স্নিগ্ধ_গাংচিল,৩,৪

0
897

#স্নিগ্ধ_গাংচিল,৩,৪
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৩

রাতে কেউ একজনের দরজা নক করার শব্দে মুনের অতীত ভাবনার ব্যাঘাট ঘটলো। সময় পেলেই সে ব্যালকনিতে গিয়ে পাশের ব্যালকনিটার দিকে তাকিয়ে রই। আজ দুদিন যাবৎ একসাথে পাশাপাশি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে গল্প করা হয় না। মনে হচ্ছে যেন অনেকদিন হয়ে গেল। মুন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে ঢুকে দরজা খুলতেই দেখতে পেল বড়ো বাবা দাঁড়িয়ে আছে। বড়ো বাবা সাধারণত কারো রুমে যাই না, যা বলার ড্রয়ইং-রুমে সবাইকে একসাথে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলে কিন্তু আজ স্বয়ং মুনের রুমে!
মুন বড়ো বাবাকে ডেকে মুচকি হাসলো।

-‘আসো, বাবা।’

আফজাল শেখ রুমে ঢুকে মুনকে ইশারায় বিছানায় বসতে বলল। মুন গিয়ে বসতেই এরপর তিনি একটা টুল টেনে মুনের সামনাসামনি বসলো।

-‘শোন মা। তোকে আমি বারণ করবো না বাইরের দেশে গিয়ে পড়ার জন্য। আমি নিজেও চাই আমার মেয়েগুলো যেন শক্ত মনের হয়। আমার পুরোপুরি ভরসা আছে তোর উপর কিন্তু তোর কী ওই সুদূর দেশে যেতেই হবে?’

-‘আমি এখানে থেকে কোনোদিনও পারবো না কিছু করতে বাবা। কোনো ইচ্ছেই তো তুমি অপূর্ন রাখোনি বাবা, আমার এই ইচ্ছেটাও পূর্ণ করো বাবা।’

আফজাল শেখ কিছুক্ষন মুনের দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর নরম কণ্ঠে বলল,
-‘আমি জানি তুই এটা কেন বলছিস। আমি এটাও জানি যে আমার মেয়ে নরম নই, সে চাইলে এই সবকিছুকে দূরে সরিয়ে দিয়ে মনকে শক্ত করতে পারবে। তোর এই ইচ্ছেটাকেও আমি অপূর্ন রাখবো না।’

মুন হেসে আফজাল শেখের পাশে গিয়ে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রাখলো।
-‘আমি জানতাম বাবা। তুমি কোনোদিনও বারণ করবে না। তাই তো কাল রাতেই সবকিছু ঠিক করে ফেলেছি।’

আফজাল শেখ মুনের মাথায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিল,’তোরা আমার ভাইয়ের একমাত্র সম্বল। সবসময় চায় এই বাসায় তোদের যেন কোনো কষ্ট না হয়, সব ইচ্ছেই যেন পূর্ণ হয়। কোন দেশে এপলাই করেছিস?’

-‘নিয়ইয়র্ক, বাবা।’

-‘এতো দূরে তুই নিজেকে মানাতে পারবি মা?’

-‘অবশ্যই পারব বাবা, আমার যে পারতেই হবে। শুধু তোমার এই মেয়েটার জন্য একটু দোয়া করো।’

-‘ওখানে কার সাথে থাকবি এতো বড়ো একটা ভিনদেশে?’

-‘চিন্তা করো না। আমার ছোট বেলার এক বান্ধবী ওখানে সেটেল। ওই যে ইরা ছিল যে? সেই। বাবার সাথে ও মাধ্যমিক শেষে চলে গিয়েছিলো। ওর সাথে আমার যোগাযোগ আছে। সে-ই সবকিছু ঠিক করে রেখেছে। আমি ওর সাথেই থাকব আপাতত, সমস্যা হবে না।’

-‘পারবি তো?’
-‘হ্যাঁ,২০০%’
-‘আচ্ছা, আমি কালকে থেকেই সব ব্যবস্থা করে ফেলবো।’

এরপর মুন হেসে আফজাল শেখের বুকে মাথা রাখলো। এই মানুষটার বুকে মাথা রাখলে বাবা নামক মানুষটার বুকে মাথা রাখার মতো অনুভব হয়। ছোট থেকেই এই মানুষটাই মুনের সবকিছু বাবার মতো করেই দেখেছেন। কোনো কিছুই অপূর্ণ রাখেনি। বড়ো বাবা কোনো অন্যায় কাজ সহ্য করতে পারে না। মুন জানে না, সেই জায়গায় রিফাত ভাইয়ার অন্যায় কাজটা কীভাবে সহ্য করে এই বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে। কী জানি! হয়ত বা ছেলে বলে বাড়িতে জায়গা দিয়েছে। মুন আর কিছু না ভেবে বড়ো বাবার বুকে চোখ বুজে রইল। এরপর আর কখন এভাবে বুকে মাথা রাখতে পারবে সেটা মুন জানে না। এই মানুষটাকে সে কখনো ভুলবে না। সবসময় ছায়ার মতো পাশে ছিল।

রুমের বাইরে দরজার আড়াল থেকে আফজাল শেখ আর মেয়ের কথোপকথন শুনে রাশিদা ইসলাম আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছলো। আজ ভীষণ করে মুনের বাবার কথা মনে পড়ছে। তার চাঁদ মা যে অনেক বড়ো হয়ে গিয়েছে। ছোট বেলায় তিনি মুনের ছোট ছোট হাত-পা ধরে বলতো ‘কখন যে আমার এই চাঁদ মা’টা বড়ো হবে! আমার বুকে মাথা রাখবে! আমাকে বাবা বলে ডেকে জড়িয়ে ধরবে।’ অথচ আজ মুন বড়ো হয়ে গিয়েছে অনেক কিন্তু তিনি অনেক দূরে। এসব ভাবতেই পুরোনো স্মৃতিরা আবারো হানা দিতে থাকলো। তিনি আঁচল দিয়ে মুখ চেপে নিজের রুমে চলে গেলেন।

——————-

এরপর দুদিন মুন আর রুম থেকে বের হয়নি। সে রিফাতের সামনে পড়তে চায় না, রিফাতের সামনে পড়লেই পুরোনো স্মৃতিরা হানা দেয় তাই রুম থেকে বের হয়নি। সবকিছু রুমেই করতো। এদিকে আফজাল শেখ মেয়ের জন্য সব ব্যবস্থা অতি দ্রুতের সহিত করতে লাগলো। তিনি মুনের রুম থেকে বের না হওয়ার বিষয়টা খেয়াল করেছেন তাই তো তিনদিনের মাথায় রিফাতকে ব্যবসার কোনো একটা কাজের বাহানা দিয়ে ঢাকার বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এই কয়দিন রিফাতকে পরিবারের সাথে মোবাইলে কারো সাথে কোনো কথা বলতে নিষেধ করে দিয়েছেন। এমনকি রিফাতের বৌয়ের সাথেও। এতদিন চুপ মেরে থাকলেও এবার আস্তে আস্তে রিফাত তার শাস্তি ভোগ করবে। তার মেয়েকে তার থেকে আলাদা করার শাস্তি মুন চলে যাওয়ার পর পুরোপুরি শাস্তিটা পাবে। আর রিফাত মুন যাওয়ার সময় বাসায় থাকলে মুনের মন খারাপ হতে পারে ভাবে তিনি এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন। রিফাতকে তিনি চাইলে সেদিনই বাসা থেকে বের করে দিতে পারতো কিন্তু তিনি সেটা চায়নি, কারণ ওদের দুজনকে বের করে দিলে ওরা বাইরে অন্য কোথাও ঠিকই সংসার করবে। রিফাত সাবলম্বী ছেলে, তার চলতে কোনো কষ্ট হতো না। কিন্তু আফজাল সাহেব চান নিজের কাছে রেখেই শাস্তি দিতে। রিফাত যেকোনোভাবে বৌকে কল করবে তাই নতুন বৌয়ের কাছ থেকেও তিনি মোবাইল নিয়ে নিয়েছেন। ফল একজন কেন ভোগ করবে, দুজনেরই শাস্তি আছে।
~’পৃথিবীতে ভালোবাসার মানুষটাকে পেয়েও একে-অপরের কাছ থেকে আলাদা থাকার কষ্ট এই দুনিয়ায় আর নেই।’~আর যোগাযোগ না থাকলে তো কোনো কথাই নেই।

রিফাতের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিয়ের দুদিনের মাথায় বৌকে ফেলে ঢাকার বাইরে যেতে হয়েছে। তার উপর বাবার কড়া নিষেধাজ্ঞা, রিফাত যেন ভুলেও পরিবারের কাওকে এমনকি বউকেও কল না দেয়। তার এখন ভীষণ কান্না পাচ্ছে। মুনের সাথে দুই বছর ভালোবাসার অভিনয় করে ওকে ঠকাতে এতো কষ্ট লাগেনি, যতটা এখন লাগছে। সে বুঝতে পারছে, সামনে তাকে আরো কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।


রিফাত ভাইয়াকে বড়ো বাবা কোনো একটা কাজে কিছুদিনের জন্য ঢাকার বাইরে পাঠিয়েছে শুনে মুন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক অন্তত বাসায় যতদিন আছে ততদিন সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে পারবে মুন।
মুন নিচে নামার আগে যথেষ্ট নিজেকে পরিপাটি করে নিল। যতই উপরে বলুক না কেন মুন আর এসব ভাববে না কিন্তু দিন শেষে আবারো পুরোনো বিশ্রী অনুভূতিটা হানা দেয়। ব্যালকনিতে গেলে আরো বেশি খারাপ লাগে কারণ এই ব্যালকনিতেই পাশাপাশি তারা গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দিতো। মুনের তখন মনে হতো – সেই মনে হয় সুখী। অথচ সব না-কি মিথ্যে ছিল। মুন তাচ্ছিল্য হাসি দিল। মুন আর কিছু না ভেবে নিজের তিক্ত অনুভূতিটাকে হাসির আড়ালে ঢেকে সবার সাথে আড্ডা দেওয়ার উদ্দেশ্যে নিচে নামলো। তার ভাবতেই কান্না পাচ্ছে আর কয়েকদিন পর এই মানুষগুলোকে ছেড়ে থাকতে হবে।
মুন স্বাভাবিক ভাবে কাজিনদের আড্ডায় গিয়ে বসলো। অন্যরা আর ঘাটলো না কারণ আফজাল শেখের কড়া নিষেধাজ্ঞা – মুনের দিকে না তাকানো, স্বাভাবিক ভাবে যেন সবাই থাকে নাহলে মুনের মনে খারাপ লাগা কাজ করবে।
মুন কাজিনদের কাছে যাওয়াতে সবার স্বাভাবিক ভঙ্গিমা দেখে তার নিজেরও ভালো লাগলো। হয়ত সবাই ভুলে গিয়েছে। মুন এতক্ষন সংকোচে আসতে পারছিলো না যদি কেউ আগের কথা তুলে এই ভেবে কিন্তু এমন কিছু হয়নি ভাবে সে নিজেও স্বাভাবিকভাবে সবার মাঝখানে বসে আড্ডায় মেতে উঠলো। কাজিনদের আড্ডাতে বসতেই তার আগের আড্ডাগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। আগে রিফাত আড্ডার মাঝখানে মাঝখানে মুনের দিকে তাকাতো আর তা দেখে মুন মুচকি হেসে মাথা নিচু করে ফেলত আর এখন,,! কত তফাৎ! এসব ভাবতেই মুনের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। অন্যরা বিষয়টা খেয়াল করতেই মুনকে ওদের আড্ডার মাঝখানে রেখে হাসির হাসির কথা বলে আড্ডায় মেতে উঠলো।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

#স্নিগ্ধ_গাংচিল
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৪

সময় চলে যায় নিজস্ব গতিতে। দেখতে দেখতে মুনের যাওয়ার টাইম ঘনিয়ে আসছে। রিফাতের অনুপস্থিতিতে মুনের দিন এখন সবার সাথে ভালোই যাচ্ছে। কিন্তু আসলেই কী ভালো যাচ্ছে! রাত হলেই সব অতীত আবারো হানা দেয়।
আফজাল শেখ খুব তাড়াতাড়িই সবকিছু ঠিকঠাক করে ফেলেছেন। তিনি চান, মুন যেন অতি দ্রুত এসব ভুলে গিয়ে আবারো নতুন করে জীবন গঠন করতে পারে। আর দু’দিন পর মুনের ফ্লাইট।

গভীর রাত নেমে এসেছে, চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মুনের চোখে আজ ঘুম নেই। শুধু আছে চোখের জল। সে ব্যালকনিতে নিজের প্ৰিয় দোলনাতে বসে কাঁদতে রইল। আজ কাঁদবে, খুব করে কাঁদবে। শেষবারের মতো কেঁদে রিফাতের স্মৃতি এখানেই শেষ করে ফেলবে।
‘রিফাত ভাই কেন করলেন এমন! আপনি যদি ওই আপুকেই ভালোবাসতেন তাহলে আমার দুই বছর কেন নস্ট করলেন। আমার সুখের জীবনটাতে কেন একটা বিশ্রী অতীত দিলেন। আগে কেন বুঝতে পারিনি আমি! আমি যে নিঃস্ব হয়ে গেলাম রিফাত ভাই। আপনাকে চাইলেও ঘৃণা করতে পারছি না। সারাদিন মুখের উপর মিথ্যে হাসি ঝুলাতে ঝুলাতে আমি যে ক্রান্ত হয়ে গেলাম। আপনার জন্য আমার এতো সুন্দর পরিবার ছেড়ে ভিনদেশে যেতে হচ্ছে। তবুও মনে-প্রাণে দোয়া করি আপনি যেন সুখী হন।’ আপনমনে বিড়বিড় করে উঠল মুন। তার দু’চোখ বেয়ে আজ অজস্র ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে। মুন আজ তার চোখের জল মুছবে না। এই জলের সাথেই রিফাতের স্মৃতি বিসর্জন দিবে। আজকের পর থেকে আর ভাববে না, নিজের জীবনের দিকে ফোকাস করবে। তার মা, বড়ো বাবা যে তার সুন্দর জীবনের আশায় তাকিয়ে আছে।

মুন চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। বিছানায় শোবার পরও ঘুম আসছে না। এই দুই বছরের প্রতি রাতেই রিফাতের সাথে কথা শেষ করে ঘুমাতে যেত। অভ্যাসটা চাইলেও বদলানো যাচ্ছে না।

‘রাতে কারো সাথে কথা বলে নিয়ম করে প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার অভ্যাসটা সবচেয়ে বাজে অভ্যাস।’
মুনের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছে, মুন সেই জল আজ আর মুছবে না।

‘চোখের পানি হয়েই জড়তে থাকুক হৃদয়ের গহীন ব্যথাগুলো। ভালোবাসার মানুষটার জন্য যত হৃদয়ের গহীন ভালোবাসা আছে সব আজ মুছে যাক। মুছে যাক বেপরোয়া মনের লোকায়িত দীর্ঘশ্বাস।’

কাঁদতে কাঁদতে মুন একসময় ঘুমিয়ে গেল।


অন্যদিকে রিফাতের দিন যেন কাটছেই না। প্রীতির সাথে কথা না বলে তার দিন যেন কাটতেই চাইছে না। কোনো কাজেই মন বসাতে পারছে না। বাবাও কোনো যোগাযোগ করতে দিচ্ছে না। কেমন আছে মেয়েটা! সেই খবর পর্যন্ত জানতে পারছে না রিফাত। মুনের সাথে দুইবছর ভালোবাসার অভিনয়ের পরেই প্রীতিকে পেয়েছিল রিফাত।
দুইবছর আগে এক বন্ধুর আত্মীয়র বিয়েতে প্রীতিকে দেখেছিল রিফাত। প্রথম দেখাই ভালোবেসে ফেলেছিলো রিফাত। কিন্তু প্রীতিকে এরপর হাজার খুঁজেও পেলো না। রিফাতের যখন পাগল পাগল অবস্থা ঠিক তখনই বন্ধুরা তাকে একটি শর্ত জুড়ে দিছিলো যে প্রীতিকে পেতে হলে রিফাতের নিজের চাচাতো বোন মুনের সাথে দুইবছর প্রেমের নাটক করতে হবে, বিয়ের দিন সে প্রীতিকে পাবে। ওরা প্রীতিকে রিফাতের জন্য খুঁজে দিবে। রিফাত প্রথমে মুনের সাথে প্রেমের বিষয়টা মানতে না চাইলেও পরে প্রীতিকে পাওয়ার লোভে হিতায়িত জ্ঞানশূন্য হয়ে মুনের সাথে অভিনয় করেছিল। আর এছাড়াও মুনের প্রতি রিফাতের ছোটকাল থেকেই একটা সুপ্ত রাগ ছিল কারণ রিফাত শেখ পরিবারের বড়ো সন্তান হয়েও সবাই রিফাতের চেয়ে মুনকেই বেশি ভালোবাসতো, যার ফলে মুনের প্রতি রিফাতের চাপা ক্ষোভ ছিল। তাই তো বন্ধুদের কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলো – এক ঢিলে দুই দিকেই কাজ হয়ে যাবে ভেবে। রিফাত মুনের উপর ছোটকাল থেকে ক্ষোভটা এভাবেই মিটিয়ে ফেলতে চেয়েছিলো। মুনের সাথে এতো বড়ো অন্যায় করার পরেও রিফাতের একটুও অনুচোশনা হচ্ছে না। রিফাত এখন বুঝতে পারছে মুনের সাথে হয়ত একটু বেশিই অন্যায় করে ফেলেছে, ছোটবেলার রাগটা ভালোবাসার নাটক করে এভাবে মিটানো উচিত ছিল না। ভালোবাসার মানুষটাকে না পাওয়া যে কতটা যন্ত্রনার তা রিফাত হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। তবুও মুনের প্রতি অতটা অপরাধবোধ জেগে উঠছে না, শুধুমাত্র প্রীতির জন্য খারাপ লাগছে।

——————

দেখতে দেখতে মুনের যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো। আজ রাত ১২টাই মুনের ফ্লাইট। কিছুসময় পর পরই মুনের চোখ ভিজে আসছে। মা- বোন, বড়ো বাবা, বড়ো মা এদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওই দূর দেশে পাড়ি কীভাবে থাকবে তা ভাবতেই মুনের চোখ ভরে উঠছে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো। মুন এক হাতে কাপড় গোছাচ্ছে আরেক হাত দিয়ে একটু পর পর চোখের জল মুছছে।

রাশিদা ইসলাম মুনের রুমে এসে মুনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল।
মুন নিজের হাতে পরম যত্নে মায়ের চোখের জল মুছে মুচকি হাসলো।
-‘মা, তুমি এভাবে কাঁদলে আমার তো যেতে ইচ্ছে করবে না। আর আমি তো একেবারের জন্য যাচ্ছি না, সবসময় ফোনে ভিডিও কলে আমাকে দেখতে পারবে। এখন হাসো, নাহলে আমার যেতে মন চাইবে না।’

রাশিদা ইসলাম মুনের কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বলল,’আচ্ছা আর কাঁদবো না। তুই সবসময় কল করবি তো আমাদের?’

-‘হ্যাঁ, ফাক্কা।’ মুন মায়ের পাশে বসে দুহাতে মা’কে জড়িয়ে ধরলো। কতদিন এই মা’কে কাছে পাবে না ভাবতেই কান্না পাচ্ছে কিন্তু মায়ের সামনে তাকে যে শক্ত থাকতে হবে।

রাশিদা ইসলাম ‘একটু আসছি’ বলে মুনের রুম থেকে বেরিয়ে গেল। এরপর সাথে সাথে হাতে কিছু একটা নিয়ে আবারো মুনের রুমে প্রবেশ করলো। তিনি তার হাতের শাড়িটা মুনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-‘এই নেয় এটা তোর কাছে রাখ। মনে করবি, মায়ের আমানত। এটা দেখলেই তোর আমার কথা মনে পড়বে, সাথে সাথে কল দিবি। এই শাড়িটা তোর বাবা আমাকে শখের বশে কিনে দিয়েছিলো। তোর বাবার অনেক পছন্দের শাড়ি ছিল। সবসময় আমাকে বলতো,’তুমি এটা একদিন পড়িও’। অথচ পড়ার আগেই আমাকে একা রেখে চলে গেল। আজকে আমি এটা তোর হাতে তুলে দিলাম। ওই দেশে গিয়ে আমাদের সংস্কৃতিটা যাতে ভুলে না যাস।’

মুন শাড়িটা এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে শাড়ির উপর হাত বুলালো। এই শাড়িতেই তার বাবার ছোঁয়া আছে ভাবতেই এক অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে। সাদা পাড়ের নীল-রঙা শাড়ি। অসম্ভব সুন্দর শাড়ি। যতই শাড়িটার দিকে তাকাচ্ছে ততই বাবার কাছে যাচ্ছে অনুভূতি হচ্ছে। ক্ষনে ক্ষনে চোখ ভরে উঠছে শাড়িটার দিকে তাকালে কিন্তু এখন মায়ের সামনে কান্না করা যাবে না তাই মুন মুচকি হেসে শাড়িটা নিজের কাপড়ের সাথে গুছিয়ে ব্যাগে ঢুকালো।

মীরা এসে বড়ো বাবা নিচে অপেক্ষা করছে বলতেই মুন উঠে দাঁড়ালো। মীরাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো মুন। মীরা তো কেঁদে-কেটে অবস্থা খারাপ। এরপর একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বড়ো বাবার সাথে এয়ারপোর্ট-য়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো মুন। রাত হয়ে যাওয়াতে বড়ো বাবা একাই যাচ্ছে, কাওকে যেতে বারণ করেছে কারণ তিনি জানে ওখানে সবাই গেলে মুনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সবাই কান্না জুড়ে দিবে কিন্তু তিনি এটা চান না, তিনি চান মুন যেন শক্ত মন নিয়ে যায়।

এয়ারপোর্টে পৌঁছেই মুন বাকি সময়টুকু আফজাল শেখের বুকেই কাটিয়েছিল।

মুন সিট্ বেল্ট বেঁধে বসে আছে। তার চোখ বারবার ভিজে আসছে। আফজাল শেখের চোখ মুনকে বিদায় দেওয়ার সময় বারবার ভিজে আসছিলো। মুন বুঝতে পেরেছে, লুকিয়ে লুকিয়ে আফজাল শেখ ঠিকই চোখের পানি মুছেছে। মুন এই মানুষটাকে বুঝতে পারে না, নিজের সন্তানদের চেয়ে মুনকেই বেশি ভালোবাসেন তিনি। তিনি মুনকে বিদায় দেওয়ার সময় বারবার করে বলেছিলেন মুন যাতে শক্ত থাকে, জীবনে যেন হেরে না যায়, মুন পারবে।

কিছুক্ষনের মধ্যে এয়ারহোস্টেস এসে সবাইকে দরকারি কথাগুলো বুঝিয়ে দিল। প্লেনটা বিরাট ঝাঁকুনি দিয়ে একটু একটু করে উড়া শুরু করলো। প্লেন যত চলছে মুনের মন ততো বিষন্নতায় ভরে যাচ্ছে। এতদিন নিজের মনকে সবার সামনে শক্ত রাখতে পারলেও এখন আর পারছে না। মনে হচ্ছে নিজের আপনজনদের ফেলে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে, কীভাবে চলবে পরিবার ছাড়া এমন একটা ভিনদেশে মুন!

#চলবে ইন শাআল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here