#স্নিগ্ধ_গাংচিল,১৩,১৪
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১৩
আদ্রিন আজকে ভার্সিটি যাবে। আজই সে চাকরিটা ছেড়ে দিবে। ভার্সিটি’তে আসার পর থেকে একবারও মুনকে চোখে পড়লো না। আদ্রিন মনে করেছে হয়ত ক্লাসে আছে। ক্লাসে যাওয়ার পরও মুনকে কোথাও দেখা গেল না। মুনদের দলটাতে আজ তিনজন উপস্থিত কিন্তু মুন আর অর সাথের মেয়েটা নেই। সে বুঝতে পারলো না এর কারণ। কোনোমতেই ক্লাসটা শেষ করে বের হলো। চাকরিটা আজ ছেড়ে দেওয়ার কথা থাকলেও ছাড়লো না। মুন যেদিন আসবে সেদিনই ছেড়ে দিবে। আদ্রিন মনে করলো, হয়ত কোনো কারণে আসেনি। তাই সেদিন সে আর কোনো ক্লাস করালো না, যার জন্যই আসে সে যদি না আসে তাহলে আর ক্লাস কী জন্য করাবে!
সেদিনের দিনটা আদ্রিনের কোনোমতেই কাটলো। এরপরের দিন ক্লাসে গিয়েও দেখলো মুন আসেনি। সে ক্লাস শেষে রিক-সিমিরা চলে যাওয়ার সময় ডেকে উঠল। রিক-সিমিরা দাঁড়াতেই আদ্রিন তাদের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,’মুনের ব্যাপারে তোমরা কিছু জানো?’
-‘মুন দেশে চলে গিয়েছে , জানি না আর ফিরবে কিনা!’
আদ্রিন সিমির মুখ থেকে কথাটা শুনেই স্তব্ধ হয়ে গেল। সে সামনে থাকা কাঁচের টুলে লাথি মারতেই সেটা ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়লে রিক-সিমি তিনজনেই অবাক দৃষ্টিতে আদ্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল। আদ্রিন সামনে থাকা তিনটা মানুষের চোখে ভয় দেখতে পেয়ে নিজেকে যথাসম্ভব ঠান্ডা করার চেষ্টা করে শান্ত মাথায় ওদের বসতে বলল। ওরা ভয়ে ভয়ে বসতেই আদ্রিন তার অনুভূতির কথা জানালো।
আদ্রিনের কথা শুনে সামনে বসা তিনজন্যই অবিশ্বাস্য-দৃষ্টিতে আদ্রিনের দিকে তাকালো। তারা ভাবতে পারছে, মুনের মতো একটা সাধারণ মেয়েকে এত্ত বড়ো নামকরা মানুষ ভালোবাসে! আদ্রিনের কথা শুনে সিমির একটু মন খারাপ হলো কারণ তার ক্রাশ বলে কথা! কিন্তু পরবর্তীতে মুনের কথা ভাবতেই তিনজনেই উৎফুল্ল হয়ে গেল।
আদ্রিন ওদের কাছ থেকে ইরার বাংলাদেশি নাম্বার নিয়ে ওই অবস্থায় রেখে বেরিয়ে নিজের গাড়ির দিকে হাঁটা ধরলো। তার মনটা আজ ভীষণ খারাপ। তবুও সে হাল ছাড়বে না, জীবনের প্রথম এমন অনুভূতি হয়েছে, সেটাকে সে কোনোমতেই হারাতে দিবে না। যার দরুন সুদূর বাংলাদেশ যেতে হলেও সে রাজি।
———–
বাসায় এত্তো এত্তো পুলিশকে বিদায় দিয়ে আফজাল শেখ রিফাতের সামনে তুটনিতে হাত রেখে বসে রইল। পাশেই আফজাল শেখের স্ত্রী রোকসানা বেগম মুখে আঁচল চেপে কান্না করছে। রোকসানা বেগমের কান্নার মাঝে মাঝে হিচকির আওয়াজে আফজাল শেখ ‘চ’আকারে বিরক্ত-সূচক শব্দ তুলে ধমকে উঠল,
-‘এমন প্যাচ প্যাচ শব্দ তুলবে না তো রোকসানা। এখান থেকে যাও।’
আফজাল শেখের কথা শুনে রোকসানা বেগম অন্য-সময় চুপ থাকলেও এখন আর পারছে না। সে কান্নার মাঝেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল।
-‘তোমার কী মায়া-দয়া একদম নেই? ছেলেটা সুসাইড করতে করতে বেঁচে গেল আর আমি কাঁদবো না? তুমি তো শান্তিতে আছো।’
-‘হ্যাঁ, আমি শান্তিতে আছি। এত্তো এত্তো পুলিশদের কে থামিয়েছে? তুমি না-কি আমি! ছেলেটা কেমন ভয়ানক হয়েছে, ভাবতে পারছো? তার বউ চলে যাওয়ায় সে আত্মহত্যার চেষ্টা করছে আর আমরা! আমরা বুঝি তার কেউ নাহ! ফাঁসিতে ঝুলার আগে তার কী একবারও আমাদের কথা মনে হয়নি? সে যদি আজ মারা যেত তাহলে ফাঁসতাম আমিই! কারণ তার মোবাইলে কললিস্টে প্রথম আমার নামটাই ছিল।’ এরপর আফজাল শেখ ব্যাডে শোয়া রিফাতের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে উঠল,
-‘আরে তোর উপর একটু রাগ করেছিলাম। আর তুই সেই রাগকে সত্যিকারে ভেবে ফেললি বাবা? কোনো বাবা-মা’ই তার সন্তানের খারাপ চায় না। ওই মেয়েটাকে প্রথম দিনই আমি বুঝেছি, কোনো ঘাপলা নিশ্চই আছে। আর আমাদের মুন মা ওই মেয়ে থেকে কিসে কম ছিল, তুই বল! এখন কে কষ্ট পাচ্ছে! তুই না কি আমরা? আমি কয়েকদিন তোর উপর রাগ রেখেছি এরপর তো আর কোনো কথা বলিনি ওই বিষয়ে। কেন ফাঁসি নিতে গেলি বাবা? আজ এই যাত্রায় যদি তুই বেঁচে না ফিরতি তাহলে ভাবতে পারছিস, এই পরিবার, এই মানুষগুলো কেমন ভেঙে পড়তো? তোর মা তো কাঁদতেই কাঁদতেই শেষ হয়ে যেত। এই পরিবারটা ছন্নছাড়া হয়ে যেত। তুই শেখ পরিবারের বড়ো ছেলে হয়ে যদি না বুঝিস!তাহলে আর বাকিগুলো কী করবে! আমার আর কিছু বলার নাই বাপ্। বোঝার ক্ষমতা আমাদের চেয়ে তোর বেশি আছে।’ বলেই আফজাল শেখ বেরিয়ে যেতে নিলে রিফাত পেছন দিক থেকে ডেকে উঠলো। আফজাল শেখ ফিরতেই রিফাত এগিয়ে আফজাল শেখকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।
রিফাত একে একে সব বলতে লাগলো সবার সামনে। মূলত রিফাতের যে বন্ধুটা প্রীতিকে পাওয়ার জন্য মুনের সাথে দুইবছর অভিনয় করতে বলেছিলো সে অনেক জঘন্য মনের একজন। আকাশ নাম তার । প্রীতির সাথে তার অনেক আগে থেকেই সম্পর্ক ছিল। রিফাত যখন প্রীতিকে পছন্দের কথা আকাশকে জানাই, আকাশ তখন রিফাতকে শর্ত দেয় ‘প্রীতিকে পেতে হলে মুনের সাথে দুইবছর অভিনয় করতে হবে বিনিময়ে প্রীতিকে পাবে ‘। রিফাত প্রীতিকে দেখে এতো বেশি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল যে সে হিতায়িত জ্ঞান হারিয়ে রাজি হয়ে যায়। আকাশের রিফাতকে এমন শর্ত দেওয়ার কারণ হচ্ছে, প্রীতির সাথে সম্পর্কে জড়ানোর আগে আকাশ মুনের পেছনে দুইবছর ঘুরেছিল কিন্তু মুন আকাশের সাথে সম্পর্কে জড়ায়নি আর তার উপর একদিন আকাশ মুনের হাত ধরায় মুন রাস্তায় সবার সামনে আকাশকে তাপ্পর দিয়েছিলো, যেটা আকাশকে ক্ষোভে পরিণত করেছে, তার মুনের উপর একটা চাপা ক্ষোভ থেকে গিয়েছিল। এরপর সে প্রীতির সাথে সম্পর্কে জড়ায়। প্রীতিকে তার পরিবার থেকে বিয়ের চাপ বেশি দেওয়ায় তখন আকাশ বুদ্ধি করে রিফাতের সাথে প্রীতির প্ল্যান অনুসারে পরিচয় করায়। এরপর প্রীতি রিফাতের সাথে সম্পর্কে যাওয়ার অভিনয় করে। আকাশ বলেছিল, মুনের বিয়ের দিনই রিফাত প্রীতিকে পুরোপুরি পাবে। হয়েছেও সেটা। তবে বিয়েটা নকল ছিল যা রিফাত বুঝতে পারেনি কারণ কাজী আকাশই এনেছিল। আসলে প্রীতির পরিবার থেকে অন্যজায়গায় বিয়ের চাপ আসায় রিফাতের সাথে বিয়ের নাটক করে একটা থাকার জায়গা হিসেবে রিফাতের বাড়িতে উঠেছিল। কারণ তখনও আকাশ বেকার ছিল তাই আপাতত রিফাতের সাথে নাটক করে তার বাসায় উঠেছিল প্ল্যান করে। শুধু তাই নই, রিফাতের বাসায় প্রীতির হাতের কাছে যা অর্থ পাবে তা-সব নিয়ে একদিন প্রীতি-আকাশ দুজনে অনেকদূরে চলে যাবে। শেষপর্যন্ত তাদের আশা সফল হয়েছে।
পরিবারের সবাই রিফাতের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। তারা কোনোদিন কল্পনায়’ও এমন কিছু আনেনি। রিফাত আফজাল শেখের দিকে এগিয়ে গিয়ে হাঁটুমুড়ে বসে পড়ল।
-‘বাবা আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি আর এমন কাজ করতে যাবো না। আমি মানসিক যন্ত্রনায় এতটাই অন্ধ হয়ে গেছি যে, সে সময় কী করবো আমি ভাবতে পারিনি।’ বলেই রিফাত রুমে থাকা পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের দিকে তাকিয়ে হাত জোর করে ক্ষমা চাইলো। রিফাত মুনের দিকে এগিয়ে গেল। মুনকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,’আমায় ক্ষমা করে দিস মুন। আমি তোকে আমার বোনের নজরেই দেখতাম। মোহর টানে হিতায়িত জ্ঞান হারিয়ে তোর সাথে প্রেমের নাটক করেছিলাম। মাঝখানের এই দুইটা বছর ভুলে যা। আমি আগের মতোই বড়ো ভাই হিসেবে তোকে আগলে রাখবো। প্রমিস করছি, এই বিশ্বাসটা কোনোদিন ভঙ্গ করবো না। আজীবন তোর বড়ো ভাই হয়েই থাকবো। আমি তোকে সবসময় বোনের নজরেই দেখেছি। উপরে প্রেমের অভিনয় করলেও মনে মনে তোকে বোন হিসেবেই মেনে এসেছি। আমাকে ক্ষমা করে দেয় মুন, একটা শেষবারের মতো সুযোগ দেয় আমায় প্লিজ।’ বলেই কাঁদতে কাঁদতে রিফাত মুনের পায়ের নিচে বসে পড়ল।
রিফাতের কান্না দেখে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের চোখে পানি এসে গেল। মুনের পাশে ইরা দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখেও পানি, সে এতক্ষনে যা বোঝার বুঝে ফেলেছিল। মুন এখান থেকে যাওয়ার কারণটা ইরাকে বলেছিলো। ইরা মুনের দিকে তাকিয়ে একটু সরে দাঁড়ালো। তার এই ছেলেটার জন্য বড্ড মায়া লাগছে। এক অদ্ভুত মায়া জন্মে গেছে অল্পসময়ে এই ছেলেটার প্রতি। মাঝখান দিয়ে কতই না কষ্ট পেল এই ছেলেটা!
মুনের দু’চোখ বেয়ে অঝোরে ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। সে তো এটাই চেয়েছিল সব আবার আগের মতোই হয়ে যাক।
এরপর রিফাত মুনের মা রাশিদা ইসলামের কাছে গিয়ে তার হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে উঠল,’আমায় ক্ষমা করে দিও চাচীমা। না বুঝে মুনের সাথে অন্যায় করে তোমাকে নিজেরই অজান্তে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।’
রাশিদা ইসলাম মারার ভঙ্গিতে বলে উঠল,’এই ছেলে, মায়েরা কোনোদিন তাদের সন্তানদের উপর রাগ করে থাকতে পারে না। তুইও আমার সন্তান। তোর উপর কীসের রাগ। মার খাবি।’
এরপর রোকসানা বেগম হেসে রিফাতের দিকে এগিয়ে আসতেই রিফাত মা’কে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো।
রাশিদা ইসলাম রিফাতের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,’কী খাবি? কী বানাবো বল, আজ তোর মেঝোমা তোর পছন্দের রান্না করবো।’
রিফাত হেসে উত্তর দিতেই তিনি ইরার দিকে এগিয়ে গেলেন। ইরাকে জিজ্ঞেস করতেই ইরা উৎফুল্ল কণ্ঠে তার পছন্দের কথা জানাল। এরপর শেখ পরিবারের সব বউরা মিলে রান্না করার উদ্দেশ্যে রান্নাঘরে চলে গেল। আজ তারা সব জা মিলে আবারো আগের মতো হাসিখুশিভাবে মিলেমিশে রান্না করবে। আর পোলাপাইন সব আড্ডা দিতে বসে পড়ল। আবারো সুখ ফিরে এল শেখ পরিবারে। ইরাকে দূর থেকে এসব দেখতে দেখে মুন-রিফাত দুজনেই তাদের আড্ডার আসরে ইরাকে ডাকলো। ইরা যেতেই আসর জমে উঠল।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।
#স্নিগ্ধ_গাংচিল
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১৪
সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে এলোমেলো চুলে ড্রয়ইং-রুমে যেতেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো। মুন নিজের চোখের ভ্রম ভেবে দুহাত দিয়ে ভালোভাবে চোখ কচলে নিল। না, এটা ভ্রম নই। মানুষটা সত্যিই এসেছে কিন্তু কীভাবে সম্ভব! এই সুদূর দেশে! মুনের আয়ত্তে আসলো না কিছুই।
তার সোফা থেকেই কিছুদূরে আরেকটা সোফায় মানুষটা আর আফজাল শেখ হেসে হেসে গল্প করছে। আফজাল শেখ বাংলায় কথা বলছে। আদ্রিন একটু-আধটু বুঝলেও পুরোপুরি বুঝতে পারছে না। পাশেই ইরা বসে মাঝে মাঝে আফজাল শেখের কথাগুলো অনুবাদ করে দিচ্ছে। আদ্রিন ‘হা-হু’ মাথা নাড়ছে।
মুনের আর বুঝতে বাকি রইল না। মানুষটা বাংলাদেশে! তাও বা মুনের বাসায়! এদের পাশে ইরাকে বসে থাকতে দেখে মুন বুঝতে পারল – এই সবকিছু ইরার দ্বারা’ই সম্ভব।
এই অবস্থায় মুনের রিঅ্যাকশন কেমন হওয়া উচিত -সে বুঝতে পারছে না!
তার মানে ইরা সবকিছুই জানতো। ইরা জেনেও মুনকে কিছু বলেনি।
মুনকে দেখতেই আফজাল শেখ ডাক দিল। আদ্রিনের দৃষ্টি তখন মুনের মধ্যেই আবদ্ধ।
মুন এগিয়ে যেতেই আফজাল শেখ উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে উঠল,’মুন মা, চিনেছিস আদ্রিন বাবাকে?’
মুনের খটকা লাগলো। বড়ো বাবা সহজে কারো সাথে মিশেন না, মানুষ বুঝেই মিশেন। এই ব্যাটা এমন কী করলো যে বড়ো বাবা এতো উৎফুল্ল তার উপর ‘বাবা’ সম্বোধন করে কথা বলছে!
মুনকে অন্য মনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইরা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মুনের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,’মুন আমাদের আদ্রিন স্যারকে চিনিস নাই?’
-‘চিনবো না ক্যান! উনিই তো সবসময় আমাকে শাস্তি দিতো, তাকে কী ভোলা যায়!’
মুনের কথা শুনে ইরার মুখ পানশুটে হয়ে গেল। আর আফজাল শেখ ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলে উঠল,’কীইইই?’
মুনের কথা আদ্রিন ভালোভাবে বুঝতে পারেনি যার ফলে সে পাত্তা নে দেওয়ার ভঙ্গিতে সোফায় আগের মতোই বসে রইল কিন্তু ইরা কী করবে বুঝতে পারছে না। এখন এই বাসায় আদ্রিনকে রাখার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ইরার। তার মাথায় আসছে না কী বলবে। এদিকে মুনকে ভার্সিটিতে আদ্রিন বিনা কারণে শাস্তি দিতো, সেটা শুনলে আফজাল শেখ নিশ্চিত রেগে যাবে। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ইরার দিকে তাকিয়ে রইল। ইরা মুনের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে উঠল,’সুযোগ বুঝে কোপ’টা মারলি!’ মুন দু’হাত বুকে গুঁজে সামনে আদ্রিনের দিকে তাকালো, যার অর্থ,’এবার বুঝবে সব। আমাকে বিনা কারণে শাস্তি দেওয়ার মজা।’
আদ্রিন মুনের তাকানো দেখে কী বুঝলো বোঝা গেল না। সে মুনের তাকানো’তে পাত্তা না দিয়ে মুনকে পাল্টা হাসি দিয়ে ইরার দিকে তাকালো। যার অর্থ,’এই বাসায় আমায় কীভাবে রাখবে সেটার দায়িত্ব তোমার।’
মাঝখানে পড়ে ইরা ভয়ে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে রইল। সে মুনের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো। যাতে এবারের মতো তাকে বাঁচিয়ে নেয়। আফজাল শেখ এখনো ইরার দিকে তাকিয়ে আছে। ইরা ভয়ে ভয়ে বলে উঠল,’আস,,লে আঙ্কেল, মুন ক্লাসে পড়া শিখে যেত না যার ফলে আদ্রিন স্যার সবসময় শাস্তি দিতো। সেই কথা’য় বলছে মুন।’
ইরার কথা শুনে মুন রাগী দৃষ্টিতে ইরার দিকে তাকালো আর আফজাল শেখ উচ্চস্বরে হেসে উঠল,’ওহবে, এই কথা। এটাকেই মুন শাস্তি বলছে!’ বলে আফজাল শেখ মুনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
-‘আরে মুন। পড়া না পারলে তো শাস্তি দিবেই। তুই এভাবে ক্যান বলছিস! আর জানিস, এছাড়াও আদ্রিন বাবা’র পরিচয় কী?’
-‘বাবা, উনি এমনিও শাস্তি দি,,,’ মুনের কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই আফজাল শেখ হেসে তাকে থামিয়ে দিল।
-‘তুই বাচ্চা’ই রয়ে গেলি এখনো। পড়া না পারলে শাস্তি তো দিবেই। এটা নিয়ে এতো কথা বলিস না আর। এখন আদ্রিন আমাদের মেহমান। ওকে খাতির-দারি করবি, তা না করে তুই এসব বলছিস! ছেলেটা এতদূর থেকে কাল’ই আসলো মাত্র। সকালে উঠেই তুই এসব বলছিস। আর উনি তোদের টিচার, না?’
আফজাল শেখের কথায় মুনের মুখ পানসুটে আকার ধারণ করলো। সে আর কথা আগানোর সাহস পেল না, ভয়ে শুপসে গেল।
-‘এখন যা। ওর জন্য কিছু ভালো খাবার রান্না করতে বল তোর বড়ো মা’দের। আর গিয়ে বল, আদ্রিন ঘুম থেকে উঠছে – নাস্তার ব্যবস্থা করতে।’
আফজাল শেখের কথা শুনে মুন রাগী দৃষ্টিতে একবার ইরার দিকে তাকালো, যার অর্থ,’সবকিছুর মূল তুই।’ ইরা মুনের তাকানোর অর্থ বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে ফেলে। এরপর মুন রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ানোর আগে আদ্রিনের দিকে রাগী দৃষ্টি নিঃক্ষেপ করলো।
আদ্রিন মুনের তাকানো’কে পাত্তা না দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে আরেকটু আরাম করে বসে মোবাইলের দিকে দৃষ্টি দিল।
মুন আর কাউকে না পেয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখল, বড়ো মা’রা সবাই একসাথে রান্নার কাজে ব্যস্ত। মুন গিয়ে বলে উঠল,’কে একটা জানি আসছে! উনার জন্য নাস্তা’র ব্যবস্থা করতে বলেছে বড়ো বাবা। আর আমাকেও কিছু খেতে দাও, সকালে উঠে এখনো কেউ আমাকে কিছু খেতে দেয়নি।’
মুনের কথা শুনে সবাই আদ্রিনের জন্য নাস্তা নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মুন সবার এতো তাড়াহুড়ো দেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এমনকী তার মা’ও মুনের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে আদ্রিনের জন্য নাস্তা বানাতে দৃষ্টি দিল। মুন মায়ের দিকে এগিয়ে বলে উঠল,’মাআআ, আমাকে নাস্তা দিবে না? আমি এখনো কিছু খায়নি।’
-‘ঐতো টেবিলে রাখছি। ওখানে থেকে নিয়ে খা। আমি ছেলেটার জন্য নাস্তা বানাচ্ছি, দেখছিস না?’
মায়ের এমন জবাবে মুন অবাক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। আজ মুনের থেকে আদ্রিন বেশি হয়ে গেল। মুন রাগী দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। রান্নাঘরের কেউই মুনের দৃষ্টিকে পাত্তা দিল না। তারা আদ্রিনের জন্য নাস্তা বানাতে দৃষ্টি দিল।
মুন ধপধপ পা ফেলে ড্রয়ইং’য়ের টেবিলে এসে নাস্তা নিয়ে খেতে বসলো। তার সামনেই আদ্রিন সোফায় পায়ের উপর পা তুলে আরামসে বসে মোবাইল স্ক্রল করছে। বড়ো বাবা পত্রিকা পড়ছে, ইরাকে দেখা যাচ্ছে না, হয়ত মহাশয় রুমে। মুনের ইচ্ছে করলো, এখনই গিয়ে আদ্রিনের মাথা ফাটিয়ে দিতে। এমন কে আসছে যে, বাসার কেউই মুনকে পাত্তা না দিয়ে মানুষটাকে মাথায় তুলতেছে।
মুন নাস্তা চিবিয়ে চিবিয়ে আদ্রিনের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এমন সময় বড়ো মা’রা সবাই মিলে আদ্রিনের জন্য টেবিলে নাস্তা নিয়ে আসলো। তারা এসেই আদ্রিনকে সোফা থেকে টেবিলে নাস্তার উদ্দেশ্যে ডাকলো, সাথে আফজাল শেখকেও। আদ্রিন উঠে এসে মুনের পাশে বসতেই মুন চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। এরপর নাস্তার প্লেটটা হাতে নিয়ে জোরে টেবিলে রেখে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই মায়ের কণ্ঠস্বর কানে ভেসে উঠতেই থেমে গেল,’মুন এগুলো কোন ধরণের স্বভাব। এভাবে প্লেট রাখা! নাস্তা না করে কই যাচ্ছিস! কী হয়েছে তোর?’
মুন রেগে আদ্রিনের দিকে একবার তাকালো। মানুষটা নিজের খাওয়ার দিকে ব্যস্ত। মুন দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,’কিছু না। যাকে খাওয়াচ্ছ, তাকেই খাওয়াও!’ বলেই হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল।
আদ্রিন মুনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো।’আমাকে একা ওই দেশে রেখে আসার স্বাদ নাও।’ বিড়বিড় করে আওড়ালো।
মুন রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। ইরাকে শুয়ে শুয়ে কানে ইয়ারফোন দিয়ে গান শুনতে দেখে তার রাগ আরো বেড়ে গেল। মুন রাগ করেছে সেটা সবাইকে বোঝাতে হবে তো। তাই সে রুমের দরজাটা আবার খুলে সশব্দে আটকালো কিন্তু তাতেও যখন ইরা চোখ খুলল না, মুনের রাগ আরো বেড়ে গেল। সে দরজাটা আবার খুলে লাথি দিয়ে বন্ধ করলো, তবুও ইরার কোনো ভ্রূক্ষেপ না দেখে সে ইরার দিকে এগিয়ে দেখল, চোখ বন্ধ করে কানে ইয়ারফোন গুঁজা। হাত দিয়ে বুঝতে পারল, ইরা ঘুম আর কানের ইয়ারফোন নিয়ে শুনে দেখল জ্ঞান চলছে। মুনের এদিকে বারোটা বাজিয়ে আর উনি সুখের ঘুম দিচ্ছে -এটা তো হতে পারে না। তাই মুন ওয়াশরুমে গিয়ে পানি এনে ইরার মুখ বরাবর ঢেলে দিল। ইরা ধরফড়িয়ে উঠে বসে সামনে মুনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। সে অন্যপাশ ফিরে আবারো ঘুমিয়ে পড়লো। মুন বুঝতে পারলো না, সবাই ওকে এভাবে ইগনোর কেন করছে! সব ওই ইংরেজ ব্যাটার কারণে।
#চলবে