#স্নিগ্ধ_গাংচিল,পর্ব_২
#নাজমুন_বৃষ্টি
রাতের নিস্তব্ধতা কেটে গিয়ে ধরণীর বুকে দিনের আলো প্রবেশ করেছে।
দরজা ধাক্কানোর শব্দে মুনের ঘুমের ব্যাঘাট ঘটে। সে বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে। আবারো দরজা ধাক্কানোর শব্দে মুন চোখ খুলে নিজের অবস্থান বুঝতে পারলো। রাতে ব্যালকনি থেকে এসে দরজার পাশে বসেই স্মৃতিস্মরণ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
মুন বিরক্তসূচক শব্দ করে দরজা খুলতেই দেখলো মা দাঁড়িয়ে আছে।
মুনের মা মুনের দিকে মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
-‘কী ব্যাপার, মা। রুমে এসো। তাকিয়ে আছো যে!’
-‘তুই এখনো বিয়ের সাজে!’
মায়ের কথায় মুনের হুশ ফিরলো। সে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখল ;তার গায়ে এখনো বৌ-য়ের পোশাক। এসব দেখে মায়ের হয়তবা মন খারাপ হয়েছে তা ভেবে মুন নিজেকে নিজে কয়েকটা গালি দিল। তারপর হেসে বলল,
-‘ওহ এই ব্যাপার। আসলে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মা তাই আর খেয়াল হয়নি। তুমি তো জানোই মা, আমার ঘুম অনেক ভারী।’
মুনের মা মেয়ের দিকে নিঃস্পলক-ভাবে তাকিয়ে রইলো। তার ছোট্ট বাচ্চামো স্বভাবের মেয়েটা কথা লুকাতে শিখে গিয়েছে। তিনি জানেন, তার এই মেয়েটা অনেক নরম স্বভাবের মেয়ে। কিছু না হতেই কেঁদে-কেটে অবস্থা খারাপ করে ফেলে আর এখন এতো বড়ো ঘটনার পরেও মনের ভেতর এতো বড়ো পাথর চাপা দিয়ে কী নিঃসংকোচে মিথ্যা বলা শিখে গিয়েছে। তিনি রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। রুমের অগোছালো ভাব দেখে যা বোঝার বুঝে ফেলেছে। তিনি গিয়ে বিছানাটা ঝাড়তে ঝাড়তে মুনকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বললেন। মুনও বাধ্য মেয়ের মতো মাথা হেলিয়ে কাপড় নিয়ে ফ্রেশ হওয়ার উদ্দেশ্যে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। ততক্ষনে রাশিদা ইসলাম মুনের রুমটা গুছিয়ে ফেলল এরপর বিছানার এক কোনে বসে মুনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।
মুন ওয়াশরুম থেকে বের হতেই মাকে বিছানায় বসে থাকতে দেখল। রাশিদা ইসলাম মিষ্টি হেসে ইশারায় মেয়েকে তার কাছে ডাকলেন। মুন এগিয়ে মেঝেতে বসে মায়ের কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে মায়ের কোলে মুখ গুঁজে জড়িয়ে ধরলো।
‘পৃথিবীর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য স্থান হলো মায়ের কোল ; যেখানে নিঃসন্দেহে সব দুঃখ-কষ্ট জমিয়ে রাখা যায়।’
রাশিদা ইসলাম মেয়ের মাথায় পরম যত্নে হাত বুলাতে লাগল। সে জানে তার এই মেয়ে মন খারাপ হলেই মায়ের কোলে মাথা রেখে শান্তি পায় কিন্তু আজ শত মন খারাপ হলেও সে রাশিদা ইসলামের কাছে যেত না। কারণ সে তার দুঃখে মা’কে ব্যতিত করতে চায়নি।
মুনের চোখ গড়িয়ে অশ্রু নির্গত হলো। কাঁদবে না বললেও কান্না আসে। সে বুঝতে পারছে কিছুতেই এই বাসায় থাকা হবে না। এই বাসায় থাকলে প্রতি পদে পদে দু’বছরের অতীত স্মরণ হবে। জীবনটাকে সুন্দর করে গুছিয়ে নিতে পারবে না।
রাশিদা ইসলাম মেয়ের চোখে পানি দেখে মেয়ের মুখ-পানে তাকালো। তিনি মুচকি হেসে মেয়ের চোখের পানিগুলো নিজে হাতে পরম যত্নে মুছে দিল।
-‘কাঁদে না মা। জীবনে চলতে গেলে এমন কত কিছুই তো ঘটে, সবকিছু মাথায় নিতে হয় না মা। কিছু কিছু জিনিস ভুলে গেলেই ভালো। সামনে যে এখনো তোর সম্পূর্ণ জীবনটাই বাকি। আমি জানি আমার মেয়ে পারবে। সব ভুলে আবারো সুন্দর করে জীবন গুছিয়ে নিতে।’
মুন মাথা তুলে মায়ের দিকে তাকালো,
-‘মা, আমি একটি জিনিস চাইলে তুমি দিবে?’
রাশিদা ইসলাম মেয়ের কথা শুনে মুচকি হেসে বলল,
-‘কেন দিবো না মা! তোরা দুই মেয়ের জন্য আমি সব করতে পারবো।’
মুন মায়ের কথা শুনে কিছুক্ষন মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। সে জানে এখন মুন কথাটি বললে মা কান্না করে দিবে কিন্তু এটা করা ছাড়া যে মুনের আর উপায় নেই।
-‘মা, আমার একটি ইচ্ছে ছিল তা তো তুমি জানতে কিন্তু এই বিয়ে উপলক্ষে সেই ইচ্ছেটাকে বিদায় জানিয়েছিলাম।’
-‘হ্যাঁ তা তো জানি, ওই বিদেশে পড়তে যাওয়ার ইচ্ছে । অনেক আগে একবার বলেছিলি যে তুই,,,’ বলতে বলতে থেমে গেল রাশিদা ইসলাম। তিনি কিছু বুঝে উঠতেই মুহূর্তের মধ্যে মুখটা মলিন হয়ে গেল।
মুন কান্নারত চোখে মাকে অনুরোধ করলে রাশিদা ইসলাম বলে উঠেন,
-‘কিন্তু মুন,,,’
-‘মা প্লিজ। আমার এই একটা কথা রাখো। এই বাসায় থাকলে আমি কিছুতেই কোথাও মন বসাতে পারবো না।’
-‘দরকার হলে আমি আমার দুই মেয়েকে নিয়ে বহুদূরে অন্য আরেকটা বাসায় চলে যাব। তবুও তোকে ছাড়ছি না আমি। তোদের ছাড়া আমি আমার জীবন ভাবতে পারবো না।’
-‘মা, এমন কথা ভুলেও বলিও না। বাবা মারা যাওয়ার পর বড়ো বাবা আমাদের আলাদা হতে দেয়নি। আর এখন আমার জন্য কেন আলাদা হবে! আমি হতে দিবো না। বড়ো বাবা, মায়ে’রা তো কিছু করেনি। তাঁদের থেকে কেন আলাদা হবে, মা। বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের আগলে রেখেছেন উনারা।’
-‘তাহলে হোস্টেল,,, আমি গিয়ে গিয়ে দেখে আসবো।’
-‘হোস্টেলে থাকলে বাসায় আমার আসতে হবেই। এই বাসায় আসলেই আমার অতীত পুনরায় মনে পড়বে। আমি ভুলতে পারবো না, মা। প্লিজ মা।’
রাশিদা ইসলাম মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়ের একটা কথাও তার ফেলনা মনে হলো না। কতটা কষ্ট নিয়ে মেয়েটা এমন কথা বলছে তা ভাবা উচিত। তিনি মুনের মুখ দুহাতে আবদ্ধ করে নিয়ে বলে উঠল,
-‘বড়ো হয়ে গেছিস তুই, মা।’
মুন হেসে মাকে জড়িয়ে ধরল।
—————-
দুপুরে খাওয়ার জন্য মুনের ছোট বোন মীরাকে দিয়ে বড়ো বাবা ডাকতে পাঠিয়েছে যার কারণে মুন বাধ্য হয়ে নিছে নামলো। মুন টেবিলের কাছে গিয়ে বসতেই দেখল রিফাতের চেয়ারটা খালি। মুন বুঝতে পারলো এটা বড়ো বাবারই কাজ। হয়ত রাগে রিফাত ভাইয়াকে একসাথে খেতে নিষেধ করে দিয়েছে, সবার পরেই ও খেতে পারবে। টেবিলের এক পাশে নতুন বৌ দাঁড়িয়ে আছে। মুন টেবিলের কাছাকাছি যেতেই বড়ো বাবা মুনকে ডেকে তার পাশে বসালো। এরপর নিজের প্লেট থেকে মুনের প্লেটে মাছের মাথাটা তুলে দিল। সবাইকে ইশারায় খাওয়া শুরু করতে বলল। এই বাড়ির নিয়ম এটা – বড়ো বাবা যতক্ষণ কিছু বলবে না ততক্ষন কেউ মুখ খুলবে না। সবাই অনেক মান্য করে তাই তো সবাই একসাথে এতদিন আছে।
-‘মা, তুমি মীরার পাশের চেয়ারটাতে বসে খেয়ে নাও।’ বড়ো বাবা নতুন বৌয়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠল।
-‘না, বাবা। আমি পরে খাবো।’ নতুন বৌ মাথার আঁচল টানতে টানতে বড়ো বাবার কথার প্রতিউত্তর করলো। এরপর বড়ো বাবাও আর জোর করেনি। হয়ত রিফাত ভাইয়ার সাথে খাবে বলে একসাথে খাচ্ছে না। মুন খেতে না পারলেও খাওয়ার অভিনয় করে যাচ্ছে। এইতো মুনের পাশের চেয়ারটাতে এতদিন রিফাত ভাইয়াই বসেছিল আর আজ,,! মুনের কেন জানি ভীষণ কান্না পাচ্ছে।
খাওয়ার মাঝখানে মুন বড়ো বাবার দিকে একবার তাকাল। মনে মনে নিজেকে কথাটা বলার জন্য প্রস্তুত করে নিল কিন্তু তবুও কোথাও একটা বাধা কাজ করছে, ভয় ভয় লাগছে। কিন্তু এখন এতকিছু ভাবলে চলবে না, ভয়কে একপাশে ফেলে অবশেষে মনের সাথে দীর্ঘক্ষন যুদ্ধ করে বড়োবাবাকে ডাক দিল।
-‘বড়ো বাবা।’
মুনের ভয় ভয় কণ্ঠস্বর শুনে আফজাল শেখ খাওয়া থেকে চোখ তুলে মুনের দিকে তাকালো। টেবিলে বসা বাকিদের দৃষ্টিও ততক্ষনে মুনের দিকে।
-‘হ্যাঁ, মা।’
-‘বাবা, আমি কিছু চাইলে তুমি দিবে?’
-‘হ্যাঁ, অবশ্যই দিবো। তুই নিঃসঙ্কোচে বল।’
-‘বাবা, আমি বাইরের দেশে গিয়ে পড়তে চাই। এই ইচ্ছেটা আমার অনেক আগে থেকেই ছিল কিন্তু কোনো কারণে এতদিন দমিয়ে রাখলেও এখন আর পারছি না। এখন তো আর কোনো বাধা নেই।’ মুন এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে বড়োবাবার দিকে তাকালো। জানে না, কীভাবে এতো কঠিন কথাগুলো এতো স্বাভাবিকভাবে বলতে পেরেছে মুন।
আফজাল শেখ কিছুসময় মুনের দিকে শান্তদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তার কোনো ভাবান্তর নেই। যেন এমন কিছু হওয়ারই ছিল। মুন এমন কিছু বলবে তা যেন তিনি আগে থেকে জানতেন। বাকিদের দৃষ্টি হতবাক, স্তব্ধ। তাদের কেউর’ই আর বোঝার বাকি নেই যে মুনের হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণ।
মুন খাওয়া শেষে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলেই রিফাতকে নামতে দেখল। এমন ভাব করছে যেন কিছুই হয়নি। মুন না দেখার ভান করে রিফাতকে পাশ কাটিয়ে উঠতে গেলেই রিফাতের ডাকে পা স্থির হয়ে গেল।
-‘মুন,,’
মুন নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করেও পারলো না। রাগী দৃষ্টিতে রিফাতের দিকে আঙ্গুল তাক করে কিছু বলার উদ্দেশ্যে ফিরতেই নিচে বড়ো বাবাকে দেখে থেমে গেল। বড়ো বাবাকে দেখে রিফাত মাথা নিচু করে নেমে গেল।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।