স্বপ্নচারিণী,পর্ব_১৬,১৭
সামান্তা সিমি
পর্ব_১৬
নিশানকে নিজের কেবিনে দেখে মুশতাক রহমানের ভ্রু কিছুটা কুঞ্চিত হলো।এই লোক হঠাৎ এখানে কেনো।শহরে নিশানের নাম ডাক তিনি অনেক শুনেছেন।ক্রিমিনালরা যার নাম শুনলেই ভয়ে কেঁপে উঠে সে হলো নিশান।সেই লোক যখন এখানে পা রেখেছে নিশ্চয়ই কোনো ঘাপলা আছে।
চেহারায় যথাসম্ভব জবুথবু ভাব এনে মুশতাক রহমান বললেন,
“—আরে স্যার আপনি! অনেক সৌভাগ্য আমার।কোনোদিনও সরাসরি আপনার দেখা পাব ভাবতেই পারিনি।প্লিজ বসুন।”
নিশান তীব্র চোখে তাকিয়ে আছে মুশতাক রহমানের দিকে।নিশানের ভাবভঙ্গি বুঝে উঠতে পারছেন না মুশতাক রহমান। ছেলেটার চাহনি দিয়ে যেন আগুনের হল্কা বের হচ্ছে। কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলেন।
হঠাৎই দরজার কোনায় যূথীর আগমনে কাঠের পুতুলের মত দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি।এই মেয়ে এসময় এখানে কি করছে?
সমস্ত ঘটনাটাকে একসাথে মিলানোর চেষ্টা করলেন।তাঁর ভাবনা যদি সত্যি হয় তাহলে তো সর্বনাশ!গলা শুকিয়ে আসছে তাঁর।জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বিনয়ী গলায় বললেন,
“—যূথীকা তুমি এখানে? কোনো প্রয়োজন থাকলে কাল এসো।আজ আমি একটু…….
বাকি কথা সম্পূর্ণ করার আগেই নিশানের তান্ডব শুরু হয়ে গেল।টেবিলের কোনায় পরে থাকা মোবাইলটা পকেটে নিয়ে মুশতাক রহমানের কলার চেপে ধরল নিশান।হতভম্ব হয়ে গেলেন মুশতাক রহমান।টাল সামলাতে না পেরে দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেলেন। যূথী ভয়ে কাঠ হয়ে এক কোনায় জড়োসড়ো হয়ে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে।নিশানের এমন ভয়াবহ রূপ আবার দর্শন করতে হবে সেটা ভাবেনি।
মুশতাক রহমানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই টেনে হিঁচড়ে মাঠে নিয়ে এল নিশান।
সকলের পরীক্ষা কিছুক্ষণ আগেই শেষ হয়ে গেছে।মাঠের আনাচে-কানাচে, ক্লাসের বারান্দার সামনে অল্প সংখ্যক ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে।হঠাৎ করে এমন এক দৃশ্য দেখতে পেয়ে সবার আকর্ষণ সেখানে চলে গেল।কেউ কেউ গেইট দিয়ে বাইরে যাচ্ছিল কিন্তু মাঠের কাহিনী দেখে ওখানেই থেমে গেল।সবার চোখে একরাশ বিস্ময় এবং কৌতুহল।এরকম ঘটনা তাঁরা কস্মিনকালেও দেখেনি।
মুশতাক রহমানকে এক ধাক্কায় মাটিতে ফেলে দিল নিশান।
“—নর্দমার কীট! তুই কলেজের শিক্ষক? তোর ক্যারিয়ার আমি শেষ করে দিব।তোর মত লোকদের এই সমাজে জায়গা নেই।তোদের স্থান আস্তাকুঁড়ে। ”
নিশানের বলা কথাটা চারদিকে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।ততক্ষণে ছেলেমেয়েরা জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে গেছে।ভীরের এক কোনায় মনীষা এবং নীলিমাও আছে।অবাক চোখে তাঁরা তাঁদের ভাইকে দেখছে।ঘটনার বিষয়বস্তু কিছুই মাথায় ঢুকছে না।অনেকদিন পর নিশানের এমন ভয়ঙ্কর চেহারা দেখল ওঁরা। নিশানের পেছনেই কাঁদো কাঁদো চেহারায় যূথীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দুইজন আরো বেশি ধাঁধায় পরে গেল।পরীক্ষা শেষে ওরা তো যূথীকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। আর এই মেয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছে।
অবস্থা বেগতিক দেখে মুশতাক রহমান গলায় কাঠিন্যত্ব এনে বললেন,
“—এটা কেমন ব্যবহার মিস্টার নিশান?আপনি আমার সাথে এমন মিসবিহেভ করার মানে কি?”
ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল নিশান।তাঁর মন চাইছে এই মানুষরূপী জানোয়ারটাকে মারতে মারতে রক্তাক্ত করে দেয়।ফের মুশতাক রহমানের কলার ধরে দাঁড় করিয়ে নিশান গর্জে উঠে বলল,
“—একদম চুপ। তোর গলা টেনে ছিড়ে ফেলব আমি।কবে থেকে এভাবে নিরীহ মেয়েদের ফাঁসিয়ে নিজের লালসা পূরণ করছিস বল!”
এমন একটা কথা শুনে ভীড়ের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল।কেউ কেউ মূল ঘটনার সুত্রপাত কোথায় সেটা আন্দাজ করে ফেলেছে।ঘৃণ্য দৃষ্টিতে ওঁরা মুশতাক রহমানের দিকে তাকাচ্ছে। ভীড়ের মধ্য থেকে একজন মেয়ে গলা উঁচিয়ে বলল,
“—উনি শিক্ষক নামে কলংক নিশান স্যার।অনেক মেয়েদের সাথে অশালীন কাজ করেছেন।কিন্তু ভয়ে কেউ তাঁকে কিছু বলতে পারে না। আজ আপনাকে দেখে সব বলতে ইচ্ছা হলো।গতবছর শিউলি নামে আমাদের একটা ক্লাসমেট উনার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সুইসাইড করেছে।শিউলির বাবা মা গরিব তাই তাঁরা টু শব্দও করেনি।চুপচাপ মেনে নিয়েছে।না জানি আজ আবার কে উনার কুৎসিত জালে আটকা পরেছে।”
তখনই ভীড় ঢেলে কলেজের প্রিন্সিপাল হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলেন।তাঁকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে বেশ ঘাবড়ে গেছে।রুমাল দিয়ে একটু পর পর কপালের ঘাম মুছে নিচ্ছেন।নিশানের আসার খবর শোনা মাত্রই তিনি কোনোরকমে দৌড়ে এসেছেন।কৌতুহলী চোখে নিশানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“—কোনো সমস্যা হয়েছে স্যার? মুশতাক রহমান কিছু করেছে?”
নিশান সকলের সামনে স্পষ্ট ভাষায় মুশতাক রহমানের কুকীর্তি শুনিয়ে দিল।কিন্তু সেখানে যূথীর কথা উল্লেখ করে নি।
মুশতাক রহমানের চেহারা রক্তশূণ্য। তিনি এমন বাজেভাবে ফেঁসে যাবেন তা স্বপ্নেও ভাবেন নি।এতগুলো মানুষের ক্ষুব্ধ দৃষ্টির সামনে তাঁর কেমন হাঁসফাঁস লাগছে।আঁটসাঁট করে লাগিয়ে রাখা গলার কাছের বোতাম কয়েকটা খুলে দিলেন।
“—কলেজের প্রিন্সিপাল আপনি।আপনার কলেজে কি করে এমন একজন নিকৃষ্ট মনের মানুষ শিক্ষকতা করতে পারে? কোনো খবর রাখেন না আপনি? ”
নিশানের ধমকে কলেজ ক্যাম্পাস আবার কেঁপে উঠল।প্রিন্সিপাল চারদিকে অন্ধকার দেখছেন।এ কেমন সমস্যায় পরলেন উনি।তাঁর অগোচরে এতসব ঘটে চলেছে এতদিন।এখন তো কলেজের বদনাম শহরে বিদুৎ গতিতে রটে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা নিশান যেহেতু এই ঘটনায় হাত দিয়েছে তাহলে এত সহজে ছাড় পাওয়া যাবে না।
প্রিন্সিপাল কঠোর গলায় মুশতাক রহমানকে বললেন,
“—আপনাকে একজন সৎ এবং ভালো মনের মানুষ হিসেবে জানতাম।আর আপনি একটা সম্মানিত ব্যক্তির আসনে বসে এমন কুকর্ম করলেন কিভাবে?”
লজ্জায় অপমানে মুশতাক রহমানের মুখ লাল হয়ে উঠেছে।দরদর করে ঘামছেন।কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন কিন্তু গলা দিয়ে টু শব্দও বের হচ্ছে না।ঘটনা দেখে বুঝেছেন যূথীকা নামের মেয়েটা কোনোভাবে নিশানের পরিচিত। মারাত্মক ভুল করে ফেলেছেন আজ।কে জানে এখন তাঁর কি দশা হয়।
জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেমেয়ে গুলোর মুখ রাগে থমথম করছে।এতক্ষণ সবাই নিচুস্বরে আলোচনা করলেও এবার বেশ হৈচৈ শুরু হয়ে গেল।
কয়েকজন চিৎকার করে প্রিন্সিপালকে বলতে লাগল,
“—এই জঘন্য মানুষটাকে বের করে দিন কলেজ থেকে নাহলে আমরা তান্ডব বাঁধিয়ে দেব।আর কোনো মেয়ের ক্ষতি হতে দিব না আমরা।”
নিশান সকলের দিকে একবার চোখে বুলিয়ে নিতেই ওঁরা চুপ মেরে গেল।সবাইকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
“—উনি যা করেছেন তাঁর শাস্তি তো অবশ্যই পাবেন।আজকের পর থেকে কোনো মেয়েকে যদি কখনো কেউ অসম্মান করে তাহলে সাথে সাথে তোমরা আমাকে জানাবে।যা-ই ঘটুক আমাকে ইনর্ফম করবে।আমিও দেখতে চাই কার বুকে কতখানি দম আছে যে মেয়েদের ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে।”
মুশতাক রহমানের দিকে আরো একবার কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিশান প্রিন্সিপালকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“—উনাকে আপনাদের কাছে কিছুক্ষণের জন্য রেখে যাচ্ছি। আধাঘন্টার ভেতর আমি লোক পাঠাবো।ওঁরা এসে নিয়ে যাবে এই বদমাশকে।ওর দফারফা করে ছাড়ব আমি।কার দিকে হাত বাড়িয়েছে এই কু**বা** নিজেও জানে না।”
নিশান যূথীর হাত ধরে গেইটের বাইরে নিয়ে গেল।কিছুই বলছে না যূথী।মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে আছে নিশানের দিকে।তাঁর ভালো লাগছে এভাবে তাকিয়ে থাকতে।আজ কি নিশান ভাইয়ার সৌন্দর্য দ্বিগুন বেড়ে গেছে?কই অন্যদিন তো এমন হয় না?
ঘামের কারণে নিশানের চুলগুলো কপালের ছোট চুলগুলো একসাইডে লেপ্টে আছে। এটাই যেন লোকটার সৌন্দর্য একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে।লোকটা সত্যিই অপরূপ। আনমনেই যূথীর ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠল।
________________
রাতে ডিনার করার পর রুম অন্ধকার করে বারান্দায় বসে আছে যূথী।আকাশে তারার ছিটেফোঁটাও নেই।পরিবেশটা কেমন থম মেরে আছে।জোরে বর্ষণ হওয়ার পূর্ব লক্ষণ।এরকম আবহাওয়া যূথীর খুব পছন্দের। গ্রামে যখন ছিল তখন বৃষ্টির দিনে তাঁর খুশির সীমা থাকত না।টিনের চালে টুপটাপ বৃষ্টির ঝংকার শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিত।সেই সুখময় দিনগুলো খুব মিস করে যূথী।আজ সে বারান্দায় বসে বৃষ্টিবিলাস করবে।কেনো জানি মেঘলা আকাশটার দিকে তাকিয়ে থাকতেও ভালো লাগছে।
পেছনে কারোর উপস্থিতি টের পেতেই চমকে উঠল যূথী।দূরের বিল্ডিং থেকে আসা হালকা আলোয় মানুষটাকে চিনতে কষ্ট হলো না।নিশান ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে।যূথী দেখেও না দেখার ভান করলো।নিশান সেটা ঠিকই লক্ষ্য করেছে।
“—অন্ধকারে বসে আছো কেন?”
যূথী এখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে। খেয়াল করলো এই মুহূর্তে নিশান ভাইয়ার এখানে আসাতে সে একটুও বিরক্ত হয় নি।উল্টে তাঁর অবচেতন মন যেন এতক্ষণ এটাই চাইছিল।
নিশান আবার বলল,
“—চুপ কেনো?ঝড় আসতে পারে।রুমে চলে আসো।”
যূথী এখনো কোনো জবাব দিচ্ছে না।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিশান যূথীর পাশের চেয়ারটায় গিয়ে বসল।যূথীর হাতটা নিজের হাতের ভাঁজে ঢুকিয়ে বলল,
“—মন খারাপ? আমি থাকতে কোনো ভয় নেই তোমার।কেউ চোখ তুলে দেখার সাহসও করবে না তোমায়।”
যূথী ঘাড় ঘুরিয়ে নিশানের দিকে তাকাল।কেনো এত কেয়ার করে নিশান ভাইয়া?সত্যিই কি সে এত কিছুর যোগ্য ছিল।তাঁর মন চাইছে পাশে বসা লোকটাকে দুইহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।কিন্তু পারছে না।এটা হয় না।সে কি দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে? সে যদি নিজেকে শক্ত করতে না পারে তাহলে চরম ভয়াবহ অবস্থা নেমে আসবে এই পরিবারের উপর যা সে কখনোই হতে দিবে না।
চলবে………
স্বপ্নচারিণী,পর্ব_১৭
সামান্তা সিমি
বাইরে প্রবল বেগে বর্ষণ হচ্ছে। বছরের প্রথম বর্ষণ প্রকৃতিকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে।কিছুক্ষণ পর পর আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।এ যেন অন্ধকারের বুকে গাছের শাখা-প্রশাখার মত আলোর রেখা ধিকিধিকি জ্বলছে।সত্যিই প্রকৃতির সৌন্দর্যের তুলনা হয় না।
বারান্দার এককোণে বসে সেই সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে দেখছে যূথী।একটু পর পর বৃষ্টির ছাট তাঁর গায়ে লাগছে।এতে কোনো হেলদুল নেই তাঁর।উল্টে শীতল হাওয়ার আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে বারবার।
নিশান অনেকক্ষণ আগেই চলে গিয়েছে। যূথীকে বলে গেছে বাইরে বসে না থেকে তাড়াতাড়ি যেন ঘুমিয়ে পরে।কিন্তু সে এখনো ঠায় বসে আছে।
“—যূথী!”
মনীষার ডাকে যূথীর বৃষ্টিবিলাসের ধ্যান ভঙ্গ হলো।মনীষা কখন এসেছে টেরও পায়নি সে।আজ কি হলো তাঁর?এতটা উদাসীন হয়ে থাকছে কেনো?উদাস হওয়ার মত কিছু হয়েছে কি?নিজের মন থেকে কোনো উত্তর পায় না যূথী।
“—তুমি এখনো ঘুমাও নি মনীষা?
যূথীর পাশের চেয়ারটায় বসতে বসতে মনীষা বলল,
“—না।তোমাকে দেখতে এলাম।সন্ধ্যা থেকে দেখছি মনমরা হয়ে আছো?”
“—না তেমন কিছুই নয়।”
“—শোনো যূথী!আজকের ব্যপারটা নিয়ে আর ভেবো না।ভয়ের কিছু নেই।নিশান ভাইয়া সব সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। আর তোমার তো প্রথমেই ঘটনাটা নিশান ভাইয়াকে জানানো উচিত ছিল।তা না করে কেঁদে কেটে অস্থির।অবশ্য ওইরকম পরিস্থিতিতে মাথা ঠিক রাখাও কঠিন।যাই হোক প্লিজ এভাবে চুপ করে থেকো না।ভালো লাগে না আমার।”
মুচকি হাসলো যূথী।সবাই ভাবছে আজকের ঘটনার কারণে তাঁর মন খারাপ।কিন্তু তা তো নয়।তাঁর ভালো লাগছে এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে।
যূথীকে নীরব থাকতে দেখে মনীষা আবার বলল,
“—যূথী! চলো আমরা চারজন মিলে হরর্ মুভি দেখব।বাইরে দেখেছো কি পরিমাণ বৃষ্টি! সাথে বজ্রপাত। ভূতের ছবি এক্কেবারে জমে যাবে।”
যূথী আঁতকে উঠে বলল,
“—কখনো না।আমি এমনিতেই ভীতু।ভূতকে আমি ভীষণ ভয় পাই।”
“—কিচ্ছু হবে না।তুমি আমাদের তিনজনের মাঝখানে বসে থাকবে।আমরা তোমাকে গার্ড দিয়ে রাখব।হাহাহা।চলো।”
যূথীও আর দ্বিরুক্তি না করে মনীষার পিছু পিছু চলে গেল।
___________________
কানে ইয়ারফোন গুঁজে বিছানায় শুয়ে আছে যূথী।তাঁর দৃষ্টি মাথার উপরে অনবরত ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে।এই দুপুরের সময়টায় তাঁর প্রায়ই মন খারাপ থাকে।কারণটা সে নিজেও জানে না।মনে হয় কিসের যেন শূন্যতা,কি যেন নেই!
আজ অনেকদিন পর তাঁর গ্রামের কথা খুব মনে পরছে।সেই মেঠোপথ,পাখির কলকাকলি, সবুজ ফসলের মাঠ!কতদিন সে দেখে না এগুলো।তাঁদের বাড়িটারও বোধ হয় জরাজীর্ণ অবস্থা। ঘরের ভেতরে হয়তোবা নানা কীটপতঙ্গের বসবাস! বাড়ির উঠোনে শুকনো পাতার স্তূপ।চোখ বন্ধ করে যূথী এমন একটা দৃশ্য কল্পনা করে নিল।
রুমে কারো প্রবেশ করার আওয়াজ পেতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল সে।নীলুফা চৌধুরী হাতে ব্যাগ নিয়ে রুমে ঢুকছেন।
“—যূথী তোর থেকে বিদায় নিতে এলাম।আমি গ্রামে যাচ্ছি এখন।লতিফার নাকি শরীরটা বেশ খারাপ।”
যূথী উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“—কি হয়েছে চাচীর?আমাকে তো কিছু বলেনি!”
“—বলেনি আর কি।আমি দুই তিনদিনের ভেতর চলে আসব কেমন!তোর কিছু দরকার লাগলে মেজো মা’কে বলবি।দ্বিধা করার দরকার নেই।”
যূথী বড়মা’র পিছন পিছন মেইন ডোর পর্যন্ত গেল।একবার ভাবল বলবে যে তাঁরও গ্রামে যেতে ইচ্ছে করছে।এখন তো পরীক্ষাও শেষ।কিন্তু শেষমেষ আর বলা হলো না।কি দরকার গ্রামে যাওয়ার।হয়তোবা দেখা যাবে ফেরার সময় তাঁর খুব কান্না পেয়ে যাবে।
‘
‘
‘
* ডাইনিং রুমে পাতানো বিশাল টেবিল ঘিরে সবাই ডিনার খেতে ব্যস্ত।কারিমা এবং আশা চৌধুরী খাবার পরিবেশনের তদারকি করছেন।
আজ নিশানও উপস্থিত আছে।যার কারণে মনীষা,বিদীষা এবং নীলিমা মুখে কুলুপ এঁটে ভাত গিলছে।
নীরবতা ভঙ্গ করে নিশানের বাবা মফিজ চৌধুরী বলে উঠলেন,
“—বিয়ে নিয়ে কিছু চিন্তা ভাবনা করেছো নিশান?
মফিজ চৌধুরী সবসময়ই সোজাসাপ্টা কথায় অভ্যস্ত।ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলা তাঁর ধাতে নেই।কিন্তু এই মুহূর্তে টেবিলে বসা প্রত্যেকের ভীত দৃষ্টি নিশানের দিকে।এই বুঝি সকলের উপর দিয়ে কোনো ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাবে।
নিশান শান্ত ভঙ্গিতে ভাত খেয়ে যাচ্ছে যেন কথাটা শুনতেই পায় নি।
মফিজ চৌধুরী আবার বললেন,
“—আমি কিছু বলছি নিশান।এভাবে আর কতদিন! সামনের বছর তেত্রিশের কোঠায় পা রাখতে চলেছো।কিন্তু তোমার মধ্যে বিয়ে করার কোনো লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না।তুমি সন্ন্যাসী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছো নাকি।বাড়ির বড় ছেলে তুমি।তোমাকে নিয়ে আমাদের অবশ্যই অনেক স্বপ্ন আছে।বাড়ির লোকের দিকটাও তো একটু দেখবে।”
“—করব বিয়ে।আমাকে নিয়ে তোমাদের আর টেনশন করতে হবে না।”
সবাই গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে নিশানের দিকে।কথাটা কারোই বিশ্বাস হচ্ছে না।আশা চৌধুরী ভাতের গামলা নিয়ে কিচেনে যাচ্ছিলেন।নিশানের কথা শুনে সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি।
মনীষা,বিদীষা,নীলিমা খুশিতে “ইয়াহু” বলে চিৎকার দিয়ে উঠল।ওঁরা এত আনন্দ বোধ হয় বিগত কয়েক বছরেও পায় নি।
মাহির খাওয়া ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“—প্লিজ আরেকবার কথাটা বলো বিগ ব্রো! আমি মোবাইলে রেকর্ড করে রাখতে চাই।”
নিশান রাগি চোখে তাকাতেই মাহির মেকি হেসে নিজের জায়গায় বসে পরল।তবে সকলের মুখ আনন্দে ঝলমল করছে।অবশেষে নাফিস ইমতিয়াজ নিশান বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছে।এর থেকে সুসংবাদ আর কি হতে পারে!
মফিজ চৌধুরী বললেন,
“—ঐশীর সাথে তোমার বিয়ের একটা আলোচনা চলছিল কিছুদিন আগে।তুমি বোধ হয় আভাস পেয়ে থাকবে।মেয়েটা ভালোই।পরিবারের দিক থেকেও ভদ্র এবং শিক্ষিত। তোমার জন্য ওই মেয়েটাই পারফেক্ট। তুমি যেহেতু রাজি আছো তাহলে কাল ঐশীর বাবা-মা’কে রাতের ডিনারে ইনভাইট করি।সেখানেই না হয় বিয়ের ব্যপারে কথাবার্তা বলা যাবে।”
এতক্ষণ টেবিলের এক কোনায় বসে যূথী আপনমনে ভাত খাচ্ছিল।এত আলোচনার মধ্যে একবারও মাথা তুলে তাকায়নি।কিন্তু নিশানের বাবার বলা শেষ কথাটা তাঁকে তীক্ষ্ণ ছুরির ফলার মত আঘাত করল।ভাত গলা দিয়ে নামছে না।হাত-পা কাঁপছে খুব।মন চাইছে সব ফেলে ঘরে ছুটে যায়।কিন্তু তা বেয়াদবি হবে।
এমন কেন হচ্ছে তাঁর? এটা তো খুব ভাল খবর যে নিশান ভাইয়ার বিয়ে হবে।বাড়ির লোক কতটা খুশি সেটা সকলের চেহারা দেখলেই বুঝা যাচ্ছে। তবে তাঁর কেন এত কষ্ট হচ্ছে! এমন তো হওয়ার কথা ছিল না।ছোট্ট হৃৎপিণ্ডটার মধ্যে কেউ যেন খুব জোরে আঘাত করছে।
কারিমা যূথীর ছটফটানি ভাবটা লক্ষ্য করল।যূথীর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“—খাচ্ছো না কেনো যূথী! শরীর খারাপ লাগছে?
“—আমি আর খেতে পারছি না ভাবি।”
“—আচ্ছা জোর করে খাওয়ার দরকার নেই।নাহলে বমি হয়ে যেতে পারে।তুমি রুমে গিয়ে শুয়ে পরো।যাও।”
যূথী আর এক সেকেন্ড দেরি না করে উপরে চলে গেল।নিশান যূথীর যাওয়ার দিকে একবার তাকিয়ে খাওয়ায় মন দিল।
‘
‘
‘
মেয়েদের গ্রুপটা গোল হয়ে বসে আছে বারান্দায়। মনীষা,বিদীষা এবং নীলিমা’র মধ্যে টান টান উত্তেজনা। বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান মানেই তাঁদের শপিং করার হিড়িক পরে যায়।জামা থেকে শুরু করে জুতা সবই কয়েক সেট কেনা হয়।এবার তো কেনাকাটার পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে।নিশান ভাইয়ার বিয়ে বলে কথা!ওঁরা এখন থেকেই কি কি করবে তাঁর একটা নকশা তৈরি করে নিচ্ছে।
চেয়ারে মাথা হেলিয়ে বসে আছে যূথী।মনীষাদের এত উত্তেজনা কিছুই তাঁকে স্পর্শ করছে না।একটু আগে নীলিমা তাঁকে জোর করে রুম থেকে এখানে নিয়ে এসেছে।
তিনবোন যতবারই “নিশান ভাইয়ার বিয়ে” শব্দগুলো উচ্চারণ করছে ততবারই যেন তাঁর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। না চাইতেও চোখের কোনে জল জমে উঠছে।তাঁর মন কি চাইছে সে বুঝতে পারছে না।কেনো তাঁর এত যন্ত্রণা হচ্ছে! কেনো সে তিনবোনের মত খুশি হতে পারছে না!মেয়েগুলোর মুখের উপচে পরা হাসি সহ্য হচ্ছে না তাঁর।ওদের সামনে আর এক মুহূর্তও বসে থাকতে পারবে না সে।
“—নীলিমা, আমার সত্যিই ভালো লাগছে না।আমি রুমে যেতে চাই।”
যূথীর কথায় ওদের আলোচনায় ভাটা পরল।নীলিমা ঠোঁট উল্টে বলল,
“—আরেকটু থাকো না! গায়ে হলুদের প্রোগ্রামের প্ল্যানটা তো এখনো শোনো নি।”
“—আমি কালকে শুনব।এখন রুমে যাব আমি।প্লিজ আটকিয়ো না।”
বাকিরা আর কিছু বলল না।যূথীর অদ্ভুত ব্যবহারগুলো তারা যে খেয়াল করছে না এমন নয়।তখন ডাইনিং টেবিলে খাবার ছেড়ে উঠে যাওয়া আবার এখন আড্ডার মাঝখান থেকে হুট করে চলে যাওয়া এগুলো কি শুধুমাত্র শরীর খারাপের কারণে! কি যে হলো মেয়েটার কে জানে!
মনীষা’র রুম থেকে বেরিয়েই নিশানের সাথে দেখা হয়ে গেল যূথীর।থমকে দাঁড়িয়ে গেল যূথী।এখনই কি লোকটার সামনে আসার দরকার ছিল?
যূথী একপলক নিশানের দিকে তাকিয়েই আবার চোখ নামিয়ে নিল।কিন্তু নিশান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে যূথীর দিকে তাকিয়ে।ভাব এমন যেন চোখ দিয়ে যূথীর মনের সব না বলা কথাগুলো পড়ে নিচ্ছে যে কথাগুলোর অর্থ যূথী নিজেও উদ্ধার করতে ব্যর্থ।
ভারী গলায় জিজ্ঞেস করল,
“—খাওয়া ছেড়ে তখন উঠে গেলে কেনো?
“—ভালো লাগছিল না।”
নিশান ভ্রু কুচকে বলল,
“—ভাল না লাগার কারণ কি?যখনই দেখি মুখ গোমড়া করে ঘুরে বেড়াও।”
জবাব দিল না যূথী।বরাবরের মত নিশান ভাইয়ার সামনে এভাবে কাঠ পুতুলের দাঁড়িয়ে থাকতে অস্বস্তিতে ভুগছে সে।লোকটা এত অদ্ভুত কথাবার্তা কেনো বলছে!নিজেই তো গোমড়ামুখো হয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়ায়।অবশ্য এখন তো আনন্দের সময়। কয়েকদিন পর বিয়ে করবে।নতুন জীবনসঙ্গী আসবে।
যূথীর মন চাইছে এখান থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে।যে মানুষটার জন্য মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে তাঁরই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কি যে কষ্টকর!
“—আমার ঘুম পাচ্ছে নিশান ভাইয়া। রুমে যাচ্ছি। ”
নিশানকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে যূথী সাইড কেটে চলে যাচ্ছিল।কয়েক কদম এগুতেই ঝড়ের গতিতে নিশান যূথীকে একটান দিয়ে নিজের কাছে এনে ফেলল।এমন আচমকা আক্রমণে যূথী কিছুটা আর্তনাদ করে উঠল।হাতের কবজিটা বোধ হয় আর আস্ত নেই।
যূথীর মুখে ব্যথার ছাপ দেখেও নিশান যূথীকে ছেড়ে দিল না।বরং আরো কাছে টেনে দাঁত কটমট করে বলল,
“—আমার সাথে এটিটিউড দেখাবে না।একদম মাথায় তুৃলে আছাড় মারব।”
যূথী ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করছে।নিশান এখনো ছাড়ছে না তাঁকে।যূথী চোখ পিটপিট করে খুলতেই নিশানের তীব্র চাহনি দেখতে পেল।বহু কষ্টে বলল,
“—হাতে ব্যথা পাচ্ছি নিশান ভাইয়া।ছেড়ে দিন আমায়।”
কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে নিশান যূথীকে হালকা ধাক্কা দিয়ে ছাদের দিকে চলে গেল।হতভম্ব যূথী দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে।ব্যথা পাওয়ার জায়গাটায় হাত ঘষছে ঘনঘন।মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগে তাঁর উপর দিয়ে ছোট-খাটো একটা দুর্যোগ গেল।এমন কেনো লোকটা!পৃথিবীর সব রাগ,বদমেজাজ, চোখ রাঙানো উপরওয়ালা উনার মধ্যে দিয়েছে।
চলবে………