স্বপ্নচারিণী,পর্ব_২৫,২৬

0
3439

স্বপ্নচারিণী,পর্ব_২৫,২৬
সামান্তা সিমি
পর্ব_২৫

রাতে ডাইনিং টেবিলে জড়ো হয়েছে সবাই।যে যার মত নিঃশব্দে ভাত খেয়ে যাচ্ছে। কাচের প্লেট, গ্লাসের টুংটাং শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই।
যূথী গোগ্রাসে ভাত গিলছে।এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাওয়া যায় ততই ভালো।বড় আব্বুর সামনে থাকতে তাঁর একটুও ভালো লাগে না।লোকটি কেমন রাশভারি গোছের। চেহারায় রাগী রাগী ভাব।অনেকটা নিশান ভাইয়ার মত।নিশান ভাইয়ার মুখের আদল বেশিরভাগই বড় আব্বুর সাথে মিলে যায়।একদিক দিয়ে বিচার করতে গেলে তাঁরা দুজনের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যাবে।
যূথী হতাশভবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।বিচার বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে এখন খাওয়ায় মনযোগ দেওয়া যাক।

মফিজ চৌধুরী অনেকক্ষণ থেকেই কিছু বলার চেষ্টা করছেন।কিন্তু কথাটা বারবার গলায় আটকে আসছে।ডাইনিং টেবিলে আসার আগে ভেবে রেখেছিলেন কথাটা এখানেই বলবেন।
কিন্তু সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে নিতে এখনো বলতে পারেন নি।সবার মুখের উপর একবার চোখ বুলিয়ে শেষমেষ বলেই ফেললেন।

“—নিশান আর যূথীর বিয়েটা তো এবার অনুষ্ঠান করে করা উচিত তাই না নীলু?”

সকলের খাওয়ার গতিতে ভাটা পরল।অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মফিজ চৌধুরী’র পানে।যূথীও বাদ নেই।একটু আগেই যে মানুষটার ভয়ে তাড়াতাড়ি ভাত খেয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল এখন সেই মানুষটার মুখের দিকেই বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে।
মফিজ চৌধুরী আবার বললেন,

“—কি হলো! সবাই এমন গোল গোল করে তাকিয়ে আছো কেনো?”

এবার নীলুফা চৌধুরী’র উচ্ছ্বসিত কন্ঠ শোনা গেল।
“—তুমি মেনে নিয়েছো ওঁদের? হে আল্লাহ্! এর চেয়ে খুশির সংবাদ আর কি হতে পারে।”

“—না মেনে আর কি করব বলো।আমার ছেলের ভালোবাসাটাই বড় আমার কাছে।বাকি সব গোল্লায় যাক”

“—যদি এমনই হয় তাহলে সেদিন এত রাগারাগি করলে কেনো?”

মফিজ চৌধুরী চেহারায় কঠোর ভাব এনে বললেন,
“—আমার জায়গায় থাকলে যে কেউই এটা করত নীলু।রাতের বেলা কাজি নিয়ে এসে বলছে বিয়ে করবে।ঝটকা সামলাতেই তো বেগ পেতে হচ্ছিল।আমাদের ছেলে যে আর কত অদ্ভুত কান্ড করে বেড়াবে কে জানে!

“—আচ্ছা যাই হোক।তুমি যে মেনে নিয়েছো এটাই সবচেয়ে বড় কথা।”

মনীষা,বিদীষা আর নীলিমা খুশি চেপে রাখতে পারছে না।নিচু স্বরে হাসাহাসি করছে ওঁরা।
“—কংগ্রাচুলেশন যূথী।এ বাড়ির বড় বউ আমাদের ভাবী!”

লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিল যূথী।সকলের অগোচরে নিশানের দিকে আড়চোখে দেখল একবার।সাথে সাথেই মন খারাপ হয়ে গেল তাঁর।বড় আব্বু এত বড় একটা আনন্দের কথা ঘোষণা করেছে আর ওই লোকের মুখের এক্সপ্রেশন শূন্য। এ কেমন মানুষ! আচ্ছা এমন নয় তো যে তিনি বিয়ের খবরটা শুনে খুশি হয়নি।মাঝে মাঝে যূথীর মনে হয় নিশান ভাইয়া একজন অনুভূতিহীন মানব। হাসি,আনন্দ, দুঃখ কোনোটাই কি তাঁকে স্পর্শ করে না?

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সবাই উঠতে যাবে তখনই মফিজ চৌধুরী আবার বসতে বললেন।
চশমার কাঁচের ভেতর দিয়ে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে যূথীর দিকে তাকালেন।
যূথী খুব অস্বস্তি বোধ করছে।বড় আব্বুর এভাবে তাকিয়ে থাকার অর্থ সে খুঁজে পাচ্ছে না।

“—বিয়েতে তোমার কোনো আপত্তি আছে যূথীকা? তোমার মতামত তো নেওয়া হয় নি।যদি আপত্তি থাকে নির্দ্বিধায় বলতে পারো।আমরা তোমার সমস্যার কথাও বিবেচনা করে দেখব।”

যূথী আগের চেয়েও দ্বিগুন লজ্জায় কুঁকড়ে উঠল।নিচের ঠোঁট বারবার কামড়ে ধরছে।মাথা তুলে তাকাতেই দেখে নিশান ভ্রু কুঁচকে দেখছে ওকে।
যূথী মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল কোনো আপত্তি নেই তাঁর।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে যূথী।কল্পনায় ভাসছেহাজারো স্বপ্ন, অসীম সুখের অনুভূতি। অবশেষে এই বাড়ির বউ হতে চলেছে সে।নাফিজ ইমতিয়াজ নিশানের বউ।কে জানে আগামী দিনগুলো কেমন কাটবে।সে কি পারবে সকল দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করতে! পারবে কি নিশান ভাইয়ার যোগ্য হতে?নিশান ভাইয়া তো কত শিক্ষিত।
পিছনে কারো উপস্থিতি টের পেতেই ঘুরে দাঁড়াল যূথী।নিশান দাঁড়িয়ে আছে।বাম হাতে সিগারেটের প্যাকেট আর ডান হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।
বাতাসের সাথে কটু গন্ধটা সরাসরি যূথীর নাকে আসতেই খুকখুক করে কেশে উঠছে।
হঠাৎ সে একটা দুঃসাহসিক কাজ করে বসল।নিশানের হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে ঢিল মেরে ফেলে দিল নিচে।

“—কি করলে এটা!”

নিশানের ধমকে কেঁপে উঠল যূথী। নিশান যে এতটা রেগে যাবে তা বুঝেনি।
যূথীকে দেয়ালের সাথে ধাক্কা মেরে নিশান কঠোর গলায় বলল,
“—আ’ম ওয়ার্নিং ইউ।নেক্সট টাইম এরকম কিছু করলে খুব খারাপ হয়ে যাবে।”

ধুপধাপ পা ফেলে নিশান রুমে চলে গেল।
যূথীর চোখে পানি টলমল করছে।সে কি অন্যায় কিছু করেছে?নিশান ভাইয়া এরকম না করলেও পারত।হয়তোবা কোনো কারণে মাথা গরম হয়ে আছে তাই বলে এত রুডলি কথা বলবে! অন্য সময়ও তো তাঁকে ধমক দেয় বিভিন্ন কারণে কিন্তু এখনের ব্যবহারটা খুব গায়ে লেগেছে তাঁর।এরকম বদমেজাজি একটা লোকের সাথে সারাজীবন থাকবে কিভাবে!
না চাইতেও যূথীর চোখ দিয়ে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পরল।

হঠাৎ করেই সে খেয়াল করল মাটি থেকে কয়েক হাত উপরে ভাসছে।ভালোভাবে তাকাতেই দেখে সে নিশানের কোলে।যূথীর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেল।এতক্ষণ গলা ফাটিয়ে ধমক দিয়ে এখন আসছে কোলে নিতে।
যূথীকে নিয়ে রুমে যেতে যেতে নিশান বলল,

“—চোখ দিয়ে আর এক ফোঁটা পানি পরলে আছাড় মেরে ফেলে দেব নিচে।”

যূথী নিশানের টি-শার্ট খামচে ধরে আরো জোরে কেঁদে উঠল।

“—এটুকুতেই কান্নাকাটি করে অস্থির তাহলে বাকি জীবন তো পরেই রইল।আমি কেমন ধারার মানুষ সেটাতো তুমি ভালো করেই জানো।”

নিশান যূথীকে আস্তে করে বেডে শুইয়ে দিল।
যূথীর খুব রাগ লাগছে নিশানের কথাবার্তা শুনে।কি মনে করে নিজেকে!কোনো রাজা-বাদশা!যখন যা বলবে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে! পারবে না সে।রাগ শুধু উনারই আছে নাকি।তাঁরও যথেষ্ট রাগ আছে।তাঁরও মাথা গরম হয়।

লাইট অফ করে নিশানও শুয়ে পড়ল।সন্ধ্যা থেকেই তাঁর মাথায় সূক্ষ্ম একটা যন্ত্রণা হচ্ছে। মেডিসিনেও কাজ হচ্ছে না।এবারের কেইসটা একটু জটিল।শুরুতেই বুঝতে পেরেছিল এটা নিয়ে অনেক দৌড়াদৌড়ি করতে হবে।
পাশ থেকে যূথীর নাক টানার শব্দ পেতেই নিশান শান্ত চোখে সেদিকে তাকাল।

“—আর একটাও আওয়াজ শুনলে আমি কিন্তু কামড়ে তোমার ঠোঁট ছিড়ে ফেলব।তখন ইচ্ছামত কেঁদো।”

নিশানের বলা কথাটা শুনে যূথী এক্কেবারে ঠান্ডা হয়ে গেল।কি ভয়ানক কথাবার্তা বলছে এই লোক।কামড়ে নাকি ঠোঁট ছিড়ে ফেলবে।যূথী এখন নিশ্চিত হলো যে রাক্ষস নামটা নিশান ভাইয়ার জন্য একদম পারফেক্ট।

ঘাড় ঘুরিয়ে নিশানের দিকে একবার তাকাল সে।চোখের উপর একহাত দিয়ে সোজা হয়ে শুয়ে আছে লোকটা।এটা দেখে যূথীর কিছুটা মায়া লাগল।নিশ্চয়ই কোনো বড় বিষয় নিয়ে চিন্তায় আছে।না জেনে না বুঝে কি কান্ডটাই না সে করে বসল।খুব অপরাধ বোধ হচ্ছে যূথীর।
তাই উঠে বসে নিশানকে নিচু গলায় ডাকল।

“—আপনার কি মাথা ধরেছে?”

নিশান কোনো রেসপন্স করল না।যূথী ভাবছে ঘুমিয়ে পরল নাকি লোকটা। এত তাড়াতাড়ি কিভাবে ঘুমাতে পারে।ডেকে তোলার কারণে আবার যদি বকা লাগায়!
যূথী এবার ভয়ে ভয়ে বলল,

“—আমি চুল টেনে দেই আপনার?”

নিশান এবার হাত উঠিয়ে তাকাল যূথীর দিকে।সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নিল যূথী।এই বুঝি ঘর কাপিয়ে ধমক দিবে।
যূথীর ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে নিশান উঠে বসল। যূথীর কপালে আলতো করে চুমো দিয়ে কোমল গলায় বলল,

“—কোনো দরকার নেই।আমার চুল টানলে তুমি ঘুমাবে কখন?”

“—আমি তো দুপুরে অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছি।তাই দেরি করে ঘুৃমালেও সমস্যা নেই।”

নিশান আর দ্বিরুক্তি না করে যূথীর কোলে মাথা রেখে দিল।মুচকি হেসে যূথী নিশানের চুল স্পর্শ করে মনে মনে বলে উঠল,

“—আমার রাগী বর।”

_________________________

নিশান এবং যূথীর বিয়ে উপলক্ষে সমস্ত বাড়ি সেজে উঠেছে এক ভিন্ন রূপে।চারদিকে হরেক রকমের ফুল আর রং-বেরঙের আলোর ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।বাড়ির সদস্যরা নানা কাজে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে।মফিজ চৌধুরী চারদিকে তীক্ষ্ণ নজর দিয়ে রেখেছেন যাতে কোনো কিছুর ক্রুটি না হয়।বাড়ির বড় ছেলের বিয়ে বলে কথা!
নীলুফা চৌধুরী ধকল সহ্য করতে না পেরে কিছুটা অসুস্থ বোধ করছেন। তবুও এক সেকেন্ডের জন্য নিজেকে বিরতি দিচ্ছেন না।
মনীষা,বিদীষা আর নীলিমাও সাজ গোজে ব্যস্ত।পিচ্চি সাফা সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে খুশিতে একতলা থেকে দোতলা দৌড়াদৌড়ি করছে।

এঙ্গেজমেন্ট থেকে শুরু করে বিয়ে পর্যন্ত যূথী একটা ঘোরের মধ্যে ছিল।তাঁকে যা যা করতে বলা হয়েছে সে তা-ই করে গেছে।
যূথী তাঁর বাবা-মা’র অনুপস্থিতি অনুভব করছিল সারাক্ষণ। কাঁদতে গিয়েও বারবার সামলে নিয়েছে।এখন আর তাঁর নিজেকে একা মনে হয় না।এ বাড়ির সকল লোকজন তাঁর আপন।সবাই তাঁর কাছের লোক।

কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই নিশান এবং যূথীর বিয়ে খুব সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
মনীষা,বিদীষা,নীলিমা যূথীকে ফুলে সাজানো রুমে নিয়ে আসলো।ওঁদের বিভিন্ন ইয়ার্কিতে যূথী লজ্জায় লাল-নীল হয়ে যাচ্ছে। মনে মনে ঠিক করে নিল ওদের যখন বিয়ে হবে তখন সে কড়ায় গন্ডায় উসুল তুলবে।

বেশ কিছুক্ষণ হলো যূথী একা বসে আছে ।এতদিন তো সে এই রুমেই থেকেছে নিশানের সাথে।কিন্তু হঠাৎ করে যেন রুমটাকে অচেনা লাগছে।লাল-সাদা ফুল আর মোমবাতির আলোয় চারদিকটা খুব স্নিগ্ধ লাগছে।বারান্দার খোলা দরজা দিয়ে আসা হাওয়ায় পর্দাগুলো উড়ছে মৃদুভাবে।
কিছু একটা শব্দ হতেই যূথী ভালোভাবে ঘোমটা টেনে নিল।না দেখেও বুঝতে পারছে নিশান প্রবেশ করেছে।যূথীর হার্ট বিট করছে দ্রুত গতিতে। শরীরে ঘাম দিচ্ছে খুব।এত ভয় লাগছে কেনো তাঁর!

অনেকক্ষণ পর্যন্ত নিশানের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে যূথী চিন্তায় পরে গেল।সে তো স্পষ্ট শুনেছিল রুমে কেউ এসেছে।তাহলে এখন কোথায় গেল!
ওয়ারড্রবে খুটখাট আওয়াজ শুনতেই যূথী সচকিত হয়ে গেল।
ঘোমটা টা হালকা একটু তুলে দেখার চেষ্টা করল আসলে হচ্ছে টা কি।
সামনের দৃশ্যটা দেখে হতভম্ব হয়ে গেল যূথী।

চলবে………..

স্বপ্নচারিণী
সামান্তা সিমি
পর্ব_২৬

ঘোমটা টা হালকা একটু তুলে দেখার চেষ্টা করল আসলে হচ্ছে টা কি।
সামনের দৃশ্যটা দেখে হতভম্ব হয়ে গেল যূথী।
নিশান ড্রয়ার থেকে সিগারেট নিয়ে বারান্দার দিকে যাচ্ছে। গায়ে ধূসর রঙের একটা টি-শার্ট আর পরনে ব্ল্যাক কালারের ট্রাউজার্স।
বাসর রাতে বউ রেখে কেউ সিগারেট খেতে যায় এটা যূথীর জানা ছিল না।বিয়ের পাঞ্জাবিও খুলে ফেলেছে।রাগে যূথীর শরীর জ্বলে যাচ্ছে। যার জন্য সেজেগুজে বসে আছে সেই মানুষটাই তাঁকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে দূরে গিয়ে বসে আছে।এই লোক নাকি তাঁকে ভালোবাসে।কেমন ভালোবাসা এটা!অভিমানে যূথীর প্রায় কান্না আসার উপক্রম।
বিছানায় ছড়িয়ে থাকা গোলাপের পাপড়ি গুলো হাত দিয়ে ফেলে দিল।খাটে লাগানো ফুলগুলোকে টেনে ছিড়ে ফেলতে মন চাইছে।
বিছানা থেকে নেমে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরল।থমকে গেল যূথী।
বউ সাজে নিজেকে দেখে নিজেই মোহিত হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের তাড়াহুড়োয় তখন ভালোভাবে দেখার সুযোগই হয় নি।খয়েরি রঙয়ের লেহেঙ্গায় কি সুন্দর দেখাচ্ছে তাঁকে।সারা শরীর গয়নায় ঝলমল করছে।লজ্জা পেয়ে গেল যূথী।নিজের প্রশংসা কেউ নিজেই করছে এরকম হয়েছে কখনো!
ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠতেই তা আবার মিলিয়ে গেল।এত সাজগোজ করে কি লাভ হলো!যার জন্য সেজেছে সে তো চোখ তুলেও দেখেনি।
ড্রেসিং টেবিলের পাশ থেকে লাগেজ নিয়ে খুলতেই দেখল শাড়ি দিয়ে ঠাসা।দেখলেই বুঝা যায় শাড়ি গুলো বেশ দামি।বড়মা বলেছিল এগুলো নাকি নিশান ভাইয়া নিজের পছন্দমত কিনে এনেছে।মুখ ভেংচালো যূথী।সব নাটক! সব ঢং!

ভাঙাচুরা মন নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে রওনা হলো সে।হাতে লাল রঙের একটা শাড়ি।অনেকক্ষণ থেকেই লেহেঙ্গাটা গায়ে ফুটছে।আর ভারী মেকাপের কারণে তো দম বন্ধ হয়ে আসছে তাঁর।তাই একেবারে গোসল শেষ করেই বেরিয়ে আসলো।
রুমে কেউ নেই।তাঁর মানে নিশান ভাইয়া এখনো বারান্দায়। থাকুক বারান্দায়। যূথী ওখানে একদমই যাবে না।চুপচাপ ঘুমিয়ে পরবে এখন।

যাবে না যাবে না করেও যূথী বারান্দায় একবার উঁকি দিল।নিশান আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে।
গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল যূথী।

“—ঘুমাবেন না?”

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল নিশান।যূথীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে আবার সামনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল যেন কিছুই শুনতে পায় নি।
ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে আছে যূথী।নিশানের ভাব-গতিক সে ঠাওর করতে পারছে না।

“—ঠিক আছে।আপনি না হয় বারান্দাতেই থাকেন আজ।আর বিরক্ত করব না আমি।গুডনাইট। ”

রাগে গজগজ করতে করতে যূথী রুমে আসল।ধপ করে বসে পরল বিছানায়।রাগে মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তাঁর।এ কেমন ব্যবহার নিশান ভাইয়ার! কিছু বলছেও না কিছু শুনছেও না।শুধু মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে।
মস্ত বড় একটা হাই তুলল যূথী।এতক্ষণে টের পেল ঘুমে তাঁর চোখ জ্বালা করছে।বিয়ে উপলক্ষে এ কয়েকদিন তো কম ধকল যায় নি।
যূথী বালিশে মাথা রাখতে যাবে সেই মুহূর্তে রুমে নিশানের আগমন। চোখগুলো লাল হয়ে আছে। নিশ্চয়ই সিগারেট খাওয়ার কারণে এই অবস্থা। নিশানকে দেখতে পেয়েই যূথী আবার সটান হয়ে বসে পরল।
রুমের সব লাইটগুলো নিভিয়ে দিল নিশান।মোমবাতির হলদে আভায় চারদিক ঝলমল করছে।শুভ্র রঙের দেয়ালে রুমের আসবাবপত্র গুলোর অদ্ভুত অদ্ভুত ছায়া তৈরি হয়েছে।
যূথী অবাক চোখে তাকিয়ে আছে নিশানের দিকে।এই রহস্যময় লোকটার রসহ্যের কূল কিনারা সে কখনো খুঁজে পায় নি।এখনো পাচ্ছে না।
নিশান হালকা ধাক্কা দিয়ে যূথীকে ফেলে দিল বিছানায়।
দুই দিকে হাতে ভর দিয়ে একটু ঝুকে এল।
যূথী কিছু বলছে না।রক্তশূণ্য মুখে চেয়ে আছে শুধু।নিশান যূথীর কপালে ছড়িয়ে থাকা এলো চুলগুলো ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দিল।তৎক্ষনাৎ চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল যূথী।

“— রাগ করেছো আমার সাথে?এই যে তোমাকে রেখে আমি বারান্দায় গিয়ে বসে আছি! কি করব বলো!তোমাকে বউ সাজে দেখে যে আমি তোমাতেই আটকে গেছি।কিছু ভালো লাগছে না আমার।তোমার কাছে আসতেও যে আমার নার্ভাস লাগছে।বুঝতে পারছো কি বলছি?নাফিজ ইমতিয়াজ নিশানের নার্ভাস লাগছে।খুব হাস্যকর না কথাটা?কিন্তু এটাই সত্যি। তাই তো তখন রুমে এসে আমি তোমাকে দেখেই সিগারেট নিয়ে বারান্দায় চলে গেছি।”

নিশানের এমন ঘোর লাগা কথা শুনে যূথীর সব চিন্তা ভাবনা কুন্ডলী পাকিয়ে আসছে।এতদিন হার্ট অ্যাটাক হতে গিয়েও হয় নি।আজ নির্ঘাত অঘটন ঘটেই যাবে।নিশানের চোখের দিকে তাকানোর সাহসও নেই তাঁর। এখনো দুচোখ বন্ধ করে আছে।

“—আমার দিকে তাকাও যূথী।আমাকে কি আজ খুন করে ফেলার প্ল্যান করেছো?কিছুক্ষণ আগে লাল টকটকে শাড়ি পড়ে ভেজা চুলে আমার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছো।ভাবতে পারছো আমার অবস্থাটা তখন কি হয়েছিল?এটা কি ঠিক করলে?
জানো যেদিন বাগানে সাফার সাথে দৌড়াতে দেখেছিলাম তোমাকে সেদিন আমার ঘুম উধাও হয়ে গেছিল।নিজেকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছি যে তুমি আমার বোনেদের বয়সী।ওঁদের যে নজরে দেখি তোমাকেও সেই জায়গাটায় রাখতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি।দিন দিন আসক্তি বেড়েই চলেছে তোমার প্রতি।তোমাকে বলেছিলাম অনেক টাইম দেব। কিন্তু পারছি না আমি।তোমাকে কাছে চাই।খুব কাছে।যতটা কাছে পেলে কেউ তোমাকে আমার থেকে দূরে নিতে পারবে না।তুমি শুধু আমার যূথী।”

নিশানের কথাগুলো যূথীর হৃদয়কে স্পর্শ করে যাচ্ছে। কারোর কথাও কি এত ভালোবাসাময় হতে পারে?কেউ তাঁকে এমন গভীরভাবে ভালোবাসবে তা কখনোই ভাবে নি।সত্যিই এত সুখ তাঁর ভাগ্যে আছে!
হালকা কাঁপছে যূথী।চোখ খুলতেই দেখে নিশান তাঁর দিকে মায়াবী চোখে তাকিয়ে আছে। যেই চোখে খেলা করছে এক সমুদ্র ভালোবাসা। সবটুকুই যূথীর জন্য।যূথী এই ভালোবাসায় সারাজীবন ডুবে থাকতে চায়।হাত বাড়িয়ে নিশানের গালে হাত ছোঁয়ালো যূথী।কম্পিত গলায় বলে উঠল,

“—আমি শুধু আপনার।আর কারো নয়।আমিও যে আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি নিশান।”

নিশানের ধৈর্য্যের বাঁধ শেষ।আর বিলম্ব না করে যূথীর ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ করে দিল।ধীরে ধীরে সেই স্পর্শ হতে লাগল গভীর থেকে গভীরতর।
রাত বাড়ার সাথে আকাশের চাঁদের আলোও ফিকে হয়ে আসলো।রুমের মোমবাতিগুলো প্রায় নিভু নিভু।মোমবাতির মৃদু আলো আর বাইরের আবছা অন্ধকারে রুমের পরিবেশটা এক অন্যরকম রূপ ধারণ করেছে।

______________________

রিসিপশনের অনুষ্ঠানে যূথী সেজে উঠেছে অপরূপ এক সাজে।গায়ে দামি শাড়ি আর সোনায় বাঁধানো গয়না।বাড়ির ভেতরে আনাচে কানাচে চিকচিক করছে নানা রঙের লাইটের আলো।এ যেন কোনো রূপকথার প্রাসাদ আর যূথী সেই প্রাসাদের রানী।
অন্যদিকে নিশানও কোনো অংশে কম নয়।ডার্ক ব্লু স্যুট বুটে সকলের নজর কেঁড়ে নিচ্ছে সে।
বাড়ির পরিবেশ লোকে লোকারণ্য। সকলের কলহাস্যে আবহাওয়া মুখরিত।
লতিফা বেগম যূথী আর নিশানের বিয়ের চার-পাঁচ দিন আগেই এসেছিলেন।দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছেন যূথীকে।মেয়েটার মুখ খুশিতে আলোড়িত। দেখলেও চোখ জুড়িয়ে যায়।অবশেষে যূথীর কষ্টের দিনগুলো শেষ হলো।তিনি মন থেকে দোয়া করছেন ওঁরা দুজন যেন সুখী হয়।

নিশানের ফোনে কল আসতেই সে বেরিয়ে গেল।সকলে অনেক চেষ্টা করেছে বাঁধা দেওয়ার।কিন্তু নিশান শুনেনি।অফিসে নাকি তাঁর খুব জরুরি কোনো কাজ রয়ে গেছে।
এদিকে কাপল পিক তোলার জন্য নিশানের ডাক পরেছে।মনীষা ভাইকে খুঁজতে এসে দেখে সে অনেকক্ষণ আগেই চলে গেছে।ব্যস মুখ অন্ধকার হয়ে গেল সবার।

প্রায় ঘন্টা খানেক পর বাড়ি ফিরল নিশান।ততক্ষণে বাড়ি প্রায় ফাঁকা।যূথী এখনো ফুলে সাজানো সোফাটায় ঠায় বসে আছে।তাঁকে ঘিরে আছে মনীষারা।কাপল পিক না তুলে নাকি ওঁরা ছাড়বে না।সারাদিনের ধকলে তাঁর শরীর খুবই ক্লান্ত। কিন্তু কি আর করা।মেয়েগুলো তো বড্ড জেদি।অবশেষে ছবি তুলেই ক্ষান্ত হলো তিনবোন।

নিশানের অনেক আগেই রুমে এসেছে যূথী।ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে আসছে তাঁর।সাজানো-গোছানো বিছানাটা দেখে যূথী আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না।দৌড়ে গিয়ে শুয়ে পড়ল।

রুমে এসে নিশান দেখে যূথী গভীর ঘুমে।মৃদু হাসল সে।মেয়েটা চেঞ্জও করেনি।এই ভারী ভারী অর্নামেন্টস নিয়ে সারারাত থাকবে কিভাবে।
নিশান কাছে গিয়ে একে একে সব গয়না খুলে দিল।যূথীকে ঠিক করে বালিশে শুইয়ে দিল।
আজ নিজেকে পরিপূর্ণ লাগছে নিশানের।ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দ বোধ হয় একেই বলে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here