স্বপ্নচারিণী,পর্ব_৯,১০
সামান্তা সিমি
পর্ব_৯
বাড়ির মেয়েদের গ্রুপটা একসাথে জড়োসড়ো হয়ে নিশানের রুমের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।ওরা ভেতরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না।
তাঁদের নিশান ভাইয়া আজ এখনো অফিসে যায় নি।ঘুম থেকে উঠেই ওদের সবাইকে রুমে ডেকে পাঠিয়েছে।
যূথীর মেজাজ বিগড়ে আছে।সে কোনোভাবেই নিশানের সামনে যেতে চায় না।এ কয়েকদিন নিজেকে আড়ালে রেখেছিল।কিন্তু আজ তো একদম ঘরে ডেকে পাঠিয়েছে।
যূথী বলল,
“—এই তোমরা ভেতরে যাও।আমি না গেলে এমন কিছুই হবে না।কি জন্য ডেকেছে সেটা শুনে চলে আসো।”
“—নেভার! ভাইয়া আমাদের সবাইকে ডেকেছে।আমরা সবাই একসাথে ভেতরে যাব।বকা খেতে হলে একসাথে খাব।” (মনীষা)
“—এত কথা বলার দরকার কি! এখানে বকবক না করে চল দেখে আসি কি জন্য ডেকেছে।” (নীলিমা)
মনীষা আস্তে আস্তে দরজায় নক করল,
“—ভাইয়া আসবো?”
ভেতর থেকে আওয়াজ আসলো,
“—আয়!”
চারজন রেলগাড়ীর মত সিরিয়াল ধরে রুমে ঢুকল।সবার পেছনে যূথী।সে ইচ্ছে করেই নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে।
নিশান সোফায় বসে কফি খাচ্ছিল।ওদের আসতে দেখে কাবার্ড খুলে একটা বড় প্যাকেট সামনে রাখল।
নীলিমা স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করল,
“—কেন ডেকেছো ভাইয়া?”
“—প্যাকেটটা খুলে দেখ।”
মনীষা হাত বাড়িয়ে প্যাকেট নিয়ে খুলে ফেলল।যূথী বাদে বাকি দুইজন হামলে পরল প্যাকেটটার উপর। ভেতর থেকে লেটেস্ট মডেলের চারটা নিউ ফোনের বক্স বেরিয়ে আসলো।ওদের চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে নিশান ভাইয়া ওদের ফোন গিফট করেছে।
বিদীষা চিৎকার করে বলে উঠল,
“—ওওও ভাইয়া!!! নিউ ফোন!! আমাদের জন্য???”
নিশান কোনো জবাব দিল না।সে স্ট্রেইট তাকিয়ে আছে পেছনে বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকা যূথীর দিকে।এতদিন ইচ্ছে করে তাঁর থেকে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল মেয়েটা।নিশানের মন চাইছে ঠাস ঠাস করে যূথীর গালে দুইটা চড় বসিয়ে দেয়।যূথী এখনো জানে না তাঁর রাগ সম্পর্কে।
নীলিমার ডাকে যূথীর থেকে চোখ ফেরাল নিশান।
“—ভাইয়া! আমাদের তো ফোন আছে।যূথীর অবশ্য নেই।আমাদের জন্য শুধু শুধু কেনো আনতে গেলে!”
“—ভাল না লাগলে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আয়।”
নিশানের এমন কথায় নীলিমা থতমত খেয়ে গেল।সে একটু ভাব নিয়ে কথাটা বলতে গেছিল উল্টে নিশান ভাইয়া তাঁর গালে একটা অদৃশ্য চড় বসিয়ে দিল।
ফোন হাতে নিয়ে চারজন বেরিয়ে যেতে নিলে নিশান বলে উঠল,
“—মনীষা তোরা যা।যূথীর সাথে আমার কথা আছে।”
একটা ঢোক গিলল যূথী।এখন কি করবে সে? “যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়”- এই প্রবাদ বাক্যটা আজ তাঁর কাছে সত্য মনে হচ্ছে। যতই সে নিশান নামক রাক্ষস লোকটা থেকে দূরে যাওয়ার প্ল্যান করছে ততই যেন তাঁকে কাছে যেতে হচ্ছে।
যূথীকে ঘরে রেখে বাকি তিনজন দরজা লাগিয়ে বেরিয়ে গেল।
যূথী আড়চোখে দেখছে আর বুঝার চেষ্টা করছে আসলে নিশানের উদ্দেশ্যটা কি!
নিশান সোফা থেকে উঠে এসে ডিরেক্ট যূথীর গলা চেপে ধরল।যদিও হালকাভাবে ধরেছে কিন্তু যূথী ভাবতেও পারেনি নিশান এমন একটা কাজ করে বসবে।অটোমেটিক তাঁর চোখ বড় বড় হয়ে গেল।লোকটা কি তাঁকে মেরে ফেলতে চাইছে নাকি।
“—আমার সাথে চালাকি করবে না।একদম জানে মেরে ফেলব।”
নিশানের এমন ভয়াবহ হুমকি শুনে যূথীর কলিজা কেঁপে উঠল।দিনদিন যেন নিশান তাঁর আসল রূপ যূথীর সামনে তুলে ধরছে।শুধুমাত্র দূরে ছিল বলে মেরে ফেলার থ্রেট দিচ্ছে তাঁকে। কেমন লোকের পাল্লায় পরলো সে?
যূথী করুণ মুখে বলল,
“—এমন করছেন কেনো আপনি? প্লিজ ছাড়ুন।”
“—পালিয়ে বেড়াচ্ছিলে আমার থেকে?এটাই লাস্ট কিন্তু। আর যদি এরকম দেখি তাহলে সেদিন খুব খারাপ হয়ে যাবে।”
নিশানের কথার উত্তরে যূথী কিছুই বলছে না।এখন কিছু বলা মানে ঘুমন্ত বাঘকে জাগিয়ে তুলা।এরচেয়ে চুপ করে থাকা ভালো।
হঠাৎ নিশান একহাতে যূথীর কোমড় চেপে ধরে একটানে কাছে নিয়ে আসলো।যূথীর গলায় নিজের ঠোঁট ছুইয়ে বলতে লাগল,
“—ড্যু ইউ নো দ্যাট ইউ আর আ ক্রিমিনাল? ইচ্ছে করে একদম জেলে ঢুকিয়ে দেই যাতে আর পালিয়ে বেড়াতে না পারো।আজ হোক কাল হোক তোমাকে ঠিক অ্যারেস্ট করে নিব।”
নিজের মনেই নিশান কথাগুলো বলে যাচ্ছে। এদিকে যূথীর অবস্থা খুব শোচনীয়।তাঁর শিরা-উপশিরা গুলো যেন রক্ত চলাচলে সক্ষম হচ্ছে না।বারবার দম আটকে আসছে।নিশানের দাড়ি গুলো তাঁর গলায় ফুটছে।
যূথী চোখ খিঁচে বারবার নিশানের টি-শার্ট খামচে ধরছে।
যূথীর এমন কাঁপা-কাঁপি অবস্থা টের পেয়ে নিশান যূথীকে ছেড়ে দিল।একদিনে এত ডোজ সহ্য হবে না।আজ এতটুকুই যথেষ্ট। নিজের মনে কিছুক্ষণ হাসলো নিশান।
ছাড়া পেতেই যূথী চোখ মেলে তাকাল।তবে নিশানের দিকে নয়।ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে।তাঁর তো উচিত এখন এ রুম থেকে অতিসত্বর বেরিয়ে যাওয়া।কিন্তু পা দুটো যেন মাটিতে আটকে গেছে।এক কদম চলারও শক্তি পাচ্ছে না।দুইহাতে পরনের স্কার্টটাকে চেপে ধরল সে।
দুষ্টু চোখে নিশান বলে উঠল,
“—যূথী….”
বাক্যটা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই যূথী একদৌড়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।
অনেকদিন পর নিশান প্রাণখোলা হাসি হাসলো।কি আছে এই মেয়েটার মাঝে যে মাত্র এ কয়েকদিনেই তাঁকে এতটা বদলে দিল!
* নিশানের রুম থেকে বেরিয়ে যূথী আস্তে আস্তে পা ফেলে সামনে এগুচ্ছে। তাঁর চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠছে যেন এখনই গড়িয়ে পরবে।
নিশানের এমন ব্যবহারগুলো সে মেনে নিতে পারছে না।কেনো লোকটা তাঁকে মায়ায় জড়াতে চাইছে? সে তো এই বাড়িতে অনেকটা আশ্রিতার মতো।এটা জানার পরেও নিশান ভাইয়া কেনো তাঁকে কাছে টানছে।
দিনদিন নিশান ভাইয়ার পাগলামি বেড়েই যাচ্ছে।বাড়ির লোক যদি ঘূর্ণাক্ষরেও কিছু টের পেয়ে যায় তাহলে ওইদিনই হয়তোবা এ বাড়িতে যূথীর শেষদিন হবে।এই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলে সে যাবে কোথায়?
গ্রামে তো নিজের কোনো নিরাপত্তা খুঁজে পায় না সে।
যূথী সিদ্ধান্ত নিল এভাবে ভয় পেয়ে আর চুপ করে থাকবে না।নিশান ভাইয়া যদি আবার তাঁর সাথে এরকম কিছু করে তাহলে সে অনেকগুলো শক্ত কথা শুনিয়ে দিবে।এরপর যা হয় হোক!
_______________
অস্পষ্ট কিছু চেচাঁমেচির শব্দ কানে যেতেই যূথীর ঘুম ভেঙে গেল।ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে পাঁচটা বেজে গেছে।দুপুরবেলা লাঞ্চ করে একটু শুয়েছিল।কখন যে চোখ লেগে গেছে বুঝতেই পারে নি।
চেঁচামেচির উৎস খুঁজতে যূথী দরজা খুলে বাইরে এল।করিডোরের একপাশে মনীষা, বিদীষা আর নীলিমা কি বিষয়ে যেন কথা বলছে আর হাসতে হাসতে লুটিয়ে পরছে।
যূথীকে দেখতে পেয়ে ওরা দৌড়ে আসল।সবার মুখে আনন্দের হাসি।
মনীষা বলল,
“—গন্ধ পাচ্ছো যূথী?”
যূথী চোখ সরু করে মেয়েগুলোর দিকে তাকাচ্ছে। ভাবছে ওরা কি পাগল টাগল হয়ে গেল নাকি!এখনো উন্মাদের মত হেসেই যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন যূথীকে খুব একটা মজার প্রশ্ন করেছে।
যূথী গলা পরিষ্কার করে জিজ্ঞেস করল,
“—আমি কোনো গন্ধ পাচ্ছি না।অনুগ্রহ করে আপনারা বলবেন কি কারণে এরকম হিহি করে হেসে যাচ্ছেন?”
“—বাড়িতে বিয়ে লাগবে!চারদিকে বিয়ে বিয়ে গন্ধ।” (মনীষা)
“—কার বিয়ে?” (যূথী)
“—মাহির ভাইয়ার।আমার তো খুশির চোটে লাফাতে ইচ্ছা করছে। এই বাড়ির প্রথম বিয়ে এটা।ভাবতে পারছো!” (বিদীষা)
“—একি! বড় ভাইয়ের এখনো বিয়ে হলো না তার আগেই ছোট ভাই বিয়ে করে ফেলছে?” (যূথী)
তখনই কোথা থেকে মাহির চলে আসলো।যূথীর কথা শুনতে পেয়ে মুখ কালো করে বলল,
“—বিগ ব্রো’য়ের উপর আমি খুব রেগে আছি যূথী।আজ আমার বিয়ের ডেট ফিক্সড হবে আর সে অফিসে গিয়ে বসে আছে।আর বিগ ব্রো তো নিজে বিয়ে করবে বলে মনে হয় না।এই কারণে আমার বিয়ে আটকে থাকবে কেনো? আমি তো এই মাসেই বিয়ের কাজ কমপ্লিট করব।তারপর হানিমুন তারপর একটা ক্রিকেট টিম বানাবো। ভালো হবে না?”
মাহিরের এমন বেকুবমার্কা কথা শুনে চারজন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।এই ছেলের এখনো বিয়েই হয় নি আর ক্রিকেট টিম বানানোর চিন্তায় পরে আছে।
“—উফ্ থামো ভাইয়া।তোমার মত এমন একটা নবজাতক’কে বিয়ে করে কারিমা আপুর তো একদম নাজেহাল অবস্থা হয়ে যাবে সেটা কি জানো?” (বিদীষা)
“—জিহ্বা টেনে ছিড়ে ফেলব তোর।আমাকে তোর কোন এঙ্গেল থেকে নবজাতক লাগে!” (মাহির)
“—এক সেকেন্ড! কেউ আমাকে বলো এই কারিমা আপুটা কে?” (যূথী)
“—ওহ্ সরি।তোমাকে আসল কথাই বলা হয়নি।কারিমা আপু আর মাহির ভাইয়ার প্রায় তিন বছরের রিলেশন।আজ সন্ধ্যায় আপুর বাবা-মা আসবে বিয়ের ব্যপারে কথা বলতে।শুনেছি যদি সব ঠিকঠাক থাকে তাহলে সামনের শুক্রবার এঙ্গেজমেন্ট আর পরের শুক্রবার বিয়ে।” (নীলিমা)
“—গাইজ! আমি একটা ডিসিশন নিয়েছি।বিয়েতে আমরা যা যা শপিং করব তার সবটা কিন্তু মাহির ভাইয়াকে বহন করতে হবে।” (মনীষা)
“—ইম্পসিবল! একটা কানাকড়িও পাবি না।তোদের আমি হাড়েহাড়ে চিনি।দেখা যাবে আমার একাউন্ট খালি করে আমাকে ফতুর বানিয়ে দিয়েছিস।” (মাহির)
“—তাই নাকি! আচ্ছা ভাইয়া তোমার মনে আছে মেডিকেলের ফার্স্ট ইয়ারে যখন পড়তে তখন ওই রাস্তার মোড়ের দুইতলা বিল্ডিংয়ে যে পরী নামের মেয়েটা থাকত তাঁকে যে ডিস্টার্ব করতে! আমরা এখনই গিয়ে আনন্দের সহিত এই খবরটা কারিমা আপুকে জানিয়ে আসছি।”
“—তোদের মত এমন কূটনী বোন থাকলে আমার মত এমন অসহায় ভাইদের মাথা ন্যাড়া করে কয়েকদিন পর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হবে।এত কূটনীতিবাজ তোরা! শুধু শুধু এ বাড়িতে পরে আছিস।পলিটিক্সে নেমে পর যা।” (মাহির)
এমন একটা অপমানজনক কথা তিনবোন হজম করতে পারল না।মনীষা ছুটে এসে মাহিরের চুল টেনে ধরল।আর বিদীষা মাহিরের পেটে একের পর এক ঘুষি মেরে চলেছে।
মারামারির এই দৃশ্য দেখে হাসতে হাসতে যূথীর পেটে খিল ধরে যাচ্ছে। ভাইবোনদের মধ্যে যে এত খুঁনসুটিময় ভালোবাসা থাকতে পারে ওদের না দেখলে সে জানতেই পারত না।
সন্ধ্যার পর অতিথিরা বাড়িতে এসে গেছে।তাঁদের আপ্যায়নে সবাই ব্যতিব্যস্ত।মাহিরের হবু বউ কারিমাকে দেখে যূথীর চোখ ধাঁধিয়ে গেল।এত সুন্দরও কেউ হতে পারে! এই প্রথম নিজের গায়ের শ্যামলা রঙ নিয়ে যূথীর একটু আফসোস হলো।
রাত দশটার দিকে ডিনার শেষে অতিথিরা এঙ্গেজমেন্ট ও বিয়ের ডেট ফিক্সড করে বিদায় নিল।পরশুদিন এঙ্গেজমেন্ট।
বাড়ির সবাই বিয়ের আনন্দে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছে।
কিছুক্ষণ পর মেইন ডোর দিয়ে নিশানের আগমন ঘটল।ড্রয়িং রুমে সবার উপস্থিতি এবং কলরব এসব কিছুতেই তাঁর ভাবান্তর হলো না।
হাতের ব্লেজারটা কাঁধে ঝুলিয়ে সিড়িতে পা রাখল।
নীলুফা চৌধুরী জলদি সোফা থেকে উঠে গিয়ে নিশানকে ডাকলেন।
“—নিশান! আমরা তো মাহিরের বিয়ের ডেট ফাইনাল করে ফেলেছি।পরশুদিন এঙ্গেজমেন্ট।তোকে কিন্তু সেদিন বাড়িতে থাকতে হবে। কাজের বাহানা দিলে চলবে না।”
“—আই উইল ট্রাই।”
মাহির বলে উঠল,
“—বিগ ব্রো তুমি না থাকলে কিন্তু আমি এঙ্গেজমেন্ট ক্যান্সেল করে দিব।”
নিশান ভাবলেশহীন গলায় উত্তর দিল,
“—ভেরি গুড।”
নিশান আর দাঁড়িয়ে না থেকে রুমের দিকে রওনা দিল।বেচারা মাহিরের মুখটা অপমানে ছাইবর্ণ হয়ে গেছে।বাকিরা সবাই বাড়ি কাঁপিয়ে হাসতে লাগল।
চলবে…..
স্বপ্নচারিণী
সামান্তা সিমি
পর্ব_১০
সকাল থেকে বাড়ি হৈচৈ এবং কলরবে মুখরিত।মাহির এবং কারিমার এঙ্গেজমেন্ট আজ।বাড়ির সবাই যে যার মত রেডি হতে ব্যস্ত।আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা কারিমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিবে।
মনীষা এবং বিদীষা আলমারি থেকে একের পর এক ড্রেস বের করেই যাচ্ছে। কোনোটাই তাঁদের পছন্দ হচ্ছে না।যূথী এবং নীলিমা পাশে দাঁড়িয়ে ওদের কীর্তি-কালাপ দেখছে।
“—কেউ আমাকে ড্রেস সিলেক্ট করে দাও।আমি কনফিউজড।” (মনীষা)
“—আমাকেও দাও।দেখো না আমার সবগুলো জামা কেমন পুরনো লাগছে।” (বিদীষা)
“—তোরা দুবোন জাস্ট বিরক্তিকর। কোথাও যাওয়ার সময় এই ড্রেস নিয়ে এমন সিনক্রিয়েট করিস আমার মাথা ধরে যায় একদম।” (নীলিমা)
“—তোমাদের কাহিনী দেখে আমার ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। চলো নীলিমা আমরা গিয়ে রেডি হয়ে নেই।” (যূথী)
“—চলো তো! এরা থাকুক এভাবে।”
যূথী রুমে ঢুকেই শুনতে পেল ওর ফোন বাজছে।হাতে নিয়ে দেখে নিশান নামটা ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে।
যূথী কিছুটা বিরক্ত বোধ করল।আবার কি জন্য কল করছে কে জানে।একটু আগেই তো ড্রয়িংরুমে দেখল।
এই ফোনটাই সেদিন নিশান গিফট করেছে।সে খুব ভালো করেই জানে নিশানের উদ্দেশ্য ছিল যূথীকে ফোন কিনে দেওয়া।একারণেই ট্রিকস খাটিয়ে চারজনের জন্য ফোন কিনে এনেছে যাতে কেউ সন্দেহ না করতে পারে।অসম্ভব বুদ্ধিমান এই লোক।
আরো কয়েক মিনিট বাজার পর যূথী ফোন রিসিভ করল।
তখুনি নিশানের রাগ মিশ্রিত আওয়াজ শোনা গেল।
“—কল রিসিভ করছিলে না কেনো?”
যূথী আমতাআমতা করে উত্তর দিল,
“—ওই… আসলে ব্যস্ত ছিলাম।”
“—রুমে আসো।”
রুমে যাওয়ার কথা শুনেই যূথীর ভয় ধরে গেল।ওইদিন রুমে নিশান যা করেছে এরপর তো যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।কেয়ামত হয়ে গেলেও আজ সে যাবে না।তাই চোখ খিঁচে বলে বসল,
“—না।”
“—আমি আসতে বলেছি।”
“—আমি যাব না।”
ফোনের অপর পাশ থেকে আর কোনো আওয়াজ আসছে না দেখে যূথী বুঝতে পারল নিশান কল কেটে দিয়েছে।হয়তোবা রেগে এমনটা করেছে।করুক রাগ।যূথী সবসময় উনার কথা কেনো শুনতে যাবে।
ওয়ারড্রব থেকে অনেক খুঁজে ভায়োলেট কালারের জামাটা বের করে নিল।নিশান ফোন না দিলে এতক্ষণে রেডি যেতে পারত।যূথীর মন চাইছে নিশানকে কয়েকটা দুর্দান্ত গালি দেয়।
দরজা লাগানোর জন্য পেছনে ঘুরতেই আঁতকে উঠল সে।দরজার সামনে পকেটে দুইহাত রেখে নিশান দাঁড়িয়ে। যূথী চোখে দিশাহারা অবস্থা দেখল।সে যায়নি বলে এই লোক তাঁর রুমে পর্যন্ত হাজির হয়ে গেছে।এখন যদি কেউ দেখে ফেলে তাহলে কি না কি ভেবে বসবে!
নিশান এগিয়ে এসে দাঁত কটমট করে জিজ্ঞেস করল,
“—আমার কথার অবাধ্য হওয়া আমি একদমই পছন্দ করি না।আর এই কাজটাই তুমি বারবার করো।”
যূথী কিছু না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।আজ সে ভয় পাবে না।যে কথাগুলো এতদিন মনে মনে সাজিয়ে রেখেছে সেগুলো বলেই ছাড়বে।
জোরে একটা শ্বাস নিয়ে বলতে লাগল,
“—এভাবে যখন তখন আমাকে রুমে ডাকবেন না নিশান ভাইয়া।বাড়ির কেউ এটা দেখলে খারাপভাবে নিবে।আপনার কিছু বলার থাকলে আপনি ফোন করে বলতে পারেন।আমি চাইনা আমার জন্য এই বাড়িতে কোনো ঝামেলা হোক।আশা করি আপনি আমার ব্যপারটা বুঝবেন।”
কথাগুলো বলে যূথী কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল।কেনো উত্তর না পেয়ে মাথা তুলে দেখে নিশান আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে।চোখগুলো রক্তলাল।চেহারায় অজস্র রাগ ফুটে আছে।
নিশান দুইপা এগিয়ে এসেও থেমে গেল।যেন কোনো একটা জায়গায় সে বাধা পাচ্ছে।
রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দরজাটা এত জোরে শব্দ করে লাগিয়েছে যে যূথী ভয় পেয়ে চমকে উঠেছে।
হঠাৎ যূথীর খুব মন খারাপ হয়ে গেল।এমন একটা অনুষ্ঠানের দিনে সে তো চায় নি লোকটাকে এভাবে রাগিয়ে দিতে।কিন্তু আজ বাধা না দিলে নিশান ভাইয়ার পাগলামি দিনদিন বেড়ে যেত।
আর কোনো চিন্তা না করে রেডি হয়ে নিচে চলে গেল।সবাই সুন্দরভাবে সেজেগুজে ড্রয়িংরুমে বসে আছে।বড়মা যূথীকে দেখতে পেয়ে মুচকি হাসলো।আশা চৌধুরী মেয়েদেরকে বাইরে যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছেন।
ঠিক সেই মুহূর্তে নিশানকে দ্রুত পায়ে সিড়ি দিয়ে নামতে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে গেল।নীলুফা চৌধুরীও বেশ ভয় পেয়ে গেলেন।
ছেলেটাকে কেমন উদভ্রান্তের মতো লাগছে।চুলগুলো এলোমেলো। শার্টের বোতামও কয়েকটা খোলা।তিনি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“—বাবু কোথায় যাচ্ছিস! এখনো রেডি হসনি?”
নিশান যূথীর দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে বলল,
“—আমি এঙ্গেজমেন্টে যাচ্ছি না।তোমরা যাও।বারবার ফোন দিয়ে বিরক্ত করবে না আমায়।”
গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে নিশান বেরিয়ে গেল।নিশানের এমন ব্যবহারে সবাই হতভম্ব। আজকে একটা খুশির দিনে কেউই এটা আশা করেনি।
নীলুফা চৌধুরী চিন্তিত মুখে মেইন ডোরের দিকে তাকিয়ে আছেন।তিনি ভেবেই পাচ্ছেন না ছেলেটার হঠাৎ কি হলো! সকালেও তো বলেছে কারিমাদের বাড়িতে যাবে।এত অল্প সময়ে এমন কি হলো যে হুট করে সিদ্ধান্ত বদলে নিল!
যূথী সোফার এককোনায় এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল।তাঁর নিজের চুল টেনে ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।তখন নিশান ভাইয়াকে ওই কথাগুলো না বললেই পারত।আর কথাগুলো এত রুডলি না বলে একটু সুন্দরভাবে বললেই হত।নিশ্চিত নিশান ভাইয়া খুব কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি ব্যপারটা এতদূর গড়াবে।নিশান ভাইয়া যেভাবে তাকাচ্ছিল তাঁর দিকে এতে স্পষ্টই বুঝা গেছে শুধুমাত্র তাঁর উপর রাগ করেই এভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।বাড়ির সবাই কতটা কষ্ট পেয়েছে।সবকিছু তাঁর জন্য হলো।যূথী প্রায় কেঁদে দেওয়ার উপক্রম।
“—তোমার আবার কি হলো যূথী! এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? চলো।”
মনীষার কথায় যূথীর হুঁশ ফিরল।চোখের কোনার জলটা আঙুল দিয়ে মুছে সবার সাথে বেরিয়ে গেল।
________________
সন্ধ্যা হতে হতেই বাড়ির চারদিকে লাগানো মরিচ বাতিগুলো জ্বলে উঠল।গার্ডেনের একপাশে মাহিরের গায়ে হলুদের জন্য স্টেজ সাজানো হচ্ছে।অনুষ্ঠানে আসা মেহমানদের অনেকেই বাগানে ঘোরাঘুরি করছে।ছোট ছোট বাচ্চারা এদিকে সেদিকে ছুটাছুটি করতে ব্যস্ত।
উদাস মনে যূথী বারান্দায় বসে আছে।একটু পর পর হাতে মোবাইলের লক খুলে কিছু একটা দেখছে আর বারবারই অস্থিরতায় তাঁর চোখ-মুখ কুঁচকে যাচ্ছে।
আজ ছয়দিন হয়ে গেল নিশানের সাথে তাঁর কোনো যোগাযোগ নেই।যূথী নিশ্চিত যে নিশান ইচ্ছে করেই তাঁর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।সেই যে এঙ্গেজমেন্টের দিন তাঁর রুমে এসেছিল এরপর থেকে যূথীকে খুব বাজেভাবে ইগনোর করে যাচ্ছে।
যূথী নিজের মনকে বুঝে উঠতে পারছে না।সে তো চাইতো নিশান ভাইয়া যেন তাঁর থেকে দূরে থাকে।এখন তো নিশান তাঁর আশেপাশেও নেই।তাঁর থেকে দূরে দূরে থাকছে।তবু কেন নিশানের সাথে কথা বলার জন্য সে এত উদগ্রীব হয়ে আছে?
হয়তোবা ওইদিন নিশান তাঁর কথায় কষ্ট পেয়েছে এজন্য যূথীর খারাপ লাগছে।যূথী সিদ্ধান্ত নিল নিশান ভাইয়াকে যেভাবেই হোক সরি বলতে হবে।এরকম ইগনোর আর সে নিতে পারছে না।ওইদিন তো করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎই নিশানের মুখোমুখি হয়ে গেছিল।কিন্তু নিশান তাঁর দিকে না তাকিয়ে একপ্রকার সাইড কেটে চলে গেছে।
যূথী আবার মোবাইল চেক করল।গত তিনদিন থেকে সে নিশানকে মেসেজ দিয়েছে অনেকগুলো।
“রাগ করেছেন?”, ” আর হবে না” ইত্যাদি অনেক মেসেজ।কিন্তু একটারও রিপ্লাই আসেনি।
রুমে কারো আসার আওয়াজ পেতেই যূথী বারান্দা থেকে চলে আসলো।
মনীষা আর নীলিমা হাতে কতগুলো প্যাকেট নিয়ে রুমে ঢুকল।
“—বাইরে এত মানুষ আর তুমি এখানে বসে আছো যে?”(নীলিমা)
“—না এমনি।ভালো লাগছিল না।আমি তো কাউকে চিনি না তাই।” (যূথী)
“—না চিনলেও সমস্যা নেই।তুমি আমাদের সাথে থাকবে।” (মনীষা)
“—আচ্ছা চলো এখন রেডি হয়ে নেই।আমরা কিন্তু শাড়ি পরব।” (নীলিমা)
“—না না।প্লিজ আমি পরব না।আমি শাড়িতে কম্ফোর্ট না।” (যূথী)
“—একদিন পরলে কিছু হবে না।এখন তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে আসো। “(নীলিমা)
যূথী ভাবছে এদেরকে কি জিজ্ঞেস করবে নিশান ভাইয়ার কথা! আজ তো একবারও লোকটাকে দেখেনি।কোথায় আছে কে জানে! ওদের জিজ্ঞেস করলে হয়তোবা কিছু জানা যাবে।
যূথী প্যাকেট থেকে শাড়ি বের করতে করতে বলল,
“—আচ্ছা মনীষা! নিশান ভাইয়াকে তো দেখলাম না কোথাও।না মানে ছোট ভাইয়ের গায়ে হলুদ আর বড় ভাই নেই!”
“—ভাইয়ার কথা আর কি বলব! একটা কেসের ইনভেস্টিগেশন করতে নাকি ঢাকার বাইরে গেছে।কখন আসবে বলতে পারি না।বড়মা ভাইয়াকে দুইবার কল করেছিল।তৃতীয়বার ফোন করাতে এমন এক ধমক দিল যে এরপর আর কেউ ফোন করার সাহস পায় নি।”
যূথী আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।তাঁর মনটা আরো খারাপ হয়ে গেছে।ভেবেছিল অন্তত গায়ে হলুদে নিশান উপস্থিত থাকবে।
সবার সাথে রেডি হয়ে যূথী বাগানে চলে এল।চারপাশটা লাইটের তীব্র আলোয় ঝলমল করছে।যূথী দেখল বাগানের একপাশে মাহির তাঁর বন্ধুদের সাথে কথা বলছে।মাহিরের মুখে হাসি যেন উপচে উঠছে।ভালোবাসার মানুষকে কাছে পাওয়ার আনন্দ এটা।
যূথী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।তাঁর মনটা না চাইতেও খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে।সে কি নিশান ভাইয়াকে মিস করছে?
যূথী বারবার গেইটের দিকে তাকাচ্ছে এই বোধ হয় নিশান ভাইয়া এসে পরল।কিন্তু না।তাঁর মনের আশা পূরন হলো না।
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান যূথী একপ্রকার নিরানন্দভাবেই কাটিয়ে দিল।
________________
* বিয়ের দিন বিকেলের দিকে সারা শরীরে জ্বর নিয়ে বাড়ি ফিরল নিশান।বিয়ে উপলক্ষে ড্রয়িংরুম লোকে লোকারণ্য। তাই কেউই নিশানকে তেমন একটা লক্ষ্য করল না।
তবে নীলুফা চৌধুরী কি একটা দরকারে ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখলেন হেলতে দুলতে তাঁর ছেলে সিড়ি দিয়ে উঠছে।চোখ-মুখ, নাক লাল হয়ে আছে।
নীলুফা চৌধুরী বুঝে গেছেন নিশান আবার অসুখ বাঁধিয়ে বাড়ি ফিরেছে।তিনি আর দেরি না করে নিশানের পিছু পিছু রুমে চলে গেলেন।
নিশান হাত থেকে ঘড়ি খুলছিল তখন নীলুফা চৌধুরী রুমে প্রবেশ করলেন।
“—নিশান! কি হয়েছে আব্বু? চোখ মুখ এমন লাগছে কেনো?”
নীলুফা চৌধুরী এগিয়ে গিয়ে নিশানের কপালে হাত রেখে আঁতকে উঠলেন।শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। তিনি দিশাহারা হয়ে পরলেন।একদিকে বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় অন্যদিকে ছেলের এই অবস্থা।
“—এত জ্বর কিভাবে বাঁধালি নিশান? জলদি হাত-মুখ ধুয়ে আয়।আমি মেডিসিন নিয়ে আসছি।মেডিসিনে কাজ না করলে ডাক্তার ডাকতে হবে।”
গায়ের শার্ট খুলতে খুলতে নিশান বলে উঠল,
“—ডোন্ট বি প্যানিক মা! আমি ঠিক আছি। ”
“—চুপ থাক!সবসময় নিজেকে বীরপুরুষ প্রমাণ না করলে হয় না তাই না?এসব বীরপুরুষ গিরি বাইরে দেখাবি আমার সামনে না।তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে আয়।আমি এখুনি আসছি।”
নিশান শার্ট খুলেই বিছানায় শুয়ে পরল।শরীরে জ্বর থাকলেও তেমন দুর্বলতা নেই।তবে বেশ ক্লান্ত অনুভব করছে।তাঁর ফিট বডিতে জ্বর-ঠান্ডা এত সহজে কাবু করতে পারে না।
নীলুফা চৌধুরী বের হওয়ার জন্য দরজার হ্যান্ডেলে হাত রাখতেই নিশান জিজ্ঞেস করল,
“—বরযাত্রী কখন যাচ্ছে?”
নীলুফা চৌধুরীর ভ্রু সামান্য কুঞ্চিত হলো।ভাবছেন তাঁর ছেলে কি বিয়েতে যাওয়ার চিন্তা ভাবনা করছে নাকি।
“—এইতো সন্ধ্যার পর পরই বের হবে।কেনো রে?”
“—যূথীকে বিয়েতে যেতে মানা করো।”
নিশানের কথায় নীলুফা চৌধুরী বেশ অবাক হলেন।তাঁর ছেলে কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে গেল বুঝতে পারছেন না।এখানে যূথীর প্রসঙ্গ কেনো আসছে?
“—এ কেমন কথা? মনীষাদের সাথে যূথী যাবে।এতক্ষণে বোধ হয় সবাই তৈরি হয়ে বসে আছে।”
নিশান চোয়াল শক্ত করে বলল,
“—আমি বললাম তো যূথী যাবে না।ব্যস্!”
“—কিন্তু কেনো?”
“—আমি চাই না সে বিয়েতে যাক।”
নীলুফা চৌধুরী মুচকি হেসে বিছানায় বসলেন।নিশানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন,
“—যূথীকে তোর পছন্দ?”
নিশান কোনো উত্তর না দিয়ে মায়ের কোলে মাথা রাখল।
চলবে………….