স্বপ্নচারিণী,পর্ব_১৮,১৯
সামান্তা সিমি
পর্ব_১৮
বিকেল হতেই বাড়িতে হৈহৈ ভাব।সকলের চোখেমুখে হাসি উপচে উঠছে।বাড়ির বড় ছেলের বিয়ের কথাবার্তা হবে আজ।বিথী চৌধুরী এবং আশা চৌধুরী বিভিন্ন রকম আইটেম রান্নায় ব্যস্ত।সবকিছু সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।তবু যেন কোথাও কমতি থেকেই যাচ্ছে। তাঁদের বড় আপা থাকলে একা হাতেই সবটা সামলে নিতেন।বড় আপাকে ফোনও করা যাচ্ছে না।মফিজ চৌধুরী বলে দিয়েছেন নিশানের মা’কে এখন কিছু জানানোর দরকার নেই।বিয়ে তো আর হয়ে যাচ্ছে না।শুধুমাত্র আলোচনা হবে আজ।গ্রাম থেকে ফিরে আসলে না হয় জানানো যাবে।
মফিজ চৌধুরী ড্রয়িংরুমে সোফায় অত্যন্ত বিরক্ত মুখে বসে আছেন।যার জন্য বাড়িতে এত আয়োজন সেই লোকটিই নেই।নিশানকে অনেক বার বারণ করেছিলেন আজ অফিসে না যেতে। ছেলেটা তাঁর কথাকে পাত্তাই দিল না।তাঁর মন চাইছিল নিশানকে কিছু কঠিন কথা শুনিয়ে দেয়।কিন্তু শেষমেষ তা করলেন না।আর যাই হোক এত বড় ছেলের উপর রাগারাগি করা যায় না।উল্টে দেখা যাবে ছেলেটা মাথা গরম করে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে।নিশানের স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে তাঁর ভালই ধারণা আছে।এর আগেও এমন ঘটনা বহুবার ঘটেছে।তাই তিনি মেজাজ যথাসম্ভব ঠান্ডা রেখে বলে দিয়েছেন একটু তাড়াতাড়ি করে বাড়ি ফিরতে।
সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে যূথী রুমে দরজা আটকে বসে আছে।মনটা একদমই ভাল নেই তাঁর।বাড়ির সকলের চেহারায় আনন্দের রেশ।একমাত্র তাঁর মুখে হাসি নেই।ইচ্ছে করছে বাড়ি থেকে আজ রাতের জন্য কোথাও উধাও হয়ে যেতে।
বিছানার এককোণে অবহেলিত অবস্থায় গুটিয়ে থাকা গোলাপি রঙের জামাটার দিকে তাকাল যূথী।মনীষা বলে গেছে আজ যেন এ ড্রেসটা পরে।কিন্তু তাঁর এসব মনে ধরছে না।জামাটা ছিড়ে কুটি কুটি করে ফেলতে পারলে শান্তি লাগত।ড্রয়িংরুম থেকে জোরে কথাবার্তার আওয়াজ পেতেই বুঝতে পারল অতিথিরা এসে গেছে।ধক করে উঠল যূথীর হৃৎপিণ্ডটা।সত্যিই কি ওই রাগী লোকটার বিয়ে হয়ে যাবে! সে যে সহ্য করতে পারবে না এটা।কিন্তু কিচ্ছু করার নেই।যা হবে চোখের সামনে দেখে যেতে হবে।ভারাক্রান্ত মন নিয়ে যূথী জামাটা হাতে নিয়ে তৈরি হতে লাগল।
ড্রয়িংরুমের পরিবেশ অনেকটা জমে উঠেছে।অতিথিদের অ্যাপায়নে বাড়ির সকলে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। ঐশীর বাবা মাহবুব আলমের মুখে হাসির ঝিলিক।যেসব কথায় হাসার দরকার নেই সেসব কথায়ও ঘনঘন হেসে উঠছেন।এই মুহূর্তে তাঁর মনে অনাবিল সুখ কাজ করছে।এত বড় বাড়িতে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার সৌভাগ্য কয়জনের হয়?
মাহবুব আলম নিশানের বাবার অফিসেই কর্মরত অবস্থায় আছেন।সেদিন যখন মফিজ চৌধুরী নিশানের সাথে তাঁর মেয়ের বিয়ের আলাপ নিয়ে এসেছিলেন তখন যেন তিনি ঈদের চাঁদ হাতে পেলেন।তৎক্ষনাৎ তিনি রাজি হয়ে গেছিলেন।কিন্তু তাঁর মেয়ে মাঝখান থেকে বেঁকে বসেছিল।সে নাকি কার থেকে শুনেছে নিশান খুব বদমেজাজি। মেয়ের মুখে এসব কথা শুনে মাহবুব আলমের মেজাজ খারাপ হয়েছিল।কেনো যে তাঁর মেয়েটা এত বোকা।বোকা না হলে কি এরকম ভিত্তিহীন কথা শুনে কেউ বিয়ে করবে না বলে চেঁচায়!
দীর্ঘক্ষণ কুশল বিনিময়ের পর মফিজ চৌধুরী বললেন,
“—নিশান আর ঐশীর বিয়ে নিয়ে যে কথাবার্তা চলছিল সেটা আমরা এগিয়ে নিতে চাইছি।বাড়ির সকলের ইচ্ছে বিয়েটা এই মাসেই হয়ে যাক।এতে আপনাদের কোনো সমস্যা থাকলে বিনা দ্বিধায় বলতে পারেন মাহবুব সাহেব।”
অনেকটা জোড়হাতের ভঙ্গিতে মাহবুব আলম বললেন,
“—কোনো সমস্যা নেই।আপনাদের সাথে আত্মীয়তা করতে পারলে আমরাও ধন্য হই।কিন্তু ছেলেমেয়ে দুজনের আলাদা কথা হলে ভালো হয়।তাদেরও তো একটা মতের ব্যাপার আছে।তবে এটা বলতে পারি আমার মেয়ের তরফ থেকে কোনো ঝামেলা নেই।আমি নিশানের ব্যপারটা জানতে চাইছি।”
“—এটা নিয়ে ভাববেন না।নিশানও রাজি আছে।আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সে এসে যাবে।তখন না হয় ওরা দুজন আলাদা কথা বলতে চাইলে বলবে।”
‘
‘
দুতলার এক কোনায় দাঁড়িয়ে নিচের দৃশ্য দেখছিল যূথী।একধ্যানে তাকিয়ে আছে ঐশী নামের মেয়েটার দিকে।সত্যিই মেয়েটা নিশান ভাইয়ার জন্য পারফেক্ট। দেখতে যেমন সুন্দরী লেখাপড়ার দিক থেকেও শিক্ষিত।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে যূথী আশেপাশে নিশানকে খুঁজতে লাগল।কেনো জানি লোকটাকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছে।
আজকাল তাঁর মনে কিছু অদ্ভুত অদ্ভুত ইচ্ছে জন্ম নেয়।মন চায় সারাদিন নিশান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে।কিন্তু এটা কখনোই তাঁর দ্বারা হয়ে উঠে না।দুপুরে যখন বাড়ি নিরব থাকে তখন চুপিচুপি নিশানের রুমে ঢুকে পরে যূথী।রুমের প্রত্যেকটা জিনিস হাত দিয়ে ছুয়ে দেখে।কিছুদিন পর এই রুম অন্যজনের হয়ে যাবে।তখন আর এরকম অবাধে চলাচল করা যাবে না।দেয়ালে টাঙানো নিশানের বড় ছবিটার দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে।হাত দিয়ে স্পর্শ করার সাহস পায় না।এই বুঝি ছবি থেকে আসল মানুষটা বেরিয়ে আসলো।
“—যূথী আপু! এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো!”
বিদীষা’র ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে বের হলো যূথী।কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
“—আমি…কিছু করছি না।”
“—নিচ থেকে তোমাকে হাতের ইশারা দিয়ে ডাকছি কিন্তু তুমি তো সাড়া দিচ্ছিলে না।কি হয়েছে তোমার বলোতো!”
যূথী বিদীষা’র গাল টেনে বলল,
“—কিচ্ছু হয়নি আমার।চলো নিচে যাই।”
“—হ্যাঁ চলো।মা তোমাকে ডাকছে।”
__________________
বিকেল থেকে মফিজ চৌধুরী’র মেজাজ যতটুকু খারাপ ছিল তা আরো একধাপ বেড়ে গেছে।মাথা ঠান্ডা রাখতে কষ্ট হচ্ছে।দশটা বাজতে চলল এখনো তাঁর ছেলের আসার নাম গন্ধ নেই।অতিথিরা অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত। নিশানকে ফোন করেও কোনো ফায়দা হচ্ছে না।রিং হয় কিন্তু রিসিভ করে না।এসব কান্ড করার অর্থ কি! সে তো ভালো করেই জানে বাড়িতে সকলে তাঁর জন্য অপেক্ষা করবে।
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে মাহবুব আলম বললেন,
“—হয়তোবা নিশান কোনো কাজে আটকে গেছে।আপনাদের সাথে তো যা কথা হওয়ার দরকার ছিল তা হয়ে গেছে।ঐশী আর নিশান না হয় অন্য যেকোনো দিন দেখা করবে।আজ তাহলে উঠি।”
মফিজ চৌধুরী লজ্জিত গলায় বললেন,
“—নিশানের যে আসতে এতটা দেরি হবে এটা ভাবিনি।আমরা সত্যিই খুব দুঃখিত। ”
“—সমস্যা নেই ভাইসাহেব।আজ তাহলে যাই।এমনিতেও দেরি হয়ে গেছে।”
মফিজ চৌধুরী অতিথিদের গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।মোবাইল হাতে নিয়ে আরেকবার নিশানের ফোনে কল দিলেন।কেউ রিসিভ করল না।
‘
‘
‘
রাত এগারটার দিকে সঙ্গে কাজি নিয়ে বাড়ি ফিরল নিশান। সকলে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে নিশানের দিকে।এত রাতে কাজি আনার কারণটা কেউই ঠাওর করতে পারছে না।সবাই জানে নিশান একগুঁয়ে স্বভাবের।যখন যা মন চায় তাই করে।মাঝেমাঝে কিছু অদ্ভুত কান্ডও করে বেড়ায়।কিন্তু আজকের ব্যপারটা তো চূড়ান্ত রকমের অদ্ভুত।
এতগুলো মানুষের কৌতূহল দৃষ্টি সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে নিশান ধপ করে সোফাতে বসে পরল।তাঁর পাশের সোফাতেই কাজি গুটিশুটি মেরে বসে আছে।
নিশান পকেট থেকে ফোন বের করে মনীষাকে বলল,
“—এক গ্লাস পানি দে তো মনীষা।”
মনীষা উর্ধ্বশ্বাসে পানি আনতে ছুটল।সে বেশ বুঝতে পারছে বাড়িতে ভয়াবহ কিছু হতে চলেছে।নিশান ভাইয়ার মতিগতি ঠিক লাগছে না।
বিস্ময় ভাব কাটতেই মফিজ চৌধুরী শক্ত গলায় বললেন,
“—বাড়িতে কাজি কেনো নিশান?
নিশান দরাজ গলায় বলে উঠল,
“—বিয়ে করব।আর সেটা এখনই।”
চলবে………
স্বপ্নচারিণী
সামান্তা সিমি
পর্ব_১৯
“—বিয়ে করব।আর সেটা এখনই।”
নিশানের এমন কথায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সকলে আরেক দফা অবাক হলো।মফিজ চৌধুরী ভাবছেন অতিরিক্ত কাজের প্রেশারে তাঁর ছেলের মাথাটা বোধ হয় গরম হয়ে উঠেছে।বেঁচে থাকতে এই ছেলের আরো কত কান্ড যে দেখতে হবে কে জানে।
“—নিশান তোমার কি মনে হচ্ছে না তুমি অস্বাভাবিক কথাবার্তা বলছো?
“—অস্বাভাবিক কিছু তো আমি দেখতে পাচ্ছি না বাবা।
“—রাত এগারোটায় তুমি কাজি নিয়ে এসে বলছো বিয়ে করবে এটাকে তুমি স্বাভাবিক বলছো! বিয়ে করার এতই তাড়া থাকলে দেরি করে আসলে কেনো।মাহবুব আলম তাঁর মেয়েকে নিয়ে আরো আধাঘন্টা আগে বেরিয়ে গেছে।”
নিশান চোয়াল শক্ত করে বলল,
“—আমি কি একবারও বলেছি মাহবুব আলমের মেয়েকে বিয়ে করার জন্য কাজি নিয়ে এসেছি?”
“—তাঁর মানে? কাকে বিয়ে করতে চাও তুমি?”
সোফায় হেলান দিয়ে আরাম করে বসল নিশান।হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে ভাবলেশহীন গলায় বলল,
“—যূথীকে।”
বজ্রাহতের মত সবাই তাকিয়ে আছে নিশানের দিকে।যূথী এতক্ষণ নীলিামর সাথেই দাঁড়িয়ে ছিল।একটু আগের বলা কথাটা শুনে তাঁর চোখ বড় বড় হয়ে গেল।মাথা ভনভন করে ঘুরছে।এসব কি বলছে নিশান ভাইয়া! ঢোক গিলতেই বুঝতে পারল গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।আতঙ্কে নীলিমার হাত খামচে ধরল যূথী।
মফিজ চৌধুরী হুঙ্কার ছেড়ে বললেন,
“—কিসব উদ্ভট কথাবার্তা বলছো তুমি?পাগল হয়ে গেছো নাকি আমাদেরকে পাগল ভাবছো?”
নিশান শান্ত গলায় উত্তর দিল,
“—এখানে চিৎকার করার কিছু নেই বাবা।যূথীকে আমি বিয়ে করব।আমি শুধু এটাই বলেছি।”
“—তুমি আমাদেরকে না জানিয়ে এমন একটা সিদ্ধান্ত কিভাবে নিতে পারো?আমাদের মতামত জানারও প্রয়োজন মনে করো নি!আমি ঐশীর সাথে তোমার বিয়ে নিয়ে কথা বলার জন্য মাহবুব আলমকে ডেকেছি বাড়িতে।সব জানার পরেও তুমি কাজি নিয়ে এসেছো যূথীকে বিয়ে করবে বলে?”
“—তোমাদেরকে না জানিয়ে এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছি এরজন্য আমি খুবই দুঃখিত।আর সাথে এটাও জানিয়ে রাখছি যূথীকে আমি ভালোবাসি এবং ওঁকে এই মুহূর্তেই বিয়ে করব।”
মফিজ চৌধুরী কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেলেন।ড্রয়িংরুমে উপস্থিত বাকিরাও মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।ভয়ে কাঠ হয়ে আছে ওঁরা সাথে অবাকও।নিশানের এই রূপ তাঁদের অপরিচিত।যে ছেলেকে এতদিন তাঁরা অনুভূতি শূণ্য মানুষ বলে জেনে এসেছে সেই ছেলে বলছে কাউকে ভালোবাসে।একটা মানুষের এতটা পরিবর্তন কি করে হতে পারে!
যূথীর চোখে পানি টলমল করছে।আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে সে বোধ হয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে।শরীরের স্নায়ুতন্ত্রগুলো কাজ করছে না ঠিকমত।নীলিমা যূথীর অবস্থা বুঝতে পেরে ওঁকে একহাতে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে।
মফিজ চৌধুরী কঠোর গলায় বলে উঠলেন,
“—তোমার এই সিদ্ধান্ত অন্য কেউ মানুক কিন্তু আমি মানবো না।যে মেয়ের বাড়ি-ঘরের কোনো ঠিকানা নেই,মা-বাবা নেই তাঁকে আমি ছেলের বউ হিসেবে কখনোই গ্রহণ করব না।”
এতক্ষণ পর্যন্ত নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করতে পারলেও এবার নিশান মেজাজ হারিয়ে ফেলল।হাতে থাকা কাঁচের গ্লাসটা মাটিতে ছুড়ে গর্জে উঠে বলল,
“—তুমি মানো বা না মানো এতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।যূথীর বাড়ি ঘর দিয়ে তো আমার কোনো কাজ নেই।যূথীর মা-বাবা’কে তো আমার দরকার নেই।আমার যূথীকে হলেই চলবে।বিয়েটা আমি যূথীকেই করব।”
মফিজ চৌধুরী থমথমে মুখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।অন্যদিকে কাজি লোকটা হা করে সব কিছু দেখছে।এমন কাহিনী সে জীবনেও দেখেনি।বড়লোকদের যতসব বর বড় কারবার।মনে মনে মুখ ভেঙচালো সে।
কিছুক্ষণ থেমে নিশান এবার বলল,
“—কাম হেয়ার যূথী।
যূথীর ভেতরের আত্নাটা লাফিয়ে উঠল।সে মনে মনে সবসময় চাইত যে তাঁকে নিয়ে যেন এই বাড়িতে কখনো কোনো ঝামেলা না হয়।কিন্তু ঝামলো তো নিজ পায়ে হেঁটে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।কি করবে এখন!
“—কি বলছি শুনতে পাচ্ছো না! এখানে আসো।”
যূথী চমকে নিশানের দিকে তাকালো।লোকটার চোখেমুখে অজস্র রাগের আভাস।রক্তিম চোখগুলো যেন যূথীকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে।কেনো এরকম পাগলামি করছে নিশান ভাইয়া!উনি কি বুঝতে পারছেন না যে উনার করা একটা ভুলের কারণে এই পরিবারে কি কি দুর্যোগ নেমে আসতে পারে!
যূথী কম্পিত গলায় বলে বসল,
“—আমি আপনাকে বিয়ে করব না।”
নিশান আগের চেয়েও জোর গলায় বলল,
“—তোমাকে আমি অপশন দেইনি বিয়ে করবে কি করবে না।তোমাকে বলেছি এখানে আসতে।চুপচাপ সোফায় বসো।একটা টু শব্দ করলে তোমার অবস্থা যে আমি কি করব নিজেও জানি না।”
‘
‘
‘
সকলের উপস্থিতিতে যূথী এবং নিশানের বিয়েটা হয়ে গেল।কাজি হাসিমুখে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে বিদায় নিচ্ছে।বড় লোকদের যতসব বড় বড় কারবার এই কথাটা সে মনে মনে আরো একবার উচ্চারণ করে নিল।
যূথী মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছে।গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে তাঁর জীবন এভাবে মোড় নিবে এটা সে স্বপ্নেও ভাবেনি।চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।আগামী দিনগুলো না জানি কি ভয়াবহ হয়।বাড়ির প্রত্যকেটা মানুষের তোপের মুখে পরতে হবে তাঁকে।বড়মা কত ভালোবেসে এখানে নিয়ে এসেছে।এখন বড়মা’র সামনে মুখ দেখাবে কি করে!
“—রুমে চলো।এরকম অসহায়ের মত বসে আছো কেনো?”
নিশানের ডাকে বাস্তবে ফিরল যূথী।কিছু বুঝে উঠার আগেই নিশান যূথীর হাত ধরে টেনে উপরে নিয়ে গেল।যূথী যেন রোবট হয়ে গেছে। তাঁকে যা করতে বলা হচ্ছে তাই করে যাচ্ছে।
দরজা বন্ধ করার শব্দে যূথী চমকে উঠল।চারদিকে তাকিয়ে দেখে এটা তাঁর রুম নয়।নিশানের রুম।হঠাৎ করে যূথীর রাগটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।এতক্ষণ ড্রয়িংরুমে লজ্জায় ভয়ে কিছু বলতে পারেনি।
শুধুমাত্র এই লোকটার জন্য এসব ঝামেলা।এতদিন পর্যন্ত সবকিছু কত সুন্দরভাবে চলছিল।মাঝখান থেকে নিশান ভাইয়ার এই একটা কাজের জন্য যত গোলমাল বাঁধলো।
যূথী ছুটে নিশানের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল,
“—কেনো বিয়ে করেছেন আমাকে?বিয়েটা কি ছেলেখেলা পেয়েছেন?একবার আমার দিকটা ভেবে দেখেছেন?এখন সবাই তো ভাববে আমি বাড়ির ছেলেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে প্রেমের জালে ফাঁসিয়েছি।আপনাকে তো ভয়েও কেউ কিছু বলবে না।সকলে যখন আমাকে অপমান করে কথা বলবে তখন আপনি শান্তি পাবেন তাই তো! ঝোঁকের বশে বিয়েটা করেছেন।পরে যখন ভুল বুঝতে পারবেন তখন কি করবেন?”
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামল যূথী।জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে।চোখের পানি ধরে রাখতে গিয়েও ব্যর্থ হলো সে।
নিশান স্থির চাহনি দিয়ে তাকিয়ে আছে যূথীর দিকে।হাত দিয়ে চোখের জলটা মুছে বলল,
“—শান্ত হও।আমি তোমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি।কেউ তোমাকে কিছু বলবে না।ভয় পেয়ো না।আর ঝোঁকের বশে বিয়ে করেছি মানে! আমি যা করেছি ভেবে চিন্তেই করেছি।বুঝো না কতটা ভালোবাসি তোমায়!”
নিশানের মুখে ভালোবাসি কথাটা শোনামাত্রই যূথী চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল।রুপকথার রাজকুমারদের মত দেখতে এই লোকটা তাঁকে ভালোবাসি বলছে।তাঁর জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে কি করত! আনন্দে লাফিয়ে উঠত নাকি কথাটা সবাইকে বলে বেড়াত।কিন্তু তাঁর তো ইচ্ছে করছে এই লোকটাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে।লোকটার বুকে মাথা রেখে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে কেনো এত জ্বালাতন করে তাঁকে।কেনো এমন মায়ায় জড়িয়ে ফেলছে।
যূথীর মনের অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে নিশান বলল,
“—একটু অপেক্ষা করো।আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
যূথী চুপচাপ বিছানায় বসে আছে।কি থেকে কি হয়ে গেল।সবকিছু কেমন উলটপালট লাগছে তাঁর কাছে।ভাবতে গেলেই মাথাব্যথা শুরু হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে এই রুমে কেনো বসে আছে।এখানে তো কোনো কাজ নেই!
তখনই নিশান খালি গায়ে গলায় টাওয়াল ঝুলিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো।পড়নে চেক চেক নীল রংয়ের ট্রাউজার্স।
যূথী একবার সেদিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল।বিছানা থেকে উঠে দরজার কাছে যেতেই নিশান ধমকে উঠে বলল,
“—আমার পারমিশন ছাড়া কোথায় যাচ্ছো?”
যূথী শুকনো গলায় উত্তর দিল,
“—ঘুম পাচ্ছে। রুমে যাব।”
“—এটা কি রুম নয়?”
“—এটা আপনার রুম।আমি আমার রুমে যাচ্ছি। ”
নিশানের পাল্টা জবাব,
“—আজকের পর থেকে আমার তোমার বলতে কিছু নেই।সব আমাদের। কথাটা যেন মাথায় থাকে।এখন সাইলেন্ট মুডে বিছানায় শুয়ে পরো।”
নিশানের কথা শুনে বাজ পরল যূথীর মাথায়।কি বলছে এইলোক! তাঁকে কি এখন নিশান ভাইয়ার সাথে ঘুমাতে হবে নাকি।অসম্ভব! মরে গেলেও সে এটা করবে না।কি পেয়েছে এই লোক? যখন যা বলবে সেটাই মানতে হবে নাকি।কি মনে করে নিজেকে!
“—আমি আপনার সাথে ঘুমাব না।কখনোই না।”
হাতের টাওয়ালটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে নিশান এগিয়ে গেল।
“—আমার রাগ উঠিও না যূথী।যা বলছি শুনো।”
যূথী ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিল সে নিশানের কথা শুনতে নারাজ।
চলবে……..