স্বপ্নচারিণী,পর্ব_২৩,২৪
সামান্তা সিমি
পর্ব_২৩
অর্ধসমাপ্ত একটা বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিশান।মাথার চুল এলোমেলো,গায়ের শার্টটা জায়গায় জায়গায় কুঁচকে আছে।চোখ দুটো রক্তলাল।গত দুইরাত ধরে ঘুম নেই তাঁর। ফলাফল স্বরূপ চোখের নিচে কালির দাগ স্পষ্ট। ফর্সা মুখটা যেন রক্তশূণ্য হয়ে আছে। শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে পরতে চাইছে।কিন্তু মন তা মানতে নারাজ।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিল্ডিংটার চারদিকে নজর বুলিয়ে নিল নিশান।কোথাও কেউ নেই।জায়গাটা নিস্তব্ধ নগরীর মত লাগছে।পকেটে হাত দিয়ে একবার দেখে নিল অস্ত্রটা ঠিকঠাক আছে কিনা।
ধীর পায়ে এগিয়ে গেল নিশান।ভেতরে সুনশান নীরবতা।পা ফেলার শব্দটারও যেন প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে।তিনতলা পর্যন্ত কাউকেই নজরে পরল না।চারতলায় উঠতেই একটা বন্ধ দরজা দেখা গেল।দরজাটা বন্ধ হলেও ভেতর বা বাইরে থেকে লক করা নেই।নিশান কিছুক্ষণ ইতস্তত করে হালকা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল।সচকিত দৃষ্টিতে ভেতরে তাকাল সে।আবছা অন্ধকারে চারপাশ ঢেকে আছে। এদিক সেদিক সিমেন্টের বস্তা,কয়েকটা ভাঙা টাইলসে্র টুকরো।
নিশান সর্তকভাবে সামনের রুম গুলো চেক করে নিল।কেউ নেই। দক্ষিণের কোণার রুমটাতে পা দিতেই থেমে গেল।অর্ধেক খোলা জানালা দিয়ে আসা মৃদু আলোয় দেখা যাচ্ছে একটা মেয়ে ফ্লোরে এলোমেলো অবস্থায় পড়ে আছে।হাতের রিভলভারটা পকেটে রেখে এগিয়ে গেল সেদিকে।
নিশানের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল।মেয়েটা আর কেউ নয়।যূথী!নিশানের যূথী!
হাতে-পায়ে আঘাতের চিহ্ন,শরীর বালিতে মাখামাখি, লম্বা চুলগুলো জট পাকিয়ে আছে।যূথীর হাতে স্পর্শ করতেও ভয় পাচ্ছে নিশান।যদি ব্যথা পেয়ে যায়।মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু স্বরে ডাকল।
“—যূথী! শুনতে পাচ্ছো আমায়?”
কোনো সাড়াশব্দ নেই।অচেতন অবস্থায় পরে আছে সে।নিশানের বুকটা যন্ত্রণায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে।
দ্বিতীয়বার ডাকতেই যূথী কিছুটা নড়ে উঠল। পিটপিট করে চোখ খোলার চেষ্টা করতেই ঝাপসা ভাবে দেখতে পেল সামনে নিশান বসে আছে।
দুর্বল গলায় বলল,
“—নিশান ভাইয়া..!”
নিশানের ভেতর দিয়ে একটা প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেল।গত দুইদিন থেকে এই কন্ঠটা শুনে নি।যূথীকে একনজর দেখার জন্য পাগল হয়ে গেছিল।প্রত্যকেটা সেকেন্ড ছিল অসহ্য যন্ত্রণাময়।
“—উঠে বসতে পারবে?আমার হাত ধরে উঠার চেষ্টা করো।”
যূথী ভালোভাবে তাকালো নিশানের দিকে। লোকটার চেহারা সম্পূর্ণ বদলে গেছে।উদভ্রান্তের মত লাগছে দেখতে।চোখদুটোও বসে গেছে।হয়তোবা খাওয়াদাওয়া করে নি ঠিকমতো। বড্ড মায়া লাগছে দেখতে।
হাতে ভর দিতেই বুঝতে পারল শরীরে প্রচন্ড ব্যথা।কিন্তু সেই ব্যথা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে যূথী নিশানের বুকে মাথা রাখল।সেই পরিচিত গন্ধটা নাকে এসে লাগছে।যূথী আরো একটু চেপে এল নিশানের দিকে।
“—ওঁরা কি করেছে তোমার সাথে?”
নিশানের কথা শুনে কেঁপে উঠল যূথী।এতক্ষণে তাঁর টনক নড়ল নিশান ভাইয়া এখানে কি করে আসলো।ওই লোকগুলো তো যেকোনো সময় এসে যাবে।নিশান ভাইয়াকে দেখতে পেলে তো খুন করে ফেলবে।যূথী ভয় পেয়ে নিশানের শার্টটা খামচে ধরল।
আগের চেয়েও তীব্র গলায় নিশান বলে উঠল,
“—বলো কি করেছে তোমার সাথে!যদি খারাপ কিছু করে থাকে আল্লাহ্’র কসম ওদেরকে আমি এখানেই কুরবানী দিয়ে দেব।”
যূথী চুপ করে আছে।এই মুহূর্তে নিশান ভাইয়াকে তাঁর খুব ভয় লাগছে।লোকটা চরম পর্যায়ে রেগে গেছে।জোরে জোরে শ্বাস ফেলার আওয়াজ শুনেই সেটা বুঝা যাচ্ছে।কিন্তু সে এখনো নিশানের বুকে মাথা এলিয়ে রেখেছে।
“—আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি যূথী!”
“—ওঁরা আমাকে খুব মেরেছে নিশান ভাইয়া।প্লিজ এখান থেকে নিয়ে যান আমায়।আপনি…আপনাকে দেখতে পেলে ওঁরা আরো ক্ষেপে উঠবে।ওদের কথা শুনে বুঝতে পেরেছি আপনার উপর খুব রাগ।”
“—চুপ।কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তোমার।আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।”
নিশান এতক্ষণ যূথীকে দুইহাতে জড়িয়ে রেখেছিল। পাশ থেকে উড়ানাটা উঠিয়ে ভালোভাবে গায়ে দিয়ে কোলে তুলে নিল।যূথীও আর দ্বিরুক্তি করল না।মাথাটা ব্যথায় ছিড়ে যাচ্ছে ওর।
দরজার কাছে যেতেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল নিশান।কারো কথার আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এখানেই আসছে।দুই কদম পিছিয়ে গেল সে।
তৎক্ষনাৎ তিনজন গাট্টাগোট্টা ছেলে প্রবেশ করল রুমে।হঠাৎ করে নিশানকে সামনে দেখে ভুত দেখার মত চমকে উঠল ওরা।কিছু সময়ের জন্য বাইরে গেছিল তাই দরজায় তালা লাগায় নি।আর সেই সুযোগেই এত কিছু ঘটে গেল।
নিশান তিনজনের দিকে রক্তাক্ত চোখে তাকাল।যূথীকে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“—এই তিনজনই কি তোমার গায়ে হাত তুলেছিল?”
ছেলেগুলোকে দেখেই যূথী আতঙ্কে অস্থির হয়ে উঠেছে।মাথা নাড়িয়ে বলল,
“—হ্যাঁ।এরাই।”
তিনজন ছেলের মধ্য থেকে একজন হাতে মোটা একটা লাঠি নিয়ে এগিয়ে আসলো।তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“—তুই শালা আসলেই ডেঞ্জারাস। বস ঠিকই বলেছিল।বউয়ের গন্ধে গন্ধে এখান পর্যন্ত চলে আসলি।তারিফ করতে হয় তোর!”
নিশান একপলক ওঁদের দিকে তাকিয়েই তড়িৎ গতিতে পকেট থেকে রিভলবার বের করে একে একে তিনজনকেই সুট করে দিল।ঘটনা এত দ্রুত ঘটল যে কেউই কিছু বুঝতে পারল না।গুলির প্রচন্ড শব্দ শুনে যূথী থম মেরে বসে রইল।ক্লান্ত শরীরে সে কি দুঃস্বপ্ন দেখছে নাকি!
ছেলেগুলো কিছুক্ষণ কাতরাতে কাতরাতে শান্ত হয়ে গেল।
যূথী এখনো আচ্ছন্নের মত বসে আছে। নিশান দেখেও না দেখার ভান করে ফের কোলে তুলে নিল।
তিনতলায় নামতেই আবার থেমে যেতে হলো।সিড়ি দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ছয়-সাত জনের একটা দল উঠে আসলো।
যূথী এখনো লেপ্টে আছে নিশানের বুকে।শরীরের দুর্বলতা যেন জেঁকে ধরছে ধীরে ধীরে। মাথা তুলে সামনে তাকাতেও ইচ্ছা করছে না।
নিশান তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তাঁর মুখোমুখি দাঁড়ানো ছেলেটার দিকে।যার মুখে ঝুলছে ক্রুর হাসি।ছেলেটাকে চিনতে একটুও কষ্ট হলো না নিশানের।শান্ত গলায় বলল,
“—দেখ সুমন! তোর রাগ তো আমার উপর।যূথীকে কেনো এর মধ্যে টানছিস?সামনে থেকে সরে দাঁড়া।”
সুমন নামের ছেলেটি হলুদ দাঁত বের করে হাসলো যেন খুব মজা পেয়েছে কথাটা শুনে।
“—নাফিজ ইমতিয়াজ নিশান! তুই আমার আব্বাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে ছিলি।সেই কষ্ট আমি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি।আর কি বললি!মেয়েটাকে কেনো টানছি?মেয়েটা তো তোর বউ।তাহলে তোকে শায়েস্তা করার মোক্ষম অস্ত্র এর থেকে আর বড় কি হতে পারে।”
“—তোর বাপ নিজের দোষের শাস্তি পেয়েছে।আর আমার বউয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে তুই তোর বাপের থেকেও বড় অন্যায় করে ফেলেছিস্।তুই ছাড় পাবি না আমার হাত থেকে।”
সুমন আগের চেয়েও জোর গলায় বিল্ডিং কাঁপিয়ে হেসে উঠল।
“—তোদের সিআইডিদের কি বড় বড় কথা বলার ট্রেনিং দেওয়া হয় নাকি রে।তবে তোর সাহস আছে বটে।তোর জায়গায় অন্য কেউ হলে এতক্ষণে ভয়ের চোটে প্রাকৃতিক কাজ টাজ করে ফেলত।এখন নিজের চোখেই দেখ তোর বউয়ের কি দশা করি আমি।”
নিশান কিছু বুঝে উঠার আগেই সুমন যূথীর কবজিতে ছুড়ি দিয়ে আঘাত করে বসল।যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠল যূথী।ক্ষত স্থান দিয়ে দরদর করে রক্ত ঝরছে।
“—ইউ বাস্টার্ড! ”
শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সুমনের পেটে লাথি কষাল নিশান।ভারসাম্য রাখতে না পেরে সুমন ছিটকে আরো দুই তিনজন সহ সিড়ি দিয়ে গড়িয়ে পরল। তখনই নিশানের লোকজন চারদিকে ঘিরে ধরল।দুয়েকজন পালিয়ে গেলেও বাকিরা বাধ্য হয়ে ধরা দিল।
নিশান চোয়াল শক্ত করে সুমনকে বলল,
“—তোর কি মনে হয় আমি গাধা?কোনো প্রটেকশন না নিয়েই এখানে চলে এসেছি?অল দ্যা বেস্ট।তোর সাথে আমার দেখা হবে জেল কাস্টডিতে।”
হিমেশ এগিয়ে এসে বলল,
“—স্যার যূথী ম্যাডাম মনে হয় সেন্সলেস হয়ে আছে। হাত দিয়ে তো রক্ত পরছে অনেক।উনাকে হসপিটালাইজড্ করুন জলদি।”
নিশান করুণ চোখে একবার যূথীর দিকে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে নেমে গেল।
‘
‘
‘
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে আসলো।মফিজ চৌধুরী সোফায় উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছেন।সকাল থেকে নিশানকে কল করে যাচ্ছেন।কিন্তু কোনো খবর নেই।বারবার প্রার্থনা করছেন তাঁর ছেলে এবং ছেলের বউ যেন সুস্থ শরীরে বাড়ি ফিরে আসে।তিনি আর কোনো টেনশন নিতে পারছেন না।
পাশের সেফাতেই নীলুফা চৌধুরী বিরস চেহারায় দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন।এই বুঝি তাঁর ছেলে যূথীকে নিয়ে ঢুকল।সারাদিন তিনি এই সেফাতেই বসে থাকেন।মনের ভেতর নানা অজানা আশংকা উঁকি দেয়।নিজেকে আর সামলাতে পারছেন না।দুই জা তাঁকে অনবরত সান্ত্বনা দিয়ে চলেছে।
হঠাৎ করেই নিশানকে মেইন ডোর দিয়ে ঢুকতে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি।দৌড়ে গেলেন সেদিকে।যূথীকে অচেতন অবস্থায় নিশানের কোলে দেখে অস্ফুটস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠলেন।ততক্ষণে বাকিরাও চলে এসেছে।
“—যূথীর কি হয়েছে নিশান?মেয়েটার এই হাল কেনো?হাত দিয়ে রক্ত ঝরছে কেনো?”
নিশান ধমকে উঠল।
“—প্রশ্ন পরেও করতে পারবে।এখন জলদি মাহিরকে ডাকো।ঘরে আছে তো নাকি?”
“—আছে।কিন্তু তুই ওকে হসপিটাল না নিয়ে বাড়ি নিয়ে…..”
“—আমার যা ভালো মনে হয়েছে আমি করেছি।জলদি মাহিরকে ডাকো।”
বাড়ির সবাই নিশানের পিছু পিছু উপরে উঠতে লাগল।মাহিকে ডাকার আগেই সে হাজির।চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সে বাইরে এসেছিল।যূথীর এই অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি নিজের যন্ত্রপাতি আনতে গেল।
____________________
রাত প্রায় তিনটার মত বাজে।বেঘোরে ঘুমাচ্ছে যূথী।তার পাশেই নিশান স্টিল হয়ে যূথীর হাত ধরে বসে আছে। নীলুফা চৌধুরী একটু আগেই রুম থেকে চলে গেছেন।নিশান বুঝিয়ে সুজিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে।শুধু শুধু বসে থেকে কি করবে।সকালে দেখা করলেই হবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখ মেলল যূথী।তবে ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি।নিশানকে বসে থাকতে দেখে বলল,
“—ঘুমিয়ে যান।আমি এখন সুস্থ আছি।”
নিশান মুচকি হেসে যূথীর কপালে আলতো করে চুমু খেল।
“—তোমার শরীর এখনো দুর্বল। দেখছো না স্যালাইন চলছে।”
“—তাতে কি! আপনি আসুন।ঘুমিয়ে যান।আপনাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ”
দুষ্টু চোখে নিশান বলে উঠল,
“—তোমার তো আমার সাথে ঘুম আসে না।তাহলে এখন যে উল্টো কথা বলছো?”
লজ্জা পেয়ে গেল যূথী।সত্যিই তো! সে নিজে থেকেই নিশানকে বলছে এখানে ঘুমাতে।
“—আপনি অতিরিক্ত কথা বলেন নিশান ভাইয়া।”
“—কিহ্! আবার ভাইয়া বললে?কি শাস্তি দেওয়া যায় তোমাকে।আচ্ছা যাও আজকেও মাফ করে দিলাম।যেহেতু তুমি অসুস্থ। কিন্তু এরপর থেকে ভাইয়া ডাক শুনলে শাস্তি দিয়েই ছাড়ব।”
উচ্চ শব্দে হাসছে নিশান।যূথী অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকে।নিজের মনেই বলে উঠল,
“—বাহ্! কি সুন্দর লাগছে লোকটাকে!”
চলবে……….
স্বপ্নচারিণী
সামান্তা সিমি
পর্ব_২৪
এক সপ্তাহ কেটে গেছে।যূথী এখন অনেকটাই সুস্থ। তবে হাতের ক্ষতটা এখনো পুরোপুরি ভাবে সারেনি।যূথী মাহিরের প্রেসক্রাইবড্ করা মেডিসিন খেয়ে যাচ্ছে।
এ কয়েকদিন নিশান যূথীর যত্নের কোনো ক্রুটি রাখেনি।ওষুধ কিনে আনা,সময়মতো ওষুধ খাওয়ানো সব নিজের হাতে করেছে।অফিসে গেলেও ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন দিয়ে খবর নেওয়া ছিল নিত্যদিনের রুটিন।আর সাথে বকাঝকা তো আছেই।যূথী ভেবেই পায় না একটা মানুষ কি করে এত ধমকাতে পারে।আবার মাঝে মাঝে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে নিশানের দিকে।কি করে পারে এরকমভাবে সব দিক সামাল দিতে! বাড়ির বড় ছেলে তাহলে এমনই হয়।
বাড়ির অন্যরাও প্রত্যেকদিন এসে খোঁজ খবর নিয়ে যেত।সেই সময়টা যূথী কাঁচুমাচু হয়ে বসে থাকত।তাঁর ধারণা বাড়ির লোকজন তাঁর থেকে এখনো অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে চলে।সেদিন রুমে নিশানের বাবাও এসেছিল।যূথী মাথা নিচু করে ফেলেছিল সাথে সাথে।লজ্জায় নাকি ভয়ে সেটা সে বুঝতে পারেনি।
দুয়েকটা হালকা কথাবার্তা বলে মফিজ চৌধুরী চলে গেছিলেন।যূথী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
রাতে ডিনার করার পর যূথী নিশানের আগেই রুমে এসে শুয়ে পরেছিল।হাই পাওয়ারের ওষুধের কারণে সারাক্ষণই ওর চোখে ঘুমঘুম ভাব থাকে।তাই বালিশে মাথা রাখার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পরেছে।
যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘড়িতে প্রায় একটা বাজে।যূথী চোখ খুলে দেখল রুম অন্ধকার। তবে টেবিল ল্যাম্প জ্বালানো।পাশ ফিরে দেখে কেউ নেই।নিশানকে কোথাও দেখতে পেলো না।কোথায় গেল লোকটা!
হঠাৎ করেই মাথায় আসলো এই সময়টা তো নিশান ভাইয়া ছাদে থাকে।নিশ্চয়ই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে।যূথী আর কিছু না ভেবেই দরজা খুলে ছাদের দিকে রওনা হলো।
যূথী যা ভেবেছিল তাই।নিশান একের পর এক সিগারেটে টান দিয়ে যাচ্ছে। গন্ধটা নাকে আসতেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল যূথী।এই লোক এত সিগারেট খোর কেনো।চেইন স্মোকারদের মত সিগারেট টানছে। যূথী নিঃশব্দে নিশানের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল।চোখ উপরে তুলে তাকাতেই তাঁর মনটা খারাপ হয়ে গেল।সে কত পিচ্চি লোকটা থেকে! আর ইনি যেন আইফেল টাওয়ার।লোকটার পাশে দাঁড়ালে তাঁকে একটুও মানায় না।একসাথে দাঁড়ালে মনে হবে হাতি আর মশা।
“—ঘুম শেষ?”
চমকে উঠলো যূথী।নিশান ভাইয়া তাঁর উপস্থিতি টের পেলো কিভাবে।সে তো কোনো আওয়াজ করেনি।যূথী এবার নিশানের পাশাপাশি রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পরল।
“—আপনি কি করে বুঝলেন যে এটা আমি?আর বুঝলেন কিভাবে যে পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে!”
“—সেটা তোমার না জানলেও চলবে।রুম থেকে এসেছো কেনো?”
“—প্লিজ প্লিজ বলুন না কিভাবে বুঝতে পারলেন! আমার জানতে খুব ইচ্ছে করছে।”
নিশান আড়চোখে যূথীর দিকে তাকাল।মেয়েটার মুখ খুশিতে ঝলমল করছে।চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে।সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য হচ্ছে না তবুও কেমন শ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে।
“—বাতাসে তোমার উড়না উড়ছিল।সেই শব্দটা ভালোভাবেই বুঝতে পারছিলাম।আর এত রাতে তুমি ছাড়া অন্য কেউ ছাদে আসবে না।”
যূথী এতক্ষণে খেয়াল করল চারদিকে মোটামুটি ভালোই বাতাস।এই লোক তো খুব বুদ্ধিমান। সবদিকে নজর।বাহ্! বাহ!
“—আচ্ছা আপনি এত সিগারেট খান কেনো?”
“—এনি প্রবলেম?”
“—হ্যাঁ প্রবলেম।এখন থেকে সিগারেট খাওয়া যাবে না।”
“—তোমাকে তো আগেই বলেছিলাম সব অভ্যাস করে নাও।সিগারেট আমি ডেইলি খাই।তাহলে তোমাকেও এই গন্ধটা সহ্য করতে হবে।”
মুখ কালো করে ফেলল যূথী।বদ লোক একটা! সারাক্ষণ তো বউ বউ বলে চিল্লায় আর এখন বউয়ের কথার কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না।আসলে সব নাটক।সে কি আর বুঝে না কিছু!তবে সেও কম না।সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস চিরদিনের মত শেষ করে তবেই ছাড়বে।হুহ!
হঠাৎ করেই বাতাসের বেগ বেড়ে গেল।আকাশের মেঘগুলো কালো স্তূপের আকার ধারণ করেছে।দূর থেকে গুড়গুড় আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
যূথীর গায়ের উড়নাটা বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ছে।কোনোমতেই ধরে রাখা যাচ্ছে না।
নিশান এখনো আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে।প্রকৃতির এমন উথাল-পাতাল রূপে যেন কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই তাঁর।
“—শুনছেন! রুমে চলুন।বৃষ্টি নামবে।”
নিশান ঘাড় ঘুরিয়ে যূথীর দিকে তাকাল যেন কথাটা ভালোভাবে বুঝতে পারে নি।
যূথী উড়না সামলাতে ব্যস্ত।বাতাসের ঝাপটায় চুলের খোপাটাও অর্ধেক খুলে গেছে।
“—চলুন না রুমে।আমার উড়নাটা আর ধরে রাখতে পারছি না।”
“—যেটা উড়ে যেতে চাইছে সেটাকে ধরে রেখেছো কেনো?ছেড়ে দাও।”
নিশান হাত বাড়িয়ে যূথীর উড়নাটা টান মেরে ফেলে দিল।উড়নাটা মুক্ত হাওয়ায় উড়তে উড়তে অনেক দূরে চলে গেল।
নিশানের এহেম আচরণে যূথী ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে।অদ্ভুত চোখে দেখছে নিশানকে।তড়িঘড়ি করে দরজার কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই নিশান ওর হাত চেপে ধরে কাছে টেনে আনলো।যূথীর খোপাটা এক টান দিয়ে খুলে ফেলল।নিশান নিচু গলায় বলল,
“—আমার সাথে থাকো কিছুক্ষণ। বৃষ্টিতে ভিজতে চাই তোমার সাথে।”
যূথী আরেক দফা চমক খেল।সে কি ভুল শুনছে নাকি সত্যি! নিশান ভাইয়া তাঁর সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে চাইছে!নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।যূথীর মন এই মুহূর্তে শুধু একটাই কথা বলছে।বাইরে থেকে লোকটাকে দেখলে যতটা কঠিন মনে হয় আসলে তিনি তা নন।সে তো এতদিন ভেবে এসেছে নিশান ভাইয়া শুধুমাত্র তাঁর প্রফেশনাল লাইফের প্রতি অনেক বেশি যত্নবান। কিন্তু আজ সে বুঝতে পারছে এই লোকটার মনেও অনেক লুকায়িত অনুভূতি আছে যেগুলো যূথী ছাড়া আর কারো কাছেই প্রকাশ পাবে না।
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল।সাথে ঝড়ো হাওয়া। উন্মত্ত প্রকৃতি এবার কিছুটা শান্ত হয়েছে।
বৃষ্টির ফোঁটা যূথীর শরীর স্পর্শ করতেই কিছুটা কেঁপে উঠল সে।চোখ তুলে তাকাতেই রক্ত হিম হয়ে গেল।নিশান গভীর চোখে দেখছে তাঁকে।
যূথী একটু নড়েচড়ে উঠতেই তাঁর কোমড় ধরে কাছে টেনে মাঝখানের গ্যাপটা পূরণ করে দিল নিশান।যূথীর গলায় লেপ্টে থাকা ভেজা চুলগুলো আঙুল দিয়ে সরিয়ে দিল।নিচে ঝুকে যূথীর সিক্ত গলায় আলতো করে একটা চুমু খেল।
যূথী দাঁতে দাঁত চেপে ধরেছে।আর সহ্য করতে পারছে না নিশানের স্পর্শ। এক্ষুনি বোধ হয় জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পরবে।শ্বাস-প্রশ্বাসের হার উঠানাম করছে তীব্র গতিতে।ঠোঁট দুটো কাপছে অনবরত। হৃদপিণ্ড ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
“—কি…কি করছেন নিশান ভা…”
ভেজা ঠোঁটজোড়ায় নিশানের ঠোঁটের শীতল স্পর্শ পেতেই যূথীর কথা থেমে গেল মাঝপথে।
ঠান্ডা হাওয়া ছুয়ে যাচ্ছে ওদেরকে।দুজনই ভিজে জবজবে হয়ে লেগে আছে একে অপরের সাথে।বৃষ্টির বেগ অনেকটাই কম এখন।চারদিকে পানির টিপটপ শব্দ এক ধরনের মধুর সুর তৈরি করে পরিবেশটাকে আরো মোহনীয় করে তুলছে।
______________________
সকালে যূথী ঘুম থেকে উঠতেই একরাশ বিরক্ততে তাঁর মুখ ছেয়ে গেল।মাথাটা খুব ধরে আছে।এই মুহূর্তে যদি এককাপ চা পাওয়া যেত!
মাথা ধরা অনুভব হতেই যূথীর গত রাতের কথা মনে পরে গেল।নিশ্চয়ই বৃষ্টিতে ভেজার ফল এটা।কিছু একটা মনে হতেই তৎক্ষনাৎ পাশে তাকিয়ে দেখে নিশান নেই।রুমের কোথাও নেই।
যূথী বালিশটা শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরল।সেই মুহূর্তটার কথা মনে পরতেই তাঁর কান গরম হয়ে উঠছে। সে কি করে নিশান ভাইয়ার বাহুডোরে এতক্ষণ আবদ্ধ হয়ে ছিল।ভাবতেই শরীরে কাঁপুনি ধরে যাচ্ছে।
যূথী চোখ বন্ধ করে সেই সময়টার অনুভূতিটা মনে করার চেষ্টা করল।
নিশান ভাইয়া থেকে ছাড়া পাওয়ার সাথে সাথেই যূথী আচ্ছন্নের মত হেঁটে রুমে পৌঁছেছিল।কোনোরকমে জামা পাল্টে বিছানায় কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পরেছিল।তখনও নিশান রুমে আসেনি।কেনো আসেনি সেদিকে মনোযোগ দেওয়ার মত অবস্থায় সে ছিল না।
যূথী বেড থেকে নেমে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পরল।নিজেকে দেখছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। ঠোঁটের একপাশে কালসিটে দাগ। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের উপর হাত ছোঁয়াতেই মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠল।
রুম থেকে বের হতেই কারিমার সাথে দেখা। যূথীকে দেখা মাত্রই হামলে পরল কারিমা।
সে এতদিন বাবার বাসায় ছিল।পরীক্ষা চলার কারণে আসতে এত দেরি।বাড়িতে যে একের পর এক কাহিনী ঘটে গেছে সেটা তাঁকে কেউ জানায় নি।এমনকি মাহিরও না।তাই আজ রেগেমেগে মাহিরকে ভাল-মন্দ কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিয়েছে।বেচারা মাহির মুখ শুকনো করে কিছুক্ষণ আগেই হসপিটাল চলে গেছে।
কারিমা অভিমানী গলায় বলল,
“—তোমরা সবাই এতটা স্বার্থপর হয়ে গেলে যূথী।এত ঘটনা ঘটে গেল আর আমি কিছুই জানি।আজ বাড়ি আসার পর আমার নিজেকেই কেমন জানি এলিয়েন এলিয়েন লাগছিল।”
যূথী কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছে।কারিমা ভাবী সব খবর জেনেছে তার মানে নিশান ভাইয়া আর তাঁর বিয়ের খবরটাও এতক্ষণে পেয়ে গেছে।তাহলে ভাবীও কি এখন থেকে তাঁর সাথে মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়াবে!
“—আসলে ভাবী..মনীষা বলছিল তোমার নাকি পরীক্ষা চলছে।তাই আর জানায় নি।নাহলে শুধু শুধুই টেনশন করতে।”
“—শুধু শুধু টেনশন করব মানে!বাড়ির একজন সদস্যের উপর দিয়ে এত ঝড়-ঝাপটা গেল আর আমি একটা খবরও পাব না!”
যূথী চুপ করে আছে।কারিমা যূথীর মনের অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে বলল,
“—নিশান ভাইয়া আর তোমার খবরটা আমি শুনেছি।জানো আমি খুব খুশি।আমি অবশ্য আগেই বুঝতে পেরেছিলাম।মানে সন্দেহ করেছিলাম আর কি।কিন্তু সেটা মনেই চেপে রেখেছি।কাউকে বলিনি।”
যূথী বিস্ময়ের সহিত জিজ্ঞেস করল,
“—কিভাবে সন্দেহ করলে ভাবী।”
“—আমিও যে ভালোবেসে বিয়ে করছি তাই খুব সহজেই তোমাদের ব্যপারটা বুঝে গেছিলম।আর আমাকে ভাবী ডাকছো কেনো।আমরা তো এখন জা হয়ে গেছি।সম্পর্কে কিন্তু তুমি আমার বড়।”
কারিমার মুখ হাসি হাসি।যূথীকে সে মনের দিক থেকে যথেষ্ট পছন্দ করে।
“—তাহলে এখন থেকে কি বলে ডাকবে আমায়?”
“—আমি তোমাকে ভাবী ডাকতাম আর ভাবীই ডাকব।”
দুইজন উচ্চস্বরে হেসে উঠল।
চলবে……..