলছে এসব,,,! মুন মীরার দিকে তাকাতেই মীরা নিচে যাওয়ার জন্য বোনকে অনুরোধ করলো।
মুন কিছু বুঝে উঠতেই বসা থেকে উঠে মীরার দিকে আর না তাকিয়ে দ্রুত বৌ সাজে দৌড় দিল। মীরাও বোনের পিছন পিছন ডাক দিতে দিতে ছুট লাগালো।
সিঁড়ি বিয়ে লেহেঙ্গা পরে দৌড়ে নিচে নামতে গিয়ে অনেকবার হোঁচটও খেল মুন। সে সেসবকে পাত্তা না দিয়ে নিছে নামতেই স্তব্ধ হয়ে গেল।
-‘তোকে আমার ছেলে বলতেও লজ্জা লাগছে। এই শিক্ষা দিয়েছি আমি! তুই এক্ষুনি ঘর থেকে বের হো আমি,,,’
বড়ো বাবা রিফাতকে আরো কিছু গালি দিতে গিয়ে মুনকে দেখে থেমে গেল।
দরজার সামনেই রিফাতের সাথে অন্য একটি মেয়ে বৌ সাজে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মুন কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। এই মেয়েটির জায়গায় তো মুনের দাঁড়ানোর কথা ছিল তবে কে এই মেয়ে!
পাশেই সব আত্মীয়-স্বজনরা দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কেউ তো একে-ওপরের সাথে ইতিমধ্যে কানা-ঘুষা শুরু করে দিয়েছে।
মুন ধীরে ধীরে পায়ে রিফাতের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলো,
-‘ততুমি ম,,মজা করছো তাই না?’
মুনের কথায় রিফাত একবার মাথা তুলে এক ফলক মুনের দিকে তাকিয়ে পুনরায় মাথা নিচু করে ফেলল।
মুন এবার রিফাতের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রিফাতের পাশে বৌ-সাজে মেয়েটার দিকে তাকালো।
-‘আআপু আপনি বলেন, রিফাত আমার সাথে মজা করছে তাই না? আপনি হয়তোবা আমার রিফাতের ফ্রেন্ড, না?’
মেয়েটি চোখ তুলে মুনের দিকে তাকালো। মুনের কান্ড দেখে তার চোখও ছলছল করে উঠলো। হয়ত মুন এতটাই বাচ্চামো স্বভাব করবে তা মেয়েটির ধারণার বাইরে ছিল।
মুন একে একে তার বড়ো বাবা, বড়ো মা, মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো,
-‘ও মা, তোমরা বলো না, এসব মিথ্যে। আমি জানি এসব মিথ্যে।’
-‘মিথ্যে না,আমি সত্যিই রিনিকে বিয়ে করেছি।’ রিফাত মুনের প্রশ্নের জবাব দিল।
রিফাতের কণ্ঠস্বর শুনে মুন রিফাতের দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালো। তাকে দেখতে একদম অগোছালো লাগছে। তার দৃষ্টি অগোছালো। যে মেয়ে কিছুক্ষন আগেও হেসে-মেতে মনের সব মাধুরী মিশিয়ে প্রথমবারের মতো ভালোবাসার মানুষটার জন্য বৌ সেজেছে ;সে মেয়ে মুহূর্তের মধ্যে অন্যরকম অগোছালো হয়ে গেল। রিফাতের কথা শুনে মুনের চোখ গড়িয়ে অশ্রু নির্গত হলো। নিজ হাতে চোখে কাজল দিয়ে রাঙিয়ে ছিল ;সে-ই কাজল কিছুক্ষন না হতেই কালো পানিতে পরিণত হলো।
মুন কিছুক্ষন রিফাতের দিকে তাকিয়ে পুনরায় তার দিকে এগিয়ে গেল।
-‘দুই বছরের ভালোবাসা -সব মিথ্যে ছিল?’ মুন শান্তকণ্ঠে রিফাতের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল।
রিফাত দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। মুন রিফাতের পাশের মেয়েটির দিকে এবার পূর্ণদৃষ্টি দিল। মিষ্টি একটি মেয়ে। মুন আন্দাজ করলো, সত্যিই তো রিফাত ভাইয়ার সাথে মুনকে জীবনেও মানাতো না, মুন তো রিফাত ভাইয়ার যোগ্যই না ; এই মেয়েটিই একদম পারফেক্ট ;রিফাত ভাইয়ার সাথে একেই মানাবে।
মুন বড়োবাবা, মায়ের দিকে ফিরে কন্দনরত চেহেরায় হেসে বলল,
-‘বড়ো বাবা, মা জানো? আমি সারপ্রাইস পেতে ভীষণ ভালোবাসি। এটা রিফাত ভাইয়া জানে। তাই আজকে এমন একটা সারপ্রাইস দিয়েছে যাতে আমি সারাজীবনেও যেন না ভুলতে পারি। ধন্যবাদ রিফাত ভাইয়া।’ এটা বলতেই ভেতরের সব কান্নাগুলো যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে। মুন ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে গেল কিন্তু শেষ সফল হলো না।
সে মুখ চেপে ধরেই দ্রুত উপরে উঠে দরজা বন্ধ করে মেঝেতে বসে ডুকরে কেঁদে উঠল। তার নিয়তিটা এমন কেন হলো! সে তো রিফাতকে মনে-প্রাণে ভালোবেসেছিল। এইতো কালকেই তো সব ঠিকঠাক ছিল। কালকে রাতেও তো রিফাত ভাইয়া মুনকে নিয়ে কত ছন্দ মিলিয়েছিল। অথচ আজ! তার মানে কী রিফাত ভাইয়ার এতো দিনের ভালোবাসা সব নাটক ছিল! কাকে এতো ভালোবেসেছিল মুন! সে মুখ চেপে আবারো কেঁদে উঠলো। মুন জানালা দিয়ে বাইরে চোখ দিল। বেলা গড়াচ্ছে। সন্ধ্যা নেমেছে। এই সন্ধ্যাটা মুনের জীবনের স্মরণীয় শ্রেষ্ঠ সন্ধ্যা হওয়ার কথা ছিল। অথচ আজ,,! তার বুকটা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে।
মুন চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। গায়ের গহনা গুলো এদিক-ওদিক ফেলে দিল। অসহ্য লাগছে এসব! রিফাত ভাইয়া কীভাবে পারলো! এটা করার আগে মুনের চেহেরা তার চোখে কী একবারও ভাসলো না। নিচ থেকে প্রচুর শোরগল শোনা যাচ্ছিলো এতক্ষন কিন্তু এখন নিস্তব্ধ। মুন জানতো, বড়ো বাবা কিছু সময় রেগে চেচামেচি করে কিছু বললেও সেটা করে না। আজও এর ব্যতিক্রম হলো না। রিফাত ভাইয়াকে এমনি রাগের মাথায় বেরিয়ে যেতে বলেছিলো কিন্তু শেষে শান্তি হয়ে যাবে আর রিফাত ভাই আর ওর বৌকে মেনে নিবে।
রিফাত ভাইয়া এই বাড়ির বড়ো ছেলে। বড়ো বাবার একমাত্র ছেলে। আর মুন হলো বড়ো মেয়ে অথাৎ মুনের বাবা এই বাড়ির মেজো ছেলে ছিল কিন্তু কোনো এক কারণে মুনের বাবা মারা গিয়েছিলো। এরপর মুনের মাকে বড়ো বাবারা আর যেতে দেয়নি। নিজেদের কাছেই রেখে দিয়েছিলো। মুন আর ওর ছোটবোনের পাশে বড়ো বাবা সবসময় নিজের বাবার মতোই ছায়া হিসেবে পাশে থাকতো। এমনকি দাদু, আর পরিবারের বাকিরা রিফাতের চেয়ে বেশি মুনকে ভালোবাসতো। সবার এতো এতো ভালোবাসা পেয়েও মুনের মনে হলো ও আজ হেরে গেল। আসল ভালোবাসাটাকেই পেলো না। রিফাত ভাই আধো কী মুনকে ভালোবেসেছিলো! না-কি ভালোবাসার অভিনয় করেছিল! তা মুনের অজানা। সে-ই রাতে মুন কাঁদতে কাঁদতে ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। রাতে অনেকে ডেকেছিল মুনকে কিন্তু মুন ‘ঘুমাচ্ছে’ বলে বাহানা দিয়ে দরজা খুলেনি। মাঝরাতে ঘুম ভাঙার কারণে প্রতিদিনের ন্যায় আজকেও মুন ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো কিন্তু আজ ভিন্ন। মুনের পাশের ব্যালকনি-ওয়ালা রুমটা রিফাত ভাইয়ার। অন্যদিন হলে এতক্ষনে রিফাতকে ডেকে তুলে ফেলতো মুন। মুন এক নজর পাশের ব্যালকনিটার দিকে দৃষ্টি দিল। রাতের সব নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরেছে যেন রুমটাতে। হয়ত সারারাত গল্প করার ফলে এতক্ষনে ক্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। মুন ওই রুমটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
‘ খারাপ সময়টা একদিন ঠিক’ই চলে যাবে
কিন্তু আমার তো আপনাকে চেনা হয়ে গেল।’
মুন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে ঢুকে গেল। সে বুঝতে পারছে এই বাড়িতে থাকলে সে কিছুতেই কোথাও মন বসাতে পারবে না। তাই সে এতদিন রিফাত ভাইয়াকে ভালোবাসার জন্য যে সুপ্ত ইচ্ছেটাকে দমন করে রেখেছিল সেটা আবারো পূর্ণ করার জন্য মন উঠে-পড়ে লেগেছে। কিন্তু বড়ো বাবাকে মানাতে পারলেও বাকি সবার রিঅ্যাকশন কেমন হবে ভেবে ভয় লাগছে মুনের। কিন্তু এটা ছাড়া এই বাড়ি ছেড়ে থাকার আর উপায় নেই। এটা পালন করতে মুনের জন্য কষ্টসাধ্য হলেও পালন করতে হবেই। মুনের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানিগুলো মুছে নিল। সে আর কান্না করবে না, আর নরম হবে না। আর কারো জন্য নিজের আবেগ ঢেলে দিবে না। সামনে যে আরো অনেক পথ চলা বাকি।