স্নিগ্ধ_গাংচিল,৭,৮

0
952

#স্নিগ্ধ_গাংচিল,৭,৮
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৭

ম্যারিল্যান্ডের দিনগুলো খুব সুন্দরই কাটছে মুনের।
দেখতে দেখতে কয়েকদিন কেটে গেল। ভার্সিটি ট্যুরের দিন ঘনিয়ে আসছে। মুন নিষেধ করলেও ইরা, সিমিরা জোর করে নিয়ে যাচ্ছে। এটাই ম্যারিল্যান্ডের প্রথম ট্যুর মুনের।
যথাসময়ে সকালে তাড়াতাড়ি উঠে ইরা তৈরী হতে বসে গেল। আজকের রাতে ইরা পার্টিতে যায়নি। সব স্টুডেন্টরাই শর্ট জামা পরিধান করেছে কিন্তু মুন লং গ্রাউন পড়েছে। তার এখানে সবকিছু ভালো লাগলেও ড্রেস-আপটা ভালো লাগেনি। কেউই লং কাপড় পড়ে না।
সবার মূল গন্তব্য আজ ভিন্ন। ম্যারিল্যান্ডের কুইন্স নামক একটি জায়গায়। সেই জায়গায় অন্য পিকনিক-স্পটের মতো কোনো আকর্ষণীয়-মূলক কিছু নেই। একটা ভিন্ন-রকম অনুভূতি পাওয়ার জন্যই সবার গন্তব্য আজ কুইন্সের সেনেকা ক্রিক।

কুইন্সকে মূলত একটা হাল্কা-পাতলা জঙ্গল হিসেবে ধরা হয়। এর মাঝখানে একটা ক্রিক আছে- যাকে বলে সেনেকা ক্রিক। সেই ক্রিকের আশেপাশে সারি-সারি বিভিন্ন ধরণের গাছ রয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে এটা ম্যারিল্যান্ডের মতো একটা জায়গাতে দেখার মতো জায়গা। এসব কিছু ভার্সিটি’র স্টুডেন্টদের মুখেই শুনেছে মুন । কুইন্সে মূলত প্রকৃতি-প্রেমীরায় যায়। তবে একা যাওয়া রিস্কি কারণ মাঝে মাঝে বিভিন্ন ধরণের জন্তু দেখা যায়।তাই ভার্সিটিতে আগে আগে সবাইকে বলে দেওয়া হয়েছে কেউ যেন একা কোথাও চলে না যায়, সবাই যেন একসাথেই থাকে।

যথাসময়ে সবাই ভার্সিটি থেকে দেওয়া নির্দিষ্ট একটা জায়গায় এসে পৌছালো ট্যুরের উদ্দেশ্যে।
একে একে সবাই এসে পৌঁছাতেই গাড়ি ছাড়লো। গাড়িতে মুন তারই সমবয়সী অন্য একটি মেয়ের সাথে বসেছে কারণ ইরা তার বয়ফ্রেন্ডের সাথেই বসেছিল। ইরা অবশ্য তার সাথে মুনকে সহ বসতে বলেছিল কিন্তু মুন আপত্তি করে বসেনি। অবশ্য ম্যারিল্যান্ডের মতো জায়গায় এটা একদম স্বাভাবিক। রিক আর সিমি একসাথে, রিহিও তার আরেকটা ফ্রেন্ডের সাথে বসেছে।

প্রায় অনেক লম্বা একটা জার্নি’র পর তাদের গাড়ি কুইন্সে সেই ক্রিক থেকে একটু দূরেই দাঁড়ালো। একে একে সবাই নামলো। সবাই নামার আগেও সবাইকে বারবার করে বলে দেওয়া হয়েছে যাতে কেউ একা কোথাও না যায়। আর সন্ধ্যার আগে যেন এই জায়গায় পৌছায়। তারা সন্ধ্যার আগেই এই জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে। সবাই ‘হ্যাঁ’ বোধক সম্মতি দিয়ে দল বেঁধে ঘুরার উদ্দেশ্যে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। মুনও রিক, সিমিদের সাথে মিলিত হলো।

মুনের গাড়ি থেকে নেমে চারদিকে চোখ বুলাতেই মনে হলো এটা বাংলাদেশেরই কোনো একটা জায়গা।
সে সবার সাথে সাথে আরেকটু এগিয়ে গেল। চারদিকে বিভিন্নরকমের গাছ-পালা আর মাঝখান দিয়ে একটি ক্রিক। ক্রিকের ধারে ধারে বিশাল বড়ো বড়ো উইলো গাছ দাঁড়িয়ে আছে। পানির কুলকুল ধ্বনি আর পাখিদের কিচির-মিচির ডাক। এ যেন প্রকৃতির এক অপরূপ সুন্দর দৃষ্টান্ত। মুনের মনে হলো এই জায়গাতে হৈ-হুল্লোড় করে চলে প্রকৃতির কোনো স্বাদ নেওয়া যাবে না। তাই সে ওদের দল ভঙ্গ করে একটু এগিয়ে খাঁড়ির ধারে পৌঁছে গেল সে। রোদে ঝিলিমিলি করছে পানি, ব্যস্ত ভঙ্গিতে পানিগুলো কুল-কুল শব্দ তুলে ছুটছে সামনের দিকে। ওপারে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনেকগুলো উইলো গাছ। পথটা বাঁকা হয়ে নিচে নেমে গেছে। মুন এগিয়ে কয়েক পা নামতেই পিছনে অদৃশ্য হয়ে গেল ওদের দলটা। এখন শুধু উপরে আকাশ আর নিচে আপন মনে কী-সব বলছে খালের পানি।
মুনের কেন জানি ওদের ডাকতে বা নিজের ওখানে যেতে আর ইচ্ছে করলো না। সে আপনমনে প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

মুন আরও কয়েক পা নেমে দেখল, নিচে কিছুটা চওড়া একটা সমতল জায়গায় গিয়ে থেমেছে পথ, ওখান থেকেই সিঁড়ির মতো বড়ো বড়ো পাথরের কয়েকটা ধাপ নামলেই খাঁড়ির পানি।
সে এগিয়ে খালের পাড়ে এক জায়গায় ঘাসের উপর বসে পড়লো। বিশাল প্রেয়ারির প্রান্তর জুড়ে ঘাস আর ঘাস, বাতাসের চাপে দুলছে, নুয়ে পড়ছে কিছু ফুল-গাছের বড়ো বড়ো লতা। সেখানে অসংখ্য লাল রঙের ফুল মাথা ঝাঁকাচ্ছে। মুনের পাশ দিয়ে ঘাসের ভেতর থেকে ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে আসছে ছোট ছোট নাম না জানা পাখি। খানিক উড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে জঙ্গলের বিশাল বিশাল গাছগুলোর আড়ালে। মুন চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলো, অনেক, অনেক দূরে বাঁকা হয়ে মাঠিতে মিশেছে আকাশটা। মুনের পেছনে জঙ্গলের ভেতর থেকে পানির কলকল আওয়াজ আসছে, মনে হচ্ছে যেন কোথাও থেকে পানি বেয়ে বেয়ে পড়ছে। মুন উঠে সেই সূত্র ধরে হাঁটতে লাগলো। জঙ্গল ধরে কিছুদূর যেতেই ছোট্ট একটি ঝর্ণা দেখা গেল, সেই ঝর্ণা থেকেই কুলকুল করে পরিষ্কার পানি এসে জমছে ছোট্ট একটা ডোবায়, তারপর সেখান থেকে আঁকাবাঁকা নালা বেয়ে নেমে যাচ্ছে খালে। ডোবার পানিগল্প চকচক করছে, মনে হচ্ছে যেন মুনকেই ইশারায় ডাকছে।

———

আদ্রিন আজ অনেকদিন পর তার প্রকৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটাতে আসলো সময় কাটানোর জন্য। অনেকদিন ধরে আসা হচ্ছে না তার এই প্ৰিয় বাড়িটাতে। প্রকৃতির সুন্দর আবহাওয়ার মাঝে এই বাড়িটা সে নিজের হাতে কাঠ দিয়ে খুব যত্ন-সহকারে
তৈরী করেছিল। কোনো একদিন এই জঙ্গলে এসে তার মনে হয়েছিল এখানে কয়েকটা দিন যদি সময় কাটাতে পারতো! তাই তো এর পরের দিনগুলোতে খুব পরিশ্রম করে এই বাড়িটা তুলেছিল। এই বাড়িটাতে সে যখনই সময় পায় আসে। আজ কতদিন ধরে কিছু জরুরি কাজের জন্য এটাতে আসতে পারেনি। তাই তো মন না মানাতে একটু সময় পেতেই ছুটে চলে এসেছে এই বাড়িতে। তার শহরে এতো এতো দামি বাড়ি এটার তুলনায় কিছুই না মনে হয়। সে তো এখানে একেবারের জন্য চলেই আসতে চেয়েছিলো কিন্তু নানীমার কারণে পারেনি কারণ তার একমাত্র নানীমা আদ্রিনকে ছাড়া থাকতেই পারে না। আজ নানীমাকে অনেক জোর করেই এখানে রাত কাটাবে বলে এসেছিলো। অবশ্য রাতে একটু রিস্কি হয়ে যায় এখানে কারণ বিভিন্ন ধরণের জন্তু আসে। এসবে আদ্রিনের মাথা-ব্যথা নেই। তার সুখ-ই এই ঘরে নিহিত। এই ঘরটা দেখা-শোনার জন্য আদ্রিন এক অল্প-বয়সী নিরাশ্রয় বৃদ্ধকে রেখেছে। তিনি এখানেই থাকেন, নিজের জীবন কাটান প্রকৃতির সাথে। আদ্রিনের এই জীবনটায় ভীষণ প্ৰিয়। আদ্রিনের মনে হয় সত্যিকারের সুখের জীবন মানেই এটাই। সে এসেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল শেষ বেলার জঙ্গলটার প্রকৃতির আওয়াজ উপভোগ করতে।

———-

মুন প্রকৃতির প্রেমে এতটাই মজে ছিল যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে সেই খেয়াল আর তার নেই।
আকাশের মেঘে নানান রকম রঙ ধরেছে, শির-শির করছে উইলোর পাতাগুলো আর আপনমনে বকবক করছে খালের পানি। ধীরে ধীরে প্রকৃতিটাতে আঁধার ঘনিয়ে আসছে আর আশেপাশের গাছগুলোর ফাঁক-ফোকর থেকে ঝিঁঝি পোকারা আওয়াজ তুলছে। আকাশে একটা-দুটো করে জ্বলে উঠছে তারাগুলো। ক্রিকের উপারে হাওয়াই দুলছে গাছের রঙ-বেরঙের ডালগুলো। গাছের আড়ালে দূর-পশ্চিমে জঙ্গলের শেষ প্রান্ত ছুঁই-ছুঁই করছে রক্তিম সূর্যটা। অদ্ভুত শান্ত, সমাহিত পরিবেশ শুধু কোথাও থেকে যেন কিছু ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

মুনের হুশ ফিরতেই পেছনদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো সে অনেকদূর চলে এসেছে। আশেপাশে কোথাও ওদের দলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। সে পেছনে ফিরে ফেরত আসতে নিলে বুঝতে পারলো পথ হারিয়েছে। কোথাও কোনো গাড়ির নিশানাও দেখছে না। প্রকৃতি দেখতে দেখতে কখন যে আঁকা-বাঁকা পথে চলে আসছিলো তা সে টেহর করতে পারেনি। সে তার হাতের মোবাইলটার দিকে তাকালো। ভাগ্যিস, এটা হাতে নিয়েই বেরিয়েছিল। সে কন্টাক্ট নাম্বারে গিয়ে ইরাকে ফোন লাগালো। কিন্তু ব্যর্থ হলো কারণ ইরার ফোন বন্ধ বলছে, নির্ঘাত ছবি তুলতে তুলতে চার্জ শেষ করে ফেলেছে। মুন তাড়াতাড়ি একে একে রিক, সিমি আর রিহি সবার ফোনেই কল দিলো কিন্তু কল রিসিভ হচ্ছে না। হয়ত গাড়ির পাশাপাশিই তারা, যার ফলে ওখানের গানের আওয়াজের জন্য ফোনের আওয়াজ শুনছে না। আর ওরা গাড়িতে উঠে গেলেও মুনকে খেয়াল করতে পারবে না কারণ মুন ওদের সাথে বসেনি। মুন বসেছিল অন্য একটি মেয়ের সাথে, যার সাথে মুনের কোনো বাক্য এখনো বিনিময় হয়নি আর মেয়েটা আসার সময়ও চোখ বন্ধ করে কানে ইয়ার-ফোন গুঁজিয়েই এসেছিল যার কারণে পাশে বসা মুনের দিকে অতটা খেয়াল দেয়নি, হয়ত এখনো খেয়াল করবে না যে তার পাশের মেয়েটা গাড়িতে উঠেনি। মুনের কাছে যে তিন-চারজনের নাম্বার ছিল, একের পর এক সে নাম্বারগুলোতে ফোন দিতে রইল কিন্তু কোনো ফল পেল না। মুন মোবাইল হ্যান্ড ব্যাগে ঢুকিয়ে দৌড় লাগালো যেদিকে চোখ যায় কিন্তু তার আশা আবার ব্যর্থ হলো। সে আঁকা-বাঁকা জঙ্গলের ছোট ছোট রাস্তা ধরে দৌঁড়াতে লাগলো যেদিকে চোখ যায়। এদিকে পশ্চিম আকাশে সূর্য পুরোপুরি ডোবার পথে। জঙ্গলে আস্তে আস্তে পুরোপুরি আঁধার ঘনিয়ে আসছে।
মুন কোনোমতে আঁকা-বাঁকা পথ দিয়ে ওদের গন্তব্য স্থানে আসতেই দেখল, ওদের গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গাটা পুরোপুরি ফাঁকা। আশেপাশে কোনো মানুষের পদ-চিহ্নও দেখা যাচ্ছে না। শুধু সেই জায়গায় গাড়ির চাকার চাপ দেখা যাচ্ছে। মুন মোবাইল বের করে আবারো কল লাগালো। সে কান্না-মাখা কণ্ঠে প্রার্থনা করছে, যেন কেউ মুনের কলটা ধরে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুনের আশা আবারো ব্যর্থ হলো, কেউই কল উঠায়নি। মুন মাথা চেপে ধরে মাঠিতে বসে কেঁদে দিল। সূর্য পুরোপুরি ডুবে যাচ্ছে, আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল কিছু কিছু তারা মিটিমিটি জ্বলছে। কী করবে সে এই গভীর জঙ্গলে! ভাবতেই তার কান্না পাচ্ছে।
হঠাৎ জঙ্গলের ভেতরের দিকে তাকাতেই মুন চমকে উঠল। আরে, কী ওটা! আক্রমনাত্মক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা জন্তু। মুন ঐটার দিকে চোখ দিতেই ফোঁস করে উঠলো। বসা থেকে উঠে এক লাফিয়ে পিছনে সরে গেল মুন। এরকম জন্তু সে আগে কখনো দেখেনি। অনেক লম্বা, পা-গুলো ছোট ছোট। ধূসর রঙের লম্বা লম্বা পসম। মাথা তুলে কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মুনের দিকে- যেন এখনই গিলে খাবে মুনকে।
মুন ভয় পেলেও নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত রেখে সাবধানে নিচু হয়ে নিচে পড়ে থাকা একটা মরা ডাল তুলে নিলো।
মুনকে ডাল তুলে নিতে দেখে জন্তুটা ফ্যাচ করে এক আওয়াজ তুলে লাফিয়ে মুনের কাছে আসতে নিতেই মুন ভয়ে হাতের ডালটা ফেলে আবারো পেছনদিকে দৌড় লাগালো। সে জানে না এখন কোথায় যাবে, সে শুধু এতটুকুই জানে তাকে এই জন্তুটার হাত থেকে বাঁচতে হবে। মুনের চোখ যেদিকেই যায় সে এক মনে সেদিকেই দৌঁড়াতে লাগলো। পেছনে জন্তুটা মুনকে ধাওয়া করতে লাগলো।
মুন দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে অনেক দূরে কেউ একজনকে পেছনদিকে ফিরে পকেটে হাত গুঁজে ক্রিকের ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। সে আর কিছু না ভেবে মানুষটাকে তার বাঁচার শেষ অবলম্বন হিসেবে ধরে ওই মানুষটার দিকে দৌড় লাগালো।

#চলবে

#স্নিগ্ধ_গাংচিল
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৮

আদ্রিন অন্ধকার ঘনিয়ে আসতেই ঘরের ভেতর ঢুকতে নিলেই একটি মেয়েকে তার দিকেই দৌড়ে আসতে দেখলো। সে ভ্রু-কুঁচকে কিছুক্ষন সেদিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটি তার পরনে গ্রাউনটা উঁচু করে ধরে এলো-পাতাড়ি দৌড়াচ্ছে। সে তার ভ্রম মনে করে আরেকটু এগিয়ে গেল বিষয়টা ভালো করে বোঝার জন্য, নাহ,এটা তার ভ্রম নই ;সত্যিই একটা মেয়ে দৌড়ে তারই দিকে এগিয়ে আসছে। আদ্রিন বুঝতে পারলো না এই গভীর জঙ্গলে মেয়ে কোথ থেকে আসবে! সে আবারো তার ভ্রম ভেবে ঢুকতে নিলেই মেয়েটি এসে তার হাতে খামচে ধরে তারই পেছনে লুকিয়ে পড়লো।
আদ্রিনের পা থেমে গেল। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। সত্যিই কেউ একজন তার হাতে জোরে খামচে ধরে আছে। সে পেছন ফিরে মেয়েটির দিকে তাকাতেই দেখল এয়ারপোর্ট এর সেই মেয়েটি তার হাত খামচে ধরে চোখ-মুখ কুঁচকে বন্ধ করে আছে। মেয়েটিকে দেখে আদ্রিন মনে মনে ‘চাঁদ’ বলে আওড়ালো। মেয়েটি ওই অবস্থায় আদ্রিনকে সামনে তাকাতে ইশারা করলো। আদ্রিন মেয়েটির ইশারা-কৃত আঙ্গুল অনুযায়ী তাকিয়ে দেখলো দূরে একটা জন্তু দাঁড়িয়ে আছে। এবার আদ্রিন যা বোঝার বুঝে ফেলল। এসব জন্তুদের খপ্পরে পড়েছিল মেয়েটি। এই জন্তুগুলোর সামনে ভয় পেলে ওরা নিজেদের সাহসী ভেবে আরো হামলা চালায় কিন্তু উল্টো ভয় না পেয়ে হাতে শিকারীর কোনো কিছু নিলে পালাই। আদ্রিন আশেপাশে তাকিয়ে হাতে একটা গাছের ঝরা ডাল তুলে নিয়ে জন্তুটার দিকে একটু এগিয়ে যেতেই জন্তুটি ফ্যাচ করে এক অদ্ভুত হুঙ্কার তুলে পিছনে ফিরে চলে গেল।

আদ্রিন হাত থেকে ডালটা ফেলে দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকতে নিলে মুনও আদ্রিনের পেছন পেছন আসতে নিলো। তা দেখে আদ্রিন ভ্রু কুঁচকালো যার মানে হচ্ছে -তুমি কই আসছো!

মুন আদ্রিনের প্রশ্নঃবোধক চাহনি দেখে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে তাকিয়ে রইল আদ্রিনের দিকে।

-‘এখানে একটা মেয়ে একা দাঁড়িয়ে আছে আর আপনি কেমন মানুষ! মেয়েটিকে এই গভীর জঙ্গলে ফেলেই ঢুকে যাচ্ছেন!’

আদ্রিন মুনের কথা শুনে তার দিকে ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। তার ভাব-ভঙ্গিমা দেখে বুঝা যাচ্ছে সে মুনের কোনো কথায় বুঝেনি।

আদ্রিনের তাকানো ভঙ্গিমা দেখে মুন আবারো পুনরায় কথাটা বলল।

মুনকে এতো কথা বলতে দেখে আদ্রিন বিরক্তিতে ‘চ’ সূচক শব্দ তুলে ইংরেজিতে বলে উঠল,
-‘হোয়াট?’

আদ্রিনের কথা শুনে মুনের হুশ ফিরে এলো। মুন যে এতক্ষন ভয়ে বাংলা ভাষা বলছে তা তার হুশে ছিল না। এই ইংলিশ ব্যাটা কোনোদিন আমাদের মতো মিষ্টি ভাষাটির কদর বুঝবে নি! কাকে কী বলছে মুন তা ভাবতেই মুন নিজের মাথায় হাত দিয়ে একটা তাপ্পর মারলো।

-‘তাপ্পরটা আরো জোরে দেওয়া উচিত।’ এই বলে হনহন করে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল আদ্রিন।
মুন এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখল রাত ঘনিয়ে এসেছে। এখানে কোনো সিন্ক্রিয়েট করলে নিশ্চিত জঙ্গলের পশুগুলোর আজকের খাবার হবে মুন। তাই সেও আর কোনো কথা না বলে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল।

বাড়িটা দোতলা। নিচতলায় একটা শোবার ঘর আরেকটা বসবার ঘর। দোতলাটা চিলেকোঠার মতো। একটি ছোট্ট সিঁড়ি দিয়ে একটু মাত্র ফাঁক দিয়ে দোতলায় উঠা হয় তা বুঝতে পারলো মুন। জানালাগুলো কাঁচের, অনেক সুন্দর। মুন বুঝতে পারলো, শুধুমাত্র দুইজন থাকার মতোই ঘরটা বানানো হয়েছে।
বসবার ঘরে আদ্রিন একটা টুলে পায়ের উপর পা তুলে লেপটপ নিয়ে মন দিয়ে কী যেন দেখছে। মুন এদিক ওদিক তাকিয়ে আর কাওকে না পেয়ে কেঁদে দিল।

মুনের নাক টানার শব্দ শুনে আদ্রিন লেপটপ থেকে চোখ তুলে ভ্রু-কুঁচকে একফলক ওর দিকে তাকিয়ে আবারো চোখ লেপটপে দিল।

-‘এটা কান্না করার জায়গা নই। কান্না করতে হলে উপরে গিয়ে করো।’

আদ্রিনের কথা শুনে মুন মেঝেতে বসে হাত-পা ছড়িয়ে জোরে কেঁদে দিল।

আদ্রিন বসা থেকে উঠে মুনের সামনে এসে পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়ালো।
-‘জঙ্গলে একা একা হাঁটার সাহস পেয়েছো আর এখন কেন কান্না করছো? কান্না থামাও বলছি। নাহলে এভাবে পাঁজা-কোলা করে ঘরের বাইরে ফেলে দিয়ে আসবো।’

আদ্রিনের মুখ থেকে বাইরে ফেলে দিয়ে আসার কথা শুনে মুন সাথে সাথে কান্না থামিয়ে মুখ বন্ধ করে ফেলল তবুও মাঝে মাঝে হেঁচকি উঠছে। সে অন্ততঃ এটুকু সময়ের মধ্যে বুঝে গিয়েছে- এই ইংলিশ ব্যাটাটা ভারী তেড়া।

মুন মেঝে থেকে উঠে গ্রাউনটা ভালোমতো ঝেড়ে নিলো। আদ্রিন আবারো আগের জায়গায় গিয়ে লেপটপের দিকে চোখ দিল। মুনের খারাপ লাগলো ভীষণ -এই ভেবে যে – তাকে পাত্তায় দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন ছেলেটার সাথে মুনের অনেক আগে থেকে পরিচয় এবং ওদের মধ্যে সম্পর্ক সাপে-নেওরের মতো। মুন মনে মনে বিড়বিড় করে কিছু গালি দিয়ে নিলো সামনে বসা মানুষটাকে।

সে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাতেই ওর আড়াআড়ি বরাবর একজন মধ্য-বয়সী বৃদ্ধকে কিছু রান্না করতে দেখলো। সে এগিয়ে উনার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই উনি
এক গাল হেসে ইংরেজিতে মুনের উদ্দেশ্যে বলল,
-‘আমি তুমি আসার পূর্ব-মুহূর্ত থেকে সবকিছু দেখেছি মা। সাহেবের কথায় কিচ্ছু মনে করিও না, উনি এমনই কিন্তু মানুষটা বড্ড ভালো। তা মা, তুমি এতো গভীর জঙ্গলে এই সময় এভাবে কেনই বা!’

মুন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৃদ্ধ চাচাটাকে শুরু থেকে একে একে সব বলল।
উনি সব বোঝার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো।

মুন এখান থেকে চলে যাওয়ার কথা বলতেই বৃদ্ধ বলে উঠল, এতো রাতে এই জঙ্গলটা ভয়ঙ্কর-অনেক ভয়ানক জন্তু চলাফেরা করে তাই এখন যাওয়া অনিরাপদ, কালকে সাহেব চলে যাওয়ার সময় মুনকে একসাথে নিয়ে যেতে বলবে।
মুন বৃদ্ধ চাচার কথায় মাথা নাড়ালো। মুন আর বাধ্য করলো না। এমনিও এই গভীর জঙ্গলে আজ এই ইংলিশ ব্যাটার কারণেই মুন বেঁচে গিয়েছে নাহলে মুনের এই গভীর জঙ্গলে কী হতো বা ওই জন্তুটা মুনকে কী করতো ভাবতেই গলার পানি শুকায় যাচ্ছে মুনের।

বৃদ্ধটি মুনকে কিছু খাবে কিনা জিজ্ঞেস করতেই মুন উত্তর দিলো, সে ক্রান্ত-একটু ঘুমাবে। উনি হাতের ইশারায় মুনকে উপরের ছোট্ট চিলেকোঠার ঘরটি দেখিয়ে দিল। মুন ধন্যবাদ জানিয়ে ধাপে ধাপে সিঁড়িগুলো বেয়ে উপরে উঠলো।
ছোট্ট একটি রুম। দুইপাশে দুইটা ছোট্ট ছোট্ট কাঁচের জানালা। সেই কাঁচ দিয়ে বাইরের চাঁদের আলো উঁকি দিচ্ছে ঘরের বিভিন্ন আনাচে-কানাচে। সব মিলিয়ে অসম্ভব সুন্দর একটা বাড়ি।
মুন ঘুমাতে নিলেই হঠাৎ ইরাদের কথা মনে পড়লো। সে তাড়াতাড়ি তার পরনে গ্রাউনটার উড়নার এক পাশে তাকালো। সন্ধ্যায় জন্তুটার জন্য দৌঁড়াতে গিয়ে তার মনে হলো মোবাইলটা যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় পড়ে যেতে পারে কিন্তু জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়ার ফলে বেঁচে থাকলে যোগাযোগের জন্য মোবাইলটা লাগবেই এই ভেবে তার পরনের উড়নার এক অংশ জুড়ে মোবাইলটা গিট দিয়েছিল। মুন উড়নার কোনার অংশটা সামনে এনে দেখল মোবাইল অক্ষত অবস্থায় আছে, পড়ে যায়নি। সে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল একশোর উপর কল, সব কলই ইরা, রিকদের। মোবাইল সাইলেন্ট থাকার কারণে শুনতে পারেনি। হয়ত মুনকে না পেয়ে এতো কল দিয়েছিল, মুন ইরাকে কল দিতে নিবে সেইসময় দেখল ইরার নাম্বার থেকে আবারো কল। মুন কল রিসিভ করতেই ইরা এক নিঃশ্বাসে একের পরে এক কথা অনবরত বলতে থাকল। মুন ইরাকে থামতে বলে শুরু থেকে শেষপর্যন্ত সব বলার পরেই ইরা শান্ত হলো। ইরা বারেবারে মুনের এই বিষয়টাতে সে নিজেকেই দায়ী করতে লাগলো যা শুনে মুন রেগে ধমক দিতেই চুপ হলো। এরপর মুন মোবাইল রেখে ক্রান্তিতে চোখ বুজলো ঘুমের রাজ্যে।

হঠাৎ কোথাও থেকে একটা স্নিগ্ধ সুর ভেসে আসতেই মুনের ঘুম ভেঙে গেল। সুরটা নিচ থেকেই আসছে, মুনের কেন জানি মনে হলো এই সুরটা আরেকটু কাছ থেকে না শুনলেই নই। তাই সে ঘুম ঘুম চোখে চিলেকোঠার তক্তার মই পেরিয়ে কয়েকধাপ নিচে নামতেই দেখল ঘরের মেইন দরজা খোলা, সেই জায়গার কয়েক ধাপ সিঁড়ির মধ্যে আদ্রিন আগের-যুগের বেহালা নিয়ে বসেছে আর তার পাশেই বৃদ্ধ চাচাটি বসে আদ্রিনের সুর শুনছে খুব মনোযোগের সহিত। সুরটা উঠা-নামা করছে। রাতের অন্ধকারে গভীর নিস্তব্ধ জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে সুরটা। মুনের হঠাৎ করেই পরম শান্তি লাগছে। তার এমন অনুভূতি আগে কখনো হয়নি। আদ্রিনের একটু নড়াচড়া দেখতেই মুন মই বেয়ে চিলেকোঠায় উঠে গেল। এরপর শুয়ে পড়ল।

ঘুম আসছে না মুনের। শুয়ে শুয়ে অনেক রাত পর্যন্ত ক্রিকের পানির কুল-কুল আর জঙ্গলের শুকনো পাতার ফিসফাস শুনলো মুন চোখ বুজে। তার মনে হচ্ছে জীবনে এর চাইতে শান্তির আর কিছু নেই। ভোর রাতে আবারো ঘুম ভেঙে গেল মুনের। এবার ভারী কিছু পড়ার শব্দ শুনে। কান পেতে শুনলো শব্দটা, মনে হচ্ছে ছোট ছোট পা ফেলে কারা যেন দৌড়ে-বেড়াচ্ছে ছাদের উপর। কীসের শব্দ এটা! বৃষ্টি! হঠাৎ মনে হলো বৃষ্টি পড়ছে। বহুদিন বৃষ্টির টাপুর-টুপুর শব্দ শুনেনি তাই ভুলেই গিয়েছিলো এরপর শব্দ শুনতে শুনতে আবারো ঘুমের দেশে পা বাড়াল মুন।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here