স্বপ্নচারিণী,পর্ব_৬
সামান্তা সিমি
একটা চেয়ারে হাত বাঁধা অবস্থায় ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে মতিন।তাঁর ঠিক সামনের চেয়ারেই পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে নিশান।একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাঁর সামনে বসে থাকা জঘন্য আসামীটার দিকে।মতিনের প্রতি এক ধরনের ইন্টারেস্ট ফিল করছে নিশান।কারণ এটাই একমাত্র আসামী যে ধরা পরার পরও নিশানকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে।একবার নয় বারবার।
হাতের গানটা নেড়েচেড়ে টেবিলের উপর রেখে মতিনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল নিশান।চুলের মুঠি ধরে বলল,
—কিরে! এত তাড়াতাড়ি গলার জোর হারিয়ে গেল? একটু আগেও তো বলছিলি আমাকে নাকি জানে মেরে দিবি?
যন্ত্রণায় কাতর হয়ে মতিন বলল,
—আমার কিছু হলে আমার দলের লোকেরা তোকে ছেড়ে দিবে না।মিলিয়ে নিস আমার কথা।চরম মূল্য দিতে হবে তোকে।
এক লাথিতে সামনের টেবিলটা ফেলে দিল নিশান।রাগে তাঁর মাথার শিরাগুলো দপদপ করছে।তাঁর মন চাইছে মতিনকে একটা সুট করে এখানেই শুইয়ে দেয়।
—তোর দলের প্রত্যকেটাকে টেনে টেনে আমি জেলে ঢুকিয়ে ছাড়ব।আর তুই! তুই তো এই জন্মে জেল থেকে বের হতে পারবি না হারামজাদা! অনেক মানুষের চোখের জল ঝরিয়েছিস।এবার নিজের পরিণতি নিজের চোখেই দেখ।
কথাগুলো বলে নিশান “হিমেশ” বলে চিল্লিয়ে উঠল।হিমেশ তখন পাশের রুমে নিজের ডেস্কে বসে গার্লফ্রেন্ডের সাথে প্রেমালাপে মগ্ন।নিশানের এমন ভয়াবহ হুঙ্কার শুনে তাঁর হাত থেকে মোবাইল ছিটকে পরে গেল।তড়িৎ গতিতে নিশানের সামনে গিয়ে বলল,
—ইয়েস স্যার!
—এই জানোয়ারটাকে কাস্টডিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করো।
নিজের গান পকেটে ঢুকিয়ে বের হয়ে গেল নিশান।
__________________
দুপুর থেকে কোনো কারণ ছাড়াই প্রচন্ড মাথা ধরে আছে যূথীর।আর সহ্য করতে না পেরে ওয়াশরুমে গিয়ে মাথায় পানি ঢেলে আসলো।এখন একটু আরাম বোধ হচ্ছে।
যূথী ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চল মুছছে তখনই নীলিমার আগমন ঘটল।
যূথীকে ভেজা চুলে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
—একি! তুমি আবার গোসল করেছো নাকি?
—একটু মাথা ধরেছিল৷ তাই পানি ঢেলে আসলাম।
—ও আচ্ছা। এখন আমার সাথে গার্ডেনে চলো।আমরা সবাই ওখানে অনেক মজা করছি।
নীলিমা যূথীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাত টেনে নিচে নিয়ে গেল।
গার্ডেনে সবাইকে দেখতে পেয়ে যূথীর মন ভালো হয়ে গেল।এমনিতেই আজ ছুটির দিন। এজন্য মাহির ভাইয়াও সাথে আছে।
মাহির যূথীকে দেখে বলে উঠল,
— এই যে যূথী! আজ কিন্তু আমরা তোমার গ্রামের বাড়ির গল্প শুনব।অনেকদিন হলো গ্রামে যাই না।মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে গ্রামে গিয়ে একটু প্রকৃতির ফ্রেশ হাওয়া গায়ে লাগাই।কি আর করা।এখন তোমার থেকে গল্প শুনেই শখ পূরণ করব।
মাহিরের কথা শুনে যূথী হেসে দিল।এই একটা মানুষের কথা শুনলেই তাঁর প্রাণ খুলে হাসতে ইচ্ছে করে।মাহির ভাইয়া সাথে থাকা মানেই গল্প হোক গান হোক সব জমে উঠবে।
* গল্পের একপর্যায়ে হঠাৎ সাফা কোত্থেকে যেন ছুটে আসলো।মেয়েটার চেহারা কেমন কাঁদোকাঁদো হয়ে আছে।মাহির সাফাকে কাছে টেনে জিজ্ঞেস করল,
—কিরে পিচ্চি এভাবে নাক ফুলিয়ে রেখেছিস কেনো? মা মেরেছে বুঝি?
—মারে নি।কিন্তু আমি এখন তোমাদের সবাইকে মারব।তোমরা সব নিজেদের মত করে গল্প করছো কিন্তু আমার সাথে কেউ খেলে না।আমার খুব বোরিং লাগছে।
সাফার কথা শুনে মাহির ফিক করে হেসে ফেলল।ব্যস্!
সাফাও রেগে দুমদাম মারতে লাগল মাহিরকে।
যূথী কোনোরকমে হাসি থামিয়ে বলল,
—চলো সাফামণি! তুমি আর আমি খেলব।ওদের কাউকেই সাথে নিব না।
সাফা আনন্দে লাফাতে লাফাতে যূথীকে জড়িয়ে ধরে বলল,
—ইউ আর সো সুইট আপু।চলো আমরা এসব বুড়াদের দলে থাকব না।
পিচ্চি সাফার কথা শুনে আরেকবার সবার মাঝে হাসির বান এলো।
সাফা যূথীকে গার্ডেনের একপাশে এনে বললো,
—আমি ছুটতে থাকব আর তুমি আমাকে ধরার চেষ্টা করবে। যদি ধরতে পারো তখন তুমি ছুটবে আমি তোমাকে ধরব।
যূথী মাথা নাড়ার সাথে সাথেই সাফা দৌড় শুরু করল।ছোট ছোট পা ফেলে সাফা এদিক সেদিক ছুটছে।যূথী অনেকটা ইচ্ছে করেই আস্তে দৌড়াচ্ছে যাতে বাচ্চাটার খেলার আনন্দ নষ্ট না হয়ে যায়।মাহির,মনীষা,বিদীষা,নীলিমা সবাই চিৎকার করে হাততালি দিয়ে ওদের উৎসাহ দিচ্ছে। বাড়ির বাগান সকলের হাসিতে মুখরিত।
* নিজের রুমে বসে ল্যাপটপে কিছু দেখছিল নিশান।যেদিন সে বাড়িতে থাকে তখনও কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখে না।
হঠাৎ নিচ থেকে আসা হৈ-হুল্লোড়ের আওয়াজে তাঁর মনযোগে ব্যাঘাত ঘটলো। সে বুঝে গেছে নিশ্চয়ই সবগুলো গার্ডেনে গিয়ে জটলা পাকিয়েছে। ওরা কি ভুলে গেছে যে নিশান আজ বাড়িতে আছে!
চেঁচামেচির সাথে মাহিরের গলার আওয়াজও শোনা যাচ্ছে। নিশান ভেবে পায় না তাঁর ভাই এত বড় হয়েও কিভাবে এমন বাচ্চাদের মত বিহেভ করতে পারে।মাঝেমধ্যে তো নিশানের সন্দেহ হয় মাহিরের মানসিক কোনো সমস্যা আছে কিনা।
নিশান ল্যাপটপ বন্ধ করে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল।কড়া করে কয়েকটা কথা না শুনালে ওরা থামবে না।পড়ালেখা বাদ দিয়ে দিনদিন বাড়িটাকে রঙ্গমঞ্চ বানিয়ে ফেলছে।
গার্ডেনের দিকে চোখ দিতেই নিশানের হৃৎপিণ্ডের গতি থেমে আসতে চাইলো।তাঁর চক্ষু যেন সামনে ঘটমান দৃশ্যটায় স্থির হয়ে গেল।
হলুদ স্কার্ট পরা একটা মেয়ে সাফার সাথে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। বাতাসে মেয়েটার অবাধ্য ভেজা চুলগুলো উথাল-পাতাল হয়ে উড়ছে।বিকেলে হেলে পরা সূর্যের মৃদু আলো তাঁর চোখেমুখে ছুয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
মেয়েটার হাসির ঝিলিক গভীরভাবে স্পর্শ করে দিল নিশানের হৃদয়কে।এটা তো যূথী!
শহরে মেয়েদের মুখের উপর ভারী মেকাপের আস্তরণ দেখে অভ্যস্ত সে।কিন্তু এই মেয়েটার চেহারায় যেন অজস্র মায়া ভরপুর। নেই কোনো কৃত্রিমতার ছোয়া।এমন একটা পবিত্র ফুল এতদিন তাঁর বাড়িতে তাঁর চোখের সামনেই ছিল অথচ সে ভালোভাবে
খেয়ালই করে নি।আপনমনেই বিড়বিড় করে বলতে লাগল,
—মাইন্ডব্লোয়িং!! সি ইজ জাস্ট মাইন্ডব্লোয়িং।লাইক এ ব্লুমিং সানফ্লাওয়ার!!
নিশানের আর রুমে যেতে মন চাইলো না।তাঁর মনে হচ্ছে এরকম একটা দৃশ্য দেখতে দেখতে শত যুগ কাটিয়ে দিতে পারবে।
সাফা এবং যূথীর খেলা জমে ওঠেছে।এবার যূথী দৌড়াচ্ছে আর সাফা ধরার চেষ্টা করছে।
হঠাৎ করেই মনীষার নজর গেল নিশানের বারান্দার দিকে। নিশান কেমন পলকহীন চোখে এদিকেই তাকিয়ে আছে।তাঁর মানে আজ তাঁদের ভাই রেগে ফায়ার। এতক্ষণ তো মনেই ছিল না নিশান ভাইয়া যে আজ বাসায়।ভীত চোখে মনীষা সবাইকে দেখাল।
এদিকে যূথী সাফা ছুটেই চলেছে।মনীষা ইশারায় যূথীকে চলে আসতে বললো।যূথী প্রথম না বুঝলেও পরে বুঝতে পেরে কাছে আসলো।
—এক্ষুনি রুমে চলো যূথী! উপরে তাকিয়ে দেখো কে দাঁড়িয়ে আছে!
মনীষার কথায় নিশানের বারান্দার দিকে তাকাতেই যূথীর চোখ বড় বড় হয়ে গেল।এই লোকটা এতক্ষণ এখানেই ছিল তাহলে।এজন্যই মনীষাদের চোখ-মুখে এত ভয়।
কিন্তু নিশান এখনো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।এতে সবাই আরো ভয় পেয়ে গেল।ভাবছে আজ বোধ হয় তাঁদের নিশান ভাইয়া অতিমাত্রায় হাইপার হয়ে গেছে।
মাহির সাহস নিয়ে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
—হ্যালো বিগ ব্রো! কিছু বলবে কি? না মানে এভাবে স্ট্যাচু হয়ে আছো যে তাই জানতে চাইলাম।
মাহিরের আওয়াজ শুনেই টনক নড়ল নিশানের।কোনো উত্তর না দিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে রুমে চলে আসলো।নিশান দুইহাতে নিজের চুল চেপে ধরছে।নিজেকে কোনোভাবেই শান্ত করতে পারছে না।কখনো কাউকে দেখে তাঁর এমন অস্থির অনুভূতি হয় নি।কতই বা বয়স হবে ওই মেয়েটার? আঠারো নয়তো উনিশ!
নিশান ভেবেই কূল পাচ্ছে না তাঁর মত একটা প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ কি করে তাঁর বোনের বয়সী এক মেয়ের প্রতি এতটা আকর্ষিত হতে পারে?
তাঁর মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছে এটা ঠিক নয়।কিন্তু অবাধ্য মনটাকে সে কোনোভাবেই বশে আনতে পারছে না।
তাঁর দুচোখ চাইছে আরেকবার ছুটে গিয়ে সেই সৌন্দর্যকে তৃপ্তি নিয়ে দেখে।
তৎক্ষনাৎ নিশান বারান্দায় গেল কিন্তু গার্ডেনে আর কাউকে দেখতে পেল না।নিশ্চয়ই তাঁর ভয়ে সবগুলো যার যার রুমে চলে গেছে।
দুইহাত মুঠ করে চেপে ধরল নিশান।দেয়ালে একের পর এক ঘুষি মেরে বলতে লাগল,
—হোয়্যাট আর ইউ ড্যুয়িং নিশান! ইট ডাজ নট স্যুট অন ইউ।জাস্ট ফোকাস অন ইউর ডিউটি।নাথিং ইলস্।
* সন্ধ্যায় মেয়েদের গ্রুপটা রুমে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত।
যূথী তাঁর নতুন বইয়ের পৃষ্ঠা একটা একটা করে উল্টিয়ে গন্ধ শুঁকছে।তাঁর কাছে মনে হয় নতুন বইয়ের গন্ধ পৃথিবীর সেরা সুগন্ধ গুলোর একটি।হাজারবার ঘ্রাণ নিলেও মন ভরে না।
যূথীর পাশে বসে বিদীষা হাতে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে একটু পর পর কফিতে চুমুক দিচ্ছে। মনীষা এবং নীলিমা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছে।
হঠাৎ বিদীষা বলে উঠল,
—গাইজ! আজ নিশান ভাইয়া যেভাবে তাকিয়ে ছিল।আমি তো ভয়ে আছি হৈচৈ করার অপরাধে কখন যে আমাদের ডেকে পাঠায়।
—রাইট।কিন্তু আজ তো ভাইয়ার চেহারায় কোনো রাগ দেখতে পাই নি।কেমন যেন বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। (নীলিমা)
—সিরিয়াসলি!! শোন্ এসব বিস্ময়, চমকে উঠা, অবাক হওয়া এগুলো কিছুই ভাইয়ার ধাতে নেই।সে অনেকটা যন্ত্রমানব টাইপের। শুধু জানে চোখ লাল লাল করে ধমক দিতে। (মনীষা)
যূথী এতক্ষণ চুপচাপ বসে ওদের কথা শুনছিল।এবার টিপ্পনী কেটে বলে উঠল,
—আমি ভাবছি নিশান ভাইয়ার বউ যে হবে তাঁর তো বারটার জায়গায় তেরটা বেজে যাবে।
নীলিমা মন খারাপ করে উত্তর দিল,
—আমরা ভাইয়ার বিয়ের আশা বাদ দিয়েছি বোন।ভাইয়া বড়মা’কে সাফ জানিয়ে দিয়েছে তাঁকে যেন বিয়ের ব্যপারে কেউ কিছু না বলে।প্রথম দিকে তো বড়মা আর বড়আব্বু কয়েকদিন জোর করেছিল।তারপর ভাইয়া রেগেমেগে দুইদিন বাড়ি ফেরেনি।অনেক কষ্ট করে সবাই অনুরোধ করার পর ওকে বাড়ি ফেরাতে পেরেছিল।এরপর আর কেউ কখনো বিয়ের ব্যপারে কথা বলেনি।হি ইজ অলরেডি থার্টি টু ! সে আর এ জন্মে বিয়ে করবে বলে মনে হয় না।
নীলিমার কথা শুনে যূথী ভাবছে লোকটার বয়স তো কম না।কিন্তু বিয়ে করতে সমস্যা কোথায়? বাড়ি গাড়ি কোনোকিছুরই তো অভাব নেই।ঠিকমত বিয়ে করলে এতদিনে দুই চারটা বাচ্চার বাপ হয়ে যেত।
বড়লোকদের কত যে বিচিত্র খেয়াল! যূথী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
_________________
রাতের অন্ধকার কাটিয়ে ভোরের আলো চারদিকে ছড়িয়ে পরেছে।দূরের কোনো বাড়ির ছাদ থেকে মুরগির ডাক শুনা যাচ্ছে।
যূথী আজ তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পরেছে।রাতে ঘুমানোর আগেই ঠিক করে রেখেছিল সকাল সকাল উঠে বাগানে হাঁটতে যাবে।ওইদিন দেখেছিল বাগানে হরেকরকম ফুল ফোটে।ভোরবেলা ফুটন্ত ফুলের সৌন্দর্য দেখলে এমনিতেই মন ভালো হয়ে যায়।
গলায় উড়না পেঁচিয়ে যূথী বাগানে চলে এল।
চলবে………